হিমালয়ের বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে যে বিপদ বর্তমান সময়ে পরিবেশবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে তুলছে, তা হল দাবানল। অতীতে উত্তর পূর্ব হিমালয়ে প্রচুর দাবানলের প্রকোপ দেখা যেত। কিন্তু গত পাঁচ বছরে হিমালয়ের মধ্যভাগে, অর্থাৎ হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের অরণ্যে দাবানলের বিপজ্জনক বৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছে।
চলতি বছরে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তরাখণ্ডে পাঁচ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে দাবানলে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে দাবানলে মানুষ মরল কী ভাবে? কারণ দাবানল অরণ্যে হয়। তাহলে কি দাবানল এত বিধ্বংসী আকার ধারণ করেছে যে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে অরণ্যের পাশের জনপদে? এক্ষেত্রে সম্ভাব্য কারণ বলা হচ্ছে মানুষ দাবানল নেভাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘটেছে এই ঘটনা। পাহাড়ে আদিবাসীদের একটা বড় অংশের মানুষের কাছে বৃক্ষ এবং অরণ্যের মহিমা দেবতার মত। পরিবেশবিজ্ঞান বইয়ের পাতা উল্টে শেখে না তারা। জন্ম থেকেই মানুষ প্রকৃতির হাত ধরে বাঁচে সেখানে, ফলে নাগরিক সভ্যতার বৃত্তের বাইরের মানুষ বৃক্ষদেবতা তথা অরণ্যকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে, এমন ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু এত ঘন ঘন দাবানল দেখা যাচ্ছে মধ্য হিমালয়ে যে মানুষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। গত ছয় মাসে উত্তরাখণ্ডে ১১০০টা এরকম দাবানলের ঘটনা ঘটেছে এবং বিনষ্ট হয়েছে প্রায় ১৫০০ হেক্টর বনভূমি। হিমাচলের বিপর্যয় আরও বেশি। সেখানে শুধুমাত্র মে মাসের শেষ সপ্তাহে ১৩৪৩টা দাবানলের ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া গেছে। এখন এই মুহূর্তে যখন আমি এই লেখা লিখছি তখনও পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে হিমাচল প্রদেশের বেশ কিছু জেলার বনাঞ্চল। প্রশাসন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যদি বৃষ্টি নামে, যদি বৃষ্টিধারায় আপনা থেকে নির্বাপিত হয় প্রকৃতির আগুন। বেশ কিছু সময় ধরে ভারতীয় বায়ু সেনার সাহায্য নেওয়া শুরু হয়েছে, যাতে তারা হেলিকপ্টার থেকে জল ছিটিয়ে দিয়ে কিছুটা হলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। কিন্তু এই পদ্ধতি যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে আগুন লাগলেই সেনা ডাকবার মত বিলাসিতা করা সম্ভব নয় প্রশাসনের পক্ষে। এত ঘন ঘন আগুন লাগার কারণে এমন প্রশ্নও উঠছে যে এই দাবানল কি সত্যিই প্রকৃতির রোষ, নাকি ইচ্ছে করে মানুষ আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে বনভূমি?
তবে এই প্রশ্নের মধ্যে প্রবেশ না করেও দাবানলের এত অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পরিবেশবিদরা সরাসরি বিশ্ব উষ্ণায়নকে দায়ী করছেন। বলা হচ্ছে যে শীতে যদি তুষারপাত আশানুরূপ না হয় এবং বৃষ্টিও একেবারে না হয়, মাটির আর্দ্রতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারপর গ্রীষ্মে উষ্ণ আবহাওয়ায় যখন আগুন লাগছে, মাটি শুষ্ক থাকার জন্য সেই দাবানল সহজে আপনা থেকে দমন তো হচ্ছেই না, উল্টে আরও বেড়ে যাচ্ছে। মাটি আর্দ্র থাকলে যে আকারের দাবানল অতীতে সাধারণভাবে এক হেক্টর ভূমির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, মাটি শুষ্ক থাকলে সেই আগুন অন্তত ৫ থেকে ১০ হেক্টর জমি নষ্ট করে দিচ্ছে। উষ্ণায়নের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং আগুন লাগবার সম্ভাবনা এমনিতেই বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে হিমালয়ের অরণ্যের পাইনগাছগুলি সূচের মত দেখতে পাতা ঝরায়। এই পাতাগুলি অত্যন্ত দাহ্য, তাছাড়া এই গাছের ধুনো কিম্বা রজনের পরিমাণও অনেক বেশি। বনভূমির মাটি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই সূচের মত দেখতে শুকনো পাতাগুলিতে একটু ঘষা লাগলেই আগুন ধরে যায়। এদিকে আবার তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে পাইন গাছ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি পাতা ঝরাচ্ছে এপ্রিল থেকে। এমনিতেই উষ্ণ হয়ে থাকা পাহাড়ে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে দাবানলের উত্তাপে। আর্দ্রতাহীন বাতাসে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। আগুনে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পাহাড়ে বাতাসে বাড়ছে দূষণ। এক অদ্ভুত বিষচক্র খেয়ে নিচ্ছে পাহাড়ের পরিবেশ।
তবে দাবানল নিভে গেলেই যে বিপর্যয় শেষ হয় পাহাড়ে এমন নয়। দাবানলে যে বনসম্পদ ধ্বংস হয়, সেই ক্ষতি পরিমাপ করাও কঠিন কাজ। হিমালয়ের অরণ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতে যে বৈচিত্র্য দাবানলের আগে ছিল, যে বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খল সুস্থিত অবস্থায় ছিল, তা এক ধাক্কায় নষ্ট হয়ে যায়। হিমালয়ে উদ্ভিদ এবং প্রাণীবৈচিত্র্য এভাবেই একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শূন্যস্থানে গাছ হয়তো লাগানো হচ্ছে, কিন্তু যে বিশেষ প্রজাতির গাছ দাবানলে বিলুপ্ত হয়ে গেল, সেই গাছের বীজ কে ফেরাবে? যে পক্ষীকুলের কিছু প্রজাতি হিমালয়ের অরণ্যে শুধুমাত্র দৃশ্যমান, অরণ্য ধ্বংস হলে সেই পাখির ঝাঁক কি আর দেখা যাবে কখনো? শুধু গাছ কিম্বা পাখি তো নয়, আরও কত প্রাণীকুল, অমেরুদণ্ডী পোকামাকড় থেকে শুরু করে ছত্রাক অবধি, যাদের প্রত্যেকের উপস্থিতি বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খল ধরে রাখার জন্য দরকারি, সব বিনষ্ট হয়। নষ্ট হয়ে যায় বনভূমির মৃত্তিকার স্তর। অনাবৃষ্টির কারণে তা এমনিতেই শুষ্ক ছিল। দাবানলের ফলে সেই মাটি একেবারে ঝুরঝুরে হয়ে যায়। গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেলে নষ্ট হয় শিকড়বিহীন মাটির ধারণক্ষমতা। তার পরে বৃষ্টি নামলেও জল শুষে নেবার এবং সেই জল ধরে রাখবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে মাটি। মাটির উপরের যে স্তর, সেই স্তর উদ্ভিদের এবং ফসলের খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান যোগান দেয়। দাবানলে যদি এই স্তর নষ্ট হয়, মাটিতে নতুন করে বৃক্ষরোপণ করে সেই বৃক্ষ বাঁচিয়ে রাখা খুব কঠিন কাজ। মাটির উপরের এই বিশেষ স্তর নির্মিত হতে প্রাকৃতিক নিয়মে প্রায় ২০০ বছর লেগে যায়। মাটি নষ্ট হয়ে গেলে তার পরে বর্ষাকালে হড়পা বান এবং ধস নামলে একেবারে পাহাড়ের ঢাল ধরে ধরে ক্ষয়ে কেটে ধুয়ে চলে যায় মাটি। হড়পা বান ইত্যাদিতে ভূমিক্ষয় না হলেও দাবানলে নষ্ট হওয়া অরণ্য পুনর্নির্মাণ করা অতি কঠিন কাজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না সেই জমি অরণ্যের অধিকারের জন্য। পরিবর্তে সেই জমিতে তৈরি হতে থাকে রাস্তা, কিম্বা হোমস্টে, হোটেল ইত্যাদি। সভ্যতার নির্মম হাত গিলে খায় অরণ্য। এখানেই প্রশ্ন উঠছে মানুষের ভূমিকা নিয়ে।
দাবানল রোধ করার ক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা অবশ্যই অনস্বীকার্য। বনের সীমান্তে যে জনপদ আছে, তাদের আগুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে বর্জ্য পুড়িয়ে দেয় মানুষ। সেই আগুন থেকে ছড়াতে পারে দাবানল। তাছাড়া দাবানল যখন ক্ষুদ্র আকৃতির থাকে, সেসময় লক্ষ্য করলে, সতর্ক হলে স্থানীয় মানুষ নিজেরাই নিভিয়ে ফেলতে পারে আগুন। কিন্তু গত একশ বছরে ধীরে ধীরে হিমালয় অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মধ্যেও এসেছে পরিবর্তন। অতীতে শুরুতেই অনেক আগুন গ্রামের লোকজন নিভিয়ে ফেলত। কিন্তু এখন বড় অংশের মানুষ প্রশাসনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। ফলে যে সময়টা বেরিয়ে যায় তার মধ্যে আগুন বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে ক্ষতির পরিমাণ। এই জায়গায় আরও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। যারা পাহাড়ে বেড়াতে যান, সেই টুরিস্টদেরও বিশেষ ভাবে শিক্ষিত করবার প্রয়োজন। অসাবধানে ছুঁড়ে ফেলা একটা সিগারেটের ভগ্নাংশ থেকেই ঘটে যেতে পারে বিপর্যয়। ক্যাম্পিং সাইটে যখন টুরিস্টরা আগুন জ্বালান, বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে সেটা করা উচিত। ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার আগে আগুন ঠিকভাবে নিভিয়ে যাচ্ছেন কিনা, কিম্বা রাতে নিয়ন্ত্রিত আগুন জ্বালিয়েছেন কিনা, এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি না জেনেই অনেক টুরিস্ট শুধু রোমাঞ্চের খোঁজে পাহাড়ে ক্যাম্পিং করতে চলে যান।
যেসব অরণ্যে পাইন গাছের পরিসংখ্যান অনেক বেশি, সেসব অঞ্চলের গ্রামগুলিতে যাতে গ্রামবাসীরাই অরণ্যের ভূমিতে ঝরে পড়া পাইনের ছুঁচাল পাতা সংগ্রহ করেন এবং পরে সেই পাতা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কেজি দরে কিনে নেওয়া হয়, এমন প্রকল্প চালু করবার কথাও হচ্ছে। শীঘ্র দাবানলের অস্তিত্ব এবং স্থান নির্ণয় করবার জন্য উপগ্রহ চিত্র বিশেষ সহায়ক হতে পারে। আগুন ঠিক কোন স্থানে লেগেছে, এই সতর্কবার্তা যত দ্রুত প্রশাসনের কাছে পৌঁছে যাবে, তত তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। পরিপূরক অ্যালার্ম সিস্টেম তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। ভারতের এনডিআরএফ অর্থাৎ ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের একটা শাখাকে বিশেষভাবে শুধু দাবানল নির্বাপণের কাজে শিক্ষাদীক্ষা দেবার কথাও প্রস্তাবিত হয়েছে। সভ্যতা যদি অরণ্যকে বাঁচানোর জন্য সফল উদ্যোগ না নেয়, সভ্যতার অস্তিত্ব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। এই চিরসত্য শুধু হিমালয় পর্বত নয়, সারা পৃথিবীর জন্য প্রযোজ্য।