আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। এই মানচিত্রটি দেখলে বোঝা যাবে স্ট্যানলে কোথায় দাঁড়িয়ে গোটা অঞ্চলটির বর্ণনা দিচ্ছেন।
উসেগুহহা শুরু হল উলাগাল্লা থেকে আর এর পশ্চিম প্রান্ত হল মাকাটা নদীর পূর্ব তীর।
কিঙ্গানি ও তার উপনদীগুলি বা বলা ভাল যে কিঙ্গানির মূল উপনদী উনগেরেঙ্গেরিই এখানকার সব জল বয়ে নিয়ে যায়। এখানকার মানে উকওয়েরে, উকামি, উদয় ও উসেগুহহা এইসব কয়েকটা জেলা মিলিয়ে গোটা এলাকাটার। উত্তরের পথটা ধরে লাভ হল এই যে উনগেরেঙ্গেরিকে কিঙ্গানির প্রধান শাখা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলাম। মূল নদীতে মেশার পরে যাকে স্থানীয়রা রুফু বলে।
স্পেক ও গ্রান্ট এমগেটা নামের আরেকটি শাখানদী আবিষ্কার করেন, এমকামবাকু পাহাড়শ্রেণির পশ্চিম ঢাল থেকে এই নদী বইতে শুরু করেছে আর দক্ষিণদিক দিয়ে প্রায় গোল হয়ে ঘুরে গোটা উকুটু ও উজারামোর জল বয়ে নিয়ে যায়। মোটমাট যে এলাকার জল কিঙ্গানি ও তার উপনদীরা মিলে বয়ে নিয়ে যায়, অনুমান করা যায়, সেটা বারো হাজার বর্গমাইলের বেশি নয়।
আফ্রিকার ভূগোল যাঁরা পড়েন, তাঁরা জানবেন যে স্পেক তার মানচিত্রে ৩৭ ডিগ্রি পুর্ব দ্রাঘিমারেখার কাছে একটা পর্বতমালা দেখিয়েছেন। এর নাম 'এমকামবাকু'। পাহাড়টা উত্তর-দক্ষিণে কমপক্ষে ১ ডিগ্রি এলাকা জুড়ে। আমাদের অভিযান এই পর্বতশ্রেণীর এ অংশটা দেখেছিল, তবে এর সবচেয়ে উত্তরের অংশটা কিন্তু উরুগুরু নামে পরিচিত। আর তার সবচেয়ে উত্তরের সীমানার পায়ের কাছে, যেখানে পর্বতশ্রেণীটা পূর্ব দিকে বেঁকে গেছে, সেখানে দক্ষিণ উসেগুহহার রাজধানী, সিম্বামওয়েনি অবস্থিত।
আমি যদিও কখনোই খুঁজে পাইনি, তবু শুনেছি যে এমকাম্বাকুর পুর্ব ঢালের একটি কলকলানো ঝর্ণা হল কিঙ্গানির উৎস; সেই হিসেবেই এমগেটাকে দুয়ের মধ্যে দীর্ঘতর শাখা বলে ধরা হয়েছে। যে নামেই এই নদীটিকে ডাকি না কেন - সেটা কিঙ্গানিই হোক, বা মৃমারা যেমন বলে সেই হামদাল্লাহ হোক, অথবা উকওয়েরে, উকামি, উদয় ও উসেগুহহার লোকরা যে রুফু নামে ডাকে সেই নামেই হোক - এর উৎস এখনও আর অনুমানের বিষয় হতে পারে না। স্পেক আবিষ্কার করেছেন যে দুটি প্রধান শাখার মধ্যে এমগেটা এমকাম্বাকুর পশ্চিম ঢালের থেকে জন্মেছে আর খুটুর দক্ষিণ দিয়ে বয়ে গেছে। আমি আবিষ্কার করেছি যে দ্বিতীয় প্রধান শাখাটি মানে উঙ্গেরেনগেরিও এমকাম্বাকুর বা বলা ভাল উরুগুরু পর্বতমালার পশ্চিমদিকের থেকে জন্মেছে, আর উত্তরমুখো হয়ে উসেগুহহা ও উদয়ের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে দক্ষিণের উকওয়েরে ও উকামির মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে তারপর কিঙ্গানিতে মিশেছে। এই নদীটি উকওয়েরেতে ঢোকার পর থেকে বাগামোয়োর তিন মাইল উত্তরে সমুদ্রে পড়া অবধি স্থানীয়রা একে রুফু বলে। আরবরা অবশ্য বিভিন্ন শাখার সঙ্গমস্থল থেকে একে কিঙ্গানি বলেই চেনে। অভিযাত্রীদের মানচিত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন যারা, তাদের কাছেও এই নদী কিঙ্গানি বলেই পরিচিত।
বাগামায়ো ও উসেগুহহার সিম্বামওয়েন্নির মধ্যে আমাদের অভিযান সর্বোচ্চ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সেটা হাজার ফুটের বেশি হবে না, আর কিঙ্গারু হেরার উত্তরে, দিলিমা শীর্ষ নামে যে পাহাড়গুলো পরিচিত, এখানে ওখানে তাদের একেকটা পাহাড়চূড়া বাদ দিলে, মিকেসেহের আশেপাশে ভূমি কিন্তু ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠেছে। টানা সমান্তরাল ঢেউ এর মত, পাহাড়ের শিরগুলো গভীর জঙ্গল বা মসৃণ ঘাসে ঢাকা— ঢালগুলো সুচারুভাবে পশ্চিমদিকে তরঙ্গের তলদেশের গভীরে নেমে যাচ্ছে, এর মধ্যে দিয়েই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে জল বয়ে গিয়ে উঙ্গেরেঙ্গেরিতে পড়ে।
সিম্বামওয়েন্নি ছাড়িয়ে, উনগেরেঙ্গেরির পশ্চিমে আচমকা বিশাল উঁচু, আশেপাশের থেকে বিচ্ছিন্ন একদল চ্যাপ্টা-মাথা পাহাড়ের চূড়া আমাদের সামনে হাজির হল। এই পাহাড়চুড়োগুলো নিচু স্যাডল[i] বা শৈলশিরার মাধ্যমে আরেকটা পরিপার্শ্ব-বিচ্ছিন্ন, উঙ্গেরেঙ্গেরির থেকে অন্তত দু হাজার ফুট উঁচু একটা পর্বতমালার সঙ্গে যুক্ত। উনগেরেঙ্গেরি নদীর উত্তর দিকে, একটা টানা, জঙ্গলে ঢাকা শৈলশিরা এই পাহাড়ের গোড়ার থেকে বেরিয়ে পুর্বদিকে চলে গেছে। এই শৈলশিরাই উঙ্গেরেনগেরিকে ওয়ামির থেকে আলাদা করেছে।
একজন অজানা মানুষের কাছে দেশের এই উচ্চতার দিকটাই সবচেয়ে সন্তোষজনক, তার মনে হয় যে সে এরপর আরও উঁচুতে উঠবে, জ্বরজারির থেকে মুক্তি পাবে। আফ্রিকান অভ্যন্তরের প্রকৃতি সম্পর্কে যারা কিছু জানে না তারা কেবল জঙ্গল ও উপকূল অঞ্চলের জলাভূমিকেই জ্বরের জন্য দায়ি করে।
একদিনের হাঁটাতেই সিম্বামওয়েন্নি থেকে পর্বতশ্রেণীর মধ্যের একটা গিরিপথ ধরে সিম্বোতে পৌঁছে গেলাম, এখান থেকে পিছনে ফেলে আসা উঁচু স্পষ্ট পাহাড় দিয়ে ঘেরা মহান মাকাটার চওড়া উপত্যকা স্পষ্ট দেখা যায়। এই উপত্যকার পূর্ব সীমানায় রয়েছে উসাগাড়ার অভ্রংলেহী ঝলমলে পর্বতশ্রেণী।
কিঙ্গানি ও ওয়ামি নদীর তফাৎ ঠিকমত বোঝার জন্য আমি অনেকটা সময় ব্যয় করেছি। নিজে সে বিষয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার পরেই বলছি যে এই দুই নদীর মধ্যে পার্থক্য একেবারে পরিষ্কার। আরব, মৃমার বাসিন্দারা ও স্থানীয়রা যা বলে , আর এই দেশ ও এর ভূমিতলের গড়ন সম্পর্কে আমার নিজস্ব যে জ্ঞান তা দিয়ে এটা নিঃসন্দেহে বোঝা যায় যে কিঙ্গানি এবং ওয়ামি দুটি পৃথক এবং সম্পূর্ণ আলাদা নদী। বাগামোয়োর তিন মাইল উত্তরে কিঙ্গানি সমুদ্রে প্রবেশ করে; আর হুইন্ডে ও সাদানির বন্দরের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় ওয়ামি এসে সমুদ্রে পরেছে।
দেখলাম যে উঙ্গেরেনগেরি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, কিঙ্গানির অভিমুখে বয়ে গেছে, আর এই যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি (সিম্বো), সেখান থেকে দেশের গড়নটি স্পষ্ট বোঝা যায়। পশ্চিমমুখে দাঁড়ালে, আমাদের ডানদিকে মাকাটা বা ওয়ামির উপত্যকা - সে নদী প্রথমে উত্তরদিকে আর তারপর পূর্ব দিকে বয়ে যাচ্ছে; আমাদের বাঁ দিকে উঙ্গেরেনগেরির উপত্যকা , সে নদী উত্তর দিকে একবার সোজা বাঁক ঘুরে তারপর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। বাগামোয়ো থেকে আমাদের এপর্যন্ত আসার পথটি দুটো নদীর থেকেই প্রায় সমান দূরত্বে, ডানদিকে ওয়ামি আর আমাদের বাঁ দিকে উঙ্গেরেনগেরি বা কিংগানি।
উপরের বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে যে একটাই নদী কিভাবে তিনটে বা চারটে আলাদা আলাদা নামে পরিচিত হয় আর সেই বিভিন্ন নামের ফাঁদে পড়ে ভৌগলিক তথ্যের তল্লাশকারী ভ্রমণার্থী কত সহজেই বিভ্রান্ত হন! কিঙ্গানির যেমন অসংখ্য নাম, সেরকমই হুইন্ডে ও সাদানির মুসলমানি বন্দরদুটোর মধ্যে যে নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়ে তার নাম হল ওয়ানাই, রুদেওয়া, মাকাটা এবং মুকনডোকওয়া।
মাকাটার ছড়ানো সমতল উপত্যকায় ঢোকার পরে আমরা প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ জলধারাটি পেলাম তা হল লিটল মাকাটা। ভরা মাসিকা মৌসুমে সে হয়ে ওঠে খরস্রোতা আর বিপজ্জনক। লিটল মাকাটার পরে আমরা একটা বৃষ্টির জলে টইটুম্বুর, গভীর নালার কাছে পৌঁছালাম , আর তার কয়েকশ গজ পরেই পেলাম গ্রেট মাকাটা নদী— যার অন্য নাম ওয়ামি, বা মুকনডোকওয়া— একটি জলস্রোত যা পাঁচ-ছ' গজ চওড়া নদীতে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা ধরে। গ্রেট মাকাটা পেরিয়ে পেলাম রুদেয়া নদীর একটি শাখা, নাম এমবেঙ্গেরেঙ্গা, আমাদের চলার পথের সমান্তরালে বয়ে চলেছে। লিটল মাকাটা যেখানে গ্রেট মাকাটার সঙ্গে মিশেছে, তার কাছাকাছিই এই শাখাটি ওয়ামিতে নিজের জল উজাড় করে দেয় । এমবেঙ্গেরেঙ্গা অতিক্রম করে, আমরা এরপর এলাম রুদেয়ার আরেকটি ছোট শাখার পাশে, আর তারপর দেখতে পেলাম সাক্ষাৎ রুদেয়া নদীকেই, আমাদের পথের দিকেই ছুটে আসছিল সে নদী, তারপর আচমকা পূর্ব দিকে ঘুরে গেছে। এই জায়গাও ছাড়িয়ে, দক্ষিণ -পশ্চিমে মুখ করে দাঁড়ালে, দেখতে পেলাম উরঙ্গাকে। এই নদী উত্তর উসাগাড়ার মুন্ডুর থেকে বেরিয়েছে। রেহেন্নেকো-তে আমাদের শিবিরে পৌঁছে আমরা আড়াআড়িভাবে পাহাড় পেরোলাম আর ফের মাকাটা নদীর কাছে এসে পড়লাম। এখানে তার নাম মুকনডোকোয়া। সাগারারা ওই নামেই ডাকে। মুকনডকয়া গিরিপথ ধরে আরও উপরে উঠতে লাগলাম আমরা। একই পথ ধরে ক্যাপ্টেন বার্টন ও স্পেকও গিয়েছিলেন। চলতে চলতে উপত্যকার এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম যেখান থেকে আমাদের চলার পথগুলো আলাদা হয়ে গেল। বার্টন ও স্পেক গিয়েছিলেন আরও উপরের পথ ধরে, রুবেহো পর্বতমালার শিখর ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আমাদের পথও যথেষ্ট উত্তরমুখী, পুর্বসূরীদের পথের সমান্তরালে চলেছে— মাঝে প্রায় বিশ থেকে তিরিশ মাইলের ব্যবধান।