ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এই পর্বের বিষয় নীলনদ ও তার উৎস। তরজমা স্বাতী রায়
এইভাবে যতদূর সম্ভব গবেষণা করে, এলিফ্যান্টাইন বা তার থেকেও দূরে গিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আর অন্যের মুখের কথা থেকেও এইটুকুই জানতে পেরেছি। এলিফ্যান্টাইন শহর পেরিয়ে আরও উজানে যেতে গেলে এলাকাটা খাড়া উপরের দিকে উঠে গেছে, তাই, এখানে, নৌকার দুদিকে দড়ি বেঁধে এগোতে হয়, যেমনটা লাঙ্গলে বলদ জোতার সময় করতে হয়; কিন্তু দড়ি ছিঁড়ে গেলে স্রোতের টানে নৌকা ভেসে চলে যায়। এইভাবে চার দিনের পথ চলা। এখানে নীল নদ এঁকেবেঁকে চলে। বারো শোয়েনি১ পথ এইভাবে চলতে হয়; আর তারপরে একটা সমভূমি আসে, সেখানে নীল নদ একটা দ্বীপের চারপাশে প্রবাহিত হয়; এর নাম ট্যাকোম্পেসো। এলিফ্যান্টাইনের লাগোয়া উজান এলাকায় ও দ্বীপটার অর্ধেকাংশে ইথিওপিয়ানরা বাস করে; বাকি অর্ধেক অংশে মিশরীয়রা থাকে। এই দ্বীপের কাছেই একটা বিস্তীর্ণ হ্রদ রয়েছে, যার সীমানা বরাবর ইথিওপিয়ান যাযাবরদের বাস।
এই হ্রদ ধরে চলে তারপরে নীল নদের খালে এসে পৌঁছান যাবে। খালটা হ্রদে গিয়ে পড়েছে। তারপরে জমিতে পা রাখতে হবে আর নদীর পাশ দিয়ে চল্লিশ দিন চলতে হবে। কারণ এখানে নীল নদের খাতের থেকে ধারালো পাথর জেগে গেছে, আর অজস্র ডুবো পাথরও আছে। তাদের মধ্য দিয়ে নৌকা চালানো অসম্ভব। দিন চল্লিশেকে এই এলাকা অতিক্রম করে, তারপর অন্য নৌকায় চড়তে হবে ও ফের বারো দিনের যাত্রা করে তারপর মেরোয়ে নামের একটা বড় শহরে পৌঁছানো যাবে; এই শহরটাকে গোটা ইথিওপিয়ার রাজধানী বলা হয়। এখানকার অধিবাসীরা বৃহস্পতি ও বাক্কাস ছাড়া অন্য কোন দেবতার পূজো করে না; কিন্তু তারা মহা ধুমধাম করে তাঁদের সম্মান দেখায়। তাঁদের একটা বৃহস্পতির দৈববাণীক্ষেত্রও আছে; যখনই ঈশ্বর তাদের সতর্ক করে দৈবনির্দেশ দেন, তারা যুদ্ধযাত্রা করে। যে দেশের বিরুদ্ধে দেবতা নির্দেশ দেন, তারা সেই দেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই শহর থেকে রওনা হয়ে পৌঁছানো যাবে অটোমলিদের দেশে। এলিফ্যান্টাইন থেকে ইথিওপিয়ানদের রাজধানীতে আসতে যতটা সময় লেগেছিল, তার সমান সময়ই লাগবে। এই অটোমলিদের আসমাক নামেও ডাকা হয়, গ্রিসের ভাষায় যার অর্থ হল 'যারা রাজার বাম দিকে দাঁড়ায়'। মিশরীয় যুদ্ধপ্রিয়-উপজাতিগুলোর দু-লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক ইথিওপিয়ার পক্ষে বিদ্রোহ করেছিল। কারণটা এইরকম ছিল। রাজা সামেটিকাসের Psammitichus আমলে ইথিওপিয়ানদের বিরুদ্ধে এলিফ্যান্টাইনে একদল সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। পেলুসিয়ান ড্যাফনেতে আরবী ও সিরিয়ানদের বিরুদ্ধে আরেকদল সৈন্য ঘাঁটি গেঁড়েছিল আর লিবিয়ার লোকদের বিরুদ্ধে মারিয়াতে আরেক দলকে রাখা হয়েছিল; এমনকি আমার সময়েও পারস্যদেশীয় একদল সৈন্য সামেটিকাসের সময়ে যেমন ছিল ঠিক সেই একই জায়গায় বসে এলিফ্যান্টাইন এবং ড্যাফনে পাহারা দিচ্ছিল। এবার টানা তিনবছর দায়িত্ব পালন করার পরেও এই মিশরীয়রা ছুটি পায়নি; অতএব, তারা সবাই মিলে একসঙ্গে পরামর্শ করে একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, আর সকলেই সামেটিকাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইথিওপিয়ায় চলে যায়। সামেটিকাস এইসব শুনে তাদের পিছনে ধাওয়া করেন। তারপর তাদের পাকড়াও করে, অনেক যুক্তি -তর্ক দিয়ে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন ও তাদের পিতৃপুরুষের ধর্ম, নিজ স্ত্রী-সন্তানদের ত্যাগ না করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। তবে শোনা যায়, এদের মধ্যে একজন তার নিজের গোপনাঙ্গ উন্মোচন করে আর বলে যে, এগুলো যেখানেই থাকবে, সে যেখানেই হোক না কেন, বৌ বাচ্চা সেখানেই পাওয়া যাবে। এই লোকগুলো যখন ইথিওপিয়ায় পৌঁছে সেখানকার রাজার আনুগত্য স্বীকার করল, তিনি তাদের নিম্নলিখিত প্রতিদান দিয়েছিলেন। কিছু কিছু ইথিওপিয়ান তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল; তিনি এদের বলেন তাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জমিজিরেত দখল করে নিতে। এই লোকেরা ইথিওপিয়ানদের মধ্যে বসতি স্থাপন করলে, ইথিওপিয়ানরা আরও সভ্য হয়ে ওঠে ও মিশরীয়দের আচার-ব্যবহার শিখে নেয়।
এবার, চার মাস ধরে নদীপথ-স্থলপথ দিয়ে চলার পরে, নীল নদের মিশরের মধ্যের অংশটুকু ছাড়াও নীল নদকে কিছুটা জানা যাবে। কারণ, হিসেব করে দেখা গেছে যে একজন মানুষের এলিফ্যান্টাইন থেকে অটোমলি যেতে এতগুলো মাসই লাগে। এই নদী সূর্যাস্তের দিক থেকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকের থেকে প্রবাহিত হয়; কিন্তু এর বাইরে কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারে না, কারণ ভয়ানক গরমের দরুণ দেশের বাকি অংশটুকু মরুভূমি। কিন্তু আমি কয়েকজন সাইরেনীয়ের২ থেকে নিম্নলিখিত বিবরণ শুনেছি। তারা বলে যে তারা অ্যামোনের দৈববাণী মন্দিরে গিয়েছিল ও অ্যাম্মোনিয়ানদের রাজা ইটারকাসের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিল। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে নীল নদ নিয়েও আলোচনা হয়েছিল - তারা যখন বলেছিল যে কেউ এর উৎস জানে না; তখন ইটারকাস বলেছিলেন যে কয়েকজন নাসামোনিয়৩ একবার তাঁর কাছে এসেছিল - এদের দেশ লিবিয়া, এরা সারটিস৪ ও তার ধারেকাছের পুর্বদিকের বাসিন্দা - যখন এই নাসামোনিয়রা এসেছিল, তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তারা লিবিয়ার মরুভূমির বিষয়ে আর কোন তথ্য দিতে পারে কিনা, তারা বলেছিল, তাদের মধ্যের কিছু দুঃসাহসী , ক্ষমতাবান ঘরের ছেলে সম্পত্তির মালিক হয়ে অনেকরকম অমিতব্যয়ী পরিকল্পনা করেছিল আর তার থেকেও বড় কথা, লিবিয়ার মরুভূমিতে অভিযান করার জন্য নিজেদের মধ্যে থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়েছিল। উদ্দেশ্য, আগের সবচেয়ে বেশি দূর অবধি যাওয়া অভিযাত্রীদের থেকেও আরও একটু বেশি জানা। (কারণ, উত্তর সাগরের ধারের লিবিয়ার অংশগুলিকে দেখলে, মিশর থেকে শুরু করে লিবিয়া, লিবিয়ান ও তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়েছে, গ্রীস ও ফোনেসিয়ানদের৫ দখল করা জায়গা বাদ দিয়ে, সেই বহুদূরের সোলোইসের শৈলান্তরীপ অবধি। তবে সমুদ্রের থেকে দূরভাগের অংশ হিসেবে আর যে দেশগুলো সমুদ্র অবধি পৌঁছেছে, লিবিয়ার সেই উপরের অংশ হিংস্র জন্তুতে ভর্তি; আর তার পরে শুধু বালি, জলের ভয়ঙ্কর অভাব, একেবারে জনশূন্য।) তারা আরও বলেছিল যে, “যখন তাদের সঙ্গীদের দ্বারা নির্বাচিত এই যুবকরা জল ও খাবার-দাবার নিয়ে রওয়ানা হয়, তারা প্রথমে মানুষের বসতির ভিতর দিয়ে যায়; এটা পেরিয়ে, তারা বন্য জন্তু ভরা অঞ্চলে এলো; আর এরপরে তারা মরুভূমি অতিক্রম করে, পশ্চিম দিকে যায়। দীর্ঘ বালুভূমি পেরিয়ে, অনেকদিন পথ চলে, তারপর তারা দেখে, দূরে একটা সমভূমিতে কিছু গাছ গজিয়েছে; তারা গাছের কাছে এসে ফল কুড়োতে শুরু করে৷ তারা যখন ফল কুড়োচ্ছিল, তখন কয়েকজন বামনাকৃতির লোক এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়; নাসামোনিয়রা তাদের ভাষা বোঝেনি, বা যারা তাদের ধরে নিয়ে গেল তারাও নাসামোনিয়দের ভাষা বুঝতে পারেনি। যাইহোক, তারা বিস্তীর্ণ কাদাজমির উপর দিয়ে তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেসব পেরিয়ে তারা এমন একটা শহরে এসে পৌঁছেছিল যেখানকার সমস্ত বাসিন্দারাই তাদের যারা ধরে এনেছিল তাদের মতো একই আকারের ও কালো রঙের; আর শহরের পাশ দিয়ে, পশ্চিম থেকে পূর্বে বয়ে যাচ্ছে একটি বড় নদী। সেখানে কুমির ভাসছিল।” এই পর্যন্ত আমি অ্যামোনিয়ান রাজা ইটারকাসের বিবরণ তুলে ধরেছি; এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে যে সাইরেনীয়রা তাঁকে যেমন আশ্বস্ত করেছিল, নাসামোনিয়রা সবাই নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফিরে এসেছিল আর যাদের কাছ থেকে তারা ফিরে এসেছিল তারা সবাই জাদুকর।” ইটারকাস এও অনুমান করেছিলেন যে তাদের শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই নদীটিই নীল নদ; যুক্তিতেও তাই দাঁড়ায় বটে: কারণ নীল নদ লিবিয়ার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে আর (আমার অনুমান, পরিচিত জিনিসের থেকে অজানা জিনিস সম্বন্ধে আঁচ করে) এটা ইস্টারের৬ উৎসের মতোই একটি বিন্দু থেকে শুরু হয়েছে। ইস্টার যেমন, কেল্টস৭ ও পাইরেন শহর থেকে শুরু হয়ে, নিজের জলধারা দিয়ে ইউরোপকে দুভাগে ভাগ করেছে; কেল্টরা অবশ্য হারকিউলিসের স্তম্ভের৮ বাইরে, ইউরোপের পশ্চিমপ্রান্তবাসী সাইনেসিয়ানদের এলাকার সীমান্ত অঞ্চলে রয়ে গেছে। আর ইস্টার গোটা ইউরোপের মধ্য দিয়ে বয়ে এসে ইউক্সিন সাগরে৯ এসে পড়েছে, যেখানে ইস্ট্রিয়াতে একটা মাইলেসিয়ান১০ বসতি রয়েছে। এখন যেহেতু ইস্টার একটা জনবহুল এলাকার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, এর কথা লোকে জানে। কিন্তু নীলের উৎস নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। কারণ এটা লিবিয়ার মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় আর সেই দেশটা জনহীন, ঊষর। কাজেই এই নদী সম্বন্ধে আমি খোঁজখবর করে যতটুকু যা জানতে পেরেছি সে তো আগেই বলেছি। তবে এটি শেষে মিশরে গিয়ে পড়েছে; আর মিশর সিলিসিয়া পর্বতের বিপরীতে, যতটা কাছে হতে পারে ততই কাছে, অবস্থিত, যেখান থেকে ইউক্সিন সাগরের তীরের সিনোপ অবধি সিধে হাঁটলে একজন জোয়ানের মাত্র পাঁচদিনের পথ; আর সিনোপ১১ ইস্টার যেখানে এসে সমুদ্রে পরে তার বিপরীতে। তাই মনে হয় যে গোটা লিবিয়া পেরিয়ে আসা নীল নদকে ইস্টারের সঙ্গে তুলনা করা যেতেই পারে।