ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। শুরু হচ্ছে একাদশ অধ্যায়। চলছে উকাওয়েন্ডি, উভিনযা ও উহহা-র মধ্য দিয়ে উজিজি যাত্রার বর্ণনা।। তরজমা স্বাতী রায়
১৮ অক্টোবর, রোজকার মতন সময়ে শিবির গুটিয়ে, আমরা উত্তর-পশ্চিম দিকে এগোতে থাকলাম। এই পথটা কাসেরা পাহাড়ের গোড়া দিয়ে ঘুরে ঘুরে চলেছে। এই পথ ধরে চলতে গিয়ে আমাদের সব রকমের অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অন্তত এক ডজন জলাযুক্ত গিরিখাত পেরিয়েছি, সেখানে কাদা ও জলের গভীরতা যে আমাদের কী চিন্তায় ফেলেছিল! হাতিদের তৈরি গভীর কালো গর্তে আমার গলা অবধি ডুবে গিয়েছিল। ভেজা, কাদা ও পাঁক লেগে নোংরা জামাকাপড় পরেই রুংওয়া ধারাগুলির জল চোয়ান নদীতলের উপর দিয়ে টহল দিতে হয়েছে। শালীনতা বোধের জন্য জামাকাপড় খুলতে পারিনি, অবশ্য সূর্যের তাতে গায়ে ফোস্কা পড়ার ভয়ও ছিল। তার উপর এই জলাগুলো এতই কাছে কাছে যে ঘন ঘন কাপড় খোলা-পরা করে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। আর দলের সব লোকই নিজের নিজের বোঝা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, আমাকে পার করানোর দায়িত্ব তাদের ঘাড়ে চাপানো নিষ্ঠুরতার নামান্তর। অতএব এই সব জলা, স্রোতের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগোন ছাড়া আর কিছু করার নেই, আমার মত বাকি সকলেও পোশাক এবং সাজ সরঞ্জাম সামলাতে ব্যস্ত, এই সব বিপদের সময় মন যতটা উদাসীন হতে পারে ততই সুবিধা। তবে ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিকর ছিল, অন্তত এইটুকু বলা যায় . . .
শীঘ্রই ভয়ঙ্কর জাভিরাদের এলাকায় ঢুকলাম, কিন্তু কোন শত্রু চোখে পড়ল না। সিম্বা, যুদ্ধ করতে করতে, উজাভিরার উত্তর দিকটা পুরো ফাঁকা করে দিয়েছে। একটা জনশূন্য দেশের মুখোমুখি হলাম। এছাড়া আর বেশি খারাপ কিছু দেখিনি। এই জায়গাটা নিশ্চয় আগে খুব জনবহুল ছিল। ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামের পোড়া ঘর আর ভগ্নাবশেষের সংখ্যা থেকেই তা বোঝা যায়। ক্ষেতের মধ্যে ঘন হয়ে কচি কচি গাছ গজিয়ে উঠছে, আর দ্রুত জঙ্গলের বন্য বাসিন্দাদের থাকার জায়গা হয়ে উঠছে। ওইরকমই একটা জনহীন, ভাঙ্গাচোরা গ্রামে, আমি অভিযানের থাকার জায়গার ব্যবস্থা করলাম, সেগুলি কোনোভাবেই অস্বস্তিকর ছিল না। যে নির্জন গ্রামটা আমরা দখল করেছিলাম সেই মিসংঘির আশেপাশে তিন জোড়া গিনি মোরগ মারলাম, আর আমার শিকারিদের মধ্যে একজন, উলিমেঙ্গো, একটি এন্টিলোপ মেরেছিল। এই এন্টিলোপ হল 'এমবাওয়ালা', কিছু কিছু ন্যামওয়েজি এর মাংস কুসংস্কারবশত এড়িয়ে চলে। প্রায় সাড়ে তিন ফুট উঁচু, লালচে চামড়া, লম্বা মাথা, ছোট শিং, যা বুঝলাম এই প্রজাতির এন্টিলোপ আসলে উগান্ডায় স্পেকের আবিষ্কৃত 'এনজো' অ্যান্টিলোপ। ডঃ স্ক্লাটেরের মতে, এর ল্যাটিন নাম হল 'ট্রাগেলাফাস স্পেকি'। এর বেশ একটা ছোট ঝামর-ঝোমর লেজ ও শিরদাঁড়া বরাবর লম্বা চুল রয়েছে।
একটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ গিয়েছিল। এখানেই সেই সেবল হরিণটি দেখা গিয়েছিল। এই জঙ্গলে শিকারের ছড়াছড়ি। পশ্চিম-বায়ু কোণ বরাবর একটি দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ব্যাপী পদযাত্রা আমাদের একটা নদীর কাছে নিয়ে এলো। নদীটি বয়ে গেছে একটা উঁচু শঙ্কু-আকৃতি পাহাড়ের গোড়া দিয়ে, এই পাহাড়ের ঢালে গজিয়েছে পালকের মতন বাঁশের ঘন বন।
২০ তারিখে, আমরা শিবির ছাড়লাম। শিবির ছিল নদী আর শঙ্কু আকৃতির পাহাড়ের মাঝখানে। পাহাড়ের গোড়া থেকে যে নিচু শৈলশিরা বেরিয়েছে, তাকে টপকে আমরা আবার একটা ছবির মতন দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। দিকে দিকে সুচালো মাথার অনেক অনেক খাড়া পাহাড় সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে। এই মনোরম দেশটির মধ্য দিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চলে আমরা এসে পৌঁছলাম রুংওয়ার অন্যতম উপনদী এমপোকওয়ার কাছে। একটা গ্রাম, জাভিরারা সম্প্রতি তাকে পরিত্যাগ করেছে। কুঁড়েঘরগুলো প্রায় সবই অক্ষত, ঠিক যেমন ভাবে আগের বাসিন্দারা তাদের ছেড়ে রেখে গেছে। বাগানে এখনও শাকসবজি পাওয়া যাচ্ছে, এতদিন মাংস খেয়ে বেঁচে থাকার পরে সেগুলো পেয়ে আমরা ভারি কৃতজ্ঞ। গাছের ডালে তখনও জাভিরাদের বড় বড়, অতি সুনির্মিত মাটির পাত্র ইত্যাদি সাজসরঞ্জাম টাঙ্গানো রয়েছে।
কাছের একটা নদীতে আমার একজন লোক কয়েক মিনিটের মধ্যে একা হাতে সিলুরাস প্রজাতির ষাটটা মাছ ধরে ফেলল। জলের চারপাশে পাখিরা ঘোরাফেরা করছে, যেমন সাদা মাথার মেছো-ঈগল ও মাছরাঙ্গা, বিশাল চেহারার, ধবধবে সাদা চামচে ঠোঁট, আইবিস, মার্টিনস আরও কত কী। এই নদীটা এমপোকওয়া গ্রামের উত্তরের আট মাইল মত দূরের একসারি পাহাড়ের থেকে বেরিয়েছে, সরু সুতোর মতন এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে, দুপাশে লম্বা নলঘাস ও ঘন ঝোপ - শত শত হরিণ ও মহিষের আবাসস্থল। এমপোকওয়ার দক্ষিণে, উপত্যকা চওড়া হয়েছে, আর পাহাড়গুলো পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মোড় নিয়েছে। এই বিন্দুর পরেই শুরু হয়েছে রিকওয়া নামে পরিচিত সমভূমি, মাসিকার সময় প্লাবিত হয়, কিন্তু শুকনো সময়ে সেই একই রকম রং-ঝলসানো চেহারা ধরে। আফ্রিকার সমতলে সাধারণত ঘাস পেকে গেলে এমনটাই হয়ে যায়।
এমপোকওয়ার ডানদিকের পার ধরে নদীর উৎসের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ২১ তারিখে আমরা নদীর উৎসমুখে গিয়ে পৌঁছলাম। উত্তরঙ্গ শৃঙ্গে ঘেরা সুগভীর গিরিখাতের থেকে মূল ধারাগুলি বেরিয়েছে। প্রচুর এমবাওয়ালা আর মোষ রয়েছে সেখানে।
২২ তারিখে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা হাঁটার পরে আমরা এমটাম্বু নামের একটা সুন্দর নদীর পাশে এলাম। মিষ্টি, ঝকঝকে পরিষ্কার জল। উত্তরবাহিনী নদী। এই প্রথমবার সিংহ আর লেপার্ডের আবাসভূমি দেখলাম। এই জায়গাটার সম্বন্ধে ফ্রেইলিগরা কী বলে শুনুন।
যেখানে কাঁটা ঝোপঝাড়
নিবিড় করে ভরে রাখে গাছেদের মাঝের পরিসর, যে সব গাছের ঘন শাখের ফাঁক দিয়ে
সূর্যের আলো ঢুকে আলোকিত করে না কখনও সেই স্থান, সিংহের বাস সেইখানে, রাজাধিরাজ,
অতুল বিক্রমী পশুকুলে; সবাই মানে রাজা বলে,
আপত্তি নেই কারো। সেখানে সে ঘুমোয় দেহ মেলে,
শিকার করে, পেট ভরে খেয়ে; সেখানে তার অবাধ বিচরণ, দেহটা গুটিয়ে নিয়ে ওত পেতে থাকে
রাজামশাইয়ের যখন যেমন মতি হয়।
কবি যেমনটা বলেছেন, ঠিক সেরকমই একটা জায়গার থেকে কয়েক গজ মাত্র দূরে আমরা শিবির তৈরি করেছিলাম। পশুচারকেরা মানে যারা ছাগল-গাধাদের দেখাশোনা করত তারা শিবিরে পৌঁছানোর পরপরই পশুদের জলের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, আর সেজন্য তারা ঝোপঝাড়ের মধ্যের একটা পথ ধরেছিল। হাতি, গন্ডারের পায়ে পায়ে চলা পথ। যেই না সেই অন্ধকার গুহার মত পথে পা রাখা, অমনি একটা কালো দাগওলা চিতাবাঘ লাফিয়ে পড়ল আর একটা গাধার ঘাড়ে থাবা দিয়ে আঁকড়ে ধরল, সে গাধা তো যন্ত্রণায় চিৎকার করে পরিত্রাহি ডাক পাড়তে লাগল। আর তার সঙ্গীরা ভয়ের চোটে এমন সমস্বরে ডাকতে শুরু করল আর এমন জোরে জোরে এই বিড়াল-তস্করের উদ্দেশে বাতাসে পা ছুঁড়তে লাগল যে চিতাটা ঝোপের মধ্য দিয়ে দে দৌড়, যা শোরগোল শুরু হল তার আক্রমণের ঠেলায়, যেন ভয়েই পালাল। গাধাটার ঘাড়ে বেশ ভয়ঙ্কর ক্ষত তৈরি হল, তবে তেমন বিপদের কিছু না এই যা!
লম্বা লম্বা গাছের সারির তলায় ঘন অন্ধকার। গাছেদের দুর্ভেদ্য ছায়ায় গজিয়েছে ঘন ঝোপ। মাংসাশী জন্তুদের গা ঢাকা দেওয়ার জন্য দারুণ জায়গা। ভাবলাম যে ওইখানে একটা সিংহ বা চিতার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অতএব আমার বন্দুকবাহক কালুলুকে সঙ্গে নিয়ে সেই দুর্দান্ত জায়গাতে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। সঙ্গে একটা অতিরিক্ত বন্দুকও ছিল, আর গুলি বারুদও। সাবধানে চলছি, গভীর অন্ধকার গুহার মতন জায়গাগুলো, হাঁটতে হাঁটতে সেখানে ঢোকার পথটুকুই শুধু চোখে পড়ছে, সেগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি, প্রতি মুহূর্তেই আশা করছি যে ঝোপঝাড়ের মধ্যে স্বনামধন্য সম্রাটকে দেখতে পাব। খুব স্ফূর্তিতে মনে মনে কল্পনা করছি যে পশুটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালে না জানি ক্রুদ্ধ প্রাণীর কী মহিমাময় রূপ দেখতে পাব! সবকটা গহ্বরের খোলামুখের সামনে গিয়ে উঁকি মারছিলাম, আশা করছি যে মারাত্মক চকচকে আর রাগী দুটো চোখ দেখতে পাব, আর সেই সঙ্গে সে যখন আমাকে দেখবে, তখন তার ভয়ঙ্কর, চকচকে সামনেটাও দেখব। কিন্তু হায়! এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরেও, কিছুই পাওয়া গেল না, আর ফলে সাহসও বাড়ল, পাতা-মোড়া, কাঁটাঘেরা গুহাগুলোর মধ্যে একটাতে ঢুকে পড়লাম এবং শীঘ্রই আবিষ্কার করলাম যে একটা পাতার ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে আছি। এক সুঠাম, সুউচ্চ রাজকীয় এমভুলে গাছের গুঁড়ির মাথায়, পুরো একশো ফুট উপরে, সেই ছাউনি। এমন অবস্থান কেউ কল্পনা করতে পারে? একটা মোলায়েম লনের মতন ঘাসজমি; চারপাশে ঘন, মারাত্মক বাড়ের দুর্ভেদ্য জঙ্গল; সেই সব রাজকীয় প্রকৃতিজ স্তম্ভগুলো - রাজকীয় বৃক্ষের চমৎকার সারি, অনেকটা উপরে ঝকঝকে সবুজ পাতার রাশি, সেই ঘন পাতার আবরণ ফুঁড়ে সূর্যের একটা রশ্মিও প্রবেশ করতে পারে না, এদিকে আমাদের পায়ের তলায় মসৃণ নুড়িপাথরের উপর দিয়ে আদিম জলস্রোত মৃদুস্বরে কলকল করে বইছে, চারপাশের পবিত্র নীরব দৃশ্যের সঙ্গে একদম মানানসই! প্রকৃতির এই গম্ভীর, পবিত্র একতানকে কে কলুষিত করবে? কিন্তু আমি যখন ভাবছি যে কোনও মানুষকে জায়গাটার শান্ত নির্জনতা ভঙ্গ করার জন্য প্রলুব্ধ করা অসম্ভব, তখনই দেখলাম যে একটি বাঁদর আমার মাথার উপরে উঁচুতে একটা ডালে বসে আছে, আর খুবই অবাক হয়ে এই অদ্ভুত অনুপ্রবেশকারীদের দেখছে আর ভাবছে। সেই দেখে আমি আর না হেসে পারলাম না। জোরে জোরে অনেকক্ষণ ধরে হাসলাম। শেষে যখন ডাকাডাকি, আজব শব্দ সব মিলেমিশে একটা গণ্ডগোল শুরু হল, মনে হল আমার হাসির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই, তখন আমি ক্ষান্ত দিলাম। ওই উপরের পাতার আড়ালে একদল বাঁদর লুকিয়ে ছিল, আমার হাসির আওয়াজে তারা আচমকা জেগে উঠেছে আর ভয়ঙ্কর চিৎকার, হাঁকাহাঁকি করতে করতে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি পালাচ্ছে।
(ক্রমশ...)