আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন বহু খুঁজেও পাওয়া গেল না কিঙ্গারু গ্রাম। আবার কয়েকটি জায়গা নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করা গেছে। সেগুলির নীচে লাল দাগ দেওয়া হল, যেমন বাগামোয়ো বা মিকেসে (স্ট্যানলে লিখেছেন মিকেসেহে)। বাগামোয়ো থেকে ‘উসেগুহহা’-র রাজধানী সিম্বামওয়েন্নিতে পৌঁছে এবারে উগোগো অঞ্চলের চুন্যু (চুন্যো) নামক জনপদের লক্ষ্যে চলেছে স্ট্যানলের কাফেলা। উসেগুহহা বলে কোনো স্থান বা প্রদেশ আজ আর নেই। এমনকি বোঝাও মুশকিল সেই অঞ্চলের বিস্তৃতি ঠিক কী ছিল। তবে সিম্বামওয়েন্নি নামে একটি ক্যাম্প-সাইট এখনও রয়েছে তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের কাছে। আন্দাজ করা যেতে পারে এই সিম্বামওয়েন্নি-র কথাই স্ট্যানলে বলছেন। কাজেই এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল বুটি দেওয়া পথের আশেপাশেই।—সম্পাদক
বাগামোয়ো থেকে সিম্বামওয়েনির দূরত্ব আমাদের হিসেবে ১১৯ মাইল। এই পথ পেরোতে আমাদের চোদ্দো দিন হাঁটতে হয়েছিল। তবে মাসিকার জন্য পথ-চলায় কিছু অসুবিধা হয়েছিল। আর বিশেষ করে মাগাঙ্গার অধীনের চতুর্থ কাফেলা পিছিয়ে পড়ার জন্য আমাদের সময় লেগেছিল মোট উনত্রিশ দিন, ফলে সত্যই আমাদের যাত্রার গতি খুবই ধীর—দিনে চার মাইলের সামান্য বেশি। যেমন দেখেছি তার থেকে আমার অনুমান, অসুস্থ ওয়ান্যাম্বেয়েজির কুলিরা আমাদের চলার গতি ব্যাহত না করলে, ষোলো দিনেই এই পথ পাড়ি দেওয়া যেত। গাধাদের উপর আমার পূর্ণ ভরসা ছিল; বেচারা জন্তুগুলো, প্রত্যেকে ১৫০ পাউন্ড ওজন বহন করেও, একদম চমৎকার অবস্থায় সিম্বাম্বওয়েনির পৌঁছেছিল; কিন্তু লোভী ও অলস মাগাঙ্গা আর তার শারীরিকভাবে দুর্বল, কেবলই অসুস্থ হতে থাকা দেশোয়ালি ভাইরাই এই দেরির কারণ। আবহাওয়া শুকনো হলে সম্ভবত হাঁটার দিনের সংখ্যা কম হত। যে আধ ডজন মতো আরব-দেশীয় বা অন্য বণিকেরা আমাদের আগে এই পথ দিয়ে এসেছিল, তাদের মধ্যে দুজন আট দিনের মধ্যে পুরো পথটা অতিক্রম করে। এই দেশের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে, দিন দিন আমাদের চোখের সামনে যে রূপ ফুটে উঠেছে, পাঠকদের এদেশ সম্পর্কে একটি ঠিকমতো ধারণা দেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট। তবে, সিম্বাম্বওয়েনি থেকে দূরের উপকূলবর্তী বাগামোয়ো অবধি ছড়ানো এলাকার কথা মনে পড়লে, এই উর্বর মৃত্তিকা, এই প্রাকৃতিক রেখান্যাস, এই অরণ্যানি ও মাঝে মাঝে দীর্ঘ বৃক্ষ পরিবেষ্টিত তৃণাঞ্চল, এই পাহাড়শ্রেণি ও শঙ্কু-আকৃতির পাহাড়চূড়া আর অপরূপ তরঙ্গায়িত হরিদবর্ণ ভূমিতল, সব মিলিয়ে আমাদের দেশের একটি রাজ্যের সঙ্গে খুব মিল পাই—সেটি হল মিসৌরি। সিম্বাম্বওয়েনির উচ্চতা জলতল থেকে এক হাজার ফুটের বেশি হতে পারে না, ধীরে ধীরে জমি উপর দিকে উঠেছে। এখন বর্ষাকাল। এই অঞ্চলের চরিত্র-বিষয়ে যারা কিছুই বোঝে না তাদের মুখে এখানকার বর্ষা সম্বন্ধে কত যে কুকথা শুনেছি! আমরাও স্বাভাবিকভাবেই এই ঋতুকে খুব খারাপ চোখেই দেখেছিলাম। প্রতিকূলতম পর্যায়ে গভীর কৃষ্ণকর্দম, ভয়ানক রকমেরশিশির, ঠান্ডা জল-ঝরতে থাকা ঘাস, সার বাঁধা গভীর জঙ্গল ও জ্বর-জারি ইত্যাদি সকল অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও স্মৃতিগুলির দিকে ফিরে তাকাতে ভালোই লাগে। গহন বর্ষাই সভ্য মানুষের মনে অনন্ত সম্পদ আর সমৃদ্ধির আশা জাগায়—আর কিছুদিন পরেই তারা এখানে আসবে আর জায়গাটা অধিকার করবে। ইউনিয়ন প্যাসিফিক রেলপথ১ যে কি অসীম দ্রুততায় তৈরি হয়েছিল তার গল্প আমরা বিশ্ববাসী শুনেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। তার চেয়ে অনেক কম খরচে আর অনেক বেশি সহজে ও তাড়াতাড়ি বাগামোয়ো থেকে সিম্বাম্বওয়েনি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা যেতে পারে। একটা পুরোদস্তুর জলনিকাশি ব্যবস্থা তৈরি হলে, নতুন জায়গা দখলের পরের সাধারণ অস্বস্তিটুকু বাদ দিলে, আফ্রিকার এই অঞ্চলে বসবাস খুব একটা অসুবিধার হবে না। দিনের বেলা এই মরশুমে তাপমাত্রা কখনও ৮৫ ডিগ্রিফারেনহাইটের বেশি হয় না। রাতগুলি মনোরম—জোড়া কম্বল ঢাকা না দিলে বেশ ঠান্ডাই লাগে; সিম্বাম্বওয়েনি পর্যন্ত, কোনো মশা নেই। নেব্রাস্কা এবং কানসাসের ঘাসজমি এলাকায় মশা যে কী ভয়ংকর! এখানে উপনিবেশ করতে চাওয়া জনতার পক্ষে, আমার জ্ঞানমতে, একটাই ব্যাপার ঘোর বিরক্তির—তা হল মাবঙ্গু বা ঘোড়া-মারা-মাছি বাচুফওয়া! কী যে একবগগা ধরনের আর ভয়ানক হিংস্র! এদের কথা আগেই বলেছি। ঘন বন-জঙ্গল কেটে সাফ না করা অবধি এদের জন্য গবাদি পশুপালন নেহাতই অলাভজনক হবে।
যেমনটা ভেবেছিলাম তা হল না—পরের দু দিনেও হাঁটা শুরু করা গেল না; উঙ্গেরেঙ্গেরির নৈরাশ্যময় উপত্যকায় তৃতীয় ও চতুর্থ দিন খুবই দুঃখে কাটল। শুকনো মরশুমে এই নদীটি ক্ষীণধার। কিন্তু মাসিকার সময় এটি ফুলেফেপে প্রবলা হয়ে ওঠে, খুবই দুঃখের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এটা শিখেছি। আশেপাশের অনেক পাহাড়চূড়ার আর দুটো লম্বা পর্বতশ্রেণির পাদদেশ জড়িয়ে বয়ে চলা এই নদী পাহাড়গুলোর জলনিকাশি হিসাবে কাজ করে। সূর্যের আলোর দেখা যাওয়ার সামান্য সময়টুকুতে পাহাড়ের গায়ের যে ঝর্ণাগুলোকে ঝলমল করে উঠতে দেখা যায়, তারাও এই নদীতে জল ঢালে।পর্বতের টানা সমুখ ঢাল বেয়ে নেমে আসা যত নালা আর গিরিখাত, যাদের ছোঁয়ায় পাহাড়ের ঢাল অসমান, এবড়োখেবড়ো, তাদের জলও এসে পড়ে এই নদীতে। তারপর এটি সিম্বাম্বওয়েনি উপত্যকায় প্রবেশ করে, ততক্ষণে নদীর জলভার বিপুল, সেতু তৈরির উপায় না থাকলে কাফেলাগুলির চলার পথে সে এক মারাত্মক বাধা; এর সাথে যোগ করতে হবে অবিরাম বর্ষণধারা—এমন বৃষ্টি যা মানুষকে বাড়ির ভিতরে বন্দি করে রাখে—জীবন দুর্বিষহ ও নির্মায়িক করে দেয়—ঠিক যেন লন্ডনের বৃষ্টি—কুয়াশা আর মেঘের ছায়ায় জড়ান ঘ্যানঘেনে বারিপাত। যখন সূর্যের দেখা পাওয়া যায়, তখনও যেন সে নিজেরই একটা বিবর্ণ প্রতিচ্ছবি। বয়স্ক কুলিরা বৃদ্ধ তিমি-শিকারের জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতোই চিরায়ত জ্ঞানের অধিকারী। তারা এই মরা আলো দেখে আশঙ্কিত হয়ে মাথা নেড়ে বলল যে এই বৃষ্টি আগামী তিন সপ্তাহেও ধরে কিনা দেখ! উঙ্গেরেঙ্গেরির এইদিকে যেখানে আমরা শিবির করে আছি, সেই জায়গাটা ম্যালেরিয়ার ডিপো, দেখতেও জঘন্য—স্মৃতিও বিরক্তিকর! দলের পর দল কুলিদের বর্জ্যতে অসংখ্য কীটেরা কিলবিল করছে। কালো, সাদা এবং লাল পিঁপড়ের সৈন্যদলে মাটি ছেয়ে আছে; বিবিধ রঙের কৃমির মতো কেন্নোরা ঝোপঝাড় গাছপালায় চেপে বসেছে; বড়ো বড়ো গাছের নীচের ঝোপঝাড়ে হলদে-মাথা বোলতার চাক ঝুলছে, কাঁকড়াবিছের মতন মারাত্মক তাদের হুল। বিশাল চেহারার গুবরে পোকা, ধেড়ে ইঁদুরের মতন বড়ো, গোবরের তালকে মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে; সব রকমের, আকারের, চেহারার ও রঙের অগণিত পোকামাকড় মাটিতে থিকথিক করছে; সংক্ষেপে বলা যায়, আমার তাঁবুর দেয়ালে সকাল থেকে রাত অবধি সংখ্যায় ও প্রকারে যতরকম পোকা দেখা যেত, অন্যখানের কীটপতঙ্গের সুবিপুল সংগ্রহও তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিঁকতে পারবে না।
পঞ্চম দিন বা ২৩ এপ্রিল সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য বৃষ্টি থামল, সেই ফাঁকে আমরা দুর্গন্ধময় বৈতরণী পেরিয়ে নদীর প্লাবিত অপর পারে এসে উঠলাম। সৈন্যরা সকাল পাঁচটা থেকে একটা লজঝড়ের তস্য লজঝড় ব্রিজের উপর দিয়ে মালপত্র নদীর এপার থেকে ওপারে নিচ্ছে। এই গভীর খরস্রোতা নদী পারাপারের উপায় হিসেবে ওই সেতুটিকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে শুধু বুদ্ধু আফ্রিকাবাসীরাই পারে! এমনকি চটপটে ওয়ান্যাম্বেয়েজি কুলিরাও ওই সেতু ধরে পেরোতে স্বচ্ছন্দ না। একজন পেশাদার মাদারিই শুধু এর উপর দিয়ে সহজে বোঝা নিয়ে পার হতে পারে। আফ্রিকায় সেতুর উপর দিয়ে নদী পেরোতে প্রথমেই লাগে জমি থেকে গাছের গুঁড়ির উপর অবধি একটা লম্বা লাফ, গাছটা জলে ডুবে থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে, আর তারপরে সেখান থেকে আবার একেবারে পার অবধি একটা লম্বা লাফ! পিঠে সত্তর পাউন্ডের বোঝা নিয়ে কুলিদের পক্ষে কাজটা কঠিন। কখনও সখনও গাছের থেকে ঝুলতে থাকা লতাগাছকে ধরে খানিকটা ভরসা পাওয়া যায়, তবে অনেকসময়ই সেসব থাকে না—অসভ্য মানুষেরা এসব বাহুল্য বলে ভাবে।
আফ্রিকার পুরোনো দিনের সাসপেনশন ব্রিজ
ভাগ্যক্রমে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই মালপত্র পার করা গিয়েছিল, আর জলের গতি প্রবল হলেও, প্রাণপাত করে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অজস্র গালিগালাজ করে গাধাগুলোকে প্রবল জলের মধ্যে দিয়ে টেনে ওপারে নিয়ে যাওয়া গেল। উঙ্গেরেঙ্গেরি নদী পেরোতে পুরো পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগেছিল, যদিও যে পরিমাণ শক্তি, গালিগালাজ আর ক্রোধ ব্যয় হল, তা একটা গোটা সৈন্য দলের বরাদ্দ।
ফের মালপত্র গুছিয়ে, জামাকাপড় নিংড়ে শুকিয়ে আমরা নদীর পাশের ওই নোংরা, দুর্গন্ধময় ভয়াবহ এলাকা ছেড়ে উত্তরমুখে রওনা দিলাম, এবারের রাস্তাটা সহজ—সমতলের উপর দিয়ে চলছে। দুটো জমি ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা পাহাড়কে বাঁদিকে রেখে আমরা চলছি। সেদুটোকে পেরিয়ে যাওয়ার পরে ওই বিশ্রী উপত্যকাকে আর দেখা গেল না।
(ক্রমশ...)