ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। ডাঃ লিভিংস্টোনের উজিজিতে ফেরার কাহিনি। তরজমা স্বাতী রায়
দু'জন আরবও এই ধাতুর আশায় রুয়ার কাটাঙ্গা নামের জায়গাটাতে হাজির; তবে সংকীর্ণ গিরিখাতে খননের বিষয়ে তাদের কিছুই জানা নেই, অতএব তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম। এইসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় আবিষ্কারগুলি করার ঠিক আগে ডাঃ লিভিংস্টোন ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার সঙ্গীরা আর এক পাও এগোতে রাজি নয়। একটা বড় দল ছাড়া তারা এগোতে ভয় পাচ্ছিল; আর, মান্যুয়েমায় দলবল জোগাড় করা সম্ভব ছিল না, ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তার উজিজির দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ফেরার পথ লম্বা, ক্লান্তিকর। এই পর্বের যাত্রায় তাঁর আর কোন আগ্রহ ছিল না। আগের বার এই পথ ধরে পশ্চিমমুখো যাওয়ার সময় তার মনে অনেক উচ্চাশা, অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল, লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলেই এই শ্রমের থেকে ছুটি, সেজন্যও তিনি অধৈর্য হয়েছিলেন। এখন শেষটুকু প্রায় চোখের সামনে দেখতে পেয়েও বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হতাশ, ব্যর্থ মনে ফিরে আসতে হচ্ছে। সেই একই পথ ধরে হাঁটা, মন জুড়ে শুধু নষ্ট চাওয়া, পরাজিত আশা। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তাঁর সেই পুরানো প্রত্যয়ী মন এখন প্রায় মৃত, তার শক্তপোক্ত শরীর প্রায় বিধ্বস্ত।
১৬ অক্টোবর যখন লিভিংস্টোন উজিজিতে এসে পৌঁছালেন, তখন তিনি প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। তাঁর দলের লোকদের গোঁয়ারতুমির সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব ছিল। তাই ফেরার পথে তিনি নিজেকে এইরকম স্তোক দিয়ে চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, "এখানে আর কিছু করার ছিল না। তাই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেও লাভ নেই। তবে বেশিদিন লাগবে না; আর মাত্র পাঁচ-ছ'মাস; উজিজিতে গেলে আমার মালপত্র ফেরত পাব, আবার দল ভাড়া করব, নতুন করে সব কিছু শুরু করব।" এই সব কথা, মনের আশা দিয়ে তিনি নিজেকে ভোলাতে চেষ্টা করেছিলেন যে এখনও সব কিছু ঠিকই আছে; কিন্তু মালপত্র নিরাপদে থাকবে বলে যার কাছে সেসব গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন, সেই লোকটা হাতির দাঁত কিনতে তাঁর সবকটা কাপড়ের গাঁটরি বেচে দিয়েছে, তখন তিনি কতটা ধাক্কা খেয়েছিলেন সেটাই খালি আন্দাজ করুন!
লিভিংস্টোন উজিজিতে যেদিন ফিরলেন, সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত দুই ব্যক্তি, সুসি আর চুমাকে ভয়ানক কাঁদতে দেখা গেল। ডাক্তার তাদের কান্নার কারণ জানতে চাইলে, এই প্রথম তাকে বলা হল, যে তাঁর জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।
তারা জানাল, "আমাদের সব জিনিসপত্র বিক্রি হয়ে গেছে, কর্তা; হাতির দাঁতের জন্য শেরিফ সব বিক্রি করে দিয়েছে।"
পরে সেইদিনই সন্ধ্যায়, শেরিফ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে, ও নির্লজ্জভাবে তাঁর সঙ্গে হাত মেলানোর ইচ্ছে প্রকাশ করে। কিন্তু লিভিংস্টোন তার সঙ্গে হাত মেলাতে নারাজ হন, বলেন যে তিনি চোরদের সঙ্গে হাত মেলান না। শেরিফ অজুহাত দিয়েছিলেন যে তার কানে নাকি কোরানের দৈববাণী হয়েছিল যে হাকিম (ডাক্তারের আরবি প্রতিশব্দ) মারা গেছেন।
লিভিংস্টোন এখন নিঃস্ব; তাঁর নিজের ও দলবলের আর মাত্র এক মাসের রসদ তাঁর কাছে আছে। তারপর আরবদের থেকে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
ডক্টর আরও বলেছেন, স্পেক যখন জানান যে টাঙ্গানিকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৮০০ ফুট উপরে , তখন সেটা অবশ্যই বেখেয়ালে বলা। স্ফুটনাঙ্ক দিয়ে মাপলে এর উচ্চতা, তাঁর হিসেবে, ২৮০০ ফুট আর ব্যারোমিটারের হিসেবে ৩০০০ ফুটের সামান্য বেশি।
ডাক্তারের অভিযোগ অনেক। তিনি জাঞ্জিবারের সবাইকে তাঁকে স্বাধীন মানুষ পাঠানোর জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন। তবু শুধুই ক্রীতদাসদের মারফত তাঁর মালপত্র পাঠানো হয়েছিল। যাঁদের উপর তিনি মালপত্র সরবরাহের দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা একটুখানি চেষ্টা করলেই ঠিকঠাক, বিশ্বস্ত স্বাধীন লোক জোগাড় করতে পারতেন। তবে তাঁরা যদি ডক্টর লিভিংস্টোনের চিঠি পেয়ে দলের লোক জোগাড়ের দায়িত্ব লুধা দামজিকে দেন, তাহলে যে শুধু অসৎ, অক্ষম দাসদেরই পাঠানো হবে তাতে আর আশ্চর্য কি! একজন নিগ্রো স্বাধীন মানুষ একজন ক্রীতদাসের চেয়ে একশগুণ বেশি সক্ষম আর বিশ্বস্ত। ডাক্তার যখন এই কথাটা বলেন, তখন এমন তো নয় যে তিনি একটা অজানা ব্যাপার আবিষ্কার করে ফেলেছেন। কয়েক শতাব্দী আগে পশুপালক ইউমাইউস ইউলিসিসকে বলেছিলেন: “জোভ এটা নিশ্চিত করেছেন যে যেদিনই একজন মানুষকে দাস বানানো হয়, তার অর্ধেক মূল্য উবে যায়।” ডাঃ লিভিংস্টোন বলেছেন যে তিনি বারবার ডাঃ কার্ককে তাঁকে ক্রীতদাস না পাঠাতে অনুরোধ করেছেন। ওঁর থেকে ভাল তো কেউ জানে না যে তারা কতটাই অবিশ্বস্ত হয়! বোঝাই যায় যে প্রত্যেক বার এই অপদার্থগুলো তাঁর কাজে বাধা দিত, তাঁকে হতাশ করত আর তাঁর কাছে নিজের এই মিশন যে কতটাই আশাহীন সেটাই তিনি ভাবতেন। উভয়ের বন্ধু স্থানীয়দের কাছে অবশ্য এটা খুবই দুঃখের যে এই বিষয়ে ডঃ লিভিংস্টোনের অনুরোধ গুলি ঠিকমত অনুধাবন করার চেষ্টা করাও হয়নি।
আরও একটা ব্যাপারও আছে। সেই দিকেও আমি কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। আর সেটা হল, লিভিংস্টোনের চিঠি পত্রে কলম চালানোর ব্যাপারে। মধ্য আফ্রিকার একজন ভ্রমণকারী যদি কিছু আবিষ্কার করে ফেলেন, তা সে হ্রদ, পর্বত, সমতল বা নদী যাই কিছু হোক না কেন, আর তার আবিষ্কার সম্বন্ধে কোন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, তবে তার দেওয়া যুক্তির দাম আর সব কিছুর থেকে বেশি। প্রায়শই কারণগুলি একাধিক হয় - একটা চিঠিতে লেখার পক্ষে বড্ডই বেশি কারণ - জায়গার অভাবে সেগুলোকে তিনি চেপে যেতে বাধ্য হন, যতক্ষণ না তিনি সব কিছু নিয়ে একটা বই লিখতে পারেন। এইসব ক্ষেত্রে, এটা অবশ্যই সকলের কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, ঘরে বসে থাকা ভূগোলবিদরা, সঠিক তথ্যের অভাবে, মূল আবিষ্কারক ও অভিযাত্রীর পাঠানো লেখার উপর হাত চালাতে পারে না; আর তাদের মধ্যে কোন তথ্যকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে বা হবে না সে বাবদে কোন কথাকেই চাপিয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত অভিযাত্রীদের দেওয়া তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যারা উঠে পড়ে লেগেছেন, তাঁদের বিরোধী মনোভাবের ভিত্তিতে জমা হওয়া মতামতও পাঠকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না।