ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে উকাওয়েন্ডি, উভিনযা ও উহহা-র মধ্য দিয়ে উজিজি যাত্রার বর্ণনা। তরজমা স্বাতী রায়
২৫ শে অক্টোবর দিনটা আমার মনে থাকবে। যা সব ঝামেলা হয়েছিল! আসলে, এদিন থেকে পরপর একটার পর একটা ঝামেলার হতে শুরু চলল। আমরা একটা পুবমুখো রাস্তা ধরে চলছিলাম। যে মালভূমিটা পশ্চিম আর উত্তর দিক থেকে ইমরেরার উপত্যকাকে ঘিরে আছে, সেটাই আমাদের গন্তব্য। আড়াই ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা তার পায়ের কাছে শিবির করলাম। এই মালভূমি ধাপে ধাপে খাড়াই হয়ে ইমরেরা উপত্যকার থেকে এক হাজার ফুট উপরে উঠে গেছে। একটা গিরিসঙ্কট এই মালভূমির চূড়ায় আরোহণের একটা সম্ভাব্য উপায় বলে মনে হয়েছিল।
বুঝেছিলাম যে আমার লোকরা এখানে একদিন থামতে চায়, এখানকার আর মালাগারাজুর মধ্যের এলাকার ধরণধারণ সম্বন্ধে ইমরেরা থেকে আরও বেশি খবরাখবর জোগাড় করতে চায়। এসব অবশ্য বাজে কথা ছিল, কারণ আমরা আগেই একদিন ইমরেরাতে ছিলাম, আর গাইডরা আমাকে এই রাস্তা ধরতে বলেছিল, কারণ - তারা যুক্তি দিয়েছিল যে - তারা এখানকার স্থানীয় লোকদের থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়েছে। আমার মনে পড়ে গেল, এক তরুণ বন্ধুকে দেওয়া জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের উপদেশ, সেটা ছিল, 'কোন কাজ করার আগে ভালো করে সব খতিয়ে দেখে নাও, কিন্তু, একবার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ার পরে, যাও আর কাজটা করো, আর একদম পিছনে তাকিও না', একদম এইটাই আমি করতে চেয়েছিলাম।
রাতের দিকে আমার একজন লোক একটা মোষকে গুলি করল; এই ছোট্ট ঘটনাটা ঘিরে মতবিরোধ, ক্রুদ্ধ শোধবোধের কারণ হয়ে দাঁড়াল। মোষটা জঙ্গলে পালিয়ে যেতে পেরেছিল, সেখানেই পরের সকালে তাকে মরা অবস্থায় পাওয়া গেল। কয়েকজন হ্যাংলা, আলসে পেটুক আমাকে জিজ্ঞাসা করল যে আরও একটামাত্র দিন এখানে থাকব কিনা, যাতে তারা মাংস খেয়ে গায়ের জোর করতে পারে। 'আগামীকাল সূর্যোদয়ের পরে আর এক ঘণ্টাও নয়,' এই ছিল আমার উত্তর। তখনই চেঁচামেচি শুরু হল, 'না "পোশো" - খাবার।? 'তোমাদের কাছে তিন দিনের খাবার আছে ,' আমি উত্তর দিলাম; "আরও লাগলে কিনে আন, এই যে কাপড়: যাও, কিনে আনো।'’
কিন্তু, কেনাকাটার জন্য গ্রামে যাওয়ার কথায়, প্রত্যেকেই ভয়ানক ক্লান্তির অজুহাত দিতে থাকল। তবে এও জোর দিয়ে বলে যাচ্ছে যে, আরও একদিন আমি থামতে বাধ্য , কারণ, তারা শস্য কিনে আনলেও, শস্য খাওয়ার আগে সেটা তো ভাঙ্গাতে হবে। আহ্লাদী লোকরা এইসব কথা অনেকক্ষণ ধরে বলে গেল। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। সারারাত ধরে তারা আলোচনা করল যে কী করলে আমি থামবই থামব; তবে বোম্বে ও মাব্রুকিকে আগেই নিষেধ করেছিলাম, আমার কাছে এরকম কোনো আবদার করতে, হীনানের [1] যুদ্ধের যন্ত্রণার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, এবং স্পেকের থেকে বোম্বে যে ভয়ানক শাস্তি পেয়েছিল সেটা তার ভালই মনে ছিল, আবার তার পুনরাবৃত্তি সে চায় না।
পরের দিন সকালে, সূর্যোদয় হতেই, হাঁটতে শুরু করার হুকুম দিলাম। যতটা সম্ভব কঠোর ও আপোসহীন সুরে। যাতে কেউ থামার আবদার জোরার কোন অছিলা না পায়। সবার মুখ হাঁড়ি, প্রায় বিদ্রোহ করার মত মেজাজ, তবে কোন যুক্তিই দেখাতে না পেরে, ঘোর অনিচ্ছাস্বত্বেও শেষে তাদের আমার ইচ্ছাই মেনে নিতে হল। রুগুফু নদীর উৎসে আমাদের শিবিরে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে সবাই মোটাসোটা মোষের দুঃখ ভুলে গেছে আর চমৎকার সরস মেজাজে ফিরে গেছে।
ইমেরার অববাহিকার পশ্চিম ও উত্তর দিক ঘিরে যে উঁচু পর্বতমালা রয়েছে, সেগুলোতে চড়ার সময়, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে বহুদূরে ছড়ানো দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠল। উকাওয়েন্দির প্রাকৃতিক দৃশ্যাদি সব সময়েই জীবন্ত, মনোরম, কিন্তু ঠিক মহিমান্বিত নয়। এই গিরিশিরার ভাঁজে ভাঁজে বেশ কিছু পাঁচিলে ঘেরা গ্রামের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, মনে হয় সেগুলো যুদ্ধের সময় তৈরি করা হয়েছিল।
হাঁটার পথের ধারে অনেক এমবেম্বা ফল ফলে আছে, আর কয়েক মিনিট পরপরই আমি পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছি যে দু-এক'জন লোক মাটিতে পড়ে থাকা ফল দখল করার জন্য ছুটোছুটি করছে।
শিবিরে পৌঁছানোর সামান্য আগে আমি একটা চিতাবাঘের দিকে গুলি ছুঁড়লাম, কিন্তু মারতে পারলাম না, ব্যাটা ছুটে পালাল। রাতভর এমটাম্বু নদীর কাছে সিংহেরা গর্জন করতে থাকল।
ঘন জঙ্গলের গহীন গোধূলিবৎ-ছায়ায় আমরা হাঁটতে থাকলাম।লম্বা পথ হাঁটায় বনের ছায়া আমাদের প্রখর তপনতাপ থেকে রক্ষা করেছিল। পরের দিন আমরা শিবিরে পৌঁছালাম। উজিজি থেকে আগত একদল আরব এই শিবিরটা সদ্যই তৈরি করেছে। তারা এই রাস্তা ধরে উন্যানয়েম্বের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। এতটা আসার পর মিরাম্বো আর আরবদের মধ্যে যুদ্ধের খবরে শঙ্কিত হয়ে তারা ফিরে যায়। আমাদের পথ ছিল রুগুফু নদীর ডানধার ধরে। একটা চওড়া মন্থর জলস্রোত, মাটাটা নলিকা ও প্যাপিরাসের ঝোপে আটকা-পড়া জলধারা । সর্বত্র মোষদের পায়ের ছাপ আর গাদা গাদা নাদা পড়ে আছে। যা সব চিহ্ন তাতে কাছাকাছি যে গন্ডারও রয়েছে তা পরিষ্কার। নদীর কাছেই একটা ঘন গাছের ঝোপড়ার মধ্যে একদল দাড়িওয়ালা, সিংহ সদৃশ বানরের দেখা পেলাম।
২৮ তারিখ সকালে আমরা যখন শিবির ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তখন একপাল মোষ যেন ইচ্ছা করেই আমাদের নজরের আওতায় এল। সবাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলাম, তবে প্রাণীগুলো তার আগেই দারুণ চমকে বুঝে গেল যে তারা এক ভীষণ বিপদের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের পিছু নিলাম, তবে শীঘ্রই তাদের ছুটে পালানোর খুরের বজ্রধ্বনি শুনতে পেলাম, তারপরে আর তাদের অনুসরণ করার কোন মানে হয় না, বিশেষত আমাদের জন্য যখন সামনে জনহীন প্রান্তরের মধ্য দিয়ে একটা সুদীর্ঘ পথ পড়ে আছে।
এখানে পরতে পরতে বেলেপাথর আর লৌহ আকরিক। আজকের রাস্তাটা চলেছে তাদের উপর দিয়ে। জঘন্য জল এখানে, পাওয়াও যায় খুব কম, আর ভয়ানক আকালের সম্ভাবনার করাল ভ্রূকুটি চোখে পড়ছে। ছয় ঘন্টা ধরে চলছি, আর এখনও কোথাও চাষের চিহ্ন চোখে পড়েনি। ক্যাপ্টেন বার্টন যদি নদীর অবস্থান সঠিকভাবে ম্যাপে দেখিয়ে থাকেন তো আমার মানচিত্র অনুসারে, মালাগারজি পৌঁছতে এখনও দুটো দীর্ঘ পদযাত্রা করতে হবে— যদিও স্থানীয়দের কথা অনুসারে এদিনই আমাদের মালাগারজিতে পৌঁছানো উচিত ।
[1] জন সি হীনান (১৮৩৪ - ১৮৭৩) হলেন আমেরিকার বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা। ব্রিটিশ টম সেয়ারস এর সঙ্গে তাঁর মুষ্টিযুদ্ধ ক্রীড়া ইতিহাসে বিখ্যাত। আটলান্টিকের দুপারেই এই প্রতিযোগিতা তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। ১৭ই এপ্রিল ১৮৬০ সালের এই লম্বা চ্যালেঞ্জ যুদ্ধে দুজনেই তুমুল মার খেয়েছিলেন, রক্তাক্ত হয়েছিলেন, তাও দুজনেই শেষ দেখার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন । শেষ অবধি এমনই অবস্থা দাঁড়ায় যে ড্র ঘোষণা করে লড়াই বন্ধ করতে হয়। আর এই তুমুল আলোড়ন তোলা, বেআইনী প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতি হিসেবে এরপর ১৮৬৫ সালে মুষ্টিযুদ্ধের নতুন আইনকানুন তৈরি হয়। বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে আগেকার খালি হাতে লড়ার বদলে বাধ্যতামূলক গ্লাভস পরে খেলার চল হয়।