ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
১৩ ই মার্চ। লিভিংস্টোনের সাথে আমার থাকার শেষ দিন চলে এল আর পেরিয়েও গেল। শেষ রাতে আমরা একসঙ্গে থাকব, পরের দিনটাকে তো আর এড়ানো যাবে না! যদিও আমার মনে হচ্ছে, যে-ভাগ্য আমাকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে সেই ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি। মিনিটগুলো দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে, জমে জমে ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দরজা বন্ধ, আমরা দুজনেই নিজের নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। তিনি কি ভাবছেন জানি না। আমারগুলো দুঃখের। আমার দিনগুলো যেন স্বর্গসুখে কেটেছে; নাহলে কেনই বা আমি বিদায়ের ঘণ্টার এগিয়ে আসতে এত গভীর কষ্ট পাব? আমি কি পরের পর জ্বরে ভুগি নি, ইদানীংকালে দিনের পর দিন কাতর হয়ে শুয়ে থাকিনি ? আমি কি পাগলের মতন ছুটে বেড়াইনি? আমি কি রাগে হাতের মুঠো পাকাইনি, আর প্রলাপের ঘোরে হতাশার বুনো শক্তির সঙ্গে লড়াই করিনি? তবুও, বহু আয়াসে পাওয়া এই মানুষটির সংসর্গে যে আনন্দ অনুভব করেছি তাকে ফেলে আসতে দুঃখ পাচ্ছি। সময়ের এগিয়ে চলাকে তো আর ঠেকাতে পারব না, এই রাতে সময় যেন আমাকে উপহাস করতেই উড়ে চলছে, আর আমার কষ্ট দেখে আনন্দ পাচ্ছে! তাই হোক তবে! বন্ধুদের বিচ্ছেদবেদনা আগেও কি অনেকবার সহ্য করিনি! আরও কিছু ক্ষণ দেরি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনিবার্যতাকে এড়ানো যাবে না - আমাদের সুসময় ফুরিয়ে এসেছে। একই অনুশোচনার অনুভূতি, শুধু এ যেন আরও মর্মস্পর্শী, যে হয়ত এই বিদায় চিরকালের জন্য! চিরতরে? চিরকালের জন্য? কথাগুলো সকাতর ফিসফিসানি হয়ে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।
আজ রাতে তিনি যা যা বলেছেন সব আমি লিখে নিয়েছি; কিন্তু সেসব শুধুই আমার! পাঠকের সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়া যাবে না।
তিনি নিজেও যেমন নিজের রোজনামচাটিকে ঈর্ষা করেন, তেমনটা ঠিক আমার মনে হচ্ছে। আমি নিজেই গোটা গোটা হরফে জার্মান ভাষায় রোজনামচার দুপাশে আর তার জলরোধী ক্যানভাস কভারের উপর লিখেছি যে, "কখনোই খোলা যাবে না;" আর তাতে তিনি সই করেছেন। তাঁর বন্ধু ও সন্তানদের সুষম ভাবে কৌতূহল মেটানোর জন্য তিনি যা যা বলেছেন, তার প্রতিটা শব্দ আমি স্টেনোগ্রাফ করেছি। আর সেই সঙ্গে তিনি "তাঁর প্রিয় পুরানো বন্ধু স্যার রডরিক মার্চিসন" সম্পর্কে তাঁর শেষ ইচ্ছার কথাও জানিয়েছেন। উগান্ডায় খবরের কাগজ হাতে পেয়ে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে বৃদ্ধ মানুষটি প্যারালাইটিক স্ট্রোকে শয্যাশায়ী, তখন থেকেই তিনি তাঁর সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন। আমি এডেন পৌঁছে তাঁকে অবশ্যই খবর পাঠাবো; প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি যে আফ্রিকার অন্দরে খবর যত গতিতে যায়, তিনি আমার বার্তাটি তাদের সকলের থেকে দ্রুততর পাবেন।
‘‘কাল রাতে, ডাক্তার, আপনি একা!’’
‘‘হ্যাঁ ; মনে হবে বাড়িটাতে যেন কেউ মারা গেছে। বৃষ্টি এখন কাছেই এসে গেছে, সেটা শেষ না হওয়া অবধি আপনি অপেক্ষা করলে ভাল হত।’’
‘‘ঈশ্বর! যদি তাই পারতাম তো থেকেই যেতাম, আমার প্রিয় ডাক্তার। তবে প্রত্যেকটা দিন যখন আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকব, আপনিও আপনার কাজ ও বাড়ির থেকে ততদিন দূরে থাকবেন।’’
‘‘জানি; তবে আপনার স্বাস্থ্যের কথাও তো ভাবতে হবে - এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আপনি প্রস্তুত নন। হয়েছেন কি? আর মাত্র কটা সপ্তাহ। আপনি এখন যতটা দ্রুত যাবেন, বৃষ্টি থেমে গেলে রওনা দিলেও ততটাই তাড়াতাড়ি উপকূলে পৌঁছাবেন। এই জায়গা আর উপকূলের মধ্যেটা পুরো বন্যায় ডুবে যাবে।’’
‘‘আপনি তাই ভাবছেন; তবে আমি চল্লিশ দিনের মধ্যে উপকূলে পৌঁছাব; চল্লিশের মধ্যে না হলেও, পঞ্চাশ দিনে তো নিশ্চিত। আপনার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগছি এই চিন্তা আমাকে উত্সাহিত করবে।’’
১৪ ই মার্চ।
ভোরবেলা উঠে পড়লাম, বোঁচকা-বুঁচকি মালপত্র বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হল, লোকজন ঘরে ফেরার পথে পা বাড়ানোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছিল।
একসঙ্গে একটা বিষণ্ণ ব্রেকফাস্ট করলাম। খেতেও পারিনি, বুকটা টনটন করছে; আমার সঙ্গীরও বিশেষ ক্ষুধা আছে বলে মনে হয় না।
এমন একটা ছুতো খুঁজছিলাম যাতে আরও কিছুক্ষণ একসঙ্গে থাকতে পারি। আটটার সময়ও আমি যাইনি, আর আমি কিনা ভেবেছিলাম সকাল পাঁচটায় রওনা দেব!
‘‘ডাক্তার,’’ আমি বললাম, ‘‘আপনার সঙ্গে দুজন লোক রেখে যাব। তারা আজ আর আগামীকাল আপনার সঙ্গে থাকবে, কারণ এমনও হতে পারে যে আপনি আমার বেরোনোর তাড়ায় কিছু হয়ত ভুলে গেলেন। আপনার শেষ কথা ও শেষ ইচ্ছা জানার জন্য আমি উন্যামওয়েজির সীমান্তে, তুরায় একদিন থামব। আর এবার তাহলে চলি - আর তো কোন উপায় নেই। বিদায়।’’
‘‘ওহ, চলুন আপনার সঙ্গে একটু যাই । কিছুটা এগিয়ে দিই আপনাকে।’’
‘‘ধন্যবাদ। এবার, এই যে সকলে, চল বাড়ি চল! কিরানগোজি, পতাকা তোল, আর হাঁটা শুরু করো !’’
বাড়িটাকে একদম ফাঁকা দেখাচ্ছিল — আস্তে আস্তে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। পুরানো সময়ের কথা, আমার জলন্ত আশা-আকাঙ্খার স্মৃতি মনকে ভারি করছিল। চারপাশের পুরানো পাহাড়গুলো, যেগুলোকে একসময় তুচ্ছ, মাটো-মাটো মনে হত, সেগুলোর সঙ্গে এখন ইতিহাস ও স্মৃতি জড়িয়ে গেছে। ওই বুরজানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি, স্বপ্ন দেখেছি, আশাজাল বুনেছি, কত না দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। ওই গিরিখাঁজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ হতে আর তাবোরা ধ্বংস হতে দেখেছি। এই ছাদের নীচে আমি অসুস্থ হয়েছি, ভুলভাল বকেছি, আর ভাগ্য বিপর্যয়ে নিজের লক্ষ্যকে প্রায় তলিয়ে নষ্ট যেতে দেখে শিশুর মতো চিৎকার করে কেঁদেছি। এই বটগাছের নিচে আমার মৃত কমরেড শুয়ে আছে—বেচারা শ! এই সময়ে তাকে আমার পাশে পাওয়ার জন্য আমি সাত রাজার ধনও দিয়ে দিতে পারতাম! এই বাড়ি থেকে আমি উজিজির দিকে যাত্রা শুরু করি; তার কাছে আবার ফিরে এসেছি যেভাবে লোকে একজন বন্ধুর কাছে ফিরে আসে , সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম একজন নতুন, প্রিয়তর সহচরকে; আর এখন আমি সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ইতিমধ্যেই কেমন যেন একটা অদ্ভুত স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিলাম; দলের লোকেরা জোরে গান গাইছিল। লিভিংস্টোনের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়েছিলাম, তাঁর চেহারা যেন আমার স্মৃতিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধরা থাকে।
‘‘ব্যাপারটা এই যে, ডাক্তার, আমি যতদূর বুঝেছি যে নীল নদের উৎস সম্পর্কে আপনি নিজে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আপনি বাড়ি ফেরার কথা ভাববেন না। নিজে সন্তুষ্ট হলে তবেই আপনি বাড়িতে ফিরবেন আর অন্যদের সন্তুষ্ট করবেন। তাই না?’’
‘‘ঠিক তাই। আপনার লোকেরা চলে এলেই আমি উফিপার উদ্দেশে যাত্রা করব; তারপর, রুংওয়া নদী পেরিয়ে, আমি দক্ষিণ দিকে যাব আর টাঙ্গানিকার শেষ প্রান্ত ছুঁয়ে একটা দক্ষিণ-পূর্ব মুখো পথ ধরে যাব চিকুম্বির কাছে। লুয়াপুলা নদীর ধারটিতে চিকুম্বি । লুয়াপুলা পার হয়ে, আমি সিধে পশ্চিমে যাব, সেখানে কাটাঙ্গায় তামার খনি আছে। এখানকার লোকেরা বলে কাটাঙ্গার থেকে দক্ষিণে আট দিনের পথ পেরোলে নীল নদের উৎস ঝর্ণার দেখা মেলে। সেটা খুঁজে পেলে আমি কাটাঙ্গা হয়ে রুয়ার মাটির নিচের আস্তানায় ফিরে যাব। গুহার থেকে, দশ দিন উত্তর-পূর্বে গিয়ে কামোলোন্ডো হ্রদে পৌঁছাবো। সেই হ্রদ থেকে, আপনার নৌকাটি বেয়ে চলে যাব লুফিরা নদীর উজানে। এই ভাবে লিংকন হ্রদে পৌঁছে যেতে পারব। তারপরে, আবার ফিরে এসে, আমি উত্তরে, লুয়ালাবা নদী ধরে, চার নম্বর হ্রদে যেতে পারি- মনে হয়, এইভাবে পুরো সমস্যাটা ব্যাখ্যা করা যাবে; আর সম্ভবত দেখা যাবে যে এটা হয় চৌয়াম্বে (বেকারের হ্রদ), বা পিয়াজ্জিয়া হ্রদ।’’
‘‘আর এই ছোট্ট যাত্রাপথে কত সময় লাগবে বলে আপনার মনে হয়?’’
‘‘ইউন্যানয়েম্বে থেকে রওনা হওয়ার পরে খুব বেশি হলেও দেড় বছর।’’
‘‘আপনি যা বলছেন, ধরা যাক দুই বছরই লাগল। আপনি তো জানেনই, কতরকমের ঝুটঝামেলা আসতে পারে। এই নতুন লোকদের দু বছরের জন্য নিয়োগ করাই ঠিক হবে; তারা উন্যানেম্বেতে আসার পর থেকেই কাজের দিন গোণা শুরু হবে।’’
“হ্যাঁ, চমৎকার, চলবে।’’
‘‘এবার, আমার প্রিয় ডাক্তার, শ্রেষ্ঠতম বন্ধুদের থেকেও একসময় দূরে সরে যেতে হয়! আপনি অনেকটা চলে এসেছেন, আপনার দোহাই, এবার আপনি ফিরে যান।’’
‘‘ঠিক আছে, যাওয়ার আগে একটা কথা বলি : আপনি যা করলেন তা খুব কম লোকই করতে পারবে - এমনকি আমার জানা কিছু মহান অভিযাত্রীর চেয়েও অনেক ভালভাবে আপনি কাজটা করেছেন। আর আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। ঈশ্বর আপনাকে নিরাপদে গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যান, ও আপনাকে আশীর্বাদ করুন, বন্ধু আমার।’’
‘‘আর ঈশ্বর আপনাকে আমাদের সকলের কাছে নিরাপদে ফিরিয়ে আনুন, প্রিয় বন্ধু। বিদায়!’’
‘‘বিদায় !’’
আমরা একে অপরের হাত ধরে ঝাঁকালাম, আর নিজেকে মুক্ত করার আগে আমি যেন নিজেকে টেনেছিঁড়ে নিয়ে এলাম; কিন্তু আমি পুরোপুরি চলে যাওয়ার আগে সুসি, চুমাহ ও হামোয়দাহ প্রমুখ ডাক্তারের বিশ্বস্ত সহকর্মীরা অবশ্যই আমার সঙ্গে করমর্দন করে হাতে চুমু খাবে । আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না!
‘‘বিদায়, ডাক্তার - প্রিয় বন্ধু!’’
‘‘বিদায়!’’
‘‘চলো! তোমরা থামলে কেন? হাঁটো হাঁটো! বাড়ি যাবে না তোমরা?’’ হাতের কাছের দলের লোকদের খেদাতে শুরু করলাম। আর আমার দুর্বলতা নেই। ওদের এমন হাঁটা দেখাব যে সারাজীবনেও আমাকে ওরা ভুলতে পারবে না। চল্লিশ দিনে সেই পথ পেরোব যা পেরোতে আগে পেরোতে আমারই তিনমাস লেগেছে।
হে পাঠকবন্ধু, এই উপরে বর্ণিত নির্যাসঅংশ প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার ডায়েরিতে লিখেছিলাম। ছ' মাস কেটে গেছে, আমি এখন সেই লেখা দেখছি ; তবুও এ জন্য লজ্জিত নই; সেই বিদায় ক্ষণের স্মৃতিতে এখনও চোখ সামান্য ঝাপসা হয়ে আসছে। আমার অনুভূতি এখনও গভীর, যা লিখেছিলাম তাকে মুছে দিতে বা সংশোধন করতে সাহস হয়নি। ঈশ্বর করুন যেন আপনি যদি কখনও আফ্রিকায় অভিযানে যান তবে আপনি ডেভিড লিভিংস্টোনের মতো একজন মহৎ ও সাচ্চা মানুষকে সঙ্গী হিসেবে পান। যে চার মাস চার দিন আমি তাঁর সঙ্গে একই বাড়িতে বা একই নৌকায় বা একই তাঁবুতে বসবাস করেছি , তার মধ্যে আমি তাঁর কোন দোষ খুঁজে পাইনি। আমার নিজের রগচটা স্বভাব, আর অভয় দিলে বলি যে প্রায়শই যথেষ্ট কারণ ছাড়াই আমি বন্ধুত্ব ছিন্ন করে থাকি; কিন্তু লিভিংস্টোন আমাকে কখনও বিরক্তির কোন বিন্দুমাত্র কারণ দেননি , বরং তাঁর সঙ্গে প্রতিদিনের জীবন যাপন তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধ প্রশংসা বাড়িয়েছে।
উপকূলের দিকে যাত্রা করার সময়ে আমাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করা ছাড়া, পাঠকের সামনে আর একই অভিযানের পুনরাবৃত্তি করছি না।