ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে উজিজির পথে এগিয়ে চলার বর্ণনা। এ পর্বে গভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে উটেন্ডে নামের এক গ্রামে পৌঁছনর কাহিনি। তরজমা স্বাতী রায়
দেড় ঘন্টায় এই টঙ্গোনিতে পৌঁছলাম, এটা উকাম্বার এক জন-বর্জিত অঞ্চল। তিন-চারটে পোড়া গাঁ, আর একটা বড় এলাকা জনশূন্য, মিরাম্বোর রুগা-রুগাদের কাজ। এই সমৃদ্ধ জনপদকে লুঠপাট করে পুরো ধ্বংস করার পরে, যে কজন লোক টিকে ছিল, তারা পশ্চিমে উগারায় চলে যায়। মোষের একটা বড় দল এখন হ্রদের জলে তাদের তেষ্টা মেটাচ্ছে। এই হ্রদ থেকেই উকাম্বার গ্রামগুলিতে জল যেত।
জঙ্গলের মাটির উপরে প্রচুর আয়রন হেমাটাইট বেরিয়ে আছে। অনেক বুনো ফল - বেল, তেঁতুল আর একটা ছোট কুলের মতো ফল, এই দিয়েই আমাদের অনেক অনেক ভোজনপর্ব সমাধা হবে।
উকোনঙ্গোর এই বনে মাঝে মাঝেই হানি-বার্ড দেখা যায়। এই পাখি খুব জোরে ডাকে, দ্রুত কিচিরমিচির করে। কোন বড় গাছের কোটরে বুনো মৌমাছিরা মধুর বিশাল ভাণ্ডার জমিয়ে রেখেছে, তাকে খুঁজে পাওয়ার কি উপায় তা কোনঙ্গোরা ভালই জানে। প্রতিদিন, আমার কাফেলার কোনঙ্গোরা আমার জন্য সুস্বাদু সাদা ও লাল মধুওলা মৌচাকের বড় বড় টুকরো নিয়ে আসত। লাল মৌচাকে সাধারণত অনেক মরা মৌমাছি থাকত, তবে আমাদের ভয়ানক পেটুক লোকদের তাতে কিছু এসে যেত না। শুধু যে মৌমাছিই খেতাম তাই না, মোমও খেয়ে নিতাম।
হানি-বার্ড যেই না পর্যটককে দেখতে পায়, অমনি সে বার বার উন্মত্ত, উত্তেজিত ভাবে ডাকতে থাকে আর এ ডাঁটি থেকে ও ডাঁটি, এ ডাল থেকে সে ডাল লাফাতে থাকে। তারপরে অন্য গাছে ঝাঁপ দেয়, সেই সঙ্গে অবিরাম কিচিরমিচির করতেই থাকে। এদেশিরা ছোট্ট পাখিটার ধরণ ধারণ বোঝে, তারা নির্দ্বিধায় তাকে অনুসরণ করে; অধৈর্য পাখির চোখে তার চলা খুবই ধীর, সে আবার পিছনে উড়ে আসে, আরও জোরে, আরও অধৈর্য হয়ে ডাকে, যেন তাড়াতাড়ি যেতে বলে, আর তারপর যতক্ষণ না সেই গুপ্ত ভাণ্ডারে পৌঁছায়, সামনের দিকে সবেগে উড়ে যায়, যেন সে দেখাতে চায় যে সে কত দ্রুত মধুর ভাঁড়ারে পৌঁছে যেতে পারে। তারপর স্থানীয় লোকটি মৌচাকে আগুন লাগায়, মধু সংগ্রহ করে। আর ছোট্ট পাখিটি নিজেকে জাহির করে, যেন একটা ভারি জয় করেছে এমন ভাবে ডাকতে থাকে, যেন সে বলতে চায় যে তার সাহায্য ছাড়া দুপেয়েরা মধু খুঁজেই পেত না।
আশেপাশে অসংখ্য শিকারের পাল থাকার জন্য এই পদযাত্রায় ডাঁশমাছি আর সেৎসেরা খুব ঝামেলা করছিল।
৯ অক্টোবর আমরা দক্ষিণ দিকে একটা লম্বা যাত্রা করলাম। তারপর একটা চমৎকার বন-বিতানের মাঝখানে আমাদের শিবির তৈরি করলাম। এই পথে জলের খুব অভাব। মৃমা ও ন্যামওয়েজিরা বেশিক্ষণ তৃষ্ণা সহ্য করতে পারেনা। যখন প্রচুর জল মেলে, তারা প্রত্যেকটা জলধারা, প্রত্যেকটা জলাশয়ে তেষ্টা মেটাতে থাকে; আর এই এখানে বা মারেঙ্গা ও মাগুন্ডা এমকালির মরুভূমিতে, যেসব জায়গায় জল দুর্লভ, বিকেলের দিকে টানা পথ চলা হয়, সেখানে সবাই আগে লাউের খোল জলে ভর্তি করে, যাতে পরের দিন সকালে জলের কাছে পৌঁছান অবধি টানতে পারে। সেলিম একদম তেষ্টা সহ্য করতে পারত না। কতটা মহামূল্য তরল তার সঙ্গে আছে সেটা ব্যাপার না, সে সাধারণত পরের শিবিরে পৌঁছানোর আগেই পুরোটা শেষ করে ফেলত আর ফলে রাতের দিকে ভুগত। তাছাড়া, নিজের প্রাণ বিপন্ন করে সে প্রতিটা কাদাগোলা পুকুরের থেকে জল খেত। একদিন সে ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করল যে তার রক্ত বেরোচ্ছে। মনে হল আমাশয়ের প্রথম পর্যায়।
উগান্ডা ছাড়ার পর থেকেই এই পথ চলার সময়, ক্যাম্প-ফায়ারের একটা প্রিয় বিষয় ছিল রুগা-রুগা ও তাদের নৃশংসতা। আর সেই সঙ্গে আলোচনা চলত যে এই সাহসী জঙ্গল দস্যুদের সঙ্গে যদি আমাদের মুখোমুখি হয় তাহলে কী হতে পারে। আমি তো খুব বিশ্বাস করি যে মিরাম্বোর আধ ডজন লোক অকস্মাৎ আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, আমার গোটা কাফেলার সব লোকই সোজা পিঠটান দেবে।
পরের দিন মারেফু পৌঁছলাম, সামান্য তিন ঘণ্টার পথ হেঁটে। সেখানে উন্যানয়েম্বের আরবদের পাঠানো একটা দলকে পেলাম, তারা দক্ষিণ ওয়াতুতায় যাচ্ছে, সঙ্গে নজরানা দেওয়ার জন্য অনেক কাপড়ের গাঁট, এই দলের দায়িত্বে যে তার নাম হাসান দ্য এমসেগুহহা (Hassan the Mseguhha)। এই বীর কূটনীতিজ্ঞ নেতা ওখানে দশদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে, কারণ গুজব রটেছে যে সামনে নাকি যুদ্ধ চলছে। শোনা যাচ্ছিল যে উকোনঙ্গোর এমবোগার সুলতান এমবোগো মান্যওয়া সেরার ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করছে। মারেফু থেকে উকোনঙ্গোর বড় জেলা এমবোগো মাত্র দু'দিনের পথ, ফলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে বৃদ্ধ হাসান আর এগোচ্ছে না। আমাকেও আর না এগোতে বলা হল, কারণ ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়ে এগোন অসম্ভব। তাকে জানিয়ে দিলাম যে আমি নিজের পথে এগোবই, চেষ্টা করে তো দেখি, আর তাকেও উফিপার সীমান্ত অবধি পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যেখান থেকে সে সহজেই ও নিরাপদে ওয়াতুতার পথে চলে যেতে পারে, কিন্তু সে সেকথা কানে তুলল না।
টানা চৌদ্দ দিন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চলছি। এত দিনে ১ ডিগ্রি অক্ষাংশের একটু বেশি এসেছি। আরও কিছুটা দক্ষিণে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কারণ এই রাস্তাটা ভাল, অবশ্য আরও দক্ষিণে গেলে মিরাম্বোর সাথে দেখা হওয়ার ভয়ও কম সেটাও একটা কারণ ছিল। কিন্তু মাত্র দুদিনের দূরত্বে সামনের এই যুদ্ধের খবরে, অভিযানের স্বার্থে, বনের মধ্যে উত্তর বায়ু কোণ বরাবর একটা সুবিধাজনক পথ ধরে টাঙ্গানিকার দিকে যেতে বাধ্য হলাম। হাতির চলাচলের পথ, স্থানীয়রাও চলে এই পথ ধরে। আসমানি, আমাদের পথ প্রদর্শকের সঙ্গে আলোচনা করে এই পথটা ঠিক হল; আমরা এখন উকোনঙ্গোতে, গোম্বে খাঁড়ি পেরিয়ে এই জেলায় ঢুকেছিলাম।
মারেফু পৌঁছানোর পরের দিন আমরা গ্রামের লোক আর আরব রাজদূতের চোখের সামনে দিয়ে পশ্চিম দিকে বীরবিক্রমে রওনা হলাম। রাজদূত মশাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বারবার বলতে থাকল যে আমরা অবশ্যই যুদ্ধের মধ্যে গিয়ে পড়ব।
আট ঘণ্টা একটা বনের মধ্য দিয়ে চলছি। এখানে অনেক এমবেম্বু বা বুনোপীচ মেলে। যে গাছে এই ফল ধরে সেটা অনেকটা নাশপাতি গাছের মতো, প্রচুর ফল দেয়। একটা গাছ দেখলাম, আন্দাজ করলাম যে তাতে অন্তত ছ-সাত ঝোড়া ফল আছে। অনেক অনেক পীচ খেলাম। যতদিন এই ফল ফলবে, এই এলাকার পর্যটকদের অনাহারের ভয় নেই।
একটি মনোরম পাহাড়ের পাদদেশে উটেন্ডে নামের একটি গ্রাম খুঁজে পেলাম। আমরা আচমকা তাদের মাথার উপরের পাহাড়ের গায়ে আমরা দেখা দেওয়াতে সেখানকার বাসিন্দারা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। কূটনীতি হিসেবে সুলতানের কাছে এক ডটি কাপড় উপহার পাঠালাম। সে সেটা নিল না। কারণ সে তখন মদে চুর আর তাই উদ্ধত। আরও চার ডটি কাপড় না পেলে সে কোন উপহার নেবে না বলে জানানো হল। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় একটা শক্তপোক্ত ঘর বাঁধার নির্দেশ দিলাম, কাছেই যথেষ্ট জলও আছে। চুপচাপ কাপড়টাকে ফের গাঁটরিতে ঢুকিয়ে দিলাম।
(ক্রমশ)