ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে ফের শুরু হল উন্যানয়েম্বে ছেড়ে যাওয়ার তোড়জোড়। তরজমায় স্বাতী রায়
১৫ই সেপ্টেম্বর। উন্যানয়েম্বেতে আছি প্রায় তিন মাস হল, এখনও এখানেই আছি, তবে আশা করছি তেইশ তারিখের আগেই এখান থেকে চলে যাব।
কাল সারারাত ধরে আমার সৈন্যরা তাদের উইলিয়ানকুরুর বনে মরে পড়ে থাকা কমরেডদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নাচ-গান করেছে। আজ সকাল নটা অবধি সে পর্ব চলেছে। এতই তুমুল নাচ যে দু-তিনটে বিশাল পাত্র-ভরা পম্বেতেও কুলায়নি। তাই, আজ খুব সকালে, আরেক হাঁড়ি জবরদস্ত মদের জন্য এক শুক্কা অনুদান চেয়ে আমার কাছে আর্জি জানান হল।
প্রত্যেক সৈন্য ও কুলির জন্য বোঝা ঠিক করার কাজে আজ ব্যস্ত ছিলাম। তাদের পরিশ্রম কমানোর জন্য, প্রতিটা বোঝার ওজন ৭০ পাউন্ড থেকে ৫০ পাউন্ড করেছি, আশা করি এতে দীর্ঘ পথ টানা চলতে সুবিধা হবে। গত দু-তিন দিনে দশজন কুলিকে কাজে লাগিয়েছি।
আমার দলের দু-তিনজন লোক এখনও খুব অসুস্থ, তারা যে কোন মাল বইতে পারবে এমন আশা করা প্রায় বৃথা, তবে আশা করছি যে রওনা হওয়ার আগেই তাদের জায়গায় অন্য লোক নিতে পারব। রওনা হওয়ার দিন অবশ্য মনে হচ্ছে দ্রুত এগিয়ে আসছে।
১৬ই সেপ্টেম্বর। কাজ প্রায় শেষ। ভগবান নারাজ না হলে, আজকে থেকে পাঁচ দিনের মাথায় আমরা ফের পথে নামব। দু’জন গাইড ছাড়াও আসমানী ও মাবরুকি নামের আরো দু’জন কুলিকে দলে নিয়েছি। বিশাল চেহারা দেখে যদি কেউ ভয় পায়, তাহলে অবশ্যই আসমানীর চেহারা সেই প্রভাব তৈরিতে সক্ষম। লম্বায় সে জুতো ছাড়াই ছয় ফুটের অনেকটা উপরে আর তার কাঁধটা দু’জন সাধারণ লোকের কাঁধের সমান।
আগামীকাল আমি সবাইকে একটা বিদায়ী ভোজ দিতে চাই, এই পচা দেশটা ছেড়ে চলে যেতে পারছি সেই আনন্দে।
১৭ই সেপ্টেম্বর। একটা জম্পেশ ভোজ হল। দুটো বলদ জবাই করেছি, আর একটা বারবিকিউও ছিল; ভোজের তালিকায় তিনটে ভেড়া, দুটো ছাগল ও পনেরটা মুরগি, ১২০ পাউন্ড ভাত, ভারতীয় ভুট্টার আটার তৈরি বিশটা বড় বড় রুটি, একশ ডিম, ১০ পাউন্ড মাখন ও পাঁচ গ্যালন মিষ্টি দুধ ছিল। লোকরা তাদের বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের নেমন্তন্ন করেছিল- প্রায় একশজন মহিলা ও শিশু এই ভোজে যোগ দিয়েছিল।
ভোজ শেষ হওয়ার পরে, পাঁচ গ্যালনের পাত্রে পম্বে বা দেশী বিয়ার আনা হয়েছিল, তারপর সবাই নাচতে শুরু করল, এখনও, আমার লেখার সময়ও সে নাচ চলছে।
১৯ শে সেপ্টেম্বর। আমার আজ সামান্য জ্বর হয়েছিল, ফলে আমাদের যাত্রা পিছিয়ে গেল। সেলিম ও শ দু’জনই সুস্থ হয়ে উঠেছে। সেলিম জানাল যে শ বলেছে আমি গাধার মত মরবো। আমি মরলে আমার জার্নাল আর ট্রাঙ্ক সে নিজের হেফাজতে নেবে আর অবিলম্বে উপকূলের দিকে রওনা দেবে। আজ বিকেলে, সে বলেছে বলে শুনলাম যে সে উজিজিতে যেতে চায় না, তবে আমি চলে গেলে, সে উঠোন ভরে মুরগি পুষবে যাতে প্রতিদিন তাজা ডিম পাওয়া যায়। আর একটা গরু কিনবে। যাতে টাটকা দুধও প্রতিদিন মেলে।
রাতে যখন জ্বর খুব বেড়েছে, শ আমার কাছে এসেছিল আর জিজ্ঞাসা করছিল যে আমার মৃত্যু হলে সে কাকে খবর দেবে, কারণ, সে বলেছিল, সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষও তো মারা যেতে পারে। আমি তাকে ভাগিয়ে দিলাম। বললাম যে নিজের কাজে মন দিতে আর আমার কানের কাছে বকবক না করতে।
প্রায় রাত আটটা নাগাদ শেখ বিন নাসিব এসে অনুরোধ করল যে, আমি এত অসুস্থ, এই অবস্থায় যেন কালকে রওনা না দিই। থানি সাখবুরি আরও মাস খানেক থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিল। উত্তরে আমি তাদের বলেছিলাম যে, শ্বেতাঙ্গরা কথার খেলাপ করতে অভ্যস্ত নয়। যাব বলেছি তো যাবই।
আরও একদিন থেকে যাওয়ার ফলে আমাকে রাজি করানোর সকল আশা শেখ বিন নাসিব ত্যাগ করলেন। তিনি চলে গেলেন আর বলে গেলেন যে তিনি অবশ্যই সৈয়দ বুরঘাশকে লিখবেন যে আমি কতটা গোঁয়ার; আর কেমন মরার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই হল আমাদের শেষবারের আলাপ।
রাত দশটা নাগাদ জ্বরটা চলে গেল। টেম্বেতে তখন আমি ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে। নিজের অবস্থান, উদ্দেশ্য এইসব নিয়ে ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে একটা অবর্ণনীয় একাকীত্ব মনের উপর চেপে বসল। চারপাশের দরদ-হীন মনোভাব বেশ বুঝতে পারছি। যে অন্ধকার ভবিষ্যতের ভাবনা মাথায় জমছে, তাকে তাড়াতে অনেক মনের জোর দরকার। আমার নিজের যতটা মনের জোর আছে, তার থেকেও অনেকটা বেশি। ছল-পূর্ণ আরবদের বার বার বলা সতর্কবার্তা মনের উপর যে ছাপ ফেলেছে, খুব সম্ভবত সেটাই এইসব দুশ্চিন্তার মূলে। মনের ভিতর জমা বিষণ্ণতা ও একাকীত্বের উৎপত্তিও সম্ভবত একই কারণ থেকে। একটা মোটে মোমবাতির আলোতে তো ঘরের কোণের ছায়াও দূর হয় না, তাই দিয়ে কি আর মন ঝলমলে হয়ে ওঠে? আমি যেন পাথরের কারাগারে বন্দি। কিন্তু আমিই বা কেন এই মূর্খ, মোটামাথা-ওলা আরবদের টোপ গিলছি? তাদের সতর্কীকরণ বা বাজে বকায় কান দিচ্ছি? মনে একটা সন্দেহ জাগছে যে এই সবের পিছনে হয়ত কিছু উদ্দেশ্য আছে। মনে হচ্ছে যে এই আরবরা আমাকে এখানে ধরে রাখার জন্য এই সব কথা বলছে, এই আশায় যে আমি হয়ত মিরাম্বোর সাথে তাদের যুদ্ধে আবার সাহায্য করতে পারি! এরকম ভাবলে তারা খুবই ভুল ভাবছে, কারণ আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছি আর বেঁচে থাকতে সে শপথ ভাঙব না, কোন প্ররোচনাতেই যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা থেকে সরে আসব না। সে শপথ হল এই যে যতক্ষণ না আমি লিভিংস্টোনকে জীবিত বা মৃত খুঁজে পাই ততক্ষণ তাঁর সন্ধান চালানো ছাড়ব না; আর তাঁর বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়ার জোরদার সম্ভাব্য প্রমাণ জোগাড় না করে কখনই বাড়ি ফিরব না। একমাত্র মৃত্যু এসে পথ না আটকালে, কোন জীবিত মানুষ, বা জীবিত মানুষের দল আমাকে থামাতে পারবে না। নাঃ মৃত্যুও আমাকে রুখতে পারবে না; আমি মরবো না, কিছুতেই মরবো না, মরতে পারি না! আর কেউ একটা আমাকে বলছে, কে বলছে তা জানি না- সম্ভবত আমার নিজের স্বভাবগত চিরকালীন আশাবাদ থেকেই এমন মনে হচ্ছে- বা এটা হয়ত আমার উপচে পড়া সতেজ জীবনীশক্তি- সঞ্জাত সাধারণ ধারণা, বা হয়ত আত্মবিশ্বাসের উপর আমার অত্যধিক আস্থার কারণেই এরকম মনে হচ্ছে- তবে সে যে কোন কারণেই হোক, আজ রাতে কিছু একটা আমাকে বলছে যে আমি তাঁকে খুঁজে পাব, আর বলছে- আরও বড় হরফে লেখা যাক- তাঁকে খোঁজো! খোঁজো! এমনকি কথাগুলোও মনকে চনমনে করে। বেশ খুশি খুশি লাগছে। প্রার্থনা উচ্চারণ করলাম কি? আজ রাতে আমি শান্তিতে ঘুমব।
ডায়েরি থেকে উপরের কথাগুলো তুলে দিলাম। তখন সেই জায়গায় বসে যেমন যেমন লিখেছিলাম। আমার উন্যানয়েম্বের জীবনের ওঠা-পড়ার কথা। যে কোন বর্ণনামূলক লেখার চেয়ে, তা সে যতই জীবন্ত বর্ণনা হোক না কেন, এই ডাইরি আমি সেখানে কেমন জীবন কাটিয়েছি তা অনেক বেশি ভাল ভাবে বুঝিয়ে দেয়। একদম একটা গোটা ছবি তুলে ধরে, আক্ষরিক ভাবে আর কোন অত্যুক্তি ছাড়া। যখন ঘটনা ঘটছিল, তখন তখন আমার ঠিক কি মনে হয়েছিল তার সম্পূর্ণ বিবরণ। আমার নিজের ও দলের লোকদের বারবার জ্বরের কথা লেখা আছে, আমাদের বিপদের কথা মনে পড়ায়, আর ছোটখাটো আনন্দ-বিরক্তি-সুখ যেমন যেমন ঘটেছিল সবই ধরা আছে এখানে।
(নবম অধ্যায়ের শেষ। পরের কিস্তিতে শুরু হবে দশম অধ্যায়)