ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। লিভিংস্টোনের সন্ধান পাওয়ার পর লেখক বর্ণনা দিচ্ছেন মানুষটি কেমন। তরজমা স্বাতী রায়
ডাঃ লিভিংস্টোনের বয়স প্রায় ষাট, অবশ্য শরীর সেরে ওঠার পরে তাঁকে পঞ্চাশও পেরোয়নি এমন মানুষের মত দেখাচ্ছিল। তাঁর চুল এখনও বাদামী রঙের, তবে রগের কাছে একটা দুটো ধূসর দাগ দেখা যায়; তাঁর গোঁফ-দাড়ি ঘোর ধূসর। প্রতিদিন দাড়ি কামান। তাঁর হালকা বাদামি রঙের চোখ, দারুণ ঝকঝকে; বাজপাখির মতন তীব্র দৃষ্টি। শুধুমাত্র তাঁর দাঁতই তাঁর বয়সের দুর্বলতা প্রকাশ করে; লুন্ডার কঠিন খাদ্য তাঁর দাঁতের সারিটি ধ্বংস করেছে। শিগগিরই একটু মোটা মতন হয়ে গেলেও, তাঁর চেহারা সাধারণের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা, কাঁধটা একটু সামান্য ঝোঁকা। হাঁটার সময় তাঁর পদক্ষেপ ভারী হলেও দৃঢ়, অনেকটা একজন অতি-পরিশ্রান্ত মানুষের মত। একটা নৌবাহিনীর টুপি পরেন, তার ডগাটা অর্ধবৃত্তাকার, এই টুপি দিয়েই তাঁকে সারা আফ্রিকা চেনে। যখন তাঁকে প্রথম দেখি, তাঁর পোশাক তাপ্পি-মারা, তবু অত্যন্ত পরিষ্কার।
আমাকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে লিভিংস্টোন অতি খিটখিটে, চড়ামেজাজের মানুষ; কেউ কেউ বলেছে যে তিনি বাচাল, তিনি খ্যাপা; লোকে ডেভিড লিভিংস্টোন বলতে যে শ্রদ্ধেয় ধর্মপ্রচারককে চিনত, তার থেকে তিনি আমূল বদলে গেছেন; বলেছে যে, তিনি নাকি এমনই বিবরণ লিখে রাখেন যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ পড়তে পারে না; আর আমি মধ্য আফ্রিকার উদ্দেশে যাত্রা শুরুর আগে এও বলা হয়েছিল, যে তিনি একজন আফ্রিকান রাজকন্যাকে বিয়ে করেছেন।
সবিনয়ে জানাই যে উপরের সবকটি বিবৃতির সঙ্গেই আমার মতের পার্থক্য আছে৷ হ্যাঁ এটা মানছি যে তিনি কোন দেবদূত নন, তবে একজন জীবিত মানুষের পক্ষে যতটা দেবদূত সুলভ হওয়া যায়, তিনি ততটাই। আমি কখনই তাঁর মধ্যে কোনো আক্রোশ বা মানব-বিদ্বেষ দেখিনি – বাচালতার প্রসঙ্গে বলা যায়, ডাঃ লিভিংস্টোন একেবারেই তার বিপরীত: তাঁকে চাপা স্বভাবেরই বলা যায়, আর যিনি বলেন তিনি বদলে গেছেন, আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে তিনি তাঁকে কখনই বুঝতে পারেননি, ডাক্তার সৌম্য হাস্যরসের ভাণ্ডারী, নিজ বন্ধুদের মধ্যে তিনি সর্বদা রস বিতরণ করেন একথা সর্বজনবিদিত। আর যিনি বলেছিলেন যে লিভিংস্টোন কোনও নোট নেন না বা পর্যবেক্ষণ লিখে রাখেন না, সেই ভদ্রলোকের ভুলও সংশোধন করিয়ে দিতে হবে। একটা বিশাল লেটসের ডায়েরি আমি তাঁর মেয়ের কাছে এনে দিয়েছিলাম, সেটা নোটে ভরা, আর তার মধ্যে অন্তত কম করেও কুড়ি পাতা শুধু পর্যবেক্ষণে ভরা; এগুলো তিনি যখন শেষবার একা মান্যুয়েমা গিয়েছিলেন তখন নেওয়া। বইয়ের মাঝখানে পাতার পর পাতা, কলামের পর কলাম, শুধুই পরিসংখ্যান, অতি যত্নে লেখা।
আমাকে তিনি একটা বড় চিঠি দিয়েছিলেন, স্যার টমাস ম্যাকলিয়ারকে পাঠানোর জন্য আর তাতে পর্যবেক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নেই। যে চার মাস আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম, প্রতি সন্ধ্যায় তাঁকে খুব যত্ন করে নোট তৈরি করতে দেখেছি, আর তাঁর একটা বড় টিনের বাক্সে অনেকগুলো ফিল্ড নোট-বুক ছিল, আমি সাহস করে বলি যে তার বিষয়বস্তু একদিন আলো দেখতে পাবে। তাঁর তৈরি মানচিত্রগুলোও অতি যত্ন ও শ্রমের প্রমাণ দেয়। তাঁর আফ্রিকান বিবাহের সম্পর্কে, এটা মিথ্যে এ ছাড়া আর কিছু বলা অপ্রয়োজনীয় আর ডেভিড লিভিংস্টোনের নামের সঙ্গে এমন একটা বিষয়ে জড়িয়ে ইঙ্গিত দেওয়া যে কোন ভদ্রলোকের পক্ষে একদম বেমানান।
ডাঃ লিভিংস্টোনের চরিত্রের যে কোনও দিক নিন ও সযত্নে বিশ্লেষণ করুন, যে কোনও লোককে সেখানে ত্রুটি খুঁজে বের করতে আহ্বান করছি। তিনি সংবেদনশীল, তা আমি জানি; কিন্তু উচ্চ মনের এবং উদার প্রকৃতির যে কোনও মানুষই তাই। তাঁকে কেউ সন্দেহ করছে বা কেউ তাঁর সমালোচনা করছে এ বিষয়ে তিনি সংবেদনশীল। কিন্তু তারা কারা, যারা তাঁকে সন্দেহ করে? অবশ্যই আরামকেদারাজীবি ভূগোলবিদরা; রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির তালিকার শত শত পরিশ্রমী অভিযাত্রীরা নয়। রিচার্ড বার্টন বা উইনউড রিডের মতন কাউকে তাঁর সমালোচনা করতে দেখিনি। আর এই রকম একজন যত্নশীল ও পরিশ্রমী মানুষের পক্ষে তাঁর নিজের বানানো মানচিত্র ও পর্যবেক্ষণগুলিকে কোন দায়িত্বজ্ঞানহীন দলের মর্জিমাফিক বদলে যেতে দেখা মোটেই সুখকর নয়। কোন কোন বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তে ভুল হতেই পারে, কিন্তু ওই একই অঞ্চলের অভিযাত্রী দলের থেকে প্রাপ্ত তথ্য ছাড়া কোন ঘরে বসে থাকা ভূগোলবিদ তাঁর ভুল সংশোধন করতে পারেন না। কোন ফ্রান্সিস গাল্টন বা ডাঃ বেকে, সে তাঁদের যতই মতামত থাকুক না, টাঙ্গানিকা হ্রদকে একটা কল্পনা বলে প্রমাণ করতে পারবেন না; চারজন ভ্রমণকারী এটা দেখেছেন, জানিয়েওছেন। কোন ফ্রান্সিস গাল্টন বা ডক্টর বেকে কর্নেল গ্রান্টের কাছে প্রমাণ করতে পারবেন না যে ভিক্টোরিয়া নীলের মত কোন নদী নেই। তবু এই নদী – এই জলস্রোতের কতটুকুই বা কর্নেল গ্রান্ট দেখেছেন? পঞ্চাশ মাইলও নয়। তবে যেহেতু তিনি এটিকে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে বইতে দেখেছেন, তাই তিনি আন্তরিকভাবে, সততার সঙ্গে বিশ্বাস করেন যে এটা সেই একই নদী যা তিনি গন্ডোকোরোর পাশ দিয়ে বয়ে যেতে দেখেছেন। লিভিংস্টোন চাম্বেজি, লুয়াপুলা এবং লুয়ালাবাকে ৭ ডিগ্রি অক্ষাংশেরও বেশি এলাকা জুড়ে অনুসরণ করেছেন, তারপরেও একে উত্তর দিকে বয়ে যেতে দেখেছেন। স্থানীয়দের থেকে তিনি শুনেছেন যে তিনি তাঁর পদযাত্রা যেখানে থামিয়েছিলেন, তার উত্তরে একটা বিশাল হ্রদ রয়েছে। আর দুর্ধর্ষ লুয়ালাবার জলস্রোতকে অনুসরণ করে লিভিংস্টোন একথাই বিশ্বাস করেছেন যে এই লুয়ালাবা নীল নদ ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ আরামকেদারাজীবি ভূগোলবিদরা যখন মানচিত্রে একটা তিন ডিগ্রি অক্ষাংশেরও বেশি এলাকা জুড়ে ছড়ানো একটা বিশাল পর্বতমালা আঁকেন, ওই কাল, অশুভ-দর্শন রেখা দিয়ে শুধু এটাই বোঝানোর জন্য যে তিনি একটা পাথরের দেওয়ালে মাথা ঠুকছেন, তখনও কি তাঁর বিরক্ত হওয়ার অধিকার নেই?
আফ্রিকার রহস্য বিষয়ে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান থাকা স্বত্বেও, লিভিংস্টোন এখনও জানেন না কিভাবে একটা পাহাড় গজিয়ে দেওয়া যায়। বাড়িতে বসে থাকা ভূগোলজ্ঞদের মতন নিজের খেয়ালখুশি অনুসারে প্রকৃতির চেহারা বদলে সাহস দেখানোর ক্ষেত্রে তিনি বড়ই ভিতু।১
লিভিংস্টোনের মধ্যে অনেকই পছন্দসই বৈশিষ্ট্য দেখেছি। তাঁর ভদ্রতা বোধ তাঁর নিত্যসঙ্গী; তাঁর আশা কখনো তাঁকে পরিত্যাগ করে না। কোন নাছোড় উদ্বেগ, মনের বিক্ষিপ্ততা, আত্মীয়-স্বজন-বাড়ি-ঘরের দীর্ঘ বিচ্ছেদেও তিনি অভিযোগ করেন না। তিনি ভাবেন 'শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে'; দৈবী শুভত্বে তাঁর এমনই বিশ্বাস! জাঞ্জিবারের হতচ্ছাড়াদের সৌজন্যে প্রতিকূল পরিস্থিতির খেলায় তিনি বাকরুদ্ধ হয়েছেন, ঘোর চিন্তায় পড়েছেন, এমনকি প্রায় মরতেও বসেছেন, তবুও তিনি তাঁর বন্ধু, স্যার রোডেরিক মার্চিসনের দেওয়া দায়িত্বটি ছাড়বেন না। শুধুমাত্র কর্তব্যের কঠোর নির্দেশে তিনি নিজের বাড়ি, স্বাচ্ছন্দ্য, সভ্য জীবনের সুখ, আরাম ও বিলাসিতাকে বিসর্জন দিয়েছেন। কখনও নিজের কাজ পরিত্যাগ না করার বাবদে তাঁর আছে স্পার্টার অধিবাসীদের মতন বীরত্ব, রোমানসুলভ অনমনীয়তা, অ্যাংলো-স্যাক্সনদের মতন ধৈর্যশীল প্রতিজ্ঞা। বাড়ির জন্য মন কাঁদলেও যতক্ষণ না তিনি নিজের কাজে ‘সমাপ্ত’ শব্দটা লিখতে পারছেন, ততক্ষণ তিনি দায়িত্বভার নামিয়ে রাখবেন না।
লিভিংস্টোনের স্বভাবে অতিরিক্ত মাত্রায় থাকা একটা ভাল দিক আমার নজর এড়ায়নি। তাঁর হাসি ভারি সংক্রামক - তিনি হাসতে শুরু করলেই, আমিও তাঁকে অনুকরণ করতে বাধ্য হতাম। ঠিক যেন হের টেউফেলসড্রোকের২ মত হাসি - মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত সর্বাঙ্গ দিয়ে হাসা। একটা গল্প বললে, এমনভাবে বর্ণনা করেন যাতে শ্রোতার মনে ঘটনার সত্যতা নিয়ে কোন ভাবনার অবকাশ থাকে না; গল্পের অন্তর্নিহিত মজায় তাঁর মুখ এমন জ্বলজ্বল করত যে নিশ্চিত হতাম, গল্পটি বলার মতই বটে, শোনারও মত।
তাঁর কৃশ গড়ন আমাকে প্রথম সাক্ষাতে অবাক করেছিল, তাঁর গুরু পদক্ষেপ তাঁর বয়স ও কঠিন অভিযানসমূহের কথা মনে করায়, তাঁর ধূসর দাড়ি ও গোলচে কাঁধ আসল মানুষটাকে লুকিয়ে রাখে। সেই অতি-জীর্ণ বাইরের চেহারার পিছনে রয়েছে একজন প্রাণবন্ত মানুষ, এক অক্ষয় হাস্যরসের অফুরন্ত ভাণ্ডার; তাঁর রুক্ষ চেহারার পিছনে একটা অল্পবয়সী, অতি-সমৃদ্ধ মন লুকিয়ে আছে। প্রতিদিন আমি অগুনতি কৌতুক আর ভাল ভাল ঘটনা শুনেছি; আকর্ষণীয় শিকারের গল্প, প্রধানতঃ তাঁর বন্ধু ওসওয়েল, ওয়েব, ভার্ডন ও গর্ডন কামিং সেই সব গল্পের মূল চরিত্র। প্রথমে আমি খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, অত উচ্ছলতা, কৌতুক, আর প্রাণপ্রাচুর্য কি একটা আনন্দজনক হিস্টিরিয়ার ফল? তবে যতদিন তাঁর সঙ্গে ছিলাম, এগুলো সবসময়ই দেখেছিলাম। তাই এগুলো স্বাভাবিক বলেই ভাবতে বাধ্য হলাম।
আরেকটা জিনিস খুব নজরে পড়েছিল। সেটা হল তাঁর আশ্চর্য রকমের স্মৃতিশক্তি। তিনি বহু বছর আফ্রিকায় কাটিয়েছেন। বই এর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে। তারপরেও তিনি স্মৃতি থেকে বায়রন, বার্নস, টেনিসন, লংফেলো, হুইটিয়ার ও লোয়েলের পুরো কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন - তাই একে অসাধারণ স্মৃতিই বলা যায়। এর কারণ হয়ত, বাস্তবে, তিনি প্রায় সারা জীবনই নিজের মনে কাটিয়েছেন। জিমারম্যান, মানব প্রকৃতির একজন মহান ছাত্র, এবিষয়ে বলেছেন: “ভারহীন মন যা কিছু পড়েছে, যা তার চোখকে খুশি আর কানকে আনন্দিত করেছে, সে সব মনে রাখতে পারে। পর্যবেক্ষণ, বা অভিজ্ঞতা, বা আলোচনা লব্ধ প্রতিটা ধারণা নিয়ে সে ভাবে আর প্রতিবার ভাবার ফলে নতুন নতুন তথ্য লাভ করে। বোধযুক্ত মানুষ জীবনের আগের ঘটনাসমূহের পর্যালোচনা করে; ভবিষ্যতে কী হতে পারে অনুমান করে; অতীত ও ভবিষ্যতের সকল ধারণার নির্যাস বর্তমানের জীবন বিন্দুতে মিশিয়ে দেয়।” তিনি নিজের মধ্যে আবর্তিত একটা জগতে বাস করেন। নিজের ও সঙ্গীদের তাৎক্ষণিক ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণ করার দরকারে ছাড়া সেখান থেকে খুব কমই বাইরে আসেন; তারপরেই আবার নিজের আনন্দের জগতে ডুবে যান। সেই দুনিয়ায় অবশ্যই তাঁর নিজের বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত, চেনা বই-পত্র, ধ্যানধারণা ও পরিচিত সঙ্গ তাঁকে ঘিরে থাকে। ফলে যেখানেই থাকুন না কেন বা যে কোনো পরিবেশই তাঁকে ঘিরে থাকুক না কেন, তার সুসংস্কৃত মনের কাছে বাহ্যিক পরিস্থিতির চেয়ে সেই মনোজগৎ অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
(ক্রমশ…)