ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে স্থানীয় রাজাকে ভেঁট দেওয়া নিয়ে মস্ত বিবাদ। তরজমা স্বাতী রায়
একটা কাপড়ের বস্তার উপর বসলাম, দলের বাকি সবাই যে যার নিজের বোঝার উপর বসল, একটা প্রায় অর্ধবৃত্তের আকারে। হাহারা আমার দলের লোকজনের থেকে সংখ্যায় সামান্য বেশি; তবে তাদের শুধু তীর-ধনুক, বর্শা আর লাঠি সম্বল, আমাদের কাছে রয়েছে রাইফেল, মাস্কেট, রিভলবার, পিস্তল ও হ্যাচেট।
সকলেই বসে আছে, একটা গভীর নীরবতা বিরাজমান । আমাদের চারপাশের বিশাল সমতলটি এই উজ্জ্বল দুপুরে একদম শান্ত, যেন সকল প্রাণের ছোঁয়া হীন। এবার প্রধান বক্তব্য রাখল।
উত্তরদিকে মাইল দশেক দূরে কটা ন্যাড়া পাহাড়ের কাছের একটা বড় গ্রামের দিকে দেখিয়ে সে বলল , ‘আমি মিওনভু, কিমেন্যির বড় সর্দার, রাজার পরেই আমি, রাজা ওই গ্রামে থাকেন। সাদা-মানুষের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আরব ও এনগোয়ানারা এই এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় রাজাকে ভেট দেয়, এমনটাই রীতি । সাদা-মানুষ কি রাজার পাওনা মেটাতে চান না? তিনি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? তিনি কি লুকোমো গ্রামে ঢুকবেন না? সেখানে ছায়া আছে, খাবারও আছে - সেখানে বসে তো আমরা ব্যাপারটা শান্তভাবে আলোচনা করতে পারি! নাকি তিনি যুদ্ধ করতে চান? আমি ভাল করেই জানি যে তিনি আমাদের চেয়ে শক্তিশালী। তার লোকদের হাতে বন্দুক রয়েছে, আর হাহাদের তো শুধুই তীর-ধনুক আর বর্শা; তবে কিনা উহাহা বড় জায়গা, আর আমাদের অনেক অনেক গ্রাম। সাহেব যেন নিজের চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখেন - সবটাই উহাহা, যতটা চোখে পড়ছে বা একদিনে যতটা হাঁটা যায় আমাদের এলাকা তার চেয়েও অনেক বড়। উহাহার রাজা শক্তিশালী; তবুও সে সাদা মানুষের সঙ্গে শুধুই বন্ধুত্বের প্রত্যাশী । সাহেব কি যুদ্ধ চান, নাকি শান্তি?’
মিওনভুর বক্তৃতা শেষ হতে তার দলের লোকদের মধ্যে থেকে একটি গভীর সমর্থনসূচক গুঞ্জন উঠল, আর আমার দলের লোকরা অস্বস্তি সহকারে গুনগুন করতে লাগত। কথাগুলো তাদের পছন্দ হয়নি। উত্তর দিতে গিয়ে আমার জেনারেল শেরম্যানের কথাগুলো মনে পড়ল, ১৮৬৭ সালে উত্তর প্ল্যাটের আরাপাহোস ও চেয়েনেস সর্দারদের কাছে তাঁকে বলতে শুনেছিলাম - মিওনভু, কিমেন্যির বড় সর্দারকে দেওয়া আমার উত্তরে সেই বক্তব্যের সুর প্রতিফলিত হল।
‘মহান সর্দার, মিওনভু, আমাকে জিজ্ঞেস করছ আমি যুদ্ধ করতে এসেছি কিনা। মিওনভু কবে শুনেছে যে শ্বেতাঙ্গরা কালো পুরুষদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে? মিওনভুকে বুঝতে হবে যে সাদারা কালোদের থেকে আলাদা। তারা কালোদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে নিজের দেশ ছেড়ে আসে না, এখান থেকে হাতির দাঁত বা ক্রীতদাস সংগ্রহ করতেও আসে না। তারা কালো মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আসে; তারা নদী, হ্রদ এবং পর্বতের সম্বন্ধে জানতে আসে; তারা তোমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল-বাসিন্দা-নদী-হ্রদ-বন-সমতল-পাহাড়-পর্বত এইসব আবিষ্কার করতে আসে; কালো মানুষের দেশের বিভিন্ন প্রাণীদের জানতে আসে, যাতে দেশে ফিরে গিয়ে তারা সাদা রাজাদের, বাচ্চা-বুড়োদের গল্প শোনাতে পারে যে তাদের থেকে এত দূরের দেশে এসে তারা কী দেখেছে, কী শুনেছে। আরব ও এনগোওয়ানাদের থেকে সাদারা আলাদা; সাদারা সব জানে, আর খুব শক্তিশালী। তারা যখন যুদ্ধ করে তখন আরব ও এনগোওয়ানারা পালিয়ে যায়। আমাদের বড় বড় বন্দুক আছে যা গর্জন করে, আর তারা যখন গুলি ছোঁড়ে তখন পৃথিবী কেঁপে ওঠে; আমাদের সঙ্গে এমন বন্দুক আছে যার গুলি যতদূরে তোমার চোখ যায়, তার থেকেও বেশি দুরে যায়।’ আমার রিভলভারের দিকে ইশারা করে বললাম, ‘এমনকি এই ছোট্ট জিনিসটা দিয়েও আমি তোমার দশ গুণে ওঠার আগেই দশজনকে দ্রুত ঘায়েল করতে পারি। আমরা হাহাদের চেয়েও শক্তিশালী। মিয়নভু ঠিকই বলেছে, তাও আমরা যুদ্ধ করতে চাই না। আমি এখনই মিয়নভুকে মেরে ফেলতে পারি, তবুও আমি তার সঙ্গে বন্ধুর মতন কথা বলছি। আমি মিওনভুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই, সব কালো মানুষেরই বন্ধু হতে চাই। মিওনভু কি জানাবে আমি তার জন্য কি করতে পারি?’
এই কথাগুলো তাকে অনুবাদ করা শোনানো হল— আমার মনে হয়, আধা খেঁচড়া অনুবাদ, তবুও মোটামুটি বোঝা যাওয়ার মতন— হাহাদের মুখ দেখে বুঝলাম তারা কথাগুলোর কতটা কদর করছে। একবার বা দুবার মনে হল যে একটু যেন ভয়ের মতন দেখা গেল। তবে আমি জোর দিয়েই বললাম যে আমি শান্তি চাই আর তাদের বন্ধুত্বও কামনা করছি। তাতে ওদের ভয়-টয় কেটে গেল।
মিওনভু উত্তর দিল: ‘সাদা-মানুষ বলছেন যে তিনি বন্ধুত্ব চান। তাহলে তিনি আমাদের গ্রামে আসছেন না কেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভীষণ গরম। মিয়নভু এখানে আর কোন কথা বলবে না। সাদা মানুষ যদি বন্ধু হন, তাহলে তিনি গ্রামে আসবেন।’
‘এবার থামা যাক। এখন দুপুর। তুমি তো আমাদের যাত্রা ভঙ্গ করলে। ঠিক আছে তোমাদের গ্রামেই যাওয়া যাক, সেখানে শিবির হোক,’ আমি বললাম, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম আর দলের সকলকে বোঝা তোলার জন্য ইঙ্গিত করলাম।
শিবির করতে বাধ্য হলাম; আর কোন উপায় নেই; বার্তাবাহকরা কাওয়াঙ্গা থেকে ফিরে আসেনি। গ্রামে ফিরে এসে বোমার মধ্যের কয়েকটা মাত্র গাছের ছায়ার দাঁড়িয়ে মিওনভু নিজের স্বরূপ উদ্ঘাটন করল। প্রায় দুপুর দুটোর সময় বার্তাবাহকরা ফিরে এলো, তারা এসে বলল, সত্যিই কাওয়াঙ্গার সর্দার দশটা কাপড় নিয়েছে; তবে কিনা সেটা তার নিজের জন্য, উহাহার রাজার জন্য তো নয়!
মিওনভু স্পষ্টতই খুব চালাক। আর ভালই জানে তাকে এবার কী করতে হবে। এবার সে চাগিয়ে উঠল আর পাতলা বেত দিয়ে ছোট ছোট বান্ডিল বানাতে শুরু করল। প্রতিটা বান্ডিলে দশটা করে পাতলা বেত। শীঘ্রই সে এরকম দশটা ছোট বান্ডিল হাজির করল, সব গুলো মিলে মোট একশটা বেতের টুকরো। আর জানাল যে প্রতিটা বেতের টুকরো মানে হল একটা করে কাপড়, আর উহাহার রাজার 'ভেটের' পরিমাণ হল একশত কাপড়!— প্রায় দুই গাঁটরি কাপড়!
এ যে প্রায় বর্ণনাতীত দাবি! অবাক ভাব কাটিয়ে আমরা দশ ডটি কাপড় দিতে চাইলাম।
‘দশ! উহাহা রাজার নজরানা! অসম্ভব। লুকোমো থেকে আপনি মোটেও নড়তে পারবেন না যতক্ষণ না আমাদের একশটা কাপড় দেবেন!’ মিওনভু ঘোষণা করল, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে।
কিছু বললাম না, আমার ব্যবহারের জন্য মিওনভু যে কুঁড়েটা সাফ করে দিয়েছিল , সেখানে গেলাম আর বোম্বে, আসমানি, মাব্রুকি ও চৌ পেরেহকে পরামর্শ করার জন্য সেখানে ডাকলাম।
তাদের জিজ্ঞাসা করলাম যে এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে কি উহাহার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া সম্ভব? তারা খুব ঘাবড়ে গেল। বোম্বে খুবই অনুনয়ের সুরে বলল যে আমি যেন কী করতে যাচ্ছি তা ভালভাবে ভাবি, হাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোন মানেই নেই। ‘উহাহা পুরো একটা সমান জায়গা; কোথাও লুকানোর জায়গা নেই। সব কটা গ্রাম আমাদের ঘিরে ধরবে, মোটে পঁয়তাল্লিশ জন লোক কীভাবে হাজার হাজার লোকের সঙ্গে লড়াই করবে? কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে, আর মরে গেলে আপনি কীভাবে উজিজিতে যাবেন? এটা ভেবে দেখুন, কর্তা, আর কটা কাপড়ের টুকরোর জন্য এমন হেলায় জীবন বলি দেবেন না।’
‘হুম বোম্বে, এটা কিন্তু ডাকাতি। আমরা কি ডাকাতির কাছে আত্মসমর্পণ করব? যা চাইবে তাই দিয়ে দেব? এ তো যা দেখছি এরা আমাদের সব কাপড়, সব বন্দুকও চাইতে পারে, আমরা যে আদৌ যুদ্ধ করতে পারি এটা তো এরা বুঝবেই না। আমি নিজেই মিওনভু ও তার প্রধান সাঙ্গপাঙ্গদের মেরে ফেলতে পারর, আর বাকি সব ঘেউ-ঘেউ করা লোকগুলোকে তোমরা মেরে ফেলতে পারবে, খুব বেশি ঝামেলাও হবে না। মিওনভু ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মারা গেলে আর খুব কিছু সমস্যা হবে না, আমরা তখন দক্ষিণে মালাগারাজির দিকে যেতে পারব আর তারপর পশ্চিমে ঘুরে উজিজির দিকে যেতে পারব।’
‘না, না, কর্তা, এরকম একদম ভাববেন না। মালাগারাজির কাছে গেলে হয়ত আমাদের লোকন্দা-মীরার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।’
‘আচ্ছা, তাহলে উত্তর দিকে যাব।’
‘ওই দিকে উহাহা অনেক দূর অবধি ছড়ানো; আর উহাহার পেরিয়ে তুতাদের এলাকা।’
‘আচ্ছা, বলো তাহলে কী করব। কিছু একটা করতেই হবে; এরকম লুটেপুটে নিতে তো দেওয়া যাবে না।’
‘মিওনভু যা চাইছে তাই দিন, আর এখান থেকে চলে যাই আমরা। এইটাই শেষ জায়গা যেখানে আমাদের ভেট দিতে হবে. আর চার দিনের মধ্যে আমরা উজিজিতে পৌঁছে যাব।’
‘মিওনভু বলেছে যে এটাই শেষ বারের মতন টাকা দেওয়া?’
‘বলেছে, সত্যিই বলেছে।’
‘তুমি কি বলো। আসমানী? আমরা কি যুদ্ধ করব নাকি ওদের দাবি মেটাব?’ আসমানীর মুখে হাসি লেগে ছিল, যেমন সবসময় থাকে, তবে সে উত্তর দিল, ‘আমার মনে হয় আমাদের নজরানা দিতেই হবে। এটাই অবশ্য শেষবার।’
আর তুমি, চৌপেরেহ, তুমি কি বলছ?' ‘দিয়ে দিন, কত্তা; এদেশে চুপচাপ মেনে নেওয়াই ভালো। আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী হলে ওরাই আমাদের টাকা দিত। আহা, যদি সঙ্গে মাত্র দুশো বন্দুক থাকত, তাহলে এই হাহারা কেমন লেজ গুটিয়ে পালাত!’
‘তোমার কী মত, মাবরুকি?’
‘ওহ, প্রভু, প্রিয় প্রভু; খুব কঠিন প্রশ্ন, আর এখানকার লোকেরা পাক্কা ডাকাত। ইচ্ছে করছে এদের মাথাগুলো কেটে ফেলে দিই । তেমনই ইচ্ছে করছে। কিন্তু দাবি মিটিয়ে দেওয়াই ভাল. এই শেষবার; আর আপনার কাছে একশটা কাপড় আর এমন কিই বা!’
‘ঠিক আছে, তাহলে, বোম্বে ও আসমানি, মিওনভুর কাছে যাও আর তাকে বিশটি কাপড় দেওয়ার প্রস্তাব দাও। বিশটাতে রাজি না নিলে ত্রিশটা দাও। যদি সে ত্রিশটাও না নিতে চায় তবে তাকে চল্লিশটা দিতে চাও ; এইভাবে ধীরে ধীরে আশি পর্যন্ত যেও। অনেক অনেক কথা বল; তবে আশির উপরে আর একটা ডটিও না। শপথ করছি যে মিওনভু যদি আশির বেশি একটা কাপড়ও দাবি করে, তাহলে তাকে গুলি করে মারব। যাও, বুদ্ধি করে কাজ করো।’
পরের ঘটনা খুব অল্প কথায় বললে, রাত ৯টায়, চৌষট্টিটি ডটি কাপড় মিওনভুর হাতে তুলে দেওয়া হল, এটা উহাহা রাজার জন্য; এছাড়া তার নিজের জন্য ছয় ডটি ও তার অধস্তনদের জন্য পাঁচ ডটিও দেওয়া হল - সব মিলিয়ে পঁচাত্তর ডটি – এক গাঁটরি আর তার উপর আরও এক চতুর্থাংশ! যেই না আমরা কাপড় দিলাম অমনি তার ভাগ নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করল। আমি আশা করছিলাম যে যেই দলগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে মাতবে, সেই তালে আমি তাদের ছেড়ে পালাব। দক্ষিণ দিকে একটা জঙ্গল আছে বলে আমার ধারণা, সেটার মধ্যে ঢুকে পড়ব বলে ভেবেছিলাম। এই জঙ্গলের আড়াল দিয়ে আমরা পশ্চিমদিকে চলে যাব। কিন্তু না, এটা শুধুই কথার যুদ্ধ, একটা ঘোর হট্টগোল ছাড়া আর কিছুই নয়।
(ক্রমশ...)