ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এ পর্বে উজিজি থেকে উন্যানয়েম্বে যাত্রার প্রস্তুতি। তরজমা স্বাতী রায়
যাত্রা শুরু করলাম সকাল আটটায়। আরবরা ছিল। আর তাদের সঙ্গে ভিড় জমিয়েছিল যত উটকো কৌতূহলী লোকের দল। সবাই হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল। আমরাও তাদের সবার দিকে হাত টাত নেড়ে বিদায় জানালাম। দু-একটা লোক বিশেষত মোহাম্মদ বিন সালির মতন প্রমাণিত বদমাইশ অবশ্য বেশ আবেগপূর্ণ কথাবার্তা বলার চেষ্টা করা করেছিল। তার কথায় বা তার লোক দেখানো হাত ধরে ঝাঁকানোয় অন্তত মুখে কোন অপ্রীতিকর ভাব প্রকাশ করিনি। ১৮৬৯ সালে লিভিংস্টোনের সঙ্গে সে যা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারপরে তার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের সম্ভাবনায় একটুও দুঃখিত হইনি। আমাকে বারে বারে বলা হয়েছিল যে উন্যানয়েম্বের সবাইকে অনেক অনেক সালাম জানাতে। তবে সে যেমন চেয়েছিল তেমনটা করলে সবাই আমাকে ভয়ানক গাধা ভাবলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
বাজারের শেষ প্রান্তের কাদামাটির পাড় থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে যেতে থাকলাম। এদিকে বিশালবপু আসমানি ও বোম্বের নেতৃত্বে আমাদের স্থলযাত্রীদের দল মালপত্র ছাড়াই হ্রদের তীর ধরে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। ঠিক করা হয়েছিল যে আমরা প্রত্যেক নদীর মোহনায় তাদের সঙ্গে দেখা করব। যাতে তাদের এ পাড় থেকে অন্য পাড়ে পৌঁছে দেওয়া যায়।
ডাক্তার ছিলেন সাইদ বিন মাজিদের নৌকায়। সেই নৌকাটা আমার নৌকার থেকে এক তৃতীয়াংশ বা তার থেকে সামান্য একটু বেশিই ছোট। সেটা ছিল সামনে সামনে। সে নৌকাতে একটা বাঁশের ডগায় ব্রিটিশ পতাকা পিছনের দিকে উড়ছিল। একটা লাল উল্কার মতো। আমার নৌকা আসছিল পিছনে পিছনে। চালাচ্ছিল জিজি নাবিকরা। তাদের টংওয়ে কেপ থেকে উজিজি বন্দরে নৌকা ফেরত নিয়ে যাওয়ার শর্তে নিয়োগ করেছিলাম। আমাদের নৌকায় একটা অনেক লম্বা পতাকা দন্ড ছিল, তার মাথায় চির-সুন্দর তারা ও স্ট্রাইপখচিত আমেরিকার পতাকা উড়ছিল। এটা এতটাই উঁচুতে ছিল যে ডাক্তারের দেশপ্রেম ও আনুগত্যবোধে আঘাত লেগেছিল। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর নৌকার পতাকাদন্ডের জন্য তিনি সবচেয়ে উঁচু তাল গাছ কেটে নেবেন। কারণ ব্রিটিশ পতাকাটি যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার চেয়ে এতটা নিচুতে থাকা উচিত নয়।
আমাদের সৈন্যদেরও উন্যানয়েম্বে ফিরে যাওয়ার আনন্দ আমাদের থেকে কিছুমাত্র কম নয়। তারা প্রাণের আনন্দে সমস্বরে জাঞ্জিবারের মাঝিদের উচ্ছ্বসিত গান ধরল -
আর গানের সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতন দ্রুত দাঁড় টানতে শুরু করল, যতক্ষণ না নিছক ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হয় আর তাদের সারা শরীর দিয়ে কুলকুল করে ঘামের স্রোত বইতে থাকে। একটু ঝিমিয়ে পড়ার পরে ফের একটু দেহে বল ফিরলে, তারা আবার দাঁড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে, আর মৃমাদের গান ধরে-
শিগগিরই আবার তাদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে আর তারা অমানুষিক পরিশ্রম শুরু করে। এইভাবেই ক্রমান্বয়ে একবার করে চাগিয়ে ওঠা, ছোটা, হাসি-স্বেদ-শ্রম-হাহাকার, চিৎকার ও ফুঁপিয়ে ওঠার পর্বের মধ্যে দিয়েই আমাদের দলের লোকেরা তাদের মনের আনন্দ অনুভূতিকে প্রকাশ করছিল। সবার মাথাতেই তখন ঘুরছে যে এবার আমরা বাড়ি ফিরছি। আর উন্যানয়েম্বে যেতে যে পথটা বেছে নিয়েছি, সেই পথে অন্তত কোনই বিপদ ছিল না।
হো হো হাসির বাঁধ ভাঙ্গে। সঙ্গে সবাই চেঁচাতে থাকে, আর সেই সঙ্গে ঝপাঝপ দ্রুত দাঁড় টানে। সমবেত শক্তির দাপটে পুরানো শক্ত ক্যানোগুলো এমাথা থেকে ওমাথা অবধি কাঁপতে থাকে।
আমাদের ডাঙ্গার দলটিও আমাদের উত্তেজনার অংশীদার হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। পাগলের মতন তারাও আফ্রিকান গানের সঙ্গে ধুয়ো ধরছে। আমরা যখন নদী বেয়ে অন্তরীপ আর শেষ ভূমিবিন্দু পেরিয়ে যাচ্ছি, খাড়ি পারাপার করছি- সে খাড়ির ধারগুলো নল খাগড়া আর শরে ছাওয়া - আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোনোর জন্য তারাও খুব চেষ্টা করছে। ছোট, চটপটে কালুলু, ছোট্ট বিলালি ও মাজওয়ারা কাফেলার ছাগল, ভেড়া, গাধার দলের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে দেখা গেল। এমনকি পশুরাও যেন সবার আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছে।
এছাড়াও সেই গর্বোন্নত, বন্য প্রকৃতি - সেখানে উজ্জ্বল সবুজে জড়ানো সুপ্রশস্ত প্রান্তরের উপর অনেক উঁচুতে ছড়ানো নীল ছাতাটি অনন্তে মিশে গেছে। আর আমাদের বাঁদিকে রয়েছে অসীম ব্যাপ্তি - উজ্জ্বল, ঝকঝকে জলের চাদরের ঢাকা। সেই প্রকৃতিও যেন আমাদের আনন্দের সঙ্গী। তার দিকে চেয়ে চেয়ে আমাদের আনন্দ আরওই বাড়ছে।
প্রায় সকাল দশটা নাগাদ. আমরা কিরিন্দোর গ্রামে পৌঁছেছিলাম। কিরিন্দো একজন বুড়ো সর্দার, ডঃ লিভিংস্টোনের প্রতি তার ভালবাসার শেষ নেই, কিন্তু সে আরবদের ভয়ানক শত্রু। আরবরা এর মানে বুঝতে পারত না । তবে ডাক্তারের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার : তিনি তার সঙ্গে কথা বলতেন সদয়ভাবে, আন্তরিকভাবে। এদিকে আরবেরা তার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলত যেন সে সর্দার তো দূরের কথা, যেন একটা মানুষেরও অধম।
কিরিন্দোর গ্রামটা লিউচে নদীর মোহনার কাছে। নদী এখানে খুবই চওড়া; বালসার জঙ্গল ফুঁড়ে নদীটা বেরিয়ে এসেছে। আমাদের হ্রদের দল আর পার ধরে আসা দলদুটো এখানেই পরস্পরের সঙ্গে দেখা করবে। তেমনই আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। যাতে সবগুলো ক্যানো দেড় মাইল দূরের অন্য তীরে যেতে পারে। লিউচের মুখটাতে উকারঙ্গা উপসাগর তৈরি হয়েছে, এহেন নামকরণের কারণ হল যে অন্য পাড়ে, আমরা জল পেরিয়ে যেখানে যাব, উকারঙ্গা গ্রামটি সেখানেই অবস্থিত - হ্রদ থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে । সব মালপত্র বড় ডিঙিটার পেটের থেকে বের করে আনা হল, আর ছোটটাতে গাদাগাদি করে পোরা হল। কয়েকজন বাছাই করা মাল্লা ডাক্তারকে নিয়ে নৌকায় রওনা দিল। তিনি উকারঙ্গায় গিয়ে শিবির বসানোর দেখাশোনা করবেন। আমি পিছনে রয়ে গেলাম। খিটখিটে, বদস্বভাবের গাধাগুলোকে বেঁধেবুঁধে বড় ক্যানোর একদম নীচে রেখে দিলাম, যাতে নৌকা উল্টে ক্ষুধার্ত কুমিরের খাদ্য হওয়ার মতন কোন বিপর্যয় না ঘটে। কুমীরগুলো কিন্তু এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। তারপর ছাগলের পাল ওঠানো হল। এরপর আমাদের যত লোক ঢুকতে পারে তাদেরও তোলা হল। তারপরও প্রায় ত্রিশজন আমার সঙ্গে পড়ে রইল। আমাদের জন্য আবার নৌকা ফিরে আসবে ।
সবাই নিরাপদে উকারাঙ্গায় পৌঁছে গেলাম, অবশ্য পথে বিপজ্জনকভাবে জলহস্তির একটা পালের খুব কাছে গিয়ে পড়েছিলাম। লিউচে নদী তখন বন্যায় থইথই - তার চওড়া মুখ পেরোতে প্রায় ঘন্টা চারেক লেগেছিল।
পরের দিন, একই ক্রম অনুসারে উজিজি থেকে যাত্রা শুরু করলাম। আমরা আমাদের পথ ধরে দক্ষিণমুখে চলছি, জলযাত্রীরা যতটা সম্ভব উপকূলের কান ঘেঁষে চলছিল, তাও, যখনই পারা যাচ্ছিল, বাতাস ও আবহাওয়া সুবিধাজনক দেখলে ট্যাঙ্গানিকার তীর বরাবর অসংখ্য ছোট ছোট স্থলের মধ্যে ঢুকে যাওয়া খাড়ির উপর দিয়ে আমাদের নৌকাগুলো যেন উড়ে যাচ্ছিল। তীরগুলো সুন্দর সবুজ, দেরীতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে; উপরের নীল আকাশের অপুর্ব প্রতিফলন ঘটেছে হ্রদের জলে । এখানে প্রচুর জলহস্তী। এই দিনে যাদের দেখা গেল তাদের কানের গোড়ায় আর গলায় লালচে গোলাকার দাগ । একটা দানব, অনেকটা দেরিতে এসে, তার দিকে ছুটে আসা নৌকাটা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেল, আর খুব ভয় পেয়ে এমন এক বিশাল ডুব দিল যাতে তার গোটা শরীরটা দেখা গেল! মালাগারাজি আর লিউচের মোহনার আধাআধি পথে এসে আমরা তীরে একটা শিবির দেখতে পেলাম। সেটা মোহাম্মদ বিন ঘারিবের। সে এক সওয়াহিলি, লিভিংস্টোনের থেকে তাঁর দুঃসাহসিক ভ্রমণ -অভিযানের গল্প শোনার সময় এর কথা অনেক শুনেছি। তিনি এই মানুষটার কথা বলতেন মধ্য আফ্রিকার সবচেয়ে দয়ালু ও সেরা মুসলমানদের একজন বলেই । আমিও একজন সদয় স্বভাবের লোককেই দেখতে পেলাম - এমন মুখ কদাচিৎ দেখা যায়, একটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের ছাপ রয়েছে সেখানে - সেটা হল তার আন্তরিকতা।