ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে চলছে মিসংঘি নামের একটি অঞ্চলের উদ্দেশে যাত্রা। তরজমা স্বাতী রায়
সাইদ বিন হাবিবের কাফেলার সর্দারের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে হরকরা ও আরবরা জাঞ্জিবার থেকে আমার জন্য বেশ কয়েকটি চিঠিপত্র, খবরের কাগজের প্যাকেট আর বাক্স এনেছে। জাঞ্জিবারের শেখ হাশিদের ছেলে সেলিম উন্যানয়েম্বেতে আগমনকারীদের মধ্যে সর্বশেষ ছিল। ডাক্তার আমাকে অতি মিষ্টিভাবে মনে করিয়ে দিলেন যে, তাঁর হিসেব মত, তাঁর জন্য উন্যানয়েম্বেতে চিজ ছাড়াও জেলি, নোনতা বিস্কুট, স্যুপ, মাছ ও কৌটোজাত হ্যাম অপেক্ষা করে আছে আর সেসব আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলে তিনি খুশিই হবেন। এইসব শুনে আমি খুব উল্লাসিত হয়েছিলাম, বারবার জ্বরের আক্রমণে ভুগছিলাম যখন, তখন কল্পনায় উন্যানয়েম্বেতে অপেক্ষমাণ এই সব বিলাসিতার কথা ভাবতে বেশ লাগত। পাগলের মতো হ্যাম বিস্কুট আর জেলি গিলছি, এমন একটা ছবি ভাবতাম। বেপরোয়া সব কল্পনা করতাম । পাঁউরুটি-মাখন, হ্যামস, বেকন, ক্যাভিয়ার— আমার বেচারা তিতিবিরক্ত মাথা এইসব ঘরোয়া খাবারের কথা ভেবে ক্ষেপে উঠত আর আমি ভাবতাম যে কোন দামই এইসবের জন্য যথেষ্ট না। পালাজ্বরে ভোগার সময়, যদিও আমি ইউরোপ- আমেরিকার আওতা থেকে অনেক দূরে ছিলাম, তবু তীব্র ক্লান্তি ও হতাশার এক ভয়ানক অতলে ডুবে গিয়েছিলাম। সে অবস্থায় এই সব ভাবনা আমার কাছে আনন্দের ছিল। ভাবছিলাম যে এই ধরনের বিলাসিতা যাঁদের কাছে সহজলভ্য, তাদের একবার কখনও অসুস্থ হওয়া, জীবন সম্বন্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়া উচিত। ভেবেছিলাম যে একতাল টাটকা মাখন দেওয়া একটা গমের পাঁউরুটি যদি পেতাম, তাহলে মরতে মরতেও লাফিয়ে উঠতাম আর তেড়ে ফ্যানডাঙ্গো নাচতে শুরু করতাম।
যদিও উপরে বলা এইসব ভাল ভাল জিনিসের আমাদের অভাব ছিল, তবু আমাদের কাছেও লবণে-জারানো জিরাফ ও জেব্রার জিভের আচার ছিল; হালিমাহের বানানো উগালি ছিল; এছাড়া মিষ্টি আলু, চা, কফি, ড্যাম্পার বা স্ল্যাপজ্যাকও ছিল; কিন্তু সেসব খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গিয়েছিল। আমার দুর্বল পেট, বিভিন্ন ওষুধ, ইপিকাপ, কোলোসিন্থ, টারটার-এমেরিক, কুইনাইন এইসব খেয়ে খেয়ে বিরক্ত, কাতর। এইসব হাবিজাবি খাবারের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করছিল। "ওহ, একটা গমের রুটি!" আমার মন কাঁদছিল। "একটা রুটির জন্য পাঁচশ ডলারও দিতে পারি!"
অবিরাম বর্ষা, শিশির, কুয়াশা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, লম্বা হাঁটা, পায়ের ব্যথা সত্ত্বেও, ডাক্তার কিভাবে যেন বীরের মতো খেয়ে যাচ্ছিলেন, আর আমিও সাচ্চা মরদের মতো কঠোরভাবে মনস্থ করেছিলাম যে ডাক্তার যেমন নিজের হজমশক্তির প্রতি সদা দৃষ্টি রাখেন, সেই পথ অনুসরণ করব। কিন্তু আমি বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
অভিযাত্রী হিসেবে ডাঃ লিভিংস্টোন সব কিছু পেয়েছেন। আফ্রিকার সমস্ত কিছু সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান দুর্দান্ত - সেখানকার পাথর, গাছ, ফল এবং তাদের গুণাবলী সবই জানেন তিনি। নৃতাত্ত্বিক বিষয়েও তাঁর দার্শনিক ভাবনা চিন্তা প্রচুর। শিবিরে থাকতে হলে যা কিছু জানতে লাগে, নিজের মাথা খাটিয়ে খাটিয়ে তিনি সেবিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। তার বিছানা গদি দেওয়া তোশকের মতনই আরামের। প্রতি রাতে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি এটি তৈরি করান। প্রথমত, দুটো তিন-চার ইঞ্চি ব্যাসের সোজা খুঁটি কাটান; সে দুটো দুই ফুট দূরত্বে একটির সঙ্গে আরেকটি সমান্তরালভাবে রাখেন; এই দুটো খুঁটির উপর আড়াআড়িভাবে রাখা হল তিন ফুট লম্বা ছোট লাঠি, তাদের উপর ঘাসের আঁটির পুরু আস্তরণ বিছানো হয়; তার উপর দেওয়া হয় একটা জলনিরোধক ক্যানভাস এবং কম্বলের টুকরো। আর এইভাবে একটি বিছানা তৈরি হয়। একেবারে রাজার উপযুক্ত।
লিভিংস্টোনের কথায় দুধেলা ছাগল কেনা হয়েছিল। সেকারণে উজিজি ছাড়ার পর থেকে, চা -কফির জন্য দিনে তিনবার করে তাজা দুধ মিলেছে। প্রসঙ্গত, আমরা এই দারুণ বলবর্ধকটি সোৎসাহে পান করি; প্রত্যেকে ছয় -সাত কাপ পান না করে সচরাচর থামি না। আমাদের গানের যোগানও আছে। একটু কর্কশ হলেও একেবারে না থাকার চেয়ে তো ভাল। মানে মান্যুয়েমার তোতাপাখিদের সুরেলা ডাকাডাকির কথা বলছি।
কামিরাম্বোর গ্রাম এমওয়ারু ও উকাম্বার নির্জন টঙ্গোনির মধ্যে অর্ধেক পথ চলে এসে, একটা বড় গাছে ডাক্তারের ও আমার নিজের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করেছিলাম, সঙ্গে তারিখও লিখলাম, ২রা ফেব্রুয়ারি। আরও একবার আফ্রিকায় এই দোষটা করেছিলাম। তখন আমরা দক্ষিণ উভিনজায়, খিদেয় ছটফট করছি। সেই সময় একটা যজ্ঞিডুমুরের গাছের গায়ে বড় বড় হরফে খোদাই করে দিয়েছিলাম সেদিনের তারিখ ও আমার নামের প্রথম অক্ষর। আর সেই সঙ্গে "ক্ষুধার্ত!" শব্দটাও।
উকাম্বার অরণ্যের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়, আমরা সাদা হয়ে যাওয়া মাথার খুলি দেখলাম। অভিযানের দুঃখ কষ্টের দুর্ভাগা বলি। এই ঘটনার উল্লেখ করে, ডাক্তার মন্তব্য করেছিলেন যে আফ্রিকার এই রাশি রাশি মৃত পাতার নীচে তিনি নিঃশচুপে সমাধিস্থ হতে চান। এই গম্ভীর স্থির, নির্মল অরণ্যের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় এই একটাই চিন্তা তাঁর মাথায় পাক খায়। এখানেই তিনি নিশ্চিত নির্বিঘ্নে বিশ্রাম পাবেন। ইংল্যান্ডে কোথাও নড়াচড়ার জায়গা নেই। কবরগুলোও প্রায়ই অসম্মানিত হয়। তিনি তাঁর সহধর্মিনীকে শুপাঙ্গার জঙ্গলে কবর দিয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি তেমনই একটা জায়গার জন্য হাহুতাশ করছেন, যেখানে তার ক্লান্ত হাড়গুলি তাদের আকাঙ্ক্ষিত চিরবিশ্রাম পাবে।
সেই সন্ধ্যায়, তাঁবুর দরজা নামানোর পরে, একটি প্যারাফিন মোমবাতির আলোতে ভিতরটা আলোক-উজ্জ্বল করে তোলা হল। তখন ডাক্তার আমাকে তার বড় ছেলে রবার্টের কাজ ও মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। লিভিংস্টোনের প্রথম বই, 'দক্ষিণ আফ্রিকা'- সব ছেলেদেরই পড়া উচিত। এই বইয়ের পাঠকরা হয়ত ছোট্ট "রবার্ট"-এর জন্য সেবিতুয়ানের শ্রদ্ধার কথা মনে করতে পারবেন। মিসেস লিভিংস্টোনকে সপরিবারকে উত্তমাশা অন্তরীপে নিয়ে যাওয়া হয় আর সেখান থেকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। সেখানে রবার্টকে একজন গৃহশিক্ষকের দায়িত্বে রাখা হয়। কিন্তু কোন কাজ না থাকায় সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নিজের বয়স আঠারোর কাছাকাছি হতেই, সে স্কটল্যান্ড ছেড়ে নাটালে চলে আসে। তারপর সে তার বাবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। চেষ্টা সফল হয়নি। তখন সে জাহাজে করে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করে আর উত্তরের সেনাদলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নাম লেখায়। নিউ হ্যাম্পশায়ার রেজিমেন্টে তালিকাভুক্ত হয়। সে নিজের রবার্ট মোফ্যাট লিভিংস্টোন নামটাও বিসর্জন দেয়। নতুন নাম নেয় রুপার্ট ভিনসেন্ট। তার গৃহশিক্ষক, যে কিনা জানতই না ছেলেদের প্রতি তার কি কর্তব্য, সে যাতে আর তাঁকে খুঁজে না পায়! রিচমন্ডের মুখের এক যুদ্ধে, সে আহত হয়। তাকে উত্তর ক্যারোলিনা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে সে ক্ষত থেকে মারা যায়।
৭ ফেব্রুয়ারি আমরা গোম্বে পৌঁছালাম। এর সবচেয়ে বড় হ্রদগুলোর একটার কাছে শিবির করেছিলাম। এই হ্রদটা সম্ভবত কয়েক মাইল লম্বা। জলহস্তী ও কুমিরে বোঝাই।
এই শিবির থেকে বাবুর্চি ফেরাজ্জি ও চৌপেরেহকে উন্যানয়েম্বেতে পাঠিয়েছিলাম। জাঞ্জিবার থেকে যেসব চিঠি আর ওষুধপত্র পাঠানো হয়েছিল, সেসব আনতে। উগান্ডায় আমাদের সঙ্গে ফের মিলবে তারা। পরের দিন আমরা গোম্বেতে আমাদের পুরানো আবাসে চলে এলাম। এখানেই আমরা প্রথম মধ্য আফ্রিকার আসল শিকারীর স্বর্গের পরিচয় পেয়েছিলাম। বৃষ্টি বেশিরভাগ পশুর দলকে ইতস্তত ছড়িয়ে দিয়েছিল। তাও আশেপাশে প্রচুর শিকার। সকালের জলখাবারের পরেই আমি খামিসি আর কালুলুকে সঙ্গে নিয়ে শিকারে গেলাম। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আমরা একটা হালকা জঙ্গলের কাছে পৌঁছালাম। সেখানে বেশ কিছু প্রাণীর পায়ের ছাপ খুঁজে পেলাম—শুয়োর, হরিণ, হাতি, গণ্ডার, জলহস্তী - আর অসংখ্য সিংহের থাবার ছাপ। হঠাৎ খামিসিকে বলতে শুনলাম, "কর্তা! কর্তা! এখানে একটা সিম্বা!" সে একজন রামভীতু মানুষ। উত্তেজনায়, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার কাছে এল একটা পশুর মাথা দেখাতে। লম্বা ঘাসের উপরে শুধু মাথাটুকুই দেখা যাচ্ছে, পশুটা আমাদের দিকে স্থির তাকিয়ে আছে। এর পরপরই এটা এদিক থেকে ওদিকে লাফ দিল। কিন্তু ঘাস এতই লম্বা যে প্রাণীটা ঠিক কী ছিল তা বলা অসম্ভব। আমার সামনে একটা গাছ ছিল। তার সুবিধা নিতে আমি সাবধানে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম। গাছের গায়ে ভারী রাইফেলটা ঠেকিয়ে রাখব। পরপর জ্বরের প্রভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম যে রাইফেল সোজা রেখে সঠিক নিশানাও করতে পারছিলাম না। কিন্তু রাইফেলটা সাবধানে গাছের গায়ে ঠেকা দিয়ে তার মুখটা যেদিকে ওই পশুটা দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে ফেরাতেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম। দূরের দিকে, যেখানে ঘাস পাতলা হয়ে গেছে, দেখতে পেলাম যে প্রাণীটা দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। আর এটা সত্যিই একটা সিংহ: বনের মহান রাজা যেন উড়ে যাচ্ছেন! সেই মুহূর্ত থেকে আমি তাকে "সবচেয়ে শক্তিশালী পশু" হিসাবে আর ভাবি না। অথবা এমনও ভাবি না যে তার গর্জন দিনের আলোতে একটি বাচ্চা ঘুঘুর চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর কিছু।