ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এই পর্বে মান্যুয়েমা অঞ্চলের কথা। তরজমা স্বাতী রায়
২. পুরনো নীল নদের কোন কোন অংশের সঙ্গে ওয়েবের নদীর সংযোগ সেও অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।
এই দুটো কাজ সুসম্পন্ন হলে, একমাত্র তারপরই, নীল নদের রহস্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব। হ্রদের থেকে জন্ম নেওয়া লুয়ালাবা নদী অজস্র হ্রদের মধ্যে দিয়ে বিপুল জলধারা নিয়ে যে দুটি দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে, সেই দেশ দুটি হল রুয়া (স্পেক যাকে বলেছেন উরুওয়া) ও মান্যুয়েমা। এই নদীর বিপুল জল রাশি দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। ইউরোপ এই প্রথম জানল যে ট্যাঙ্গানিকা ও কঙ্গো নদীর পরিচিত উৎসগুলির মধ্যে লক্ষ লক্ষ নিগ্রো জাতির বসবাস। যে সাদা মানুষেরা আফ্রিকার বাইরে এমন শোরগোল তোলে, তাঁদের এই নিগ্রোরা কখনও চোখেও দেখেওনি, তাদের কথা শোনেওনি। অসাধারণ শ্বেতাঙ্গদের প্রথম প্রতিভূ হিসেবে ডাঃ লিভিংস্টোনকে দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়েছিল, তিনি মনে হয় তাদের মনে একটা অনুকূল ধারণা তৈরি করতে পেরেছেন। যদিও, তাঁর উদ্দেশ্য ভুল বুঝে ও ওই অঞ্চলে নিদারুণ কীর্তির অধিকারী আরবদের সঙ্গে তাঁকে এক চোখে দেখে, বেশ ক'বার তাঁর প্রাণহানির চেষ্টাও হয়। রুয়া ও মান্যুয়েমা নামের বিস্তৃত দেশ দুটোতে সত্যিকারের বিধর্মীদের বাস, প্রতিটা গ্রামে আলাদা আলাদা সুলতান বা জমিদার আছে। এই এলাকা কারাগওয়াহ, উরুন্ডি ও উগান্ডার মতন সার্বভৌম দেশ নয়, স্বৈরাচারী রাজাদের শাসনাধীনও নয়। এই সব ছোট ছোট গ্রামের সর্দারদের মধ্যে যারা এমনকি খুবই বুদ্ধিমান, তারাও নিজেদের গ্রামের বসতিগুলোর ত্রিশ মাইল সীমানার বাইরের কথা আর কিছু জানে বলে মনে হয় না। লুয়ালাবা থেকে ত্রিশ মাইল দূরে, খুব কম লোকই ছিল যারা কখনও এই মহান নদীর কথা শুনেছিল। আদিবাসীদের মধ্যে নিজ দেশের বিষয়ে এই ধরনের অজ্ঞতা স্বাভাবিকভাবেই লিভিংস্টোনের কাজ বাড়িয়েছিল। এর সঙ্গে তুলনা করলে, আফ্রিকার যেসব জাতি-উপজাতির সংস্পর্শে লিভিংস্টোন এসেছিলেন, তাদের সভ্য বলে ধরে নেওয়া যায়, তবুও, কুটিরশিল্পে মান্যুয়েমার এই বন্যজাতির লোকেরা তাঁর দেখা অন্য যেকোনো জাতির থেকে অনেকটাই উন্নত ছিল। যেখানে অন্যান্য জাতি-উপজাতির লোকেরা তাদের কাঁধের উপর আলগোছে একটা করে পশুর চামড়া ফেলে রেখেই সন্তুষ্ট, সেখানে মান্যুয়েমার লোকেরা সরু ঘাসের থেকে কাপড় বুনত, সেই কাপড় এমনকি ভারতের সেরা ঘাসের কাপড়ের সঙ্গেও ভালই তুলনীয়। কালো, হলুদ, বেগুনি - ইত্যাদি বিভিন্ন রঙে কাপড় ছোবানোর শিল্পও তারা জানে। সে কাপড় এতোই সুন্দর যে এনগোওয়ানা মানে জাঞ্জিবারের স্বাধীন পুরুষরা সাগ্রহে তাদের সুতির কাপড়ের বদলে এই সূক্ষ্ম ঘাসের কাপড় নিত। প্রায় প্রতিটি মান্যুয়েমার কালো মানুষের গায়েই এই দেশী কাপড় থেকে মার্জিত ভাবে তৈরি দামির (আরবি) অর্থাৎ ছোট জ্যাকেট দেখেছি। এই দেশগুলোতে প্রচুর হাতির দাঁতও মেলে।
ঠিক যে কারণে লোকে ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, মন্টানা বা ইডাহোর গিরিশিরায় অভিযান করে বা সেখানে গিয়ে বসতি বানায়, অস্ট্রেলিয়ায় স্বর্ণরেণু অথবা কেপ কলোনিতে হীরা খুঁজতে জড়ো হয়, সেই একই টানে তারা পুঁতির বিনিময়ে অমূল্য হাতির দাঁত জোগাড় করতে মান্যুয়েমায় ভিড় জমায়। মান্যুয়েমা এখন আরব ও ম্রমা গোষ্ঠীর স্বর্গ - তাদের এলো ডোরাডো। প্রথম আরব ব্যবসায়ীটি রাশি রাশি হাতির দাঁত নিয়ে মান্যুয়েমা থেকে ফিরে এসেছে মাত্রই চার বছর হল, সে আরও জানিয়েছে যে সেখানে হাতির দাঁতের ছড়াছড়ি, সেই থেকেই কারাগওয়াহ, উগান্ডা, উফিপা ও মারুঙ্গুর পুরানো বহুব্যবহৃত পথগুলো প্রায় ফাঁকা। মান্যুয়েমার লোকেরা দামি জিনিসের দাম দেয় না, তাদের কুঁড়েগুলোতে হাতির দাঁতের ঠেকনা দেওয়া। সেখানে হাতির দাঁতের স্তম্ভ দেখতে পাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার আর এই সব শুনলে কেউ আর সলোমনের হাতির দাঁতের প্রাসাদের কথা শুনে আশ্চর্য হতে পারে না। বংশ পরম্পরায় তারা হাতির দাঁতকে দরজার ফ্রেম হিসেবে ব্যবহার করেছে , ছাঁচার ঠেকনো হিসেবে কাজে লাগিয়েছে যতক্ষণ না সেগুলো পুরোপুরি পচে অকাজের হয়ে পড়ে। তবে আরবদের আবির্ভাবের পরে বেশ তাড়াতাড়িই তারা জিনিসটার দাম বুঝতে শিখেছে। এখন এর বেশ দাম বেড়েছে, যদিও এখনও খুবই সস্তা। জাঞ্জিবারে গুণমান অনুসারে প্রতি ফ্রাসিলাহ মানে ৩৫ পাউন্ড হাতির দাঁতের দাম ৫০ থেকে ৬০ ডলার। উন্যান্যেম্বেতে প্রতি পাউন্ড দাঁতের দাম প্রায় এক ডলার দশ সেন্ট, কিন্তু মান্যুয়েমাতে, প্রতি পাউন্ড হাতির দাঁত কিনতে আধ সেন্ট থেকে ১৪ সেন্ট মূল্যের তামা লাগে। আরবদের অবশ্য নিজেদের কৃপণতা ও নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে বাজার নষ্ট করার অতিশয় দক্ষতা আছে। একটা ছোট দল আরবও মাস্কেটের সাহায্যে মান্যুয়েমার লোকদের বিরুদ্ধে অজেয়, যারা কিছুদিন আগে অবধিও কখনও বন্দুকের আওয়াজ শোনেনি। মাস্কেটের শব্দ তাদের এমনই প্রাণে ভয় ধরায় যে কহতব্য না। তাদের বন্দুকের নলের মুখের মুখোমুখি হতে প্ররোচিত করা প্রায় অসম্ভব। তারা বিশ্বাস করে যে আরবরা বজ্র চুরি করেছে আর এই রকমের লোকদের বিরুদ্ধে তীর-ধনুক সামান্যই প্রভাব ফেলতে পারে। এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব, আর তারা প্রায়ই ঘোষণা করে যে, যদি বন্দুক না থাকত, তাহলে একজন আরবও জ্যান্ত অবস্থায় এই দেশ ছেড়ে যেতে পারত না; এর থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে যদি না বারুদের আচমকা বিস্ফোরণে তারা ঘাবড়ে যেত, তাহলে যে অপরিচিত লোকেরা নিজেদের এমনই ঘৃণার পাত্র করে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে তারা খুবই উৎসাহের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করত।