ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে অভিযাত্রীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বনাম তাত্ত্বিক ভূগোলবিদদের ধ্যানধারণা নিয়ে কিছু জরুরি কথা। তরজমা স্বাতী রায়
সংস্থা হিসাবে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ করা থেকে লিভিংস্টোন বিরত ছিলেন; কিন্তু তিনি তাঁর বন্ধু স্যার রডরিক মার্চিসনকে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, আর সেই লম্বা চিঠিতে যা কিছু ছিল, সোসাইটির সভাপতির উচিত ছিল নিজ সংস্থার বৈজ্ঞানিকদের সামনে সেগুলি হাজির করা। তাঁর কাছ থেকে তেমনটাই আশা কার যায়। কিন্তু, লিভিংস্টোন আমাকে যেমন বলেছেন বা অন্যান্য বন্ধুদের কাছে যেমন চিঠিতে লিখেছেন, যে ভয়ের চোটেই তিনি বিশদ বিবরণ দেন নি। পাছে তার পাঠানো খবরাখবরকে ভুল ভাবে নিজের প্রিয় তত্ত্বের খাপ খাওয়াতে সংশোধন করা হয়। অনেক সমালোচক ভুলেই গিয়েছিলেন যে তিনি যা কিছু বলছেন, সেগুলো তিনি অনেক ধৈর্য ধরে অভিযান করে তবেই জানতে পেয়েছেন।
এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আবিষ্কারকরা যেটাকে অবিসংবাদিত সত্যি বলে জেনেছেন, সেটাও বলতে পারবেন না, বললেই তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হবে যে তাঁরা দেশের ভৌগোলিকদের প্রিয় তত্ত্বগুলির বিরোধিতা করার জন্য দল বেঁধেছেন। বা অভিযোগ করা হবে যে সুপরিচিত তথ্যগুলোকে তাঁরা বিকৃত করছেন। বিদগ্ধ মিঃ কুলি' একজন আরবের কথার ভিত্তিতে একটা গোটা মধ্য আফ্রিকা জোড়া বৃহৎ হ্রদের রূপরেখা এঁকেছিলেন। সেই হ্রদ নিয়াসা, টাঙ্গানিকা ও এন'ইয়ানজা ইত্যাদি বেশ কয়েকটা হ্রদকে জুড়ে রয়েছে। এদিকে লিভিংস্টোন, বার্টন, স্পেক, গ্রান্ট, ওয়েকফিল্ড, নিউ, রোশার, ইয়োন্ডারডেকেন এবং বেকার যখন প্রমাণ করলেন যে, এগুলো একটা না অনেকগুলো আলাদা আলাদা হ্রদ, আলাদা আলাদা নামের, দূরে দূরে ছড়ানো, তখন কেন তিনি একবারও স্বীকার করবেন না যে তিনি ভুল করেছেন? একটি বড় একটা হ্রদের জায়গায় ছটা হ্রদ আঁকতে অতিরিক্ত পরিশ্রম তো খুব বেশি লাগত না । আর এই রকম একদল অভিযাত্রীর সাক্ষ্য অবশ্যই একজন আরবের চেয়ে বেশি ওজনের। তবুও আমি যখন বলেছিলাম যে টাঙ্গানিকা নিজেই একটা আলাদা হৃদ; মিঃ কুলি বলেছিলেন যে আমি কানেও শুনি না, বা কিছু বুঝিনা। আর সেই হ্রদ আবিষ্কারের পর থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন বার্টনের প্রতি খাপ্পা। ভৌগোলিক বিষয়ে তার সমস্ত পাণ্ডিত্য থাকা স্বত্বেও, তাঁর এখনও নিজের ভুল স্বীকার করার নৈতিক সাহসের অভাব রয়েছে। মিঃ কুলি ভৌগোলিকদের একটা ছোট অংশের প্রতিভূ। কিন্তু বিশাল অভিজ্ঞতা, পাণ্ডিত্য, এবং উচ্চ বুদ্ধির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই কুলিইজম স্পষ্টতই সংক্রামক; কারণ শখের ভৌগোলিক ডঃ বেকে যখন প্রবল জোর দিয়ে বলছিলেন যে লিভিংস্টোন নীল নদের উৎস মোটেই আবিষ্কার করেননি, তখন আমি অভিযাত্রীদের সমর্থনে মুখ খুলেছিলাম। আর তখন অতীব মধুর স্বভাবের, সদা-হাস্যমুখ মিঃ এফ. গ্যালটন সেটাকে 'একটি চাঞ্চল্যকর গল্প' বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এইরকম জোর দিয়ে চটজলদি মতামত ঘোষণা করা, অবশ্যই, ডাঃ বেকের পক্ষে শোচনীয় বুদ্ধিহীনতার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। সেই মহান অভিযাত্রী, যিনি আফ্রিকার ৪ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ আর ২৫ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে বসে এই বিষয়ে নোট লিখেছেন, তাঁর তুলনায় যে তিনজন ভদ্রলোকের নাম আমি উল্লেখ করলাম, তাঁরা নিশ্চয় বেশি ভরসা যোগ্য নন।
অবশ্য ডক্টর লিভিংস্টোন, এই কুলিইজমকে ঘৃণা করতেন। তাঁর কাছে এর অর্থ গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা ও সংকীর্ণতা, তিনি ঘোষণা করেছেন যে তিনি তাঁর নোটগুলি নিজের কাছেই রাখবেন; আর প্রকৃতপক্ষে, আমার বিনীত মতে, সেটাই একদম সঠিক কাজ । দ্য জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি সকল দেশের প্রকৃত ভূগোলের জ্ঞান প্রচার ও প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সোসাইটি যদি এই কুলিইজম দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং অভিযাত্রীদের আবিষ্কারের বিরুদ্ধে জোর করে কান বন্ধ করে রাখে, তাহলে কী এটি কখনই নিজের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে? এই ধরনের আচরণ কি অভিযাত্রীদের উত্সাহ দেবে? ক্ষুদ্র ঈর্ষা, প্রিয় তত্ত্ব, কাঁচা, অবাস্তব ব্যাখ্যা যদি সদস্যদের প্রভাবিত করে, তাহলে কি মানুষ আফ্রিকার রহস্যময় অভ্যন্তর বিষয়ে বিশ্বের জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার ডলার খরচ করবে?
যা দেখিনি সেরকম কোন কিছুই বিষয়েই আমি আমার নিজস্ব মতামত দিতে যাইনি, কারণ ইতিমধ্যেই আমি যা অপমানিত হয়েছি, আরও যেচে অপমানিত হওয়ার আমার কোন সাধ নেই। দুর্ভাগ্যবশত, আমার উপর বেশ কিছু ভূগোলবিদ অসন্তুষ্ট , কারণ, না বুঝে, আমি এমন একটা কাজ করে ফেলেছি যেটা তাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে থেকে কোন একজন করুক। .
আমি ভাবতাম - এবং সত্যি সত্যি, সারা পৃথিবীই তাই ভাবে - যে তাঁদের মহান সহযোগীর বিষয়ে তাঁরা চিন্তিত ছিলেন - তাঁরা ডেভিড লিভিংস্টোন বেঁচে আছেন কিনা জানতে উদ্বিগ্ন ছিলেন - অন্তত সেরকমই তাঁরা জানিয়েছিলেন। আমেরিকানরাও একই উদ্বেগে ভুগছিলেন; এবং একজন আমেরিকান সংবাদপত্রের মালিক আচমকা মধ্য আফ্রিকায় অনুসন্ধান ও ত্রাণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তিকে পাঠানোর উদ্যোগ নেন। নির্বাচিত ব্যক্তি সফল হয়েছেন, ফের সভ্যসমাজে ফিরে এসেছেন ও ঘোষণা করেছেন যে মহান অভিযাত্রী লিভিংস্টোন বেঁচে আছেন। তখনই খবরটাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে! রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এটাকে ফালতু খবর বলে ঘোষণা করেন; ভাইস-প্রেসিডেন্ট এটাকে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা বলে জানান; কুলিইজম একে বধিরতা ও ভুল ধারণা বলে ঘোষণা করেছে; এবং বেকে নামের একজন ঘোষণা করেছিলেন যে ডাঃ লিভিংস্টোনের ব্যাখ্যাটি অসম্ভব।
প্রায় গোটা ইংল্যান্ড, ও আমেরিকার একটা বড় অংশ বিভ্রান্ত হয়ে যায়; তবে ধীরে ধীরে, এই মহান সত্যের প্রমাণগুলো সামনে এলো। লিভিংস্টোন যে শুধু জীবিত তাই নয়, তাঁর লেখা চিঠি বলে যেগুলো অনুমান করা হচ্ছিল, সেগুলো সত্যিই তাঁর নিজের লেখা, একটাও অন্যের কথা বা অন্যের পরামর্শ সেখানে নেই, অন্য কারোর হাতের ছোঁয়াও নেই। তারপরই শুরু হল হতভাগ্য সংবাদপত্রের প্রতিবেদকের চরিত্রের ওপর হামলা । একজন তাকে 'ভণ্ড, মিথ্যাবাদী' বললেন ; আরেকজন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি নিজের সম্বন্ধে যা যা দাবি করেছেন, তার কোনটাই তিনি নন; অন্যরা ভেবেছিল যে এই অতি- নির্যাতিত সাংবাদিক চিঠিগুলো কোন বার্তাবাহকের থেকে চুরি করেছে; এবং আরও অনেক জঘন্য, অন্যায় চর্চা চলছিল।
(ক্রমশ...)
এই বিনীত সংবাদপত্রের প্রতিবেদককে অনুমতি দেওয়া হোক যাতে সে সকল ভূগোলবিদ, সম্পাদক, পর্যালোচক, সমালোচক ও কুচ্ছাকারীদের জিজ্ঞাসা করতে পারে যে আপনারা যদি আপনাদের যাবতীয় বিতর্ক, তত্ত্ব-আলোচনা, ঝগড়া, অনুমান এবং জল্পনা চালিয়ে যেতেন - হায় ঈশ্বর! বিখ্যাত অভিযাত্রী ডেভিড লিভিংস্টোন তাহলে কোথায় যেতেন, যদি কেউ তাঁর কাছে স্বাচ্ছন্দ্য-স্বাস্থ্য-সাহায্য না নিয়ে যেত?
ডাঃ লিভিংস্টোন ভাবতেই পারেননি যে তার সামান্য বন্ধুটি এই ধরনের আক্রমণের মুখোমুখি হবে, আর আমিও ভাবিনি যে আমার সামান্য প্রচেষ্টাকে এই ভাবে দেখা হবে। আমি তো একমনে কাজটা করেছিলাম, আর কোন রকম হিংসা বা বিদ্বেষের সম্ভাবনার কথা একটুও ভাবিনি। সরলভাবে ভেবেছিলাম যে সৎ ভাবে সত্যি কথা বললে, সবাই সঙ্গে সঙ্গে নির্বিচারে, নিঃসন্দেহে সেকথা শুনবে, নিজের সততা, সম্মানের উপর এহেন আক্রমণের জন্য আমি যে খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম সেটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তার উপর এমন সব লোকের কাছ থেকে আঘাত এসেছিল যেখানে আমি এমন ব্যবহার মোটেই আশা করিনি, আর যেখানে সবচেয়ে বেশি আশা আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে সবচেয়ে বেশি আশা করেছিলাম।
ডাক্তার রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিতে কোনও চিঠিপত্র পাঠানো যে কতটা ঠিক সে নিয়ে গুরুতর সন্দেহ পোষণ করেছেন, কারণ এমন কোন নিশ্চয়তা ছিল না যে তার পাঠানো তথ্যগুলোকে কোন আর্থিক লাভের বিষয় করে তোলা হবে না। সদস্যদের ব্যক্তিগত জ্ঞানৈষা মেটাতে তিনি জ্ঞান ভাণ্ডার উজাড় করে দিতে রাজি ছিলেন। তবে তার আবিষ্কার ভাঙ্গিয়ে অন্য কেউ খাবে এতে তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল।