ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালার শেষ পর্যায়। তরজমা স্বাতী রায়
আমার আগমনের পরের দিন সকালে লেফটেনান্ট হেন আমার কাছে এলেন আর ডক্টর লিভিংস্টোনের কাছ থেকে যে আদেশটি পেয়েছিলাম তা দেখতে চাইলেন। দেখালাম। সেই আদেশের একটি অনুলিপি এখানে দিচ্ছি:
উন্যানয়েম্বে ১৪ই মার্চ, ১৮৭২।
"রাজদূত মহাশয়ের আমার জন্য পাঠানো কাফেলাগুলিতে ক্রীতদাসদের নিয়োগের কারণে আমি এতটাই ক্ষতির শিকার হয়েছি যে, মিঃ স্ট্যানলি যদি এই ধরণের অন্য কোনও পক্ষের দেখা পান, আমি তাঁকে নিজ বিবেচনা সাপেক্ষে তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি,
"ডেভিড লিভিংস্টোন।"
লেফটেন্যান্ট হেন বললেন, “কিন্তু এতে তো আমাদের অভিযান নিয়ে কিছুই বলা নেই!"
"না, অবশ্যই বলা নেই" আমি উত্তর দিলাম; "এটা দাস-পরিচালিত কাফেলার বিষয়ে । আপনাদের অভিযান নিয়ে আমার কিছু বলার নেই; আমার কথা বলতে গেলে, আপনি যেতেই পারেন। তবে, যদি আপনার মনে থেকে থাকে যে, আপনি আমাকে গতরাতে জিজ্ঞেস করেছিলেন ডাঃ লিভিংস্টোনকে প্রয়োজনীয় রসদ দেওয়া হয়েছে নাকি। আপনাকে আবার উত্তর দেব যে হ্যাঁ দেওয়া হয়েছে , আর এছাড়াও এখানে এই যে জিনিসগুলো লেখা আছে, এইগুলো তাঁর মতে তাঁর আরও লাগবে।" এই বলে তাঁকে ডাক্তারের বানানো তালিকা দেখানো হল। "আপনার যদি মনে হয় যে আপনার তাঁর কাছে যাওয়া দরকার, তো যাবেন। যাইহোক, আমি বলব যে যেমন শোনা যাচ্ছে— আপনি নাকি সব মালপত্র এখনই বেচে দেবেন, সেটা করবেন না। অন্তত রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির কাছ থেকে না শোনা পর্যন্ত। তাঁদের অন্য রকমের মতামত থাকতেই পারে, বিশেষত আপনি যখন অভিযানের প্রস্তুতি বাবদ এতো বিশাল খরচ করেই ফেলেছেন।"
"ওহ্, আমি পদত্যাগ করব আর পুরো ব্যাপারটা লিভিংস্টোনের ছেলের হাতে তুলে দেব।"
"সে আপনার ইচ্ছা। আপনার ব্যাপার আপনি নিজেই ভাল বুঝবেন।"
"আমি জানি কী করব। ক্যাপ্টেন ফ্রেজারের সঙ্গে কিলিমাঞ্জারোতে যাব, আর সেখানে জব্বর জব্বর শিকার করব। শুনছি যে সে দেশে অনেক শিকার মেলে।"
লেফটেন্যান্ট হেন আমেরিকান কনস্যুলেট থেকে সোজা গিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন। এই সময় থেকে অভিযানটির ভার গেল মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোনের হাতে, তিনি তাঁর বাবার জন্য দরকারী রসদ টুকু রেখে বাকি সব বিক্রি করে দেবেন বলেই মনস্থির করলেন। কিন্তু, আমি ডাঃ কার্ককে পরামর্শ দিলাম যে সেসব বিক্রি করার আগে, কিছুদিন রেখে দেওয়া ভাল, কারণ রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি হয়ত অভিযান সংক্রান্ত অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ডক্টর কার্ক কিন্তু বললেন, "না, এই জিনিসগুলো ডাঃ লিভিংস্টোনের জন্যই কেনা হয়েছিল, যেহেতু তার এগুলো প্রয়োজন নেই, তাই বেশি ক্ষতি হওয়ার আগে এগুলো বিক্রি করে টাকা করে নেওয়াই ভাল। তাঁর বেশি কাজে দেবে।"
মোম্বাসা থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে, আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে একজন আবাসিক ধর্মপ্রচারক আছেন। রেভারেন্ড চার্লস নিউ। তাঁর থেকে আমি ইংরেজদের এই অভিযানে ধ্বস নামার বিষয়ে অনেক তথ্য পেয়েছি। যদিও তিনি প্রথমে মৌখিকভাবে তাঁর মন্তব্যগুলি জানিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেগুলো আমাকে একটি চিঠির আকারেও লিখে পাঠিয়েছেন। আমি এই সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলো তুলে দিচ্ছি এখানে।
পূর্ব আফ্রিকায় দীর্ঘকাল বসবাসের পর আমি ইংল্যান্ডে ফিরছিলাম, ফেরার পথে জাঞ্জিবারে, ইংরেজ অভিযাত্রী দলের সঙ্গে দেখা হয়। কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই, রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির কাউন্সিলের অনুরোধে, আমাকে অভিযানে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। অনেক বিবেচনার পর, বেশ খানিকটা দ্বিধাসহ, আমি দোভাষী ও নেতৃত্বের লাইনে তৃতীয় হিসেবে যোগ দিতে সম্মত হলাম। লেফটেন্যান্ট ডসন যেভাবে আমার সঙ্গে চুক্তিটি করেছিলেন, সেটা এরকম :--
"রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি পরিচালিত, ইংল্যান্ডে পরিকল্পিত লিভিংস্টোন অনুসন্ধান ও ত্রাণ অভিযানে আমার আন্তরিক পরিষেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যোগ দিতে আমি নিম্নলিখিত শর্ত মোতাবেক সম্মতি জানাচ্ছি -
"১. লেফটেন্যান্ট হেন কোন দুর্ঘটনার দরুণ কাজ করতে অক্ষম হলে, আমি লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম হেনকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে তাঁর অধীনে কাজ করতে রাজি।
"২. এমনকি লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম হেনও অসমর্থ হয়ে পড়লে, আমি অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নিতে রাজি, এবং রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির নির্দেশ অনুসারে নির্ধারিত অভিযানের উদ্দেশ্যগুলি সম্পাদন করার জন্য আমার সর্বোত্তম চেষ্টা করব।"
এই চুক্তিতেই আমি স্বাক্ষর করেছি। অভিযানে যোগ দেওয়ার পর, সব প্রস্তুতির শেষে, যাত্রা শুরু না করা পর্যন্ত অভিযানের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কুলি জোগাড় করে অবিলম্বে যাত্রা শুরু করতে লেঃ ডসন, লেঃ হেন ও আমি মালপত্র ও সেপাই সহ খাঁড়ি পেরিয়ে বাগামোয়ো এসেছিলাম। বাগাময়োতে পৌঁছে আমরা তিনজনের দেখা পেলাম। এঁরা দু-তিন দিন আগে সেখানে এসেছিল। শুনলাম এরা নাকি দেশের ভিতর থেকে এসেছে। আপনার কাছ থেকে। তাদের প্রশ্ন করে জানা গেল, যে আপনার সঙ্গে উজিজিতে ডাঃ লিভিংস্টোনের দেখা হয়েছে; এও শুনলাম যে আপনি ও ডাক্তার একসঙ্গে লেকের উত্তর প্রান্তে গিয়েছিলেন; রুসিজি নদীকে হ্রদে পড়তে দেখেছেন; আরও শুনলাম, আপনারা তখন উজিজিতে ফিরে এসেছেন - সেখান থেকে পূর্ব দিকে উন্যানয়েম্বে পর্যন্ত পথ ঠেলে এসেছেন; আর ড. লিভিংস্টোন আরও গবেষণার জন্য সেখানেই রয়ে গেছেন, কিন্তু আপনি পুরো দমে উপকূলে ফিরে আসছেন; ইতিমধ্যেই উগোগোতে পৌঁছে গেছেন, আর দু-তিন দিনের মধ্যে বাগামোয়োতে পৌঁছাবেন আশা করা যায়।
ডসন ও হেন এরপরেই তাদের অভিযান বাতিল করে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কারণ যে কাজ করতে তাঁরা আফ্রিকায় এসেছিলেন তা তো আপনি ইতিমধ্যেই সমাপন করেছেন। কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যায় লেঃ ডসন আমার কাছে জানতে চাইলেন যে যদি এরপরেও ডাঃ লিভিংস্টোনকে ত্রাণ পাঠানো প্রয়োজন বলে বিবেচিত হয়, তাহলে আমি তার দায়িত্ব নিতে রাজি কিনা । জানালাম যে এরকম প্রস্তাব এলে অবশ্যই ভেবে দেখব। পরদিন লেঃ ডসন ডাঃ কার্কের সঙ্গে পরামর্শ করতে জাঞ্জিবারে ফিরে এলেন। দুদিন পর আমি ডক্টর কার্ক ও লেফটেন্যান্ট ডসনের কাছ থেকে একটা করে চিঠি পেলাম। দুজনেই আমার হাতে ত্রাণ অভিযানটি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন; মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোনও আমার অধীনে কাজ করতে সম্মতি দিয়েছেন, তিনি এখনও তার বাবার কাছে যাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন। ত্রাণ অভিযানের দায়িত্ব নিতে আমি প্রস্তুত একথা জানিয়ে ডাঃ কার্ককে চিঠি লিখলাম। কিন্তু, এরই মধ্যে লেঃ. হেনের মন বদলে গেল। আর তিনিই নেতা হতে চাইলেন। ধরে নেওয়া হল যে আমি তার দাবি মেনে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবো। তবে এও আশা ছিল, আমি লেঃ হেনের অধীনে সহকারী নেতা হয়ে কাজ করব। যদি এটার সত্যিই দরকার থাকত বা সম্ভবও হত, তাহলে করতাম বৈকি।
কিন্তু ইংল্যান্ডের থেকে অভিযানটি যেভাবে ভাবা হয়েছিল সেরকম তো আর নেই; এখন সেটা ইউন্যানয়েম্বে যাতায়াতের একটা তুচ্ছ অভিযান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সত্যিকারের আগ্রহ থাকলে যেকোন দু'জন লোক যথেষ্ট অধ্যবসায় আর মনের জোর কাজে লাগিয়েই এটা শেষ করতে পারবে। আমার তো এই বাবদে এরকমই ধারণা হয়েছিল । অতএব এই ভেবেই আমি যে সরে দাঁড়ালাম যে আমার সাহায্যের আর দরকার নেই। আমার উপস্থিতি শুধু একটা সহজ কাজকে জটিল করে তুলবে। সবাই ভাবে যে আমি যে কোন পরিস্থিতিতেই লেফ্টেন্যান্ট হেনের অধীনে কাজ করার জন্য চুক্তি সই করেছি। । ব্যাপারটা এমন নয়. আমার চুক্তি ছিল ইংল্যন্ডে আদি পরিকল্পনা করা এক অভিযানের সঙ্গে। এবং লেঃ ডসন দুর্ঘটনা বশতঃ কর্মে অক্ষম হলে, তখন লেফটেন্যান্ট হেনের অধীনে কাজ করার জন্য। কিন্তু লেঃ ডসন তো দুর্ঘটনার কারণে অক্ষম হননি, তিনি পদত্যাগ করেছেন; আর তাঁর পদত্যাগ, আগের পরিকল্পিত সব কিছকেই ঘেঁটে দিয়েছে। ডঃ কার্কও চিঠিতে এরকম মতই প্রকাশ করেছেন। আর সেই ভিত্তিতেই আমাকে অভিযানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পরে লেঃ ডসনের পদত্যাগের পরে নতুন ব্যবস্থা করা হল, প্রতিটি ব্যক্তিরই তখন নিজের ইচ্ছা মত কাজ করা বা অবসর নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল।
তবে এই অভিযানে লেঃ হেনের অধীনে দ্বিতীয় স্থান না নেওয়ার পিছনে আমার অন্য কারণও ছিল। হেন. আমার মতে অযোগ্য। এই ধরনের অভিযান পরিচালনার কাজে অক্ষম। শুরুতেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য হল হাতি-মোষ শিকারের চেষ্টা করা। এই ধরনের একজন মানুষ, আমার মতে, ডঃ লিভিংস্টোনের ত্রাণ অভিযান পরিচালনার উপযুক্ত লোক নন, আমি এও মনে করি না যে আমাকে তাঁর অধীনে সহকারী হিসেবে কাজ করতে বলা আদৌ উচিত। অবশ্য, মূল পরিকল্পনা অনুসারে অভিযানটি হলে, আমি সব বিপদ মাথায় করেও যেতাম। আরও একটা কথা - আপনার আসার খবর পাওয়ার আগেও লেঃ হেন একবার অভিযান থেকে অবসর নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন; এইভাবে অস্থিরতা দেখানো নেতা হিসেবে তাঁর সাফল্য সম্ভাবনার বাবদে খুবই খারাপ ধারণা তৈরি করে। লেঃ হেনের অবসর নেওয়ার হুমকি দেওয়ার কথা শুনে আমি ডক্টর কার্ককে ফোন করেছিলাম, ওঁর সঙ্গে সরাসরি স্পষ্টভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলাই উদ্দেশ্য ছিল । আমি ডাঃ কার্ককে দেখিয়ে দিয়েছিলাম যে এইসব ঘটনা অভিযানের সাফল্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। লেঃ ডসন আর লেঃ হেনের মধ্যে আরও ভাল বোঝাপড়ার উদ্দেশ্যে দলটিকে একসঙ্গে ডেকে আলোচনায় বসানোর পরামর্শও দিয়েছিলাম তাঁকে। ডাঃ কার্ক অবশ্য বলেছিলেন, "না; এমন কিছু করবেন না। হেন আপনার সঙ্গে দেশের ভিতরদিকে দু-তিন দিন যাবে, তারপর চুপচাপ কেটে পড়বে।"
এখানেই থামা যাক।
ক্রমশ…