ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। লিভিংস্টোন এখনও অধরা। এদিকে রসদ ফুরিয়ে আসছে। স্থানীয় সর্দারদের ভেঁটের দাবি এড়াতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গোপনে চলেছে কাফেলা। তরজমা স্বাতী রায়
ঘণ্টা খানেক বিশ্রাম নেওয়ার পর, কয়েকজন স্থানীয়কে দেখা গেল। তারা মালাগারাজি থেকে নুন নিয়ে নদীর ডান তীর ধরে আসছিল। আমাদের গা-ঢাকা দেওয়ার জায়গার কাছাকাছি এসে, আমাদের দেখতে পেল, আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের লবণের বস্তাগুলো ফেলে দিয়ে, তারা দে-ছুট। সেই সঙ্গে চিৎকার। আমাদের প্রায় মাইল চারেক উত্তরের গ্রাম ক'টাকে সতর্ক করার জন্য। দলের সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে মালপত্র ঘাড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা রুসুগি পার হলাম, আর ঠিক সামনের একটা বাঁশের জঙ্গলের দিকে সোজা যাচ্ছিলাম। যেই না সেখানে ঢোকা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বুদ্ধু মেয়েছেলে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল। এই শোরগোলের চোটে দলের লোকেরা বেজায় ঘাবড়ে গেল। হাহারা তাদের নজরানাকে ন্যায্য পাওনা ভাবে, তা এড়ানোর চেষ্টার জন্য এবার কী তাদের প্রতিশোধ আমাদের মাথার উপর নেমে আসবে? আধ ঘণ্টার মধ্যে জঙ্গলে আমাদের চারপাশে শয়ে শয়ে গর্জনকারী বর্বর জুটে যাবে আর একটা নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। বৌটা ভয়ের চোটে চেঁচাচ্ছে তো চেঁচাচ্ছেই, কোন কারণ ছাড়াই চেঁচাচ্ছে। কয়েকজন, আত্ম-রক্ষার্থে সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের সামান-টামান ফেলে জঙ্গলে উধাও হয়ে গেল। গাইড আমার কাছে ছুটে এলো, বৌটার চেঁচানো বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করল। বৌটার স্বামী, রাগে-ভয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে, নিজের তলোয়ার বের করল আর তার মাথাটা কেটে ফেলার জন্য আমার কাছে অনুমতি চাইল। তখন ন্যূনতম ইঙ্গিত দিলেই, নিজের মূর্খতার দাম তাকে জীবন দিয়ে শোধ করতে হত। তার মুখের উপর হাত চাপা দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে ভয়ানক মারামারি করতে লাগল, আর আগের চেয়েও জোরে জোরে চেঁচাতে লাগল। এরপর তার কাঁধে চাবুক মারা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। প্রথম ঘা'র পরে তাকে চুপ করতে বললাম। ‘না!’ আরও জোরে, আরও চিল্লিয়ে সে পাগলের মত কাঁদতেই লাগল। আবার আমার চাবুক তার কাঁধে নেমে এলো। 'না না না!'
আরও এক ঘা। 'চুপ করবি?' 'না না না!' আরও জোরে জোরে চেঁচাতে লাগল সে, আর এই দজ্জাল মহিলাকে চুপ করানোর জন্য আমি আরও দ্রুত চাবুক মারতে থাকলাম। তবে, সে যখন দেখল যে সে যেমন কাঁদবেই বলে ঠিক করেছে, আমিও তেমন তাকে চাবুক মেরে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন সে ক্ষান্ত দিল। দশ ঘা দেওয়ার আগেই চুপ করল। তার মুখের উপর একটা কাপড় বেঁধে দেওয়া হল, আর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হল; আর কিছুক্ষণের মধ্যেই, পালিয়ে-যাওয়া লোকেরা ফিরে আসতেই, অভিযান আবার দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে চলল। টানা চলতে থাকলাম, যতক্ষণ না, বিকেলে, মুসুনিয়ার ছোট্ট হ্রদটি দেখতে পেলাম, ন’ ঘণ্টা হেঁটে তখন আমরা যারপরনাই ক্লান্ত।
উহহার এই অংশে দেখা-যাওয়া বৃত্তাকার অববাহিকাগুলির মধ্যে একটা হল মুসুনিয়া হ্রদ। এখানে এমন হ্রদ অনেকগুলোই আছে। এই হ্রদগুলোকে আরও সঠিক ভাবে বলতে হলে বলতে হয় দিগন্তবিস্তারী জলরাশি। মাসিকার মরসুমে, মুসুনিয়া হ্রদটি দৈর্ঘ্যে নিশ্চিত তিন বা চার মাইল আর প্রস্থে দুই মাইল হয়ে দাঁড়ায়। ঝাঁকে ঝাঁকে জলহস্তীরা ঘুরে বেড়ায় , আর এর তীরে বড় শিকাররা ঘোরে।
আমাদের ছাউনিতে সবাই একদম চুপ, ঠিক যেমনটা ভাবা হয়েছিল, তাঁবু খাটানো বা কুঁড়ে বানানো হয়নি, আগুনও জ্বালানো হয়নি, যাতে কেউ ধাওয়া করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিনা বিলম্বে পালাতে পারি। আমার উইনচেস্টার রাইফেলে (আমার বন্ধু মিস্টার মরিসের দেওয়া উপহার, আর এমন সংকটের জন্য একটি বিরল উপহার) গুলি ভরা, আমার কাঁধে ঝোলানো একটা ব্যাগে আরও দুশ কার্তুজও রয়েছে। সব সৈনিকের বন্দুকও গুলিভরা, একদম প্রস্তুত। এমন একটা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার আবহে আমরা ক্লান্তি মুছে ফেলার জন্য ঘুমাতে গেলাম।
৮ নভেম্বর। ভোর হওয়ার অনেক আগেই, হাঁটতে শুরু করেছি, আর যখন দিনের আলো ফুটছে তখন আমরা বাঁশবন থেকে বেরিয়ে এলাম, আর উহহার খোলা সমতলের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগলাম। আবার পথের পাশে বেশ ক'টা বড় জলাশয় দেখা গেল — অনেক দূর অবধি এই ঢেউ খেলানো জমির বিস্তার — মাঝে-সাঝে এখানকার স্বভাবমতো এক একটা গাছের গুচ্ছ যেন সামগ্রিক নগ্নতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা হেঁটেই চলেছি, এই মাটির ঢেউ-এর উপর দিয়ে, আফ্রিকার রীতি মাফিক উত্তপ্ত সূর্য দাউদাউ করে জ্বলছে, অবশ্য স্বাগত-জানানো মৃদু পবনের দরুন সে উত্তাপ কিছুটা সহনীয়, বাতাসে কচি ঘাসের সুগন্ধ। আর বিচিত্রবর্ণের অদ্ভুত ফুলের সৌরভের ছোঁয়া বাতাসে । আমাদের চারপাশে দূর অবধি ছড়ানো ফ্যাকাসে-সবুজ চাদরের ফাঁক দিয়ে সেই ফুলেরা উঁকি মারছে।
আমরা রুগুফু নদীর ধারে পৌঁছলাম — এটা উকাওয়েন্ডির রুগুফু না, তবে ওই একই নামের উত্তর দিকের একটা জলধারা, মালাগারজির একটা উপনদী। চওড়া বটে, তবে খুব একটা গভীর না, মন্থরগতি ধারা, প্রায় অদৃশ্য স্রোত দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী। ডান পারের খুব কাছের একটা ঘন জঙ্গলের গভীর ছায়ায় আমরা বিশ্রাম নিতে থামলাম, ফের হাঁটতে শুরু করার আগে একটা ছোট বিশ্রাম, তখন একটা শব্দ শুনলাম। স্পষ্ট বজ্রপাতের মতন, দূরে পশ্চিমের থেকে আসা শব্দ । বজ্রপাতই কিনা সেকথা জিজ্ঞেস করতে শুনলাম এটা কাবোগো।
কাবোগো? সে আবার কি? এটা টাঙ্গানিকার অন্য দিকের একটা বিশাল পর্বত, গভীর খাদে ভরা, তার মধ্যে জল পাক খায়; আর যখন টাঙ্গনিকার উপরে বাতাস বয়, তখন মভুহা (বজ্রের) এর মতো শব্দ হয়। সেখানে অনেক নৌকা উবে গেছে, আরব ও স্থানীয়রা এখানকার প্রথা মত হ্রদের মুলুনগু (দেবতা) কে খুশি করার জন্য মার্কিনী ও কানিকি কাপড় -আর বিশেষ করে সাদা (মেরিকানি) পুঁতি দেবতাকে নিবেদন করে। যারা পুঁতি দেয়, তারা সাধারণত বিনা ঝঞ্ঝাটে পেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যারা হ্রদে পুঁতি ফেলে না, তারা হারিয়ে যায় আর ডুবে মরে। ওহ, এটা একটা ভয়ানক জায়গা! আমার সদা-হাস্যমান গাইড আসমানি আমাকে গল্পটা বলল, আর আমার সঙ্গের অন্যান্য প্রাক্তন নাবিকরা গল্পটা সমর্থন করল।
রুগুফু নদীর তীরে যেখানে আমরা রাতের খাবারের জন্য থামলাম, উজিজি থেকে সে জায়গাটা অন্ততপক্ষে সাড়ে আঠার ঘণ্টা বা ছেচল্লিশ মাইল দূরে, আর যেহেতু শুনলাম যে কাবোগো উগুহার কাছে, তাহলে এটা উজিজি থেকে ষাট মাইলের বেশিই হতে হবে। অতএব এই জলের গর্জনের শব্দ, যা নাকি কাবোগোর কন্দরে কন্দরে জলের পাক খাওয়ার শব্দ, সেটা একশো মাইলেরও বেশি দুরের থেকে আমাদের কানে পৌঁছল।
আরও তিন ঘণ্টা আমরা হাঁটলাম। হালকা বনের মধ্যে দিয়ে, আদিম পাথরের ছড়ানো ভূমিতলের উপর দিয়ে, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বড় বড় পাথরের মধ্যে দিয়ে, অসংখ্য মহিষ, জিরাফ এবং জেব্রার পাল পেরিয়ে, একটা তলতলে প্যাচপেচে ডোবার মতন জায়গার উপর দিয়ে আমরা সুনুজ্জির সরু স্রোতের কাছে পৌঁছলাম। এখানেই আমাদের শিবিরের জায়গা। এটা হহাদের একটা বড় বসতির থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। তবে আমরা এক গহন বনের গভীরে রয়েছি – আশেপাশে কোন রাস্তা নেই, কোন শব্দ করা হয়নি, গভীর নীরবতা বজায় রাখা হয়েছিল; আগুনও জ্বালানো হয়নি। তাই কোন ঝামেলার ভয় ছাড়াই আমরা শান্তভাবে নিরাপদে বিশ্রাম করতে পারলাম। আমাদের গাইড ভরসা দিয়েছে যে আগামীকাল সকালেই আমরা উহা পেরিয়ে যাব, আর সেদিনই যদি আমরা উকারঙ্গার নিয়ামতগায় পৌঁছাতে পারি, তাহলে পরের দিন আমরা নিশ্চয় উজিজিতে পৌঁছব। ধৈর্য ধর, মন! আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই এসবের শেষ দেখা যাবে! সাদা গোঁফ-দাড়িওলা সেই সাদা মানুষটির মুখোমুখি হব, সে তিনি যেই হোন না কেন!
(ক্রমশ...)