ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট। আর আমার ধারণা ডাক্তারও তাই মনে করেন। স্যার স্যামুয়েল বেকারকে আলবার্ট এন'ইয়ানজার দৈর্ঘ্য অক্ষাংশ বরাবর ২° যদি বা নাও হয়, ১° কমাতেই হবে। এই বহু পরিচিত অভিযাত্রীটি হ্রদটিকে রুয়ান্ডাদের এলাকার অনেকটা বেশি ভিতরদিকে করে দেখিয়েছেন। আর রুয়ান্ডাকে দেখিয়েছেন তার পূর্ব দিকে। আসলে কিন্তু রুয়ান্ডার পুরোটা না হলেও একটা বড় অংশই হ্রদের উত্তরাংশ জুড়ে, তাঁর মানচিত্রে তিনি সেই জায়গাটাকে উসিগে বলে বর্ণনা করেছেন। রুহিঙ্গার মত একজন বুদ্ধিমান মানুষের কথা ফেলে দেওয়ার না। কারণ, আলবার্ট হ্রদ যদি টাঙ্গানিকার একশো মাইলের মধ্যে থেকে থাকতো, তাহলে এমনকি নিজের চোখে না দেখলেও সে নিশ্চয় এর অস্তিত্বের কথা শুনত। আদতে সে মুতুম্বির লোক। সেখান থেকে মুগিহেওয়াতে এসেছে। আর এখন সেখানকার শাসক। উরুন্ডির মহান রাজা মেওয়েজিকে দেখেছে। তার বর্ণনা অনুসারে প্রায় বছর চল্লিশেক বয়সের মেওয়েজি খুব ভাল মানুষ।
আমাদের কাজ এখন শেষ। মুগিহেওয়াতে বসে থাকার আর কোন কারণ নেই। রুহিঙ্গা আমাদের উপর খুবই সদয় ছিল। আমাদের পেটপুজোর কারণে জবাই করতে একের পর এক বলদ সরবরাহ করছিল। মুকাম্বাও তাই করেছিল। তাদের মহিলারা আমাদের প্রচুর পরিমাণে দুধ এবং মাখন দিয়েছিল। ফলে এখন আমাদের ভাঁড়ারে দুই-ই অঢেল!
ডাক্তার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণের জন্য সারে সারে পর্যবেক্ষণ নথিভুক্ত করেছিলেন। সেই হিসেব মত দেখা গেল মুগিহেওয়া ৩° ১৯' দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থিত।
৭ ডিসেম্বর, খুব ভোরে, মুগিহেওয়া ছেড়ে চললাম। কাতাঙ্গারা দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ প্রান্ত পেরিয়ে, আমরা উয়াশির মালভূমিতে পৌঁছলাম। জায়গাটা মুকাম্বার দেশ ও উভিরার মধ্যের সীমানার কাছে। এই সীমারেখাটি আসলে একটা প্রশস্ত গিরিখাত। খাতের গভীরে ভিড় করে আছে লম্বা, সরল -সুন্দর গাছের দল। এই গাছ থেকে স্থানীয়রা নৌকা তৈরি করে।
ন্যামাবেঙ্গু নদী কিরাবুলার বাজারের কাছে হ্রদে গিয়ে মিশেছে। বার্টন আর স্পেকের টাঙ্গানিকা অভিযানের সময় ওঁরা এই জায়গাটা অবধিই এসেছিলেন। এই জায়গা পেরিয়ে আমরা আরও আধা ঘণ্টার মত হ্রদের পশ্চিম পাড় ধরে দক্ষিণে কাভিম্বার দিকে এগোলাম। সকালের জলখাবার রান্না করতে সেখানে থামা হল।
উভিরার রাজা ম্রুতা যে গ্রামে বাস করত, আমাদের শিবির থেকে সেই গ্রাম দেখা যায়। সেখানে দেখা গেল ঘনঘন মানুষের দল পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামা করছে। গতিক বিশেষ সুবিধার ঠেকল না। অতএব আরও দক্ষিণে চলে যাওয়াই ঠিক হল। এছাড়াও, সেখানে একদল হতাশ-দর্শন জিজি ছিল। আমরা আসার মাত্র কদিন আগেই তারা লুঠপাট চালিয়েছিল। ভিরাদের বিশ্বাস, সেটা আসলে নজরানা এড়ানোর ধান্দা। এমনিতেই এই এলাকাগুলোর মধ্যে এতো এতো যুদ্ধ হয় যে এই এলাকার সাধারণভাবে সুরক্ষার অভাব সম্বন্ধে কিছুটা জানাই ছিল। তার উপর এই সব শুনে-টুনে আমারা আর কাভিম্বাতে থামব না বলেই সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভিরারা একত্র হয়ে আমাদের আক্রমণ করার আগেই আমরা দ্রুত নৌকায় উঠে পড়লাম, আর দক্ষিণ দিকে রওনা হলাম। তখন একটা শক্তিশালী ঝড় দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আমাদের উপর নেমে এসেছিল। ঝড়ের বিপরীতে চলা। এদিকে ঝড়ের বেগ দ্রুত বাড়ছে। প্রায় দুই ঘণ্টার মত ঝড়ের বিপরীতে নৌকা বাওয়ার মতন কঠিন কাজ করার পর, একটা ছোট্ট, শান্ত, ঘন শরবনে ঢাকা খাঁড়ির দিকে নৌকার মুখ ঘোরানো হল। রাতের মত সেখানেই বিশ্রাম।
চারপাশে বিপদ ঘাপটি মেরে আছে জানি। নির্মম, অসভ্য লোকেরাই আমাদের সব থেকে বড় শত্রু, তাদের থেকেই আমাদের যত ভয়। তাই আমরা সর্ব শক্তি দিয়ে কাঁটাঝোপের শক্ত বেড়া তৈরি করতে বসলাম। কাজ শেষ করে তবেই নৈশভোজে বসেছিলাম। তারপর ঘুমাতে যাওয়া। তবে উভিরার দুঃসাহসী চোরেরা নৌকা যদি হাওয়া করে দেয়, তাহলে আমাদের আর দুর্দশার শেষ থাকবে না, সে যে কী বিচ্ছিরি দুর্ভোগ! তাই ঘুমোতে যাওয়ার আগে নৌকা পাহারা দেওয়ার জন্য প্রহরী মোতায়েন করা হল।
ভোরবেলা, কফি, পনির ও ডৌরা কেক দিয়ে একটা সাধারণ প্রাতঃরাশের পর আমরা কুকুম্বা পয়েন্ট ছেড়ে, আবারও দক্ষিণে যাত্রা করলাম। কুকুম্বার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন, সন্দেহ প্রবণ জেলেরা আমাদের আগুন নজর করেছিল; কিন্তু আমাদের সতর্কতা আর বিশ্রামের আগে আমরা যে সজাগ প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলাম, দুয়ের দরুন কিভিরার চোররা হেরে গেল।
যতই এগোচ্ছি, ততই হ্রদের পশ্চিম তীর উঁচু হচ্ছে। উরুন্দির সবুজে ঘেরা পাহাড় বা উজিজির জঙ্গলময় টিলার থেকেও বেশি খাড়া। সামনের সারির পাহাড়গুলো হ্রদের উপরে প্রায় ২৫00 থেকে ৩000 ফুট উঁচু। তাদের চূড়ার খাঁজের ফাঁক দিয়ে পিছনের এক শৈলশিরা দেখা যাচ্ছে। দূরে যে পর্বতমালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরই অগ্রদূত যেন। পর্বতমালার সামনের সারির ফাঁকে ফাঁকে বেশ বড় আকারের বিচ্ছিন্ন পাহাড়গুলি আচমকা খাড়া হয়ে উঠেছে। একেবারে ছবির মতন। এই পাহাড়গুলোর বেশির ভাগেরই হয় গোল, মোলায়েম মাথা-ওলা নাহলে সমতল শীর্ষযুক্ত। এই পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে শৈলশিরা – তার থেকে মাঝে মধ্যে এদিক ওদিকে শৈলান্তরীপ বেরিয়ে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে গেছে - মানচিত্রে এগুলোকে আমি কেপ বা বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেছি।
এই অন্তরীপগুলো গণনা করার সময়, মাপজোক করার জন্য আর সব উল্লেখযোগ্য জিনিসের দিক নির্ণয়ের জন্য আমাদের কম্পাসগুলো উপরে চলে গিয়েছিল। বেশির ভাগ সময়েই এই অন্তরীপগুলো পলিমাটির তৈরি। এর থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে একটা না একটা নদীকে বয়ে যেতে দেখাই যাবে। এই সুন্দর পলিসমৃদ্ধ সমতলকে দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তর দিক থেকে ঘিরে আছে এক জ্যা-বৎ বিশাল পর্বত। অতি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। আপনা থেকেই বেড়ে ওঠা জঙ্গল- এলিস গিনিনসিস পাম গাছের কুঞ্জ ছায়ায় মেটে-রঙ্গা গ্রামগুলো বিরাজিত; রাজকীয়, মহিমান্বিত এমভুলে গাছের গুচ্ছের সারি; উজ্জ্বল সবুজ জোয়ার ডাঁটায় ভরা বিস্তৃত প্রান্তর, মিমোসা বৃক্ষের ছাতার মত মাথার টোপর; সাদা বালির সরু রেখা, তার উপর দেশীয় নৌকা গুলো তুলে রাখা, আছড়ে-পড়া সশব্দ ঢেউয়ের নাগালের অনেক বাইরে— জেলেরা অলসভাবে গাছের ছায়ায় হেলান দিয়ে বসে আছে— টাঙ্গানিকায় ডিঙিতে চেপে জলযাত্রার সময় এই দৃশ্যগুলিই চোখে পড়ে। এরকম বন্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় দৃশ্যের রোমান্সে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, ডানদিকে অন্ধকার, বিশাল পাহাড়ের চূড়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতে হবে— ফুরফুরে অলক মেঘের হালকা স্পর্শ তাদের শিখরগুলিতে, হাওয়া বাড়লে তারা উত্তরে ভেসে যায়। জমে থাকা মেঘেরা থেকে থেকে রূপ বদলায়— পেঁজা তুলোর মতন ধাপে ধাপে সাজানো অলক মেঘের দল বদলে যায় ঘন জল ভারাক্রান্ত ঝড়-বৃষ্টির দূত কৃষ্ণ মেঘে। তারপর দ্রুত মেঘের 'পরে মেঘ জমতে থাকে। পাহাড়-প্রমাণ হয়ে ওঠে। বুঝতে পারি, ঝড় আসছে, এবার আশ্রয় খোঁজার সময়।
মুইকাম্বা পেরিয়ে অনেক লম্বা লম্বা এমভুলে গাছের কুঞ্জ চোখে পড়ে। বেম্বা পর্যন্ত বেম্বেরা পাহাড়ের চূড়া দখল করে আছে, আর ভিরারা পাহাড়ের পায়ের কাছের পলিমাটির সমতলে আর নিচের দিকে ঢালে চাষ করে। বেম্বাতে আমরা জিজিদের কুসংস্কার মেনে পাইপ-কাদামাটির তাল কুড়িয়ে ছিলাম। জিজিরা বিশ্বাস করে এই প্রাচীন রীতি মেনে চললে আমাদের পথ চলা নিরাপদ হবে। এবং সৌভাগ্যও নিশ্চিত।
এনগোভি পেরিয়ে, একটা গভীর বাঁকের কাছে এসে পৌঁছলাম, সেটা দশ মাইল আগে কেপ কাবোগির দিকে বেঁকে গেছে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পথ যাওয়ার পরে আমরা একগুচ্ছ দ্বীপের কাছে এসে পৌঁছলাম, সংখ্যায় তিনটে দ্বীপ, সব কটাই খুব খাড়া, পাথুরে; সবচেয়ে বড়টার গোড়ার কাছে ৩০০ ফুট লম্বা আর প্রায় ২০০ ফুট চওড়া। এখানে রাতের জন্য থামা হল। দ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে পেলাম একটা রংচঙয়ে পালকওলা বুড়ো মোরগ, দ্বীপের আত্মাকে খুশী রাখতে সেটাকে পুজোয় চড়ানো হয়েছে। একটি অসুস্থ হলদেটে থ্রাশ-পাখি, একটা হাতুড়ি-মাথা সারস আর দুটো সমুদ্র-ঈগল। এরা যখন দেখল যে ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে তাদের জন্য যা কিছু সংরক্ষিত ছিল, তার সব কিছুই আমরা দখল করে নিয়েছি তখন সব চেয়ে পশ্চিমের দ্বীপে উড়ে চলে গেল। সেখানে গাছের ডালে বসে গম্ভীর ভাবে আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।