আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। বাগামোয়ো থেকে ‘উসেগুহহা’-র রাজধানী সিম্বামওয়েন্নিতে পৌঁছে এবারে উগোগো অঞ্চলের চুন্যু (চুন্যো) নামক জনপদের লক্ষ্যে চলেছে স্ট্যানলের কাফেলা। উসেগুহহা বলে কোনো স্থান বা প্রদেশ আজ আর নেই। এমনকি বোঝাও মুশকিল সেই অঞ্চলের বিস্তৃতি ঠিক কী ছিল। তবে সিম্বামওয়েন্নি নামে একটি ক্যাম্প-সাইট এখনও রয়েছে তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের কাছে। আন্দাজ করা যেতে পারে এই সিম্বামওয়েন্নি-র কথাই স্ট্যানলে বলছেন। কাজেই এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল বুটি দেওয়া পথের আশেপাশেই।—সম্পাদক
রেহনেকতে নামক জায়গা হয়ে চুন্যো নামক জনপদের উদ্দেশে বেরিয়ে, মাঝপথে একটা ফাঁকা মাঠে শিবির তৈরি করে গত তিনদিন কাটাতে বাধ্য হয়েছি। চারদিনের দিন শ’কে আরও দুজন সৈন্য দিয়ে পাঠালাম , কিঙ্গারু আর দুই মাবরুকির কি হল তার খোঁজ নিতে। রাতের দিকে সে সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে এল, মুকুনগুরুর ভয়ানক আক্রমণে একেবারে কাহিল। তবে হারানো সৈন্যদের নিয়ে ফিরেছে। তারাই নিজেদের গল্প শোনাল।
তারা যা বলল তা সংক্ষেপে এই রকম। শিবির ছাড়ার পরে তারা দ্রুত হেঁটে বেলা দশটার মধ্যেই সিম্বো পৌঁছে যায়। আমাদের পরিত্যক্ত শিবিরের আশেপাশের এলাকায় বন্দর সালেম, তার গাধা বা জিনিসপত্রের কোন হদিশ না পাওয়ায় তারা উঙ্গেরেঙ্গেরির সেতুর দিকে সিধা হাঁটতে শুরু করে। সেখানে মুসুঙ্গুর পরে কারা সেতু পেরিয়েছে সে বাবদে সেতুর মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেখানে তারা শোনে যে মুসুঙ্গুর সঙ্গে যেমন ছিল তেমন একটা সাদা গাধা সেতু পেরিয়ে সিম্বামওয়েনির দিকে গেছে বটে, কিন্তু কোন বিদেশি জামাকাপড় পরা হিন্দিকে তো তারা দেখেনি।
আমার তিন কালো গোয়েন্দা এই খবর শুনে আরও দ্রুত ছুটতে শুরু করে। বুঝে ফেলে যে বর্বরেরা নিশ্চয় রাঁধুনিকে মেরে ফেলেছে আর তার গাধা ও জিনিস নিয়ে পালিয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা সিম্বাবওয়েনিতে পৌঁছায় আর সেখানকার পশ্চিম দরজার প্রহরীদের খবর দেয় যে দুজন বর্বর একটা সাদা গাধা নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই তাদের শহরের মধ্য দিয়ে গেছে, তারা একজন বিদেশি পোশাক পরা মানুষকে খুন করেছে। খুন হওয়া লোকটা মুসুঙ্গুর (মানে শ্বেতাঙ্গ সাহেবের) দলের।
সিম্বামওয়েনির প্রহরীরা আমার লোকদের সুলতানার কাছে নিয়ে গেলে তারা সুলতানাকেও বিষয়টা জানায়। সুলতানা মিনারের প্রহরীদের কাছে জানতে চান যে তারা গাধাসহ দুই বর্বরকে দেখেছে কি না। প্রহরীরা দেখেছে বলে জানায়। তখন সে তার কুড়িজন সশস্ত্র যোদ্ধাকে মুহাল্লেহ অবধি পাঠায় সেই দস্যুদের খোঁজে। তারা সেই দুজনকে রাতের আগেই ধরে নিয়ে আসে, সঙ্গে আমাদের গাধা আর রাঁধুনির সব জিনিসপত্রও ফেরত আনে।
সুলতানা স্পষ্টতই বাবার তেজটি উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছে। সেই সঙ্গে তার সম্পদের প্রতি দুর্নিবার লোভও। আমার দুই বার্তাবাহক, দুই বর্বর, রাঁধুনির গাধা ও জিনিসপত্র তখনই তার সামনে হাজির করা হল। দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল যে তারা কিভাবে গাধা, এত বিদেশি পোশাক, কাপড়, পুঁতি পেল? তাতে তারা জানাল যে তারা গাধাটাকে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় পেয়েছিল। জিনিসগুলো কাছেই মাটিতে ছিল। ধারে কাছে সেগুলোর কোন মালিক বা দাবিদার নেই দেখে তারা ধরে নেয় যে সেগুলো সব তাদেরই আর সেইমত তারা সেগুলো নিয়ে নেয়। এরপর আমার সৈন্যদের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে তারা কি গাধাটাকে ও জিনিসপত্রগুলো চিনতে পারছে? তাতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই ‘হ্যাঁ’ বলে। তারা সুলতানাকে আরও বলে যে তারা শুধু গাধা আর জিনিসের খোঁজেই আসেনি। সেগুলোর মালিককেও তারা খুঁজছে। সে মুসুঙ্গুর দল ছেড়ে পালিয়েছে। তারা জানতে চায় যে এই অসভ্যেরা লোকটাকে কী করেছে। সুলতানাও সেকথা জানতে ইচ্ছুক ছিল আর তাই সেবিষয়ে তথ্য পাওয়ার জন্য সে সোজা লোকগুলোকে খুনের দায়ে দায়ী করল। তাদের জানাল যে সে জানতে চায় দেহটা নিয়ে তারা কী করেছে। বুনোলোকগুলো খুবই বোঝাতে চেষ্টা করল যে তারা ওইরকম কোন লোককে জন্মেও দেখেনি, সুলতানা চাইলে তারা হলফ করেও সেকথা বলতে পারে। সুলতানা মনে মনে জানে যে তারা মিথ্যে বলছে, তাই দিব্যি কেটে বলার জন্য অপেক্ষা না করেই তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে, একটা কাফেলার সঙ্গে জাঞ্জিবারে সৈয়দ বুরঘাসের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তিনিই এদের বিচার করবেন। তারপর আমার সৈন্যদের কাছে সুলতানা জানতে চায় যে, তার প্রধানদের পাঠানোর পরেও কেন মুসুঙ্গু তাকে ভেঁট পাঠায় নি? সৈন্যরা প্রভুর এইসব কাজের বিষয়ে কিছুই না জানত না, ফলে উত্তর দিতে পারেনি। তখন কিসাবেঙ্গোর উত্তরাধিকারী, নিজের দস্যুরক্তের মর্যাদা রেখে, আমার কাঁপতে-থাকা সৈন্যদের জানায় যে সাহেব যখন তাকে নজরানা দেয় নি, সে নিজেই সেটা আদায় করে নেবে। তাদের বন্দুক কেড়ে নেবে, এমনকি রাঁধুনিরটাও। গাধার সঙ্গে যে সব কাপড়, পুঁতি পাওয়া গিয়েছিল সেসব সে নিজে নেবে। হিন্দির জামাকাপড় তার প্রধানেরা রাখবে। আর তাদের বেঁধে রাখা হবে যতক্ষণ না সাহেব দলবল নিয়ে তাদের উদ্ধার করতে আসে। ঠিক যেমন ভয় দেখিয়েছিল সে, তেমনই করল। ষোল ঘণ্টা আমার সৈন্যদের বাজারের মধ্যে বেঁধে রাখা ছিল, এবং হীন মানুষদের যাবতীয় টিটকিরি তাদের সহ্য করতে হয়েছিল। তাদের খুবই কপাল ভাল যে পরের দিনই শেখ থানি সিম্বামওয়েনি এসে পৌঁছান। এঁর সঙ্গে আমার দিন পাঁচেক আগেই কিঙ্গারুতে দেখা হয়েছিল। মাকাটার জনহীন প্রান্তর পেরনোর জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে তিনি শহরে এসে শিকলে বাঁধা আমার লোকদের দেখেন আর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের আমার দলের লোক বলে চিনতে পারেন। তাদের থেকে সব কিছু শুনে এই হৃদয়বান শেখ সুলতানার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন আর তাকে বলেন যে তিনি খুবই ভুল কাজ করছেন। এমনই একটা ভুল কাজ যার দাম চোকাতে হবে অনেক রক্তের মুল্যে। শেখ জানান যে সাহেব খুবই শক্তিশালী। তার কাছে এমন দুটো বন্দুক আছে যেগুলো একবারও না থেমে চল্লিশটা গুলি ছুঁড়তে পারে আর সে গুলিগুলো আধঘন্টার পথ যেতে পারে। সাহেবের কাছে এমন অনেকগুলো বন্দুক আছে যেগুলোর গুলি ফেটে যায় আর মানুষকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেয়। সে ওই পাহাড়টার মাথায় চড়বে আর তোমার একজন সৈন্যও সেখানে পৌঁছানোর আগেই শহরের সব মেয়ে-মরদ-বাচ্চাকে মেরে ফেলবে। এই পথে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে, সৈয়দ বুরঘাস তোমার রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করবেন। যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, উদো আর ওয়াকামির লোকেরা এসে লুটেপুটে নেবে। তোমার বাবার হাতে গড়া এই শক্তিশালী রাজ্যের নাম আর উসেগুহহার লোকেরা জানবে না। ভাল চাও তো মুসুঙ্গুর লোকদের ছেড়ে দাও, ওদের খাবার দাবার দাও, আর মুসুঙ্গুর জন্য খাদ্যশস্য পাঠাও, ওদের বন্দুক ফিরিয়ে দাও আর চলে যেতে দাও। কে জানে সাহেব হয়ত এতক্ষণে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে!
আমার শক্তির এইরকম বাড়াবাড়ি বর্ণনা আর শেখের ভয়াবহ বিবরণের ফল ভাল হয়েছিল। কিঙ্গারু আর দুই মাবরুকিকে তখুনি কারাদন্ড থেকে মুক্তি দেওয়া হল। তাদের এতই খাবারদাবার দেওয়া হল যা দিয়ে আমাদের কাফেলার দিন চারেক চলে যাবে। সব আনুষঙ্গিকসহ একটা বন্দুক আর তার গুলি বারুদ ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ফেরত দেওয়া হয় রাঁধুনির গাধাটাও। আরও দেওয়া হয় একটা চশমা, মালাবারে ছাপা বই আর একটা পুরোন টুপি, যার মালিক এখন মারা গেছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। শেখ আমার সৈন্যদের সিম্ব অবধি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সেখানেই তার শিবির। সেই শিবিরে শ আমার সৈন্যদের খুঁজে পায়, তারা তখন প্রচুর পরিমাণে ঘি-ভাত খাচ্ছিল। শ এবং তার সঙ্গীদের প্রতিও শেখ একই রকম উদার আতিথেয়তা দেখান।
অবাক হয়ে আমি এই লম্বা গল্পটা শুনলাম। কত রকমের যে আবেগ মনের মধ্যে খেলা করছিল! আমার ভাবনার থেকে বাস্তবের ঘটনা যে কতই আলাদা। ভেবেছিলাম রাঁধুনিকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এইরকম শোচনীয় দুর্ভাগ্য যে তার কপালে আছে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য গভীর অনুশোচনা হচ্ছিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম দলের অন্য কেউ দামি কিছু চুরি করলেও আর কাউকে কখনও শিবির থেকে তাড়াব না— আর কেউ যেন এই রকম নিষ্ঠুর আততায়ীর হাতে মারা না পড়ে! দ্বিতীয়ত সিম্বামওয়েনির নারী যোদ্ধাটির আচরণে খুবই অবাক হলাম। একজন কাফেলা মালিকের থেকে দুটো নজরানা আদায় করাটা মোটেই নিয়ম না। আর নিয়ম যদি হয়ই, উঙ্গেরেঙ্গেরির পাশে আমি তো চারদিন শিবির করে ছিলাম— দ্বিতীয় নজরানা দেব না বলে যদি ভুল করেই থাকি, তখনই তো তার সংশোধনের যথেষ্ট সময় ছিল! তার দূতেরা যদি আবার ভেঁটের দাবি নিয়ে আসতেন, তাহলে কি আর আমি নিজের কাফেলার নিরাপত্তা বিপন্ন করতাম? তারপরেই বন্দুকগুলো ডাকাতি করার জন্য তুমুল রাগ হল, সিম্বামওয়েনির কাছাকাছি থাকলে হয়তো শহরের উপকন্ঠের উপর হামলা করে প্রতিশোধ নিতে ছুটতাম। তবে রাঁধুনির খোঁজ করতে গিয়ে যে চারদিনের দেরি হয়েছে, সেটা মনে করে আমার রাগ অনেকটাই কমে এল, এমনকি কপালে যে আরও ভোগান্তি হয়নি এজন্যই কেমন যেন কৃতজ্ঞ লাগল! তৃতীয়ত, শেখ থানি ভাল উদ্দেশ্যে বললেও তার বাড়াবাড়ি রকমের বর্ণনা আর তিন সৈন্যের দুঃখের গল্প শুনে ভারি আমোদ হল। সেই রাতেই আমি ঠিক কী ঘটেছিল তার একটা সম্পূর্ণ বিবরণ লিখলাম। পুবমুখো প্রথম যে কাফেলা পাব, তার হাত দিয়েই আমেরিকান রাজদূতের কাছে পাঠাতে হবে। আমার রাঁধুনির অদ্ভুত অন্তর্ধানের ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সৈয়দ বুরঘাস যেন সে বাবদে দুপক্ষের বক্তব্যই জানতে পারেন।
অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হৃদয়ে আমরা শিবির ছেড়ে বেরোলাম, এখানে যে কী প্রচণ্ড উদ্বেগ আর ছটফটানি ভোগ করতে হয়েছে! সারা রাত ধরে চলতে থাকা প্রচণ্ড বৃষ্টিকেও পাত্তা দিলাম না, অন্য সময় হলে এত বৃষ্টি আমাদের হাঁটার উৎসাহ কমিয়ে দিত! লাল মাটির উপর দিয়ে চলা প্রথম মাইলখানেক রাস্তার জল পূর্ব এবং পশ্চিমমুখো মৃদু ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। তবে, যে জঙ্গলের পূর্ব প্রান্তে আমাদের এত দিন দেরী হল, সেই অনুকূল জঙ্গলের আচ্ছাদনটি ছেড়ে এরপর আমরা এক সাভানাতে এসে পড়লাম— এখানে বৃষ্টির জলে মাটি পাঁকের মত নরম আর ঘন চুনবালিগোলার মতো নাছোড়বান্দা, ভয় পাচ্ছিলাম যে আমাদের কপালেও সেই আরকানস’র বিখ্যাত পর্যটকের মতন ভোগান্তি নাচছে— আরকানস কাউন্টির অজস্র কাদা ভরা জমির একটাতে তিনি এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন যে তার লম্বা 'স্টোভ-পাইপ' টুপি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
(ক্রমশ...)