আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। এখন চলছে এমপোয়াপোয়া থেকে রওনা হয়ে বিহোয়ানা পার করে কিদিদিমো হয়ে এমসালালো-র (নীচের মানচিত্রে) দিকে এগিয়ে যাওয়ার বর্ণনা। এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই (ওপরের) মানচিত্রে নীল দাগ দেওয়া পথের আশেপাশেই।— সম্পাদক
ন্যামবয়াতে যেদিন পৌঁছালাম, সেদিনটার কথা হামেদ যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তার মনে থাকবে—সেদিন সে যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিল আর যা হতাশা তাকে সহ্য করতে হয়েছিল! শিবির নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকার দরুন সে খেয়াল করেনি যে তার গাধাগুলো সুলতান পেম্বেরা পেরের মাটামার খেতে চরছে—এটাই যত সর্বনাশের মূলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সে ও তার চাকরেরা হারানো গাধাটাকে খুঁজে ফিরল, সন্ধ্যার দিকে যখন ফিরে এল, তখনও তারা পুরোপুরি ব্যর্থ। হামেদ মন্দ কপালের যন্ত্রণায়, একশো ডলার দামের মাস্কাট-দেশীয় গাধা হারানোর শোকে যেমন বিলাপ করছিল, একজন পুর্বদেশীয়ই কেবল এমনটা করতে পারে। প্রবীণ, অভিজ্ঞতর ও জ্ঞানী শেখ থানি সুলতানকে তার ক্ষতির কথা জানাতে পরামর্শ দিলেন। এই প্রাজ্ঞ পরামর্শের ভিত্তিতে হামেদ দুজন দাসের একটা দল পাঠাল আর তারা জেনে এল যে পেম্বেরা পেরের চাকররা মাঠের থেকে দুটো গাধাকে ধরেছে, তারা কাঁচা মাটামা খাচ্ছিল তখন আর তাদের মালিকের থেকে নয় ডটি উৎকৃষ্ট কাপড় না পেলে সে, পেম্বেরা পেরে, হজম করে ফেলা মাটামার ক্ষতিপূরণ হিসেবে গাধা দুটোকেই রেখে দেবে। হামেদ হতাশ হয়ে পড়ল। আধা শুক্কা দামের শস্যের জন্য নয় ডটি উৎকৃষ্ট কাপড়, উন্যানয়েম্বেতে তার দাম ২৫ ডলার! এ তো একটা অবাস্তব দাবি। কিন্তু যদি না দেয় তাহলে তার ১০০ ডলার দামের গাধার কী হবে? ক্ষতির দাবির অযৌক্তিকতা বোঝানোর জন্য আর সুলতানকে এক শুক্কা নিতে রাজি করানোর জন্য হামেদ সুলতানের কাছে গেল—গাধাগুলি যতটুকু দানা খেয়েছিল এক শুক্কা তার দামের দ্বিগুণেরও বেশি।
সুলতান তখন মদে চুর; ঘোর মাতাল, অবশ্য সেটাই তার স্বাভাবিক দশা, কাজকর্ম নিজে দেখার মতো কোনো অবস্থাই নেই। ফলে তার ডেপুটি, এক বিশ্বাসঘাতক এমনেয়ামেজি, হামেদের অনুরোধ শুনল। বেশিরভাগ গোগোর সঙ্গেই একজন করে উন্যাম্বেজির লোক থাকে, সে তাদের ডান-হাত, প্রধানমন্ত্রী, পরামর্শদাতা, জল্লাদ, এমনি সাধারণ কাজ কারবার ছাড়া আর সব কাজেই পা-বাড়ানো একটা লোক; বলা যায় একধরনের উন্যাম্বেজি ভাঁড়, সে আবার এমনই চঞ্চল, অস্থির আর অসন্তুষ্ট যে এই ধরনের মানুষ গোগো সুলতানের পরামর্শদাতাদের একজন আর এমনকি প্রধান পরামর্শদাতা বলে শুনলে সুলতানের ব্যক্তিগত ক্ষতি করার লোভ হয়। আরবদের উপর জুলুমবাজির বেশিটাই এই ধূর্ত বিশ্বাসঘাতকদের কীর্তি। শেখ হামেদ দেখেছিল যে এই উন্যাম্বেজির লোকটা সুলতানের থেকে অনেক বেশি অনমনীয়—নয় ডটি সবথেকে ভালো মানের কাপড় ছাড়া কিছুতেই গাধাটাকে ছাড়ল না। সেদিন ব্যাপারটার ফয়সালা হল না, আর বোঝাই যাচ্ছে যে সেই রাতটা হামেদের না ঘুমিয়েই কাটল। অবশ্য দেখা গেল যে গাধার ক্ষতি, বিশাল জরিমানা ও নিদ্রাহীন রাত পুরোটাই শাপে বর হয়েছে; কারণ, মাঝরাত নাগাদ, একজন গোগো ডাকাত তার শিবিরে হানা দিয়েছিল, আর একটা কাপড়ের গাঁটরি চুরি করার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ল—তিতিবিরক্ত হামেদ জেগেই ছিল—ডাকাতের কানের পাশ দিয়ে একটা গুলি চলে যেতেই সে হাওয়া।
প্রত্যেকটা কাফেলার মালিকের থেকে উন্যাম্বেজির লোকটা তার মাতাল প্রভুর জন্য পনেরো ডটি করে নজরানা আদায় করেছিল আর অন্য ছটা কাফেলার প্রতিটার থেকে ছয় ডটি করে, সব মিলিয়ে একান্ন ডটি, তবু পরদিন সকালে যখন আমরা ফের যাত্রা শুরু করলাম, তখন হামেদের দেয় জরিমানা থেকে এক টুকরো কাপড়ও বাদ দিতে রাজি হল না, আর হতভাগ্য শেখ তাই তার দাবি মেটাতে বাধ্য হল, না হলে তাকে গাধাদের কথা ভুলে যেতে হত।
পেম্বেরা পেরের ভুট্টাখেতের মধ্যে দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরে আমরা একটি ছড়ানো সমতলে এলাম, একেবারে পুকুরের উপরের তলের মতো আনুভূমিক, সেখানে উগোগোর লবণ তৈরি হয়। কানিয়্যেনি থেকে, দক্ষিণের রাস্তায়, উহুম্বা এবং উবানারামার সীমানা পেরিয়ে এই লোনাজমি ছড়ানো, অজস্র বড়ো বড়ো নুনে-পোড়া জলের পুকুর নাইট্রেটের মতো একটা বুড়বুড়ি কাটা জিনিসে ঢাকা। এরপরে, দু-দিন বাদে, যে উঁচু পাহাড়টা উগোগো আর উয়ানজিকে আলাদা করে, সেই পাহাড়টার মাথায় চড়ে এই বিশাল, প্রায় হাজার বর্গ কিলোমিটার ছড়ানো লোনা এলাকার চেহারাটা দেখতে পেলাম। আমি ভুল দেখে থাকতে পারি, তবে আমার যেন মনে হল যে বহুদূর ছড়ানো ধূসর-নীল জল দেখলাম, যার থেকে আমার ধারণা হল যে এই লবণাক্ত এলাকা আসলে একটি বিশাল লবণ-হ্রদের একটা কোণ। ন্যামবোয়া থেকে উয়ানজির সীমানা অবধি যে অসংখ্য হুম্বাদের১ বাস তাদের একজন আমার দলবলকে জানিয়েছিল যে উত্তরে দূরে একটি ‘মাজি কুবা’২ রয়েছে।
ন্যামবোয়ার পরের শিবিরটা তেরো মাইল দূরের মিজানজাতে, একটা তালগাছের ঘেরা এলাকার মাঝখানে। পৌঁছানোর পরেই আমি ফের কম্পজ্বরে কাবু হয়ে কম্বলের নীচে সেঁধিয়ে গেলাম। এই জ্বরটা সেই মারেঙ্গা এমকালির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমাকে প্রথম আক্রমণ করে। বুঝলাম যে সুস্থ হতে অন্তত একদিনের বিশ্রাম লাগবে। সেই ফাঁকে আমি কুইনিন সালফেটের অমূল্য বাঁধা ডোজটা নিতে পারব। শেখ থানিকে অনুরোধ করলাম হামেদকে পরের দিন থামতে বলার জন্য, আমার আর টানা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই, এই জঘন্য রোগের বারবার আক্রমণে আমি যেন দ্রুত অস্থিচর্মসার হয়ে যাচ্ছি। হামেদ চাইছিল দ্রুত উন্যানইয়েম্বেতে পৌঁছাতে যাতে অন্য কাফেলা বাজারে হাজির হওয়ার আগেই তার কাপড় বেচে দিতে পারে, তাই প্রথমেই সে বলল যে সাহেবের জন্য সে থামতে পারবে না। থানি আমাকে এসে সেই উত্তর জানালে আমি তাকে হামেদকে বলতে বললাম যে সাহেব তাকে বা অন্য কোনো কাফেলাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে চায় না। তাই সাহেবের এটাই ইচ্ছা যে হামেদ তাকে রেখেই চলে যাক, কারণ তার যা বন্দুকের ক্ষমতা তাতে সে একাই উগোগোর মধ্য দিয়ে যাত্রা করতে পারবে। কীসের জন্য শেখের সংকল্প বদলাল বা চলে যাওয়ার উদ্বেগ কমল তা জানি না, তবে সেই রাতে যাত্রা শুরুর জন্য হামেদের শিঙার সংকেত শোনা গেল না, বা পরের সকালেও সে যায়নি।
পরের দিন ভোরবেলা আমি কুইনাইন ডোজ শুরু করলাম; সকাল ৬টায় দ্বিতীয় ডোজ নিলাম; দুপুরের আগেই আরও চারটে ডোজ নেওয়া হয়ে গেল—সব মিলিয়ে, মেপে পঞ্চাশ ডোজ—এর ফল দেখা গেল পরে, প্রচণ্ড ঘামে আমার ফ্ল্যানেল, লিনেন ও কম্বল ভিজে টিজে একশা। দুপুরের পরে যখন বিছানা ছেড়ে উঠলাম, তখন ভারী কৃতজ্ঞচিত্তে দেখলাম যে, গত চোদ্দো দিন ধরে যে রোগ আমাকে ভোগাচ্ছিল তা শেষ পর্যন্ত কুইনিনের কাছে হার মানল।
এই দিনে উঁচু তাঁবু ও তার কেন্দ্রের খুঁটি থেকে পতপতিয়ে ওড়া আমেরিকান পতাকা দেখে মিজানজার সুলতান আকৃষ্ট হয়েছিলেন আর সেজন্যেই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে আমাকে সম্মানিত করেছিলেন। শেখ স্নি বিন আমেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানওয়া সেরকে সাহায্য করার জন্য তিনি আরবদের মধ্যে কুখ্যাত। বার্টন আর পরে স্পেক তাঁর উচ্চ প্রশংসা করেছেন, উগোগোর দ্বিতীয় শক্তিশালী প্রধান ছিলেন তিনি, অবশ্যই তাঁর বিষয়ে আমার বেশ কৌতূহল ছিল। তাঁর ঢোকার জন্য তাঁবুর দরজা তুলে ধরা হল, প্রাচীন ভদ্রলোকটি তাঁবুশীর্ষের উচ্চতা ও ভিতরের ব্যবস্থাপনায় এতই বিস্মিত হয়েছিলেন যে তার পরণের তেলতেলে বারসাতি কাপড়টি, যা রাতের ঠান্ডা আর দুপুরের তাপের বিরুদ্ধে তাঁর এক এবং একমাত্র সুরক্ষা, এক অন্যমনস্ক মুহূর্তে তার পায়ের কাছে খুলে পড়ে গেল—আগেকার এক লম্বা-চওড়া চেহারার এখনকার দুঃখী ও বয়স্ক ধ্বংসাবশেষটি মুসুঙ্গুর অপবিত্র দৃষ্টির সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ল। বাবার দুর্বলতার প্রতি মনোযোগী তাঁর বছর পনেরোর ছেলে, তাড়াতাড়ি পুত্রের কর্তব্য অনুসারে তার অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তাতে একটা বোকা চাপা হাসি হেসে তিনি আবার ওই স্বল্পবাসটি পরে নিলেন, আর মুসুঙ্গুর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, আসবাব ও শিবিরের তারিফ জানিয়ে বকরবকর করতে আর বিস্ময় প্রকাশ করতে বসে পড়লেন। টেবিলের উপরে কিছু বাসনপত্র আর আমার সঙ্গে থাকা কয়েকটা বই ছিল। অবোধ বিস্ময়ে টেবিলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। একটা ঝোলানো হ্যামক ছিল যেটা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল যে সেটা জাদুর সাহায্যে ঝোলানো। আমার জামাকাপড় থাকত যে পোর্টম্যান্টোগুলোতে সেসবও দেখলেন। তারপর সহর্ষে বললেন, ‘হাই-লে! মুসুঙ্গু একজন মহান সুলতান, তিনি তাঁর দেশ থেকে উগোগো দেখতে এসেছেন।’ তারপরে তিনি আমাকে লক্ষ করলেন আর আমার ফ্যাকাশে গাত্রবর্ণ ও সোজা চুল দেখে আবার অবাক হলেন, আর এবার যে প্রশ্নটা তুললেন তা হল, ‘এটা কী করে সম্ভব হল যে সূর্যের তাপে তার লোকদের চামড়া ঝলসে কালো হয়ে গেল অথচ আমি সাদা থেকে গেলাম?’ এরপরে তাকে আমার সোলার টুপি দেখানো হল, তিনি নিজের পশমি মাথায় সেটা পরার চেষ্টা করে নিজেও মজা পেলেন, আমাদেরও মজা দিলেন। বন্দুকগুলো দেখানো হল এরপর; উইনচেস্টার কোম্পানির অত্যাশ্চর্য রিপিটিং রাইফেল, উল্লেখযোগ্য মারণশক্তি প্রদর্শনের জন্য একটানা তেরোবার গুলি ছোড়া হল। আগে যতটা অবাক হয়েছিলেন এখন তার হাজার গুণ বেশি অবাক হলেন আর নিজের মনের কথা বলেই ফেললেন যে যুদ্ধে মুসুঙ্গুর সামনে গোগোরা দাঁড়াতেই পারবে না, কারণ যেখানেই কোনো গোগোকে দেখা যাবে, এই বন্দুক নিশ্চয়ই তাকে মেরে ফেলবে। তারপরে অন্য আগ্নেয়াস্ত্রগুলি বের করে আনা হল, প্রত্যেকটার কার্যপদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হল, শেষকালে আমার ধন এবং শক্তি দেখে প্রবল উৎসাহের বশে তিনি বলে উঠলেন যে তিনি আমাকে একটি ভেড়া বা ছাগল পাঠাবেন আর তিনি আমার ভাই হবেন। এই সম্মান দেওয়ার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম, আর বললাম যে তিনি যা খুশি হয়ে পাঠাবেন আমি তাই গ্রহণ করব।
শেখ থানি দোভাষীর ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি বললেন যে গোগো সুলতানকে কখনোই খালি হাতে ফেরত পাঠানো যাবে না, তাঁর মন্ত্রণায় আমি এক শুক্কা কানিকি কেটে সুলতানের কাছে হাজির করলাম, তবে সেটা ভালো করে দেখে, মেপে-টেপে বাতিল করা হল এই বলে যে মুসুঙ্গুর মতো একজন মহান সুলতানের তাঁকে কেবলমাত্র একটা শুক্কা দিয়ে অপমান করা উচিত না। আগেই কাফেলার থেকে বারো ডটি নজরানা পেয়েছেন। তারপরেই এরকম বলাতে আমি দুঃখই পেয়েছিলাম; তবে যেহেতু তিনি আমাকে একটা ভেড়া বা ছাগল উপহার দেবেন বলে বলেছিলেন, তাই আর-এক শুক্কায় খুব একটা আসে যায় না।
তিনি চলে যাওয়ার অল্প পরেই, তাঁর কথা অনুসারে, একটা বড়ো, ভালো ভেড়া আমার কাছে এল—চওড়া লেজ, চর্বিতে ঠাসা। তবে সেইসঙ্গে এই দাবিও এল যেহেতু আমি এখন তাঁর ভাই, তাই আমি যেন অবশ্যই তাঁকে তিন ডটি ভালো কাপড় পাঠাই। যেহেতু ভেড়ার দাম মাত্র দেড় ডটি, আমি ভেড়া আর ভ্রাতৃত্বের সম্মান দুইই প্রত্যাখ্যান করলাম, কারণ হিসেবে বললাম যে উপহার যা কিছু সেগুলো বড়োই একতরফা হয়ে যাচ্ছে। জানালাম যে নজরানা তো দেওয়াই হয়েছে, তার উপর উপহার হিসেবে এক ডটি কানিকিও দেওয়া হয়েছে। আরও কাপড় আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না যদি না বিনিময়ে আমি যথেষ্ট কিছু পাই।
ক্রমশ...