ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। চলছে ন্যামওয়েজি উপজাতির মানুষদের কথা। তরজমা স্বাতী রায়
গ্রামের মাতৃস্থানীয়রা যখন এটা-ওটা-সেটা নিরীহ কথা কানাকানি করে , তখন পরিবারের কর্তাদের পাওয়া যায় ছেলেদের আড্ডায়। সেখানে জিনিসপত্রের দাম, এলাকার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা চলে। সম্ভবত আরো অনেকটা সভ্য দেশে একই ধরণের জায়গায় যতটা বিচক্ষণতা ও বোধের সঙ্গে এই ধরণের আলোচনা হয়, এখানকার আলোচনাও সেই একই গোত্রের। কিন্যামওয়েজি গ্রামের সকলের একত্রিত হওয়ার জায়গাকে ওদের ভাষায় "ওয়ানজা" বা উওয়ানজা বলা হয়। এটা সাধারণত গ্রামের চৌকোনো জায়গার একটেরেতে থাকে। ফাঁকা সময়ে- অবশ্য ব্যস্ততা খুব কমই থাকে - তারা উবু হয়ে বসে ধূমপান করে, আর সম্ভবত মায়েদের মুখে একটু আগে যে আলোচনা শোনা গেছে, সেই একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। সদ্য আগত সাহেবটি হল সেই বিষয় । এইটুকু আশ্বস্ত হওয়া যায় যে, শ্বেতাঙ্গটিকে নিয়ে আলোচনা হলে সেটা অবশ্যই সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয়; তবে, যতই কৌতূহলোদ্দীপক হোক না কেন, আর তার সম্পর্কে সব কিছু জানার জন্য তাদের যতই প্রাণ ছটফট করুক না কেন, তারা কখনই এতটা নির্বোধ নয় যে অতিথি সত্যি সত্যি শ্বেতাঙ্গ কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবে, বা তার বক্তব্য নিয়ে বিবাদ করবে - সভ্য বলে পরিচিত কিছু লোক তেমনটাও করে বৈকি। কারোর হয়ত বর্শায় ধার দিতে লাগবে, বা তলোয়ারে কারুকার্য করতে হবে বা একটা কুঠারের হাতল তৈরি করতে লাগবে, বা পাইপ ধরাতে হবে, বা নিদেন কিছু গল্প বলতে হবে, তারা সবকিছুই করে ওয়ানজায় এসে। যদি সেখানে কেউ না থাকে, তবে সে তাড়াতাড়ি হাতের কাজ শেষ করে আর গ্রামের প্রধান গাছের নীচে তার দলবলের সন্ধান করে। এমন একটা করে গাছ সব গ্রামেই থাকে। সেখানে গাছের ছায়ায় সে আরামে আড্ডা দিতে বসে।
অ্যাথেন্সের কাছে আগোরা যেমন, এবং আধুনিক সভ্যতার রাজধানীগুলির কাছে এক্সচেঞ্জ যেমন, উন্যামওয়েজির যে কোন গ্রামের কাছে ওয়ানজাও তাই। আগের বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে ন্যামওয়েজিরা ধূমপানে আসক্ত। ওখানে যত বিভিন্ন ধরণের পাইপ পাওয়া যায় তার ছবিগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যাবে যে তারা পাইপ উৎপাদনেও দক্ষ। এটাও লক্ষ্য করা যায় যে তাদের পাইপের শৈলীর সঙ্গে উত্তর আমেরিকার ভারতীয়দের পাইপের খুব মিল। অবশ্য আমাদের ভারতীয়রা তাদের পাইপের জন্য লাল স্টেটাইট ব্যবহার করে আর ন্যামওয়েজিরা ব্যবহার করে কালো স্টেটাইট। এটা পশ্চিম উসুকুমায় পাওয়া যায়। কিন্তু এই নরম পাথর পাওয়া কিছুটা কঠিন। তাই তারা কালো কাদার সঙ্গে মিহি খড় মিশিয়ে তাই দিয়ে পাইপ বানায়। উন্যামওয়েজির তামাক খুব ভালো মানের না। সেই তামাক দিয়ে আবিসিনিয়ার তামাকের দলার মতো তৈরি করে। এক ডটি বা চার গজ কাপড় দিয়ে একটি তিন পাউন্ডের তামাকের দলা কিনতে পাওয়া যায়; আর একই পরিমাণ কাপড়ের বদলে একটা পিতল-তামার সূক্ষ্ম তার দিয়ে সাজানো ডাঁটি-ওলা, কালো স্টেটাইটের পাইপ মেলে।
এখানকার লোকেরা তামাকের সঙ্গে ভাং মিশিয়ে ব্যবহার করতে খুব পছন্দ করে। তাদের নারঘিলেহগুলো (হুঁকো) খুব সাধারণ , একটা লাউয়ের খোল আর একটা নল দিয়ে বানানো। একটা দুটো টানই ভয়ঙ্কর কাশির দমক তোলার জন্য যথেষ্ট, তার দাপটে তাদের সারা শরীর কেঁপে ওঠে বলে মনে হয়। তারা কিন্তু খুবই আনন্দ পায়, কারণ তারা প্রায়শই হুঁকা টানতে বসে; তবে ওই জোরালো কর্কশ কাশি যে কী বিরক্তি তথা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে তা বর্ণনার অসাধ্য।
উন্যানিময়েম্বের ন্যামওয়েজিরা অনেক গবাদি পশুদলের মালিক। যে দেশেই গবাদি পশু দেখা যায়, এটা ধরেই নেওয়া যায় যে সে দেশ মাঝে মাঝেই আক্রান্ত হবে। উপকূল থেকে উজিজির মধ্যে, শুধুমাত্র উসাগারা, উগোগো, উন্যাময়েম্বে ও উহহাতে গবাদি পশু পাওয়া যেত; অন্য সবকটা দেশ শুধু ছাগল, ভেড়া আর মুরগি পালন করে। উন্যাময়েম্বের ধনী আরবদের কারো কারো বিশাল বিশাল গবাদি পশুর দল আছে। এমনকি একেকজনের চল্লিশ পঞ্চাশটা দুধেল গরু আছে। আর কয়েকজন ন্যামওয়েজির অধীনে ত্রিশটিরও বেশি দুধেলা গাভী আছে। একটা দুধ-দেওয়া গরুর দাম বিশ থেকে ত্রিশ ডটি বা ৮০ থেকে ১২০ গজ চাদর; অবশ্য উসুকুমাতে দুই থেকে চার ডটিতেই তা কেনা যায়। একটা গরু আধা গ্যালন দুধ দিলেই যথেষ্ট ভাবা হয়; তবে এরকম খুব কমই হয়: বলা উচিত গড়ে গরু প্রতি তিন পাঁইট দুধ পাওয়া যায় । চার গজ কিতাম্বি বা রঙিন কাপড়ের বিনিময়ে প্রতিদিন এক গ্যালন করে দুধ দশ দিন ধরে পেয়েছিলাম। এই দুধ দিয়ে নিজের মাখন ও চীজ তৈরি করে নিতে অভ্যস্ত ছিলাম। উন্যানিময়েম্বেতে একজন শ্বেতাঙ্গের কাছে এগুলোই সবচেয়ে বড় বিলাসিতা।
অন্য সব নিগ্রোদের মত এই উপজাতির লোকেরাও খুব গান প্রেমিক। গানগুলো গ্রাম্য বটে আর কিছুক্ষণ পরেই একঘেয়ে লাগে, তবে তাদের সেরা গায়করা সবসময়ই গানগুলোকে মজাদার করে তোলে। তাদের মধ্যে অনেকেই মুখে মুখে গান বাঁধতে পারে; সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি, বা রাজনৈতিক খবর বা ব্যক্তিগত কেচ্ছা ইত্যাদি যাতেই লোকের আগ্রহ থাকে, সেটাই গ্রামীণ গানের বিষয় হয়ে যায়। মিরাম্বোর যুদ্ধ ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে, উন্যামওয়েজি জুড়ে এমন একটাও গ্রাম ছিল না যেখানে সন্ধ্যার কোন গানে কোন-না-কোনভাবে মিরাম্বোর নাম নেওয়া হয়নি। সুরগুলো দেশের সেই অংশে সুপরিচিত , শুধু আগের রাজার নামের জায়গায় এখনকার বিখ্যাত রাজার নামটা বসিয়ে দেওয়া। প্রথম আগমনের পরে মুসুঙ্গুও, কখনও কখনও যাকে মুজুঙ্গুও বলা হয়, একটা প্রিয় বিষয় ছিল, তবে শীঘ্রই তার নতুনত্ব কমে যায়।
প্রকৃতপক্ষে গোটা মধ্য আফ্রিকা জুড়ে স্থানীয়দের খাদ্য হল জোয়ারের আটা - জোয়ারকে (মাটামা) হলকাস সোর্ঘাম, বা আরবি ডৌরা, বা ডুরাও বলে। এর আটা দিয়ে এক ধরণের পুরু পরিজ বানানো হয়, একটা পোড়া ঘ্যাট মতন। এর সঙ্গে থাকে বাগানের গাছের পাতা, যেমন শিম বা শসা- সেসব সেদ্ধ করে মেশানো হয়। মাংস খুব দামী আর অনেক প্রাণীর মাংসই তারা মুখে দেয় না, তাই খুব কমই তারা মাংস খায়। এরা দারুণ ভালবেসে ভ্রূণ আর অন্ত্র খায় । আর অন্যের খরচে মাংস পেলে এরা গান্ডেপিন্ডে খেতে ছাড়ে না। আমার কাফেলায় যখন শিকারে সফল হতাম, তখন ন্যামওয়েজিরা সারা রাত ধরে তাদের মাংসের অংশ শেষ করত, যেন এটা তাদের এক পবিত্র দায়িত্ব। ভারতীয় ভুট্টা দিয়ে তৈরি আমেরিকায় প্রচলিত মাশ নামের খাবারটি সমস্ত মধ্য আফ্রিকা জুড়ে সুপরিচিত। এই তুচ্ছ খাবারটা রান্না করার সময় বাড়ির পুরুষরা হাঁড়ির চারপাশে জড়ো হয়, আর তার থেকে বড় এক মুঠো করে বের করে, সেটা সবুজ শাক-বাটা বা ঘি'র মধ্যে ডুবিয়ে মুখে চালান করে দেয়। মহিলারা আলাদা খায়, মহিলা আত্মীয়দের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসেছে এটা কেউ দেখলে সেটা পুরুষদের মর্যাদার পক্ষে অবমাননাকর।
মধ্য আফ্রিকায় খুব বুড়ো মানুষ দেখতে পাওয়া যায় না প্রায়। ধূসর চুল, নুয়ে পড়া পিঠ প্রায় প্রতি গ্রামেই দেখা যায়। উগোগো ও উন্যানয়েম্বের প্রাচীন, সুরক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত এলাকাগুলোতে আমি সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ দেখেছি। কান্যেন্যির সুলতান মাগোম্বার বয়স, অনুমান করি, নব্বইয়ের কাছাকাছি: ১৮৫৮ সালে — চৌদ্দ বছর আগে — ক্যাপ্টেন বার্টন তাকে বৃদ্ধ ও জরাজীর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। সে এখনও বেঁচে আছে, তবে না ধরলে বেশিদূর হাঁটতে পারে না। তার বড় ছেলে কিসেওয়াহের বয়স অবশ্যই ষাটের বেশি। তার ছোট ছেলে মুতুন্ডু এনগোন্ডেহর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মিজানজার সুলতান, যে বার্টন ও স্পেকের বন্ধু স্নি বিন আমেরকে হত্যা করেছিল, আমার মতে তার বয়স আশির নিচে হতে পারে না; ন্যামবওয়া প্রধান পেম্বেরা পেরেহও ওই একই বয়সী হবে।