আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন বহু খুঁজেও পাওয়া গেল না কিঙ্গারু গ্রাম। আবার কয়েকটি জায়গা নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করা গেছে। সেগুলির নীচে লাল দাগ দেওয়া হল, যেমন বাগামোয়ো বা মিকেসে (স্ট্যানলে লিখেছেন মিকেসেহে)। বাগামোয়ো থেকে ‘উসেগুহহা’-র রাজধানী সিম্বামওয়েন্নিতে পৌঁছে এবারে উগোগো অঞ্চলের চুন্যু (চুন্যো) নামক জনপদের লক্ষ্যে চলেছে স্ট্যানলের কাফেলা। উসেগুহহা বলে কোনো স্থান বা প্রদেশ আজ আর নেই। এমনকি বোঝাও মুশকিল সেই অঞ্চলের বিস্তৃতি ঠিক কী ছিল। তবে সিম্বামওয়েন্নি নামে একটি ক্যাম্প-সাইট এখনও রয়েছে তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের কাছে। আন্দাজ করা যেতে পারে এই সিম্বামওয়েন্নি-র কথাই স্ট্যানলে বলছেন। কাজেই এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল বুটি দেওয়া পথের আশেপাশেই।—সম্পাদক
অবশ্যম্ভাবী বিলম্বের সময়গুলোতে শিবিরে বসে বসে ঘেঁষটানো আর ছটফট করার চাইতে পথ চলার সময়ে আমি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ আর দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতাম। আর সে জন্যেই ভয় হয় যে, হাঁটার সময়ের কিছু কিছু ব্যাপার হয়তো একটু রং চড়িয়ে, যতটা দরকার তার থেকে খানিকটা বেশি জোরালো ভাবে উপস্থাপিত হবে। তবে আমার মতে, আমাদের সামনে এরপর যে দৃশ্যটি ফুটে উঠল সেটা সিম্বামওয়েনির বর্ণনাতীত রকমের উর্বর উপত্যকার থেকেও সেটি বেশি দৃষ্টিনন্দন। তরুণ বৃক্ষরাজির ফাঁকে লুকিয়ে থাকা একের পর এক তৃণভূমি চোখের সামনে দেখা দিচ্ছে, দূরের সঙ্গীহীন শৃঙ্গ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাহাড়শ্রেণি ছিল সীমানার দিকে। মাঝে মাঝেই যখন আমরা স্বল্প উঁচু পাহাড়ের মাথায় উঠছিলাম, উত্তর আর পশ্চিম সীমানা বরাবর নীল উসাগারা পাহাড় দেখতে পাচ্ছিলাম। মাঝের বিস্তীর্ণ সমতলভূমিও দেখা যাচ্ছিল।
একটা দীর্ঘ ঢালের পায়ের কাছে, একটা আরামদায়ক শিবিরের জায়গা পাওয়া গেল। বেশ সুন্দর ঝুপড়িও বানানো আছে। জায়গাটা উচ্ছ্বল ঝরনা আর পার্বত্য নালার জলে সিঞ্চিত। একে স্থানীয়রা সিম্ব বলে। যেখানে আমরা উঙ্গেরেঙ্গেরি নদী পেরোলাম, তার থেকে এটা উত্তর-পশ্চিমে মাত্র দু-ঘণ্টা, পাঁচ মাইল দূরে। পাথুরে জমি, পাহাড়ের উপর থেকে জলের ধারায় বয়ে আসা কোয়ার্টজ চূর্ণে ঢাকা। চারপাশে বাঁশের ঝাড়, তার মধ্যে সবথেকে মোটাগুলো প্রায় আড়াই ইঞ্চি ব্যাসের; এ ছাড়াও আছে অ্যাশ গাছের মতো সোজা কাণ্ড-ওয়ালা সুদর্শন ‘এমইয়ম্বো’১ গাছ, ডুমুর২ পাতার মতো বড়ো শাঁসালো পাতাওলা ‘ইম্বাইট’ গাছ, ডুমুর গাছ, কুল গাছ, ‘উগাজা’ বা ঝাঊ গাছ, ছড়ানো ডালপালা ও গোছ-বাঁধা ছোটো ছোটো পাতার শ্বেতখয়ের৩ গাছ, আর শিমুলতুলোর গাছ। সিম্ব-র শিবিরের ধারে কাছে কোনো গ্রাম বা জনবসতি চোখে না পড়লেও পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অনেকগুলো ঘর বেশ জটলা করে আছে। অসততা, এমনকি খুন অবধি করার দুর্নামধারী উসেগুহহার লোকেরা থাকে সেখানে।
চোদ্দো তারিখে আমরা যখন সিম্বোর শিবির ছেড়ে বেরোতে যাচ্ছি, তখন একটা দুর্ঘটানা ঘটল। এই ব্যাপারটা পরে অনেক দিনের অনেক দুশ্চিন্তার মূলে। মালাবার দেশের অধিবাসী বন্দর সালেম আমার কাছে রাঁধুনির কাজ করছিল। আমার মেসের থেকে রেশন চুরির অপরাধে সে এই নিয়ে পঞ্চমবার ধরা পড়েছে। খবর দিয়েছিল আবদুল কাদের আর আরবদেশীয় সেলিম, তারাই চুরির সাক্ষী। আবদুল কাদের আমার দলের সহকারী-রাঁধুনি, দরজি ও অতিরিক্ত কাজের লোক—বন্দর সালেমের সমব্যথী ও প্রাণের-বন্ধু। আগের চারবার নিরপেক্ষ বিচার করে তাকে ক্ষমা করা হয়েছিল। এবার সাক্ষ্য-অনুসারে শ-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে বারো ঘা বেত লাগাতে। জামার উপর দিয়েই বেত মারা হয়েছিল—ফলে খুব মারাত্মক কিছু ছিল না, তবে তার দোষের জন্য যথেষ্ট; তবে তাকে সবচেয়ে কঠোর শাস্তি যেটা দেওয়া হয়েছিল তা হল, তার গাধা ও জিনিসপত্র সমেত শিবির থেকে বের করে দেওয়া আর ঘোষণা করাযে আমি এইরকম কোনো সংশোধনের-অতীত চোর সহ্য করব না। অবশ্য সত্যিসত্যিই তাকে তাড়িয়ে দিতে চাইনি, এমন অবস্থায় ফেলতে চাইনি যাতে রাস্তার প্রতিটি লোভী বর্বর-দস্যুর দয়ায় তাকে বাঁচতে হয়! তবে ভেবেছিলাম যে একটা বড়ো রকমের ভয় হয়তো তাকে শুধরে দেবে। কিন্তু রাঁধুনিটি মুখের কথাই বিশ্বাস করেছিল—তার হাতের বাঁধন খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে টুপি, গাধা বা জিনিসপত্রের পরোয়া না করে শিবির থেকে ছুটে বেরিয়ে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে গেল। বোম্বে ও আবদুল কাদের তাকে ডেকে ডেকে হাল্লা হয়ে গেল। বন্দর সালাম ফিরে এল না, তবে যদি আসে সেই ভেবে আমরা পরের যাত্রা শুরু করার আগে তার গাধাকে তার সম্পত্তি সহ শিবিরের কাছে একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখে এলাম।
উঙ্গেরেঙ্গেরি এবং সিম্বর মাঝের চুড়োগুলো পেরোনোর সময় যে দীর্ঘ প্রশস্ত সমভূমিটি দেখেছিলাম, সেটা এখন আমাদের সামনে। পরবর্তীকালে এই জায়গাটা, যেটা কিনা মাকাটা উপত্যকা বলে পরিচিত, আমাদের অনেক দুঃখের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। এই পর্বে আমরা সিম্ব থেকে উসাগারা পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত রেহেনেকতে যাব। ছয়দিনের হাঁটাপথ। বড়ো বড়ো ঢেউ খেলানো উপত্যকা। কচি বাঁশের জঙ্গলে ঢাকা। ঝরনার দু-ধার দিয়ে ঘন হয়ে বাঁশগাছ জন্মেছে। এ ছাড়াও আছে বেঁটেখাট পাতাবাহার, রাজকীয় তালগাছ এবং শ্বেতখয়ের গাছ। উঁচুনীচু জমির ঢেউ কেটে মাঝে মাঝেই বয়ে চলে নালা-উপচানো জল, দু-পাশের বেতের ও চওড়া-শিষের ঘাসের ঘন বনকে পুষ্টি জোগায়। এই এলাকার থেকেই শুরু হয়েছে, লম্বা লম্বা ঘাসে ঢাকা বিস্তৃত সাভানা, মাঝে মাঝে এক একটা বিচ্ছিন্ন গাছ সে দৃশ্যের একঘেয়েমি ভাঙে। মাকাটা একটি জনহীন প্রান্তর, এতখানি ছড়ানো এলাকায় একটামাত্র উসেগুহহাদের গ্রাম। ফলে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ে প্রচুর হরিণের মাংস মেলে, খুব ভোরের দিকে সাভানায় খাবারের তল্লাশে কুডু, হার্টবিস্ট, অ্যান্টিলোপ ও জেব্রাদের দেখা যায়। রাতের বেলা হায়েনার দল উৎকট ডাক ডাকতে ডাকতে ঘুরে বেড়ায় ঘুমন্ত শিকারের সন্ধানে, তা সে মানুষ বা পশু যাই হোক না কেন।
সাভানা এলাকার কাদা-পাঁক ঠেলে হাঁটাই একটা দুরূহ ব্যাপার। পশু বা মানুষের যেভাবে পা আটকে ধরে তা মারাত্মক। দশ মাইল যেতে আমাদের দশ ঘণ্টা লাগল। অগত্যা আমরা ওই ফাঁকা মাঠের মধ্যে শিবির করতে বাধ্য হলাম, একটা নতুন শিবির এলাকা তৈরি করলাম। আমাদের পরে আধ ডজন অভিযাত্রী দল এই একই জায়গায় থেমেছিল।
প্রায় মাঝরাত অবধি আমাদের ঠেলাগাড়ি এসে পৌঁছায়নি। তারপর গাড়ির সঙ্গে এসে পৌঁছাল তিন-চারজন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত কুলি। আর সেইসঙ্গে এল বোম্বে, তার দুঃখের গল্প নিয়ে। সে তার বোঝা পথের ধারে নামিয়ে রেখে কাদায় আটকে যাওয়া গাড়ি উদ্ধার করতে গিয়েছিল। তারপর যেখানে বোঝা নামিয়ে গিয়েছিল সেখানে ফিরে এসে দেখেছে তার বোঝা নেই। বোঝার মধ্যে ছিল আমাদের জিনিসপত্র রাখার তাঁবু, একটা বড়ো আমেরিকান কুঠার, ওর নিজের দুটো কোট, জামা, পুঁতি আর কাপড়, বারুদ, পিস্তল, ছোটো কাঠ কাটার কুঠার। কিছু চোর-ছ্যাঁচোর থাকে যারা এইরকম কাফেলার পিছু নেয় যাতে কেউ দলছুট হলে তাকে কবজা করতে পারে। বোম্বের ধারণা তারাই ওই বোঝা নিয়ে পালিয়েছে। নিকষ কালো মধ্যরাত্রে এই দুঃখের গল্পটা শুনে আমি মোটেই ভালোভাবে নিইনি। খুবই ক্রুদ্ধভাবে বোম্বেকে তর্জন করলাম, অনুতপ্ত ক্যাপ্টেন সেসব নিজের প্রাপ্য বলে মাথা পেতে নিল। তীব্র ক্রোধে আমি বোম্বের অপরাধগুলো এক এক করে তাকে বললাম, মুহাল্লেহ-তে তার জন্য একটা ছাগল হারিয়েছে। ইম্বিকিতে খামিসি যে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে পেরেছিল সেও তার দোষে, মাঝে মাঝেই সে গাধাদের দেখাশোনার কাজে দণ্ডনীয় রকমের গাফিলতি করে, রাতের বেলা জল ছাড়াই তাদের বেঁধে রেখে দেওয়ার অনুমতি দিয়ে দেয়। সকালবেলা হাঁটা শুরু হওয়ার সময়ও সে বেলা সাতটা অবধি ঘুমায়—কোথায় সকাল সকাল উঠে গাধাদের পিঠে জিন চাপিয়ে তৈরি করে রাখবে যাতে আমরা ছটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে পারি, তা না! আজকাল আবার তার আগুনের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখা যাচ্ছে, থম ধরে আগুনের সামনে সারাক্ষণ গুটিসুটি মেরে বসে থাকে, যেন শরীরে রক্ত বলে কিছু নেই। এখন আবার সে মাসিকা ঋতুর মাঝখানে মাল রাখার তাঁবু হারাল—কাপড়গুলো এবার পচবে, কোনো দাম পাব না। উজিজিতে নৌকা বানানোর কথা ভেবে সঙ্গে আনা বড়ো কুঠারটাও সে হারিয়েছে! আর সব থেকে বড়ো কথা সে পিস্তল আর ছোটো কুড়ুলটাও হারিয়েছে আর সব থেকে ভালো মানের এক ডিবে বারুদও হারিয়েছে। সব মিলিয়ে সে যে ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য কী ভীষণ অযোগ্য! তাকে আমি ক্যাপ্টেনের পদ থেকে হটিয়ে দিলাম আর সে জায়গায় মাবরুকি বার্টনকে বহাল করলাম। উলেদি যে কিনা বোম্বের পিছু পিছু দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন ছিল সেও যেন আর ভবিষ্যতে সৈন্যদের কোনো হুকুম না দেয়। বরং সেও যেন মাবরুকির নির্দেশ মেনে চলে। মাবরুকি একাই এক ডজন বোম্বে ও দু-ডজন উলেদির সমান। শেষকালে দিনের আলো ফুটলেই তাঁবু, কুঠার, পিস্তল, বারুদ, ছোটো কুড়ুল খুঁজতে যাওয়ার হুকুম দিয়ে বোম্বেকে বিদেয় করলাম।
পরের দিন আমরা বিশ্রাম নিতে বাধ্য হলাম। আগের দিনের অভিযানের পর সবাই ভীষণ শ্রান্ত। বোম্বে হারানো জিনিসপত্রের তল্লাশে গেল। কিঙ্গারু, বড়ো মাবরুকি আর ছোটো মাবরুকিকে আমাদের হারানো রাঁধুনির সন্ধানে সিম্বামওয়েনি অবধি পাঠানো হল। আর সেই সঙ্গে ফেরার সময় তিন ডটির খাদ্যশস্য নিয়ে আসতে বলা হল—সেই খাদ্য দিয়েই আমাদের এই জনমানবহীন জায়গায় কাটাতে হবে। তিনদিন কেটে গেল, আমরা সৈন্যদের ফেরার অপেক্ষায় শিবিরে বসেই আছি—ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। এর মধ্যে খাবারদাবার খুবই কমে এসেছে, কোনো শিকারও প্রায় মিলছে না। এখানকার পাখিরা নেহাতই বন্য। দু-দিন ধরে শিকারের চেষ্টার ফলে জোগাড় হয়েছে মাত্র দু-হাঁড়ি পাখির মাংস—মেঠো মোরগ, কোয়েল, পায়রা এই সব। বোম্বে খালি হাতে ফিরে এসেছে, হারানো কিছুরই সন্ধান পায়নি। সে চূড়ান্ত অপমানিত হল।
(ক্রমশ...)