ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে চলছে উজিজির পথে এগিয়ে চলার বর্ণনা। তরজমায় স্বাতী রায়
২৮ তারিখে আমরা উগান্ডা থেকে সোয়া তিন ঘণ্টা দূরে বেনটা নামের এক গ্রামে পৌঁছলাম। জঙ্গলের কোলে একটা ছোট সুরক্ষিত গ্রাম। উগান্ডার ভুট্টা ক্ষেতের মধ্য দিয়ে পথ চলেছে। তারপরে কিসারির গ্রামগুলোর চারপাশের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পথ ঢুকল। সেই গ্রামগুলোর মধ্যে একটাতে আমরা এক কাফেলার মালিককে পেলাম যে উফিপা যাওয়ার কুলি জোগাড়ের জন্য ঢেঁড়া পেটাচ্ছিল। সে এখানে দু’মাস আটকে আছে, আমার লোকদেরকে তার কাফেলায় যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে সে প্রভূত খেটেছিল। ফলে আমার সঙ্গে তার মোটেই মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আমি আসার ক’দিন পর দেখলাম, সে দক্ষিণে যাওয়ার ভাবনা ছেড়ে দিয়েছে। কিসারি ছেড়ে, আমরা ব্ল্যাক জ্যাক গাছের একটা পাতলা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগোলাম, সূর্যের তাপে মাটি ফুটিফাটা, এখানে-সেখানে শুকিয়ে যাওয়া পুকুর, পুকুরের তলাগুলো হাতি ও গণ্ডারের পায়ের দাগে ভর্তি। মোষ ও জেব্রাদের পায়ে চলার দাগ দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝেই, আশায় বুক বাঁধলাম যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শিকারের দেখা পাব।
বেন্টাতে যথেষ্ট ভারতীয় ভুট্টা ও আর একরকম শস্য মেলে, একে স্থানীয়রা চোরোকো বলে, আমি দেখলাম ছোলা-জাতীয় গাছ। নিজের ব্যবহারের জন্য অনেকখানি চোরোকো কিনলাম, কারণ আমি এটাকে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার বলে মনে করি। বাড়ির সমতল ছাদে এমটুন্ডু গাছের ছাল দিয়ে তৈরি বিশালাকৃতি বাক্সে ভুট্টা সংরক্ষণ করা হয়। আফ্রিকায় আমি যে সবচেয়ে বড় বাক্স দেখেছি সেটা এখানেই। এটাকে একজন টাইটানের হ্যাট-বক্স হিসেবে ধরা যেতে পারে; বাক্সের ব্যাস সাত ফুট আর উচ্চতা দশ ফুট।
২৯ তারিখে, নৈর্ঋত দিকে চলার পর আমরা কিকুরুতে পৌঁছলাম। সূর্যের তাতে ফুটিফাটা জমি, এখানে ব্ল্যাক জ্যাক, আবলুস ও বেঁটেখাটো ঝোপঝাড় হয় শুধু, আর তার উপরে বালির ঢিবির মত হালকা খড়ির রঙের অজস্র পিঁপড়ের ঢিপি। এর মধ্যে দিয়ে আমরা পাঁচ ঘণ্টা পথ চললাম।
বিস্তীর্ণ বনভূমি ও টানা সমতলের এই এলাকায় প্রকৃতিদত্ত নিকাশি ব্যবস্থা তেমন সুবিধার না। তাই এখানে ঘন ঘন মুকুনগুরুর দেখা মেলে। কিসওয়াহিলি ভাষায় মুকুনগুরু মানে জ্বর। শুখা মরসুমে দেশটাকে দেখলে তেমন আপত্তির কিছু মিলবে না। পোড়া ঘাস বরং দেশটাকে একটা গম্ভীর চেহারা দিয়েছে, বর্ষার শেষভাগে এই সমভূমিতে যে সকল প্রাণীরা ঘুরে বেড়ায়, তাদের চলার পথের দাগ মাটিতে পাকাপাকিভাবে আঁকা। জঙ্গলে ঘুণ-ধরা অজস্র গাছ ইতিউতি পড়ে আছে, আর বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য পোকা সেই শুয়ে থাকা গাছের গুঁড়িকে প্রাণপণে খেয়ে যাচ্ছে। উপাস গাছের আশপাশ থেকে যেমন বিপজ্জনক বিষ-বাষ্প বেরোয়, মরে-পচে যাওয়া গাছপালাগুলোর বিষ শরীরে ঢুকলে অনেক সময় একই রকম বিপদ ঘটে।
ম্যালেরিয়ার জ্বর হলে প্রথম যে সমস্যাগুলো হয়, তা হল কোষ্ঠকাঠিন্য ও একটা চেপে ধরা আলসে ভাব, ভয়ানক ঝিমুনি আর ক্রমাগত হাই ওঠা। জিভে একটা হলদেটে অসুস্থ রং ধরে, প্রায় কালো হয়ে যায়; এমনকি দাঁত হলুদ হয়ে যায়, আর কেমন ছাতা পড়ে যায়। রোগীর চোখ জ্বলজ্বল করে ও জলে ভরে থাকে। এসবই গোড়ার দিকের নিশ্চিত লক্ষণ, জ্বর শিগগিরি তেড়ে এসে রোগীকে পেড়ে ফেলবে আর সে যন্ত্রণায় কাঁপতে থাকবে।
কখনও কখনও জ্বরের আগে একটা ভয়ানক কাঁপুনি হয়, এই সময় রোগীর মারাত্মক শীত লাগে- গায়ে কম্বলের উপর কম্বল চাপালেও শীত ভাব যেন কাটে না। তারপর একটা অস্বাভাবিক রকমের তীব্র মাথাব্যথা হয়, কোমরে, শিরদাঁড়ায় অসহ্য যন্ত্রণা, তারপর কাঁধের হাড়ের উপর দিয়ে সেটা ছড়িয়ে পড়বে আর ঘাড়ের উপর দিয়ে গিয়ে মাথার সামনে-পিছনে গেঁড়ে বসবে। সাধারণত জ্বরের আগে শীত লাগে না, কিন্তু একটা অবসন্নতা, অসাড়তা জড়িয়ে ধরে, গায়ের তাপ খুব বেড়ে যায়, মাথা দপদপ করে, পিঠের-কোমরের ব্যথা আর প্রচণ্ড তেষ্টা পেড়ে ফেলে। মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত কল্পনা ভিড় করে, কখনও কখনও উৎকট সব আকার ধারণ করে। অসুস্থ মানুষের অন্ধকার হয়ে আসা চোখের সামনে, একটা উত্তপ্ত পরিবেশে জাত-অজাত বিভিন্ন সরীসৃপের ছবি ভেসে ওঠে, প্রতি মুহূর্তে তারা আবার অপরিচিত অবয়বে রূপান্তরিত হয়, প্রতি মুহূর্তে আরও দিশাহারা, আরও জটিল, আরও অসহ্য, ভয়ানক হয়ে ওঠে। এইসব বিভ্রান্তিকর দৃশ্য আর সহ্য করতে না পেরে, প্রভূত চেষ্টা করে সে চোখ খোলে, আর সেই প্রলাপ স্বপ্ন মিলিয়ে যায়, আবার পর মুহূর্তেই সে অবচেতনভাবে আবার অন্য এক স্বপ্ন-জগতে ভেসে চলে যায়, যেখানে আরেকটা অবাস্তব নরক জ্বর-বিকারের মধ্যে ফুটে ওঠে আর সে নতুন যন্ত্রণা ভোগ করে। উঃ কত কত ঘণ্টা ধরেই না আমি জ্বরের তাড়সে ওই ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মধ্যে ছটফট করেছি! উঃ আফ্রিকার যে কোন অভিযাত্রীকেই যে শরীরের কী যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়! উঃ! সেই স্বপ্নে-দেখা ভয়ানক, অপ্রাকৃত নারকীয় দৃশ্যগুলো যে মনে কী পরিমাণ হিংসে, বদমেজাজ আর বিরক্তির জন্ম দেয়! অসীম ধৈর্যও তুষ্ট করতে পারে না, সবচেয়ে পরিশ্রমী উপচর্যাও সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়, অতি নম্রতাও অতৃপ্ত করে। এই ভয়ানক পালাবদলের সময় মন খুব বিক্ষিপ্ত থাকে, জব নিজেও খিটখিটে, পাগলের মত ক্ষিপ্ত এবং বদমেজাজি হয়ে উঠতেন। এরকম অবস্থায় একজন মানুষ নিজেকে সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করে। সেরে উঠলে, সে আবার মার্জিত হয়, সুসভ্য ও বাড়াবাড়ি রকমের অমায়িক হয়ে ওঠে, যে সব বিষয় মাত্র গতকালই তার ভয়ানক অস্বাভাবিক ঠেকেছিল, তার থেকে সে কাল্পনিক আনন্দ খুঁজে নেয়। তার দলবলকে সে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের চোখে দেখে; গতানুগতিক ব্যাপার-স্যাপারকেও সে পরম উচ্ছ্বাসে গ্রহণ করে।
(ক্রমশ...)