ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে শুরু হল চতুর্দশ অধ্যায়। তরজমা স্বাতী রায়
চতুর্দশ অধ্যায়
ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক মন্তব্যসমূহ (দ্বিতীয় ভাগ)
উয়ানজি অথবা মাগুন্ডা এমকালি ছাড়ার পর থেকে, উন্যামওয়েজি, উকনোঙ্গো, উকাওয়েন্দি, উভিনজা, উহহা, উকারাঙ্গা, উজিজি, উরুন্দি, উসওয়া, উকারাম্বা, উগোমা, উগুহহা, রুয়া ও মান্যুয়েমা এইসব দেশগুলির ভূগোল বা নৃতত্ত্ব বিষয়ে কী কী নতুন তথ্য আবিষ্কার করলাম? এই অধ্যায়টি বিশেষভাবে সেই সব বিবরণ দেওয়ার জন্যই - তাই সেগুলো এবার বলা যাক।
প্রথমেই ধরি উ-ন্যা-মওয়েজি নামের দেশটার কথা। স্থানীয়রা অবশ্য বলে, এর সঠিক উচ্চারণ হল ওও-ন্যা-মওয়েজি। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ বিষয়ে আগের সব লেখকদের থেকে অবশ্য আমি ভিন্নমত পোষণ করি। প্রথম পূর্ব আফ্রিকার অন্দরমহল বিষয়ে কৌতূহল জাগিয়ে তোলার জন্য মেসার্স ক্র্যাফ ও রেবম্যানের কাছে গোটা বিশ্ব ঋণী হয়ে আছে। ইউ-ন্যা-মওয়েজি শব্দটির অর্থ তাঁদের মতে, 'চাঁদের দেশ' । ইউ সর্বদা 'দেশ'-এর উপসর্গ। 'ন্যা' মানে 'এর', মওয়েজি হল 'চাঁদ'। পণ্ডিত ক্যাপ্টেন বার্টনও এই মতের দিকেই ঝুঁকেছেন বলে মনে হয়; কাজেই স্পেকও দ্বিধাহীনভাবে এই ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন। এঁদের আফ্রিকার বিষয়ে গভীর জ্ঞানের উপর আমার যথেষ্ট ভরসা। তবু এঁদের যথাযথ সম্মান জানিয়েও আমি এই ধরনের সুন্দর বিষয়গুলির আলোচনায় আগ্রহীদের বলব যে এক্ষেত্রে একটা কিন্যামওয়েজি শব্দের গায়ে একটা কিসাওয়াহিলি অর্থ জোড়া হয়েছে। কিসাওয়াহিলি ভাষাতে, যদি এটা চাঁদের দেশ হত, তবে এটাকে উমওয়েজি বলা হত। উন্যামওয়েজি একটা কিন্যামওয়েজি শব্দ। শুধুমাত্র শেষ দুটো শব্দাংশের কাকতালীয় মিল থেকে, সুপরিচিত কিসাওয়াহিলি শব্দ mwezi, অর্থাৎ চাঁদ দিয়ে এর মানে বোঝা যাবে না। উন্যামওয়েজি শব্দের ব্যাখ্যা খুঁজতে কিসাওয়াহিলি মাপকাঠিই ব্যবহার করলে তো কিসাওয়াহিলি ভাষায় শেষ দুটি শব্দাংশ ময়েজির-এর অন্য অর্থটাও গ্রহণ করতে পারি, চাঁদ যেমন এই শব্দের অর্থ, তেমন আরেকটা অর্থ তো চোরও।
ক্যাপ্টেন বার্টন বলেছেন যে মিঃ ডেসবোরো কুলি মনে করতেন উন্যামওয়েজি শব্দের অর্থ হিসেবে 'বিশ্বের প্রভু' শব্দটাই বেশি যোগ্য। তাঁর মতে, এর বানান অবশ্য 'মোনোমোইজি' । ক্যাপ্টেন বার্টনের কথার চেয়ে আমার নিজের মিঃ কুলির ব্যাখ্যা বেশি পছন্দ, তবুও আমার ধারণা মিঃ কুলির বক্তব্যের থেকেও আলাদা। ন্যামওয়েজিদের থেকে যতদূর যা জানতে পেরেছি, সেই সঙ্গে এদেশের লোকগাথার থেকে আরবরাও যা শিখেছে, সেটা এইরকম। একদা দেশটার নাম উকালাগাঞ্জা ছিল। পশ্চিমা উপজাতিরা এই নামেই একে জানে। সেই দেশে একসময় মওয়েজি নামে একজন রাজা বাস করতেন -তিনি উয়ানজি থেকে উভিনজা পর্যন্ত সমস্ত দেশ শাসন করেছিলেন। সে ছিল এক মস্ত রাজা; যুদ্ধে তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারত না, তার মতো বুদ্ধি খাটিয়ে আর কেউ রাজত্ব করতে পারেনি। কিন্তু, এই মহান রাজার মৃত্যুর পর, তার ছেলেদের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াই লেগে গেল; আর পরের বেশ কটা যুদ্ধে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ছেলেরা যে যে এলাকাগুলো জিতে নিয়েছিল, সেগুলো আলাদা আলাদা নামে পরিচিত হয়েছিল, দেশের মুল ও বড় অংশটার থেকে আলাদা করে বোঝার জন্য। মূল জায়গাটাকে এখনও উকালাগাঞ্জা নামেই চেনে লোকে। তবে যারা উকালাগঞ্জা দখল করেছিল, আর পুরানো মওয়েজি রাজা যাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে গিয়েছিল, তাকেই যারা স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের মওয়েজির সন্তান হিসাবে বলা হয়। আর সেই হিসাবেই দেশটাও উন্যামওয়েজি নামে পরিচিত হয়েছিল। অন্যান্য অঞ্চলগুলো কোনঙ্গো, সাগোজি, গুন্ডা, সিমবিরি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়। এমফুটো আসার পথে মাসাঙ্গি বলে একটা জায়গা পরে। সেখানকার বুড়ো সর্দার আমাকে এই ঐতিহ্যের কথা জানিয়েছিল। এই তত্ত্বের সমর্থনে এটাই বলব যে উরুন্ডির বর্তমান রাজার নাম মওয়েজি; আফ্রিকার প্রায় প্রতিটা গ্রামের নামই যে কোন না কোন জীবিত বা মৃত শাসকের নামে একথা তো সবাই জানে। যেমন ধরা যাক মিসোংঘি গ্রামের কথা। কুইহারা থেকে বাগামায়ো পর্যন্ত জায়গাটা কাদেতামারে নামে পরিচিত, সেও তাদের সর্দারের নাম; ক্যাপ্টেন বার্টন নিজেই এই ব্যাপারটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন। তাঁর মানচিত্রে জায়গাটা কাদেতামারে বলেই দেখানো। উগোগোর নিয়াম্বওয়া এলাকাও দ্রুত তার পুরানো নাম হারিয়ে ফেলছে। পেমবেরা পেরেহ নামেই জায়গাটা আরও বেশি পরিচিত। সেও ন্য্যামবওয়ার বৃদ্ধ সুলতানের নাম। উকোনঙ্গোতে এমরেরাও সর্দারের নাম, এই জায়গার পুরোনো নাম ছিল কাসেরা। 'এমবোগো', বা 'মোষ'য়ের নামে উকোনঙ্গোর এক বড়, জনবহুল এলাকার নাম; তারপরেও আছে পুম্বুরু, প্রতিবেশী এলাকা উসোয়ার মাপুন্ডার সর্দারের নাম। উগান্ডার নামও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বিখ্যাত রাজা এমটেসার নামেই ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছে; আর কয়েক বছরের মধ্যেই, সম্ভবত এক দশকের মধ্যে, ভবিষ্যৎ অভিযাত্রীরা আরবদের কাছ থেকে শুনতে পাবে উন্যামটেসা বা উমটেসা নামের এক দারুণ দেশের কথা। নাহ; উন্যামওয়েজি শব্দের অর্থ কাব্যিক ভাবে ‘চাঁদের দেশ’ ই বলো, বা বিচ্ছিরি করে 'চোরের দেশ'ই বল, আমি অবশ্যই তাতে আপত্তি জানাচ্ছি। উন্যামওয়েজির মানে খুবই সহজভাবে বললে, মওয়েজির দেশ।
এছাড়া 'নিমিয়ামায়ে', বলে যে দেশটার কথা ডাচ ইতিহাসবিদ ড্যাপার বলেছেন, বলেছেন সেই জায়গাটা আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ষাট দিনের দূরত্বে, ক্যাপ্টেন বার্টন যদি ধরে নেন যে উন্যামওয়েজি-ই সেই দেশ, তাহলে তো তাঁর সঙ্গে অবশ্যই আমার মতের পার্থক্য আছে। দুইশত বছর আগেও, ১৬৭১ সালে উন্যামওয়েজি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে তখন ট্যাঙ্গানিকা থেকে এখানে পৌছাতে মাত্র দশদিন লাগত। সেখানে ঘোড়ার পিঠে চেপেও একজন অভিযাত্রী ষাট দিনেও আটলান্টিক মহাসাগর থেকে উন্যামওয়েজি আসতে পারেনি, এটা অবিশ্বাস্য। তবে মাথায় বোঝা না থাকলে একজন স্থানীয় সম্ভবত সেই সময়ের মধ্যে মান্যুয়েমা পৌঁছাতে পারে; মনে হয় 'নিমিয়ামায়ে' শব্দটা সম্ভবত একটি অপভ্রংশ, মান্যুয়েমা বা 'মান্যুয়েমায়ে'-শব্দের উচ্চারণ শুনে ভুল বোঝার কারণে তৈরি।
আজকের দিনে উন্যামওয়েজি পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরলরৈখিকভাবে প্রায় ১৪৫ মাইল বিস্তৃত; অর্থাৎ, এনগওয়ালাহ নদীর থেকে, মগোঙ্গো টেম্বো ও মাদেদিতার মধ্যে, পূর্বে দ্রাঘিমাংশ ৩৪° থেকে উসেন্যে মানে পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ৩১° ২৫' অবধি - এটাই উকালাগাঞ্জা বা উন্যামওয়েজির পশ্চিম প্রান্ত বলে ধরা হয়; আর উত্তর থেকে দক্ষিণে, ভিক্টোরিয়া এন'ইয়ানজার দক্ষিণ প্রান্ত মানে দক্ষিণ অক্ষাংশ ৩° ৫১' থেকে গোম্বে নদী অর্থাৎ দক্ষিণ অক্ষাংশ ৫° ৪০', এই ১৪৯ ভৌগোলিক মাইল জুড়ে এই দেশের পরিসীমা। ২৪৫০০ মাইলেরও বেশি জায়গা নিয়ে তৈরি একটা বর্গাকার এলাকা।
এই বিশাল এলাকাটা বেশ কটা অঞ্চলে বিভক্ত। যেমন উন্যানেম্বে, উসাগারি, উগুন্ডা, উগারা, মগুরু, মসলালা, উসোঙ্গো, খোকোরো, উসিমবিরি, নাসাঙ্গারো, উগোরো ইত্যাদি; এদের মধ্যে উন্যানয়েম্বে হল উন্যামওয়েজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা - কেন্দ্রীয় অবস্থান ও জনবাহুল্য দুদিক দিয়েই । উন্যানয়েম্বের উত্তরদিকের লোকেরা সুকুমা বলে পরিচিত আর দক্ষিণের লোকদের সবাই টাকামা বলেই জানে । উন্যানয়েম্বেতে পরের শব্দটা খুবই কম ব্যবহৃত হয়, ওই সুকুমারাই যেটুকু যা ব্যবহার করে।
সব মিলিয়ে, সমগ্র পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে উন্যামওয়েজিকে সেরা দেশ বলা যেতে পারে। এটা একটি বিশাল মালভূমি, টাঙ্গানিকার দিকে হালকা পশ্চিমা ঢাল-ওলা। এলাকার একটা বড়ো অংশের জলই এই ঢাল বেয়ে নেমে যায়। আকাশ থেকে পাখির চোখে দেখলে, দেখা যাবে বেগুনি রঙের পাতার কার্পেট বিছানো দিগন্তে প্রসারিত বন। মাঝে মাঝে কার্পেট ফুঁড়ে এখানে-ওখানে ন্যাড়া সমভূমি আর ফাঁকা জায়গা দেখা যায়। জায়গায় জায়গায় কৃষ্ণবর্ণের পাথুরে পাহাড়েরা মৃদু ঢেউ-খেলানো মালভূমির উপরে ভোঁতা শঙ্কুর মতো মাথা তুলেছে - ঝড়ের পরের সমুদ্রের ভারী, ক্লান্ত ঢেউয়ের মতো সেই পাহাড়ের দল ওঠা-নামার তালে তালে দিগন্তের ওপারে চলে গেছে। মগঙ্গো টেম্বোর চারপাশের পাহাড়ের চূড়ার উপর চেপে বসে থাকা সাইনাইটের বিশালাকারের পাথরগুলোর উপরেই হোক, বা এনগারাইসোর পাথুরে কুঁজগুলোর উপরেই হোক, নিজের পছন্দমত যেকোনো একটা সুবিধাজনক উঁচু জায়গায় দাঁড়ালেই একটা অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাবেন। কোন বিশাল পর্বত বা দারুণ উঁচু কিছু নয়; ছবির মতন দৃশ্যও নয় - হয়ত নেহাতই গাদ্যিক, একঘেয়ে বলেই মনে হবে, উয়ানজিতে আসার পথে এরকম দৃশ্য একশ বার দেখেছেন; কিন্তু এই নিতান্ত তুচ্ছ দৃশ্যের মধ্যেও একটা অপরূপ রূপ লুকিয়ে আছে। তরঙ্গোত্তাল সফেন সমুদ্র যেমন অপরূপ, বিষুবীয় সূর্যের নীচে ঘুমন্ত, অসীম আকাশের নীলিমাকে বুকে ধারণ করে রাখা অতল ঝঞ্ঝাহীন সাগর যেমন অপূর্ব; উন্যামওয়েজির অরণ্যের বিশাল, অসীম, দৃশ্যত অন্তহীন ব্যাপ্তির দৃশ্যও তেমনই মহৎ। প্রিজমের সাত রঙের মতন গাছের পাতারা; সুদূরপ্রসারী জঙ্গলকে ঘোমটার মতন ঘিরে রাখা শান্ত, রহস্যময় কুয়াশা ; প্রথমটা দেখায় হালকা নীল রঙের, তারপর ধীরে ধীরে নীলরং আরও গভীর হয়, যতক্ষণ না, বহু দূরে তাকালে একটা আবছা আভা শুধু দেখা যায়; এই আবছা পরিসীমার দিকে তাকালে কেমন যেন মনে ঘোর লাগে, দিগন্তে যে দৃশ্যটি দেখা যায় তার রূপরেখার মতোই অস্পষ্ট সে ঘোর। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সকলেরই মনে হবে যে তার জীবনও যেন এমনই শান্তভাবে উন্যামওয়েজির বনের রূপরেখার মতোই ধীরে ধীরে দিগন্তে মিলিয়ে যায়!