ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এই পর্বে আরবদের চালান দাস ব্যবসা ও একটি গণহত্যার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
আরবরা যে দেশেই যাক না কেন, নিজের জাতের নাম ডোবাতে তারা সবসময় মুখিয়ে থাকে। তবে এর কারণ অবশ্য আরবের প্রকৃতি, গায়ের রং বা জাত নয়, এর একমাত্র কারণ হল কেবলমাত্র দাস-বাণিজ্য। যতদিন জাঞ্জিবারে দাস-ব্যবসা চলবে, ততদিন এই এমনিতে উদ্যমী আরবদের বিরুদ্ধে গোটা আফ্রিকার আদিবাসীদের ঘৃণা জেগে থাকবে। জাঞ্জিবার থেকে আফ্রিকার অন্দরে যাওয়ার মূল পথ বরাবর এই নিষ্ঠুরতার কাহিনীগুলো অজানা, তার কারণ এই যে এখানকার স্থানীয়দের হাতে বন্দুক ছিল, সেই সঙ্গে কীভাবে সেই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করতে হয় তাও তাদের শেখানো হয়েছিল, আর সেই বন্দুকের ব্যবহারে মোটেই তারা পিছপা ছিল না। আরবরা যখন অনেকটা দেরীতে স্থানীয়দের কাছে বন্দুক বিক্রি করার বোকামোটা বুঝতে পারল, তখন থেকে তারা প্রতিজ্ঞা করেছে যে কেউ ভবিষ্যতে স্থানীয়দের বন্দুক বেচলে তারা সেই বিক্রেতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তারা সকলেই একই দোষে দোষী, সেই সঙ্গে এও আশ্চর্য যে কাজটা করার সময় তারা সেই বোকামিটা বুঝতে পারেনি। আগেকার দিনে আরবরা তাদের বন্দুকধারী দাস দেহরক্ষীদের বলয়ের মধ্যে শুধু একটা লাঠি হাতে উসেগুহহা, উরোরি, উকোনোঙ্গো, উফিপা, কারাগওয়াহ, উন্যোরো ও উগান্ডার মধ্য দিয়ে চলে যেতে পারত; এখন আর কেউই তেমনটা পেরে ওঠেন না। সশস্ত্র বা নিরস্ত্র যেমনই হোক না কেন, তার প্রতিটি পদক্ষেপই বিপদসংকুল। উপকূলের কাছাকাছি সেগুহহারা তাকে আটকে তার থেকে নজরানা দাবি করে, আর না হলে যুদ্ধ করতে বলে; উগোগোতে ঢুকলেও প্রত্যেকদিন তাকে একই রকম কঠিন দাবীর মুখে পড়তে হয় অথবা অন্য কোন ভয়ানক বিকল্প তার সামনে খাড়া করা হয়। ন্যামওয়েজিরাও তাদের থেকে এই সব সুবিধা নিতে এক পায়ে খাড়া, কারাগওয়াহ যাওয়ার রাস্তাটা নানা অসুবিধায় ভরা; ভয়ঙ্কর মিরাম্বো সেই পথে খাড়া দাঁড়িয়ে আর তাদের সম্মিলিত বাহিনীকে হেলায় হারিয়ে দেয়, এমনকি উন্যানয়েম্বেতে তাদের বাড়ির দোরগোড়া অবধি তাদের পিছন পিছন ধাওয়া করে। এমনকি যদি তারা মিরাম্বোকে টপকে যেতে সফলও হয়, আরও একজন প্রধান - স্বরুরু - তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় যে গাঁটরি প্রতি উপঢৌকন দাবি করে - তার বিরুদ্ধে লড়াই করা বৃথা। আরবরা মান্যুয়েমায় যে দাস-ব্যবসা শুরু করেছিল এই মন্তব্য তারই প্রেক্ষিতে । জাঞ্জিবার এবং উন্যানয়েম্বের মাঝের এই সব ভীতিপ্রদ স্থানীয়রা সামান্যতম আঘাতেরও রক্তাক্ত প্রতিশোধ নিতে একটুও ভাবত না। এদের হাতে নাকানিচোবানি খেয়ে, আরবরা টাঙ্গানিকা থেকে সমুদ্রের মাঝের এলাকায় মানুষ অপহরণ করা থেকে বিরত ছিল; কিন্তু মান্যুয়েমায়, যেখানে স্থানীয়রা ভীতু, অসংকল্পবদ্ধ আর ছোট ছোট দুর্বল গোষ্ঠীতে বিভক্ত, আরবরা সেখানে ফের তাদের সকল দুঃসাহসিকতা ফিরে পায়, আবার বাধাহীনভাবে মানুষ অপহরণের নেশায় মেতে ওঠে। এইসব নতুন অঞ্চল থেকে ডাক্তার যেসব বিবরণ সংগ্রহ করে এনেছেন তা অতি কষ্টের। একটা ভয়ঙ্কর কাজের তিনি অনিচ্ছুক দর্শক ছিলেন - লুয়ালাবার তীরের এক লোকজনে জমজমাট এলাকার একটা হাটে বহুদিনের অভ্যাস অনুযায়ী একটা বড় জনসমাগম হয়েছিল। তাদের উপর ঘটা এক গণহত্যার তিনি সাক্ষী হয়েছিলেন। মনে হয় যে মান্যুয়েমার লোকেরা কেনাকাটি করতে খুব ভালবাসে, বিশ্বাস করে যে দরদাম করাটাই মনুষ্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপভোগ। সর্বশক্তি দিয়ে মুদ্রার শেষতম বিন্দুটি অবধি দরাদরি করার মধ্যেই তারা জীবনের সব আনন্দ খুঁজে পায়; আর যখন তারা নিজেদের প্রতিভার প্রয়োগ করে একটা পয়সাও বাঁচাতে পারে, তখন তারা তীব্রভাবে আনন্দিত হয়। বিশেষত মেয়েদের এই কেনাকাটার প্রতি অত্যধিক অনুরাগ, আর, যেহেতু তারা খুবই সুন্দরী, ফলে হাটগুলো ছেলেদের তুমুল আকর্ষণের জায়গা। এমনই একদিনে, তাগামোয়ো নামের এক মিশ্রজাতের আরব, তার সশস্ত্র দাস প্রহরীসহ , মানুষের ঘনসংবদ্ধ জমায়েতে পরের পর গুলি চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা করে। অনুমান করা হয় যে সেখানে প্রায় ২,০০০ জন উপস্থিত ছিল। গুলি চালানোর শব্দ শুনেই গরীব লোকগুলো সবাই ক্যানোর দিকে ছুট লাগায়। গুলি এড়ানোর ভয়ঙ্কর তাড়াহুড়োয়, প্রথম কয়েকজন ভাগ্যবান যারা ক্যানোগুলোকে দখলে নিয়েছিল, প্যাডেল করে ক্যানোগুলো পাড়ের থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল; যাদের কপাল এতটা ভাল ছিল না তারা লুয়ালাবার গভীর জলে ঝাঁপ দিয়েছিল, আর যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই জলভর্তি ক্ষুধার্ত কুমিরের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছিল, বেশিরভাগই নির্দয় তাগামোয়ো ও তার দুর্বৃত্ত দলের ছোঁড়া বুলেটে মারা যায়। আরবদের মতোই ডাক্তারও বিশ্বাস করেন যে প্রায় ৪০০ জন সেদিন মারা যায়। তাদের বেশিরভাগই মহিলা ও শিশু। আর আরও অনেককে দাস বানানো হয়। এই নারকীয় তাণ্ডবটি তার অনিচ্ছাকৃত ভাবে দেখা অনেক ঘটনার মধ্যে একটা। এই অমানবিক অপরাধীদের প্রতি তিনি যে ঘৃণা অনুভব করেন তা বর্ণনার অতীত। মান্যুয়েমার ক্রীতদাসরা তাদের সুচারু গঠন আর বিনয়ী স্বভাবের জন্য অন্য যেকোনো দেশের দাসের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়। ডাক্তার বারবার বলেছেন, এখানকার মেয়েরা অসাধারণ সুন্দরী , আর পশ্চিম উপকূলের নিগ্রোদের সঙ্গে একমাত্র চুল ছাড়া তাঁদের আর কোন মিলই নেই। তাদের গায়ের রং খুব হালকা, চোখা নাক, সুন্দর গড়নের ঠোঁট, মোটেই অতিরিক্ত পুষ্ট নয়, আবার অন্যদিকে এদের মধ্যে ঠেলে-বেরিয়ে-আসা চোয়ালও দেখা যায় না। পূর্ব উপকূলের মিশ্রজাতের লোকদের মধ্যে এই মহিলাদের স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য খুবই আগ্রহ, এমনকি খাঁটি ওমানি আরবরাও তাদের বিয়ে করতে আপত্তি করে না। মান্যুয়েমার উত্তরে, লিভিংস্টোন পর্তুগিজদের বা আমাদের নিজেদের লুইসিয়ানার মিশ্র-কালোদের গায়ের রঙের মতন হালকা- গাত্রবর্ণের মানুষের দেখা পেয়েছিলেন। তারা খুবই ভাল দরের মানুষ, আর বাণিজ্যিক "'সৌন্দর্য' ও সদ্বিবেচনার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানকার মহিলারা ঝিনুক তুলে আনার কাজের দক্ষ ডুবুরি। লুয়ালাবা নদীতে সে জিনিস পাওয়াও যায় প্রচুর পরিমাণে ।
রুয়ার কাটাঙ্গা নামের জায়গাটা তামায় ভরা। এখানকার তামার খনিগুলো বহু যুগ ধরে চলছে। নদীর খাতে সোনাও পাওয়া গেছে, পেন্সিলের টুকরোর মতন আকারে বা ভাঙ্গা মটরদানার মতন বড় বড় টুকরো হিসেবে সোনা ভেসে আসে।