ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে ফের শুরু হল উন্যানয়েম্বের জীবনের বর্ণনা ও ফের লিভিংস্টোনের খোঁজ শুরুর কাহিনী। তরজমায় স্বাতী রায়
২৪ অগাস্ট। এখনও আমার বাড়ির উপরে আমেরিকার পতাকা উড়ছে, আর আরবরা এখনও উন্যানয়েম্বেতে রয়েছে।
সকাল দশটা নাগাদ, তাবোরা থেকে একজন দূত এল, জিজ্ঞাসা করল যে মিরাম্বোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা তাদের সাহায্য করব কিনা। আমার ইচ্ছে করছিল তাদের সাহায্য করার জন্য ছুটে যেতে; তবে এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্ক চলল। নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম, কাজটা কি ঠিক হবে? আমার যাওয়া উচিত? আমি মরে গেলে আমার দলবলের কী হবে? ওরা ফের আমাকে ফেলে পালাবে না? খামিস বিন আবদুল্লাহর কী হল? তারপর আমি জবাব পাঠালাম যে না, আমি যাব না; মিরাম্বোর যে সামান্য দলবল তার বিরুদ্ধে নিজের নিজের টেম্বেতে বসে থাকলেই আরবরা নিরাপদ । আর আরবরা যদি তাকে কুইহারাতে আসতে প্ররোচিত করে তো আমি খুশিই হব, সেক্ষেত্রে আমি তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করব।
ওরা বলছিল যে মিরাম্বো ও তার দলের মাথারা সবসময় মাথায় ছাতা দিয়ে ঘোরে। সে নিজেও ন্যামওয়েজি কুলিদের মত লম্বা চুল-দাড়ি রাখে। যদি সে আসে তো সব ছাতা-মাথায় দেওয়া লোকদের উপরই গুলি বৃষ্টি করা হবে, ভাগ্যের জোরে একটা অন্তত যদি তার গায়ে লাগে এই আশায়। এখানকার লোকদের বিশ্বাস অনুযায়ী আমার একটা রূপোর গুলি বানানো উচিত ছিল। কিন্তু আমার কাছে কোন রূপো নেই। একটা সোনার গুলি বানাতে পারি অবশ্য।
দুপুরের দিকে শেখ বিন নাসিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমার অনুপস্থিতিতে বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য প্রায় ১০০ জন লোককে রেখে গেলাম। এই বুড়ো মানুষটা ছোটখাটো দার্শনিক গোছের। গৌণ দর্শনের অধ্যাপকই বলা যায়। সাধারণত একটু গম্ভীর, নীতিকথার অনুরাগী, ধীর-স্থির মানুষ। তাকেও এত হাল ছেড়ে দিতে দেখে অবাক হলাম। সব নীতিকথা তাকে ত্যাগ করেছে, তার দর্শনবোধ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি। প্রায় মরা মানুষের মত সে আমার কথা শুনছিল, আত্মরক্ষা আর প্রতি-আক্রমণের বিন্দুমাত্র ক্ষমতাও যে তার আছে সেটা তাকে তখন দেখলে বোঝা অসাধ্য!
২৮শে অগাস্ট। আজ আর মিরাম্বোর কোন খবর পাইনি। শ আবার আস্তে আস্তে গায়ের জোর ফিরে পাচ্ছে।
শেখ বিন নাসিব আজ দেখা করতে এসেছিল, দু'একটা ছোটখাটো জ্ঞানের কথা ছাড়া আর বিশেষ কিছু আলাপ হোল না।
এই এলাকাটা নিয়ে খানিক পড়াশোনা করলাম। তারপর ঠিক করলাম, উত্তর উকোনোঙ্গো ও উকাওয়েন্দির মধ্যে দিয়ে, একটা দক্ষিণের রাস্তা ধরে খুব দ্রুতগতিতে কাফেলা নিয়ে উড়তে উড়তে চলে যাব। আজ রাতেই শেখ বিন নাসিবকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হল।
২৯শে অগাস্ট। শ আজ উঠে অল্প একটু কাজকর্ম করতে পেরেছে। কিন্তু হায়রে! আমি যে এত করে প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি অবধি ছকে রাখলাম- নৌকা করে ভিক্টোরিয়া সাগরের উপর দিয়ে যাব, আর সেখান থেকে নীল নদ ধরে এগিয়ে যাব, অথচ মিরাম্বো নামের কালো বোনাপার্টের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে সেসব আশা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। এরই মধ্যে এখানে দু’মাস সময় নষ্ট হয়ে গেছে। আরবরা কোন একটা সিদ্ধান্তে আসতে কত যে সময় নেয়! বহু উপদেশ মেলে, আর আমাদের উপত্যকার অগণিত ঘাসের ফলার মত অসংখ্য কথাবার্তার চাষ হয়; কিন্তু সিদ্ধান্তে আর পৌঁছাতে পারে না। আরবদের আশা-ভরসাও শেষ হয়ে গেছে- খামিস বিন আবদুল্লাহ-ই আর নেই। এনগোয়ানা, ন্যামওয়েজি চারণরা বীর-গাথা গাইবে এমন বীরের দল কোথায়? কোথায় সেই বীর শাসক, মহান আবদুল্লাহ বিন নাসিব? মজিদ-পুত্র সৈয়দ কোথায়? শাসক আছেন জাঞ্জিবারে, আর এদিকে মজিদের ছেলে সৈয়দ আছে উজিজিতে, এখনও জানে না যে তার ছেলে উইলিয়ানকুরুর জঙ্গলে মরে পড়ে আছে।
শ বেশ তাড়াতাড়ি সেরে উঠছে। আমি এখনও সৈন্য জোগাড় করে উঠতে পারিনি। এখান থেকে কি আর কোনদিন রওনা হতে পারব? ভারি হতাশ লাগছে। এ যেন এক ঘুমে-ঢোলা, স্বপ্নে-ডুবে থাকা শামুকগতির দেশ। আরব, এনগোয়ানা, ন্যামওয়েজি সবাই একরকম- সময় বয়ে যাওয়া বিষয়ে ভারি উদাসীন। এদের কাল মানে কখনো কখনো এক মাস সময়ের মধ্যে। মাথা খারাপ করে দেয়!
৩০ অগাস্ট। শ কাজ করবে না। কিছুতেই তাকে হাত-পা নাড়াতে উৎসাহিত করতে পারছি না। অনেক বুঝিয়েছি, বাবা-বাছা করেছি; এমনকি নিজের হাতে তার জন্য ছোটখাটো শখের খাবার রান্না করে খাইয়েছি। আর আমি যখন সর্বতোভাবে উজিজির উদ্দেশে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন শ' উদ্দেশ্যহীনভাবে শুয়ে-বসে থেকেই খুশি। জাঞ্জিবারের সেই সদা প্রস্তুত সাহসী মানুষটার কতই না বদল!
আজ আমার কাজকর্মের সরঞ্জাম নিয়ে ওর পাশে বসলাম, উদ্দেশ্য ওকে উৎসাহ দেওয়া। আজই প্রথম ওকে আমার মিশনের আসল উদ্দেশ্যের কথা জানালাম। বললাম যে এ দেশের ভূগোল সম্পর্কে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই, আমার যাবতীয় আগ্রহ লিভিংস্টোনকে খুঁজে পাওয়া নিয়ে। এই প্রথম তাকে বললাম, ‘প্রিয় শ, তুমি হয়ত ভাবছ যে টাঙ্গানিকার গভীরতা মাপতে আমাকে এখানে পাঠান হয়েছে। না না, তা নয়; আমাকে বলা হয়েছে লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতে। লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতেই আমি এসেছি। আর সে কাজেই আমি চলেছি। ওহে দোস্ত, কাজটার গুরুত্ব বুঝলে? বুঝতে পারছ আমাকে এ কাজে সাহায্য করলে মিস্টার বেনেটের কাছ থেকে কী রকম পুরস্কার পাবে? আমি নিশ্চিত, কখনও নিউইয়র্কে এলে তোমার আর টাকার অভাব হবে না। তাই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠো; একটু লাফালাফি কর, চনমনে হয়ে ওঠো; জোর গলায় বলো যে আমি মোটেই এখন মরব না, তাতেই অর্ধেক যুদ্ধজয় হয়ে যাবে। আঙুল মটকে জ্বরকে তাড়াও দেখি। গ্যারান্টি দিচ্ছি জ্বরে তুমি মরবে না। একটা গোটা সৈন্যদলের জন্য যথেষ্ট ওষুধ আমার সঙ্গে আছে!
বাঃ! বাঃ! একটা প্রাণহীন মমির সাথে যেন কথা বলছি। তার চোখ দুটো একবার সামান্য জ্বলে উঠল, কিন্তু শীঘ্রই আবার ম্লান হয়ে গেল, আলো নিভে গেল। বেশ হতাশ হলাম। শ'কে চাগিয়ে তোলার জন্য একটা কড়া করে পানীয় বানালাম, শিরায় শিরায় যাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়। চিনি ও ডিমের সঙ্গে লেবু, মশলা মিশিয়ে তাকে ধরিয়ে দিলাম। বললাম, ‘খাও, শ, নিজের শোচনীয় দুর্বলতাগুলো ভুলে যাও। ওই রকম শেষ নিঃশ্বাস ফেলার মতন আমার মুখের উপর দীর্ঘশ্বাস ফেল না। এইসব নাটক ছাড়ো। অসুস্থ নও তুমি, হে আমার প্রিয় সহকর্মী; এ শুধু তোমার মনের ক্লান্তি। সেলিমের দিকে তাকিয়ে দেখো। যত টাকাই বল বাজি রাখব যে সে মোটেই মরবে না; তাকে নিরাপদে জেরুজালেমে তার বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দেবই! তুমি যদি আমার হাতে দায়িত্ব ছাড়, তো আমি তোমাকেও বাড়ি ফিরিয়ে দেব বলে কথা দিতে পারি।’
বিশ্রী পাইপটা টানার শব্দ শোন একবার। আর কেমন করে শ্বাস নিচ্ছে দেখ! মনে হবে যেন একেবারে মরে যাচ্ছে; কিন্তু ব্যাটা এমনকি অসুস্থও নয়। এইতো সেদিনই আমাকে বলছিল যে ঘাঘু নাবিকরা সমুদ্রে কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য যত কৌশল করে, সবই তার জানা। আমার তো খুব মনে হচ্ছে এখন সেরকমই কোন একটা কৌশল কাজে লাগাচ্ছে। মাঝে মাঝেই জ্বর! পালাজ্বরের প্রতিটি পর্যায় জানি আমি; আর এও নিশ্চিত যে ওর পালাজ্বর হয়নি।
আর এটাও খুব ভাল করে জানি যে, একবার লাঠি ধরলে ওর সব বজ্জাতি আমি ঘুচিয়ে দেব।
১লা সেপ্টেম্বর। আজ থানি বিন আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে মারোরোতে তার বাড়ি গিয়েছিলাম। সে জানাল যে মিরাম্বো তাবোরা আক্রমণ করতে এসে প্রায় দু'শ লোককে হারিয়েছে, আর আরবদের ক্ষতির তালিকায় ছিল পাঁচজন আরব, তেরো জন স্বাধীন মানুষ আর আটজন ক্রীতদাস- এছাড়াও তিনটে বড় বাড়ি আর একশোরও বেশি ছোট কুঁড়েঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, দুশো আশিটা হাতির দাঁত আর ষাটটা গরু-বলদ শত্রুপক্ষের হাতে পড়ে।
৩রা সেপ্টেম্বর। জাঞ্জিবারের ক্যাপ্টেন ওয়েবের কাছ থেকে চিঠি এবং সংবাদপত্রের একটি প্যাকেট পেয়েছি। এই একটা ভাল ব্যাপার যে বন্ধুরা, এমনকি সুদূর আমেরিকাতে বসেও, আফ্রিকায় থাকা একজন অনুপস্থিত মানুষকে স্মরণ করে! তারা বলছে, আমার আফ্রিকায় যাওয়াটা কেউ স্বপ্নেও ভেবে উঠতে পারেনি।
লিভিংস্টোনের কাফেলাকে আমার দায়িত্বে উজিজিতে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে আজ শেখ বিন নাসিবের কাছে আবেদন করলাম। কিন্তু সে কথা কেউ শুনল না। আমি নাকি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
(ক্রমশ...)