আমি শহরটা হেঁটে হেঁটে ঘুরতাম। একদিকে ঝকঝকে এলাকা—সেখানে আঁকাবাঁকা, সরু গলি, সাদা-চুনকাম করা বাড়ি, সুরকি-বিছানো রাস্তা। বানিয়াদের এলাকায় রাস্তার দুপাশে খিলান দেওয়া বড়ো বড়ো কুলুঙ্গির মতো, তার পিছনে অনেকটা লম্বা জায়গা—সামনে লাল পাগড়ি মাথায় বানিয়ারা বসে আছে, আর পিছনে ফিনফিনে সুতি, ছাপা ছিটের থান, ক্যালিকোর কাপড় আরও কত কি-ই না জিনিস। অথবা মেঝেতে ডাঁই করে রাখা হাতির দাঁত বা অন্ধকার কোণে রাখা আলগা তুলোর পাহাড়। বা বাসনপত্র, পেরেক, যন্ত্রপাতি, হরেক সস্তা মালের দোকান।
ডাঁই করে রাখা হাতির দাঁত। জাঞ্জিবার। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার ছবি। কার্ল ই আকেলি / ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ক্রিয়েটিভ
আবার নিগ্রোদের এলাকায় আর-একরকম। রাস্তাগুলোয় চড়া গন্ধ, মানে খুবই দুর্গন্ধ। কালো আর হলুদ মানুষের ঢল রাস্তায়। বোকা-সোকা মানুষগুলো ভাঙা কুঁড়ের দরজায় বসে আড্ডা দিচ্ছে, হাসাহাসি, দর কষাকষি, বকাবকি সবই চলছে। চামড়া, আলকাতরা, নোংরা আর ফেলে-দেওয়া শাক-সবজির গন্ধে টেকা দায়! আবার অন্যত্র রাস্তার ধার দিয়ে লম্বা শক্তপোক্ত বাড়ি, ছাদগুলো সমতল, কারুকার্যখচিত দরজায় বড়ো বড়ো পিতলের ঘণ্টি ঝুলছে, ভৃত্যরা পা-মুড়ে বসে প্রভুদের বাড়ির অন্ধকার দরজা পাহারা দিচ্ছে। একটা অগভীর খাঁড়ি, তারপাশে নৌকাগুলো সদ্য জল-সরে যাওয়া কাদার মধ্যে কাত হয়ে পড়ে আছে। বেলা পড়ে এলে, লাল সূর্য যখন পশ্চিম-আকাশে অস্ত যেত, তখন সারাদিনের পরিশ্রমে হতক্লান্ত ইউরোপিয়ানরা যেতেন ‘অম্নাজিমোয়া’, বা ‘নারকেল-গাছটি’ নামের জায়গাটিতে, সমুদ্রের উপর থেকে আসা টাটকা মিষ্টি বাতাসে শ্বাস নিতে।
জাঞ্জিবারের ব্যারাক ও অম্নাজিমোয়া অঞ্চলের রাস্তা। আনুমানিক ১৮৭০-এর গোড়ার দিকের ছবি। যে জাঞ্জিবার স্ট্যানলে দেখছিলেন।
মনে পড়ে এদেশে এসে মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়া নাবিকদের কবর। ডা. তোজর ছিলেন মধ্য আফ্রিকার মিশনারি বিশপ। তিনি থাকতেন একটা লম্বা বাড়িতে। তিনি ছোটো আফ্রিকান বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল চালাতেন। আরও কত স্মৃতি—সব মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে আছে। কত কত সব ছবি ঘোরে মাথায়—আরব, আফ্রিকান, বানিয়া, হিন্দি, ইউরোপিয়ান—তাদের আলাদা করাই মুশকিল।
জাঞ্জিবার হল পূর্ব আফ্রিকার বাগদাদ, ইস্পাহান বা ইস্তানবুল, যা ভাববেন তাই। এখানকার বাজার বিশাল—চারদিক থেকে ব্যবসায়ীরা এসে জড়ো হয়েছে। আফ্রিকার গভীর থেকে ব্যবসায়ীরা আনে হাতির দাঁত। এখানে আসে কোপালের আঠা, পশু-চামড়া, অর্চিলা নামের এক ধরনের জলজ গুল্ম, কাঠ এবং আফ্রিকার কালো দাস। বাগদাদে ছিল দুর্দান্ত রেশমবাজার আর জাঞ্জিবারে রয়েছে হাতির দাঁতের বাজার; বাগদাদ সেকালে রত্নবিনিময়ের মাধ্যমে ব্যাবসা করত, জাঞ্জিবার কোপালের আঠা বিনিময় করে; ইস্তানবুলে আসত সার্কাসিয়ান আর জর্জিয়ান দাসেরা। আর জাঞ্জিবারে আসে উহিয়াও, উগিন্দো, উগোগো, উন্যামওয়েজি এবং গাল্লার থেকে কৃষ্ণা-সুন্দরীরা।
জাঞ্জিবারে নিয়ে যাওয়ার পথে আরব দাস-ব্যবসায়ী সহ এই কৃতদাসদের উদ্ধার করে ব্রিটিশ জাহাজ এইচ এম এস লন্ডন। ১৮৮১। ছবি সৌজন্য: স্মিথ সোনিয়ান লাইব্রেরিজ
সব মুসলমান দেশের মতোই এখানেও একই ভাবে ব্যাবসা হয়। না, মোজেসের জন্মের অনেক আগে থেকেই এভাবে চলছে। আরবেরা কখনোই বদলায় না। এই দ্বীপে বাস করতে আসার সময়, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। মাসকট বা বাগদাদে থাকা আর-একজন আরবের যা চালচলন, একজন জাঞ্জিবারের আরবেরও ঠিক তাই। যেখানেই যায়, এরা নিজের হারেম, নিজের ধর্ম, নিজের লম্বা পোশাক, নিজের জামা, নিজের চপ্পল এবং নিজের তলোয়ার, যাকে কিরিচ বলে, সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আফ্রিকার যত ভিতরেই যাক, নিগ্রোদের হাজার হাসিঠাট্টাতেও নিজেদের ধরনগুলো তারা পালটাবে না। তবু জায়গাটা পুরো প্রাচ্যদেশীয় হয়ে ওঠেনি; আরবরা চারপাশটাকে পুরো পালটে দিতে পারেনি। দেশটা আধা-আফ্রিকান; শহরটি কিন্তু আধা-আরবীয়।
আফ্রিকায় যাঁরা নতুন আসেন, তাঁদের কাছে জাঞ্জিবারের মাসকট আরবরা রীতিমতো গবেষণার বস্তু। এদের হাবভাবে একটা প্রশংসনীয় রকমের সহৃদয়তা আছে। এরা অনবরত ঘুরে বেড়াতে থাকে—বেশিরভাগই মহামূল্য হাতির দাঁতের খোঁজে মধ্য আফ্রিকা চষে ফেলেছে। কখনও কোনো বিপজ্জনক জায়গায় যায়নি এমন মানুষ খুবই কম; বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা এদের চরিত্রে একটা স্ব-নির্ভরতার বা স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভাব এনে দিয়েছে। এমন একটা শান্ত, দৃঢ়, প্রতিবাদী, স্বাধীনচিত্ত ভাব এদের ঘিরে থাকে যে মনের অবচেতনেও শ্রদ্ধা জাগে। এরা যে সব গল্প বলে, আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সেগুলো দিয়ে অনেকগুলো রোমাঞ্চকর অভিযানের বই লিখে ফেলা যায়।
জাঞ্জিবারের আরব। (সৌজন্য http://zanzibarhistory.org)
মিশ্র-জাতিদের আমি অবজ্ঞা করি। তারা না কালো না সাদা, না ভালো না মন্দ, না প্রশংসনীয় না ঘৃণ্য। তারা সবমিলিয়ে জগাখিচুড়ি, সবসময় আরবদের তোষামোদ করে, অথচ যেসব ভাগ্যহীনেরা তাদের অধীনে থাকতে বাধ্য হয়, তাদের প্রতি প্রচণ্ড নিষ্ঠুর। একজন দুঃখিত, অর্ধাহারে থাকা কালোমানুষকে দেখলেই বলে দেওয়া যায় যে তার মালিক নিঃসন্দেহে কোনো মিশ্র-জাতের মানুষ। এরা বড্ড অন্যের ধামা-ধরা ও ভণ্ড, কাপুরুষ ও হতাশ, বিশ্বাসঘাতক ও নীচ-মনের। একজন ধনী আরবের পায়ে পড়ে তাকে পুজো করার জন্য সদাপ্রস্তুত অথচ একটি দরিদ্র কালো দাসের প্রতি তার কোনো মায়াদয়া নেই। সে দিব্যি কাটলে বুঝতে হবে যে সে মিথ্যে কথা বলছে। দুঃখ এই যে জাঞ্জিবারে এই দলের মানুষই সবচেয়ে বেশি।
বানিয়ারা জন্মগত ব্যবসায়ী—অনেক পয়সা কামাতে চায় যারা, তারাই তাদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। ঢালের উপর দিয়ে যেমন জল গড়িয়ে চলে যায়, এদেরও পকেটে তেমন সহজেই পয়সা এসে ঢোকে। কোনো বিবেক-যন্ত্রণাই এদের নিজেদের সহকর্মীদেরও ঠকানো থেকে দূরে রাখতে পারে না। টাকা কামানোর নিরিখে এরা ইহুদিদেরও ছাড়িয়ে যায়। বাজারে পারসিরাই এদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী; আরবরা এদের কাছে নেহাতই শিশু। কায়-মন-প্রাণে বানিয়ারা অর্থের আরাধনা করে, একজন নেটিভের থেকে কয়েক আনা মারতেও যা পরিশ্রম করে, তা সত্যি দেখার মতো।
ধরুন একজন স্থানীয় মানুষের কাছে কয়েক ফ্রাসিলা ওজনের একটা হাতির দাঁত আছে—এবার দাঁড়িপাল্লায় সেটার ওজন করার সময় দাঁতের মালিক ঘোষণা করে যে ওটা নির্ঘাৎ দুই ফ্রাসিলার বেশিই হবে। আমাদের বানিয়াটি ঝাঁপিয়ে পড়বে। দিব্যি গেলে বলতে শুরু করবে যে সে-লোকটি এ নিরিখে কিছুই জানে না আর এমনকি দাঁড়িপাল্লাটাও ভুল; জোর করে দাঁতটা তুলে ধরবে—যেন সেটা তোলা খুবই সোজা আর ওজনও কোনোমতেই এক ফ্রাসিলার বেশি নয়। তারপর বলতে থাকবে, ‘চলো, আর কথা বাড়িও না—এই নাও টাকা নাও, তারপর নিজের কাজে যাও। পাগল নাকি?’ যদি দাঁতের মালিক দ্বিধা করে, তখন রাগে চেঁচাতে শুরু করবে। তাকে ধাক্কা মারবে, অবজ্ঞা দেখিয়ে দাঁতটা পায়ের তলায় ফেলে দেবে—এমন ভাব দেখাবে যে যেন সম্পুর্ণ অকারণেই এত শোরগোল হচ্ছে। ঘাবড়ে যাওয়া লোকটিকে চলে যেতে বলবে, যদিও সে মোটেই চায় না যে দাঁতটা আদৌ তার দোকানের বাইরে যাক।
মধ্য আফ্রিকার বাণিজ্যের উপর এই বানিয়াদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। খুব অল্প কিছু ধনী আরব ছাড়া প্রায় আর সব ব্যবসায়ীকেই মহাজনের ঝামেলা আর সুদের বোঝা বইতে হয়। কোনো ব্যবসায়ী হয়তো দাস, হাতির দাঁত, কোপালের আঠা, বা অর্চিলা গুল্মর জন্য মহাদেশের ভিতরে যাবে, তাকে আগে বানিয়ার কাছে ৫০, ৬০ বা এমনকি ৭০ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার ডলার আগাম দেওয়ার জন্য দরবার করতে হবে। ব্যবসায়ীর নানা ঝুঁকি নেওয়া সত্ত্বেও, বানিয়ার টাকা যথেষ্ট নিরাপদই থাকে। অবশ্য একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর খুব কমই ক্ষতি হয়। তবে কোনো ব্যবসায়ীর যদি নিজের দোষে নয়, ভাগ্যের দোষে কোনো বড়োসড়ো ক্ষতি হয়, তাহলে বানিয়ার সাহায্যে সে আবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়।
আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে কীভাবে এই সব ব্যাবসা হয় তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক একজন আরব একটা কাফেলা ভরে ৫০০০ ডলারের মাল নিয়ে ভিতরের দিকে গেলেন। ইউনাইয়েম্বেতে এই পণ্যের দাম ১০০০০ ডলার, উজিজিতে (বর্তমানে তানজানিয়ার শহর) তাদের দাম ১৫০০০ ডলার—মানে, দাম তিনগুণ বেড়ে গেল। আবার উজিজির বাজারে একজন দাসের দাম পাঁচ ডটি বা ৭.৫০ ডলার। তাকে জাঞ্জিবারের বাজারে বেচে পাওয়া যাবে ৩০ ডলার। সাধারণ পুরুষ দাস হয়তো পাঁচ ডলারে কেনা হল, তাকেই উপকূল অঞ্চলে বিক্রি করা হবে ২৫ ডলারে। ব্যবসায়ীরা নিজের সাধ্যে যা কুলায় সবটুকু দিয়েই দাস কেনে। উজিজি যাতায়াতের গাড়িভাড়া ১৫০০ ডলার। সেটা বাদ দিয়ে বাকি ৩৫০০ ডলার দিয়েই ধরা যাক ৭.৫০ ডলার প্রতি জনে ৪৬৪ জন দাস কিনল একজন ব্যবসায়ী—তাদের জাঞ্জিবারে বেচে ১৩৯২০ ডলার পাওয়া যাবে। হাতির দাঁতের ব্যাবসার কথাও বলা যাক। একজন ব্যবসায়ী ৫০০০ ডলার নিয়ে উজিজি গেল। উজিজি থেকে জাঞ্জিবারে যাতায়াতের গাড়িভাড়ার ১৫০০ ডলার বাদ দিয়ে তার কাছে কাপড় আর কড়িতে ৩৫০০ ডলারের মাল আছে। সেই টাকা দিয়ে সে হাতির দাঁত কিনবে। উজিজিতে হাতির দাঁতের দাম প্রতি ফ্রাসিলাতে ২০ ডলার, কাজেই ৩৫০০ ডলার দিয়ে সে ১৭৫ ফ্রাসিলা দাঁত কিনতে পারল। ভালো মানের দাঁত হলে জাঞ্জিবারে তার দাম প্রতি ফ্রাসিলাতে ৬০ ডলার। ফলে ব্যবসায়ীর মোট লাভ হল ১০৫০০ ডলার। আরব ব্যবসায়ীরা সাধারণত এর থেকে আরও অনেকটা বেশি লাভই করে। প্রায় প্রতি খেপেই তারা একটা বিশাল মুনাফা নিয়ে ফেরে।
(ক্রমশ। পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার...)
ডাঁই করা হাতির দাঁতের পাহাড়ই বলে দিচ্ছে আফ্রিকান হাতির করুণ ইতিহাস! আর জাহাজ বোঝাই কালো মানুষ, ক্রীতদাস!
ছবিগুলোর দিকে তাকাতেও কষ্ট হয়।
অপূর্ব♥️
দারুণ