ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। উজিজিতে লিভিংস্টোনের সন্ধান পাওয়ার পর প্রথম আলাপচারিতা। তরজমা স্বাতী রায়
“যদি আমাদের মধ্যে প্রেমের বন্ধন থাকে, তবে আমাদের মিলন অকল্পনীয় রকমের মধুর ও লাভপ্রদ হবে; আর তা না হলে, আপনারও সময় নষ্ট, আর আমাকেও খামোকা বিরক্ত করবেন। আমাকে আপনার বোকা মনে হবে, আমার নাম-ডাকও মিথ্যা মনে হবে। আমার যা কিছু ভাল তা অন্যকে চুম্বকের মতন টানে, আর আমি পাঠের মাধ্যমে নয়, নিজের কাজের মধ্য দিয়ে অন্যদের শেখাই।”— এমারসনের রিপ্রেজেন্টেটিভ ম্যান।
পরের দিন সকালে আচমকা ঘুম ভাঙ্গল। ঘরটা অদ্ভুত! এটা একটা বাড়ি, আমার তাঁবু তো না! ওহ হ্যাঁ! মনে পড়ল, লিভিংস্টোনকে খুঁজে পেয়েছি, আর তাঁর বাড়িতেই আছি। কান পেতে শুনলাম, যেন তার গলার শব্দ পেলেই নিশ্চিত হব যে তাঁর বাড়িতেই আছি। ঢেউয়ের চাপা গর্জন ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলাম না।
চুপচাপ খাটে শুয়ে আছি। খাট! হ্যাঁ, এটা একটা আদ্যিকালের ছত্রি-ওলা খাট, খালি পালকের বদলে পাম-গাছের পাতা বিছানো। তার উপরে বিছানার চাদরের বদলে ঘোড়ার লোম ও আমার ভালুকের চামড়া পাতা। মনে মনে নিজেকে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলাম আর স্বীয় অবস্থানের বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম।
"আমাকে কেন পাঠানো হয়েছিল?"
"লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতে।"
"তাঁকে কি খুঁজে পাওয়া গেছে?"
" হ্যাঁ অবশ্যই; আমি তো তাঁর বাড়িতেই রয়েছি, তাই না? ওই যে খুঁটিতে কম্পাস ঝুলছে, ওটা আর কারই বা? এগুলো কার জামা, কার বুট? মেঝেতে পড়ে আছে এই যে খবরের কাগজগুলো, শনিবারের রিভিউ এবং পাঞ্চের সংখ্যাগুলো— এগুলো আর কেই বা পড়ে?"
"বেশ, এখন তাহলে কী করবে?"
"আজ সকালে তাঁকে জানাব যে কে আমাকে পাঠিয়েছেন, আর কেনই বা পাঠিয়েছেন। তারপর মিঃ বেনেটকে একটা চিঠি লেখার জন্য তাঁকে অনুরোধ করব, আর যেটুকু যা টুকরো খবর উনি দিতে পারবেন তা জানাতে বলব। আমি তো আর তাঁর খবরাখবর ডাকাতি করতে আসিনি। তাঁকে পেয়েছি এটাই আমার পক্ষে ঢের। এখনও পর্যন্ত, একটা গোটাগুটি রকমের সাফল্য। তবে আরও বড় সাফল্য হবে যদি তিনি মিঃ বেনেটের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে দেন আর একটি স্বীকৃতিপত্র দেন যে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে ।"
"কী মনে হয়, উনি চিঠি দেবেন?"
“কেন দেবেন না? আমি তো এখানে তাঁকে একটি পরিষেবা দিতে এসেছি। তাঁর কাছে কোন রসদ নেই। আমার আছে। তার সঙ্গে কোনো দলবল নেই। আমার সঙ্গে আছে। আমি যদি তাঁর সঙ্গে বন্ধুর মতন আচরণ করি, তবে তিনিও কি আমার সঙ্গে বন্ধুর মতন মিশবেন না? কবি কী বলেছেন ?—
বন্ধু পাওয়ার আশাও নেই,
কিন্তু কেই বা তোমার মধ্যে বন্ধু খুঁজে পেয়েছে।
পসরা পছন্দ হয় সবার; অল্প কজনই তার দাম দিতে রাজী থাকে
আর সেই জন্যেই এখানে বন্ধু ব্যাপারটা এত অবাক করে ! ”
আমি পসরার মূল্য দিয়েছি, ওঁকে সাহায্য করার জন্য এতদূর এসেছি। তবে গত রাতে ওঁকে যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে যে, আমাকে যেরকমটা বিশ্বাস করানো হয়েছিল উনি ঠিক ততটা কিপটে, মনুষ্যদ্বেষী নন। স্বল্প কথায় উনি আমাকে অভ্যর্থনা করলেও, আমার সঙ্গে করমর্দন করার সময় যথেষ্ট আবেগ প্রকাশ করেছেন। কেউ তাঁর পিছু নিলে তিনি যদি সে মানুষের প্রতি এতই বিরক্ত হতেন, তাহলে কি আর আমায় ওই ভাবে স্বাগত জানাতেন? তাহলে আর আমাকে তাঁর সঙ্গে থাকতেও বলতেন না, বরং বিচ্ছিরি ভাবে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না, আমাকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলতেন। এমনকি আমার দেশ নিয়েও তো ওঁর কোন মাথাব্যথা নেই; "এখানে," উনি বলেছিলেন, "আমেরিকান এবং ইংরেজরা একই মানুষ।
আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একইরকমের ধ্যান-ধারণা নিয়ে চলি। "একদমই তাই, ডক্টর, আপনার সঙ্গে সহমত, এখানে অন্তত আমেরিকান ও ইংরেজরা ভাই ভাই, আর, আমি যতটুকু করতে পারি, আপনি আমাকে নির্দ্বিধায় আদেশ দিন যেন আমি আপনারই রক্ত-মাংসের অংশ।"
চুপচাপ পোশাক পালটে নিলাম, ডাক্তার ঘুম থেকে ওঠার আগেই টাঙ্গনিকার ধারে একটু হেঁটে আসতে চাইছিলাম; দরজাটা খুললাম, তার কব্জা অবশ্য যা ভয়ঙ্কর ভাবে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠল, আর বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
“হ্যালো, ডাক্তার! -আপনি এরমধ্যেই উঠে পড়েছেন? আশা করি ভালই ঘুম হয়েছিল?”
“সুপ্রভাত, মিস্টার স্ট্যানলি! আপনাকে দেখে খুশি হলাম. আশা করি ভালই বিশ্রাম হয়েছে। কাল চিঠিগুলো পড়তে পড়তে অনেক দেরী হল। ভাল আর খারাপ দু'রকমের খবরই আপনি এনেছেন। আগে বসুন।" তাঁর পাশে আমার বসার জন্য জায়গা করে দিলেন। "হ্যাঁ, আমার অনেক বন্ধু মারা গেছেন। আমার বড় ছেলে একটা দুঃখকর দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে – হ্যাঁ আমার আদরের টম; আমার দ্বিতীয় ছেলে, অসওয়াল্ড, কলেজে ডাক্তারি পড়ছে, আর যা শুনছি ভালই করছে। অ্যাগনেস, আমার বড় মেয়ে, "স্যার প্যারাফিন" ইয়াং ও তাঁর পরিবারের সাথে নৌকাবিহার উপভোগ করছে। স্যার রোডরিকও ভালো আছেন, আর আশা প্রকাশ করেছেন যে তাঁর সঙ্গে আমার শীঘ্রই দেখা হবে । আপনি আমার জন্য অনেক খবরই এনেছেন।”
লোকটা তো আর আকাশ থেকে পড়েনি, আর গতকালের দৃশ্যগুলোও আমি স্বপ্ন দেখিনি! আমি গভীরভাবে তাঁর দিকে তাকালাম, এটাই আমার নিজেকে নিশ্চিত করার পন্থা যে তিনি পালিয়ে যাননি, উজিজির দিকে আসার সময় যে নিদারুণ ভয়টা আমাকে ক্রমাগত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল!
"এবার, ডাক্তার," আমি বললাম, "নিশ্চয় ভাবছেন, যে আমি কেন এখানে এসেছি?"
"তা তো বটেই," তিনি বললেন; "সে কথা তো ভাবছিই। প্রথমে ভেবেছিলাম, আপনি ফরাসি সরকারের একজন দূত, গন্ডোকোরোর কয়েক মাইল উপরে লেফটেন্যান্ট লে সেন্ট যে মারা গেলেন, তাঁর জায়গায় এসেছেন। শুনলাম আপনার সঙ্গে নৌকা, প্রচুর লোকজন, রসদ রয়েছে - আমেরিকার পতাকা না দেখা অবধি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম যে আপনি কোন এক ফরাসি অফিসারই হবেন; আর, সত্যি বলতে কি, বরং আপনি আমেরিকান বেরোতে খুশিই হয়েছিলাম, কারণ আমি তো আর তাঁর সঙ্গে ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারতাম না; আর যদি তিনি ইংরেজি না জানতেন, আমরা উজিজিতে সাহেবদের এক মজার জুটি হতাম! গতকাল আর আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাইনি, কারণ ভাবছিলাম এতো আমার চরকা না।"
“আচ্ছা,” হাসতে হাসতে বললাম, “অন্তত আপনার কথা ভেবে আমি খুশি যে আমি একজন আমেরিকান, ফরাসি নই, আর দোভাষী ছাড়াই আমরা একজন অপরজনকে ঠিকমতই বুঝতে পারি। দেখছি যে আরবরা খুব অবাক হয়ে ভাবছে, আপনি, একজন ইংরেজ, আর আমি, একজন আমেরিকান, একে অপরকে বেশ বুঝতে পারছি। আমরা যেন আবার তাদের না বলে ফেলি যে ইংরেজ আর আমেরিকানরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে, আর সেখানে "আলাবামার দাবিগুলো এখনও মিটমাট হয়নি। আমেরিকাতে ফেনিয়ানদের মতো লোক আছে, যারা আপনাকে ঘৃণা করে। তবে, সত্যি-সত্যি বলছি , ডাক্তার - কথাটা শুনে ভয় পাবেন না যেন, আমি আসলে আপনার পিছু পিছুই এসেছি।”
“আমার পিছন পিছন!”
“হ্যাঁ।”
"কেন?”
"বলছি। নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের নাম শুনেছেন?”
“ওহ - ওই পত্রিকার কথা কেই বা শোনেনি?”
“শ-শ! হেরাল্ডের মালিক মিঃ জেমস গর্ডন বেনেটের ছেলে মিঃ জেমস গর্ডন বেনেট বাবাকে না বলে, তাঁর অনুমতি ছাড়াই আমাকে আপনাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছেন— আপনার আবিষ্কারের যেটুকু খবর আপনি জানাতে চান,— আর সেই সঙ্গে যদি পারি তাহলে আপনাকে সাহায্য করার জন্য।”
“ইয়াং মিঃ বেনেট আপনাকে আমার খোঁজে আসতে বলেছেন, আর আমাকে সাহায্য করতে বলেছিলেন! ওহ আচ্ছা সেইজন্যেই আপনি গতরাতে মিঃ বেনেটের এত প্রশংসা করেছিলেন।”
'"বলতে বেশ গর্বই বোধ করছি, যা বলছি আমি তাকে ঠিক তেমন হিসেবেই চিনি। তিনি উদ্যমী, উদার আর সত্যিকারের একজন মানুষ।'
"আচ্ছা, তাই! আমি তাঁর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ; আর এটা ভেবে বেশ গর্ব হচ্ছে যে আপনারা আমেরিকানরা আমার বিষয়ে এতটা ভাবেন। আপনি একদম ঠিক সময়ে এসেছেন; কারণ আমি ভাবতে শুরু করছিলাম যে এবার আমাকে আরবদের কাছে হাত পাততে হবে। তাদেরও অবশ্য কাপড় দরকার, আর উজিজিতে খুবই সামান্য পুঁতি আছে। ওই শরীফ নামের লোকটা আমার সব কেড়ে নিয়েছে। আমি উপযুক্ত শব্দমালা প্রয়োগ করে মিঃ বেনেটকে ধন্যবাদ জানাতে চাই; তবে আমি যদি সেটা করতে না পারি, তাহলে, আপনার কাছে অনুরোধ করছি, আমাকে অকৃতজ্ঞ ভাববেন না। "
"আর এবার, ডাক্তার, এই সামান্য ব্যাপারটা যদি মিটে গিয়ে থাকে, ফেরাজি তাহলে নাস্তা আনুক, অবশ্য আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে।"
"আপনি আমাকে খিদের বোধ ফিরিয়ে দিয়েছেন।", তিনি বললেন, "হালিমা আমার রাঁধুনি বটে, তবে সে চা আর কফির মধ্যে তফাৎ বোঝে না।"
(ক্রমশ…)