আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন, আগের কিস্তিতে আমরা পেয়েছি, এমপোয়াপোয়া থেকে রওনা হয়ে বিহোয়ানা পার করে কিদিদিমো হয়ে এমসালালো-র (নীচের মানচিত্রে) দিকে এগিয়ে যাওয়ার বর্ণনা। কিন্তু এ কিস্তিতে লিটল কুকনডোকু বলে যে জনপদের কথা বলা হচ্ছে তার বর্তমান অস্তিত্ব খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই (ওপরের) মানচিত্রে নীল দাগ দেওয়া পথের আশেপাশেই।— সম্পাদক
৪ জুন আমরা শিবির গোটালাম, ও প্রায় মাইল তিনেক পশ্চিমে যাওয়ার পরে, আর বেশ অনেকগুলো নোনা জলের পুকুর ছাড়িয়ে, আমরা উগোগো ও উয়ানজির সীমানা বরাবার অবস্থিত নিচু পাহাড়ের শ্রেণিকে এড়াতে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলতে লাগলাম।
তিন ঘন্টা হাঁটার পরে আমরা অল্প কিছুক্ষণের জন্য লিটল মুকনডোকুতে থামলাম আসল মুকনডোকুর রাজার ভাইয়ের সঙ্গে ভেট দেওয়ার ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে। দুটি গ্রামের অধীশ্বর সুলতান তিন ডটিতেই তুষ্ট। পশুচারক হুম্বা আর দলত্যাগী হেহেদের বাস সেই গ্রামদুটোতে। হুম্বারা বাস করে শঙ্কুর গড়নের গোবর-লেপা কুঁড়েতে, দেখতে তুর্কিস্তানের তাতারদের তাঁবুর মতো।
আমি যতটা দেখেছি, হুম্বারা বেশ সুন্দর, সুসংহত জাত। পুরুষেরা তো নিঃসন্দেহে সুদর্শন, লম্বা, ছোট মাথাযুক্ত, পুরুষ্টু পশ্চাৎদেশ বেশ ভালমতন বেরিয়ে আছে। বোঁচা নাক আর মোটা ঠোঁট খুঁজলে মিলবে না। বরং, এদের মুখ খুব সুন্দর করে কুঁদে বার করা, ছোটর উপর সুন্দর; নাক গ্রিকদের মত, আর এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটি এতই সর্বজনীন যে আমি তখনই এদের নাম দিলাম, 'আফ্রিকার গ্রিক'। গোগো বা অন্য সব উপজাতির মত এদের নিচের অঙ্গ অত ভারি দেখতে না, বরং অ্যান্টিলোপের মত বেশ লম্বা আর সুন্দর, ছিমছাম গড়নের। লম্বা, সরু ঘাড় আর তার উপরে তাদের ছোট্ট মাথাটা ভারি লীলায়িতভাবে বসানো। ছোটবেলা থেকে খেলাধূলো করা, জন্মগতভাবে পশুপালক আর নিজেদের মধ্যেই বিয়ে করে এরা নিজেদের জাতকে শুদ্ধ রেখেছে। অ্যান্টিনাস, হায়লাস, দাফনিস বা অ্যাপোলোর মুর্তি মার্বেলপাথরে অমর করে রাখতে ইচ্ছুক যে কোন ভাস্কর এদের থেকে যে কোন কাউকেই মডেল হিসেবে বেছে নিতে পারেন। ছেলেরা যেমন সুদর্শন, মেয়েরাও তেমনই সুন্দরী। ঝকঝকে আবলুস কাঠের মতন ত্বক, কয়লার মতন কাল না, বরং বরং মসীকৃষ্ণবরণ। গহনা বলতে কান থেকে ঝোলা পিতলের সর্পিল বলয়, গলায় ব্রাসের বলয়ের কলার। আর কাঁধের থেকে ঝোলানো, অর্ধেক বুক ঢাকা, হাঁটু ছোঁয়া, শরীর ঘিরে থাকা বাছুর বা ছাগলের চামড়াটিকে স্বস্থানে আটকে রাখার জন্য কোমরে পিতলের তারের সর্পিল কোমরবন্ধ।
হেহেদের আফ্রিকার রোমান বলা যেতে পারে।
এক ঘন্টা বিশ্রামের পরে আবার যাত্রা শুরু হল। আরও চার ঘন্টা পরে আমরা আসল মুকনডোকুতে পৌঁছালাম। উগোগোর এই প্রান্তে অনেক মানুষের বাস।
সুলতান স্বরুরু যেখানে থাকেন সেই কেন্দ্রীয় টেম্বের১ চারপাশে ছত্রিশখানা গ্রাম। গ্রাম থেকে ঝেঁটিয়ে লোক চলে এল সাদা-মুখো, আশ্চর্য পোশাক পরা, ভারি বিস্ময়কর অস্ত্র-ওলা সাহেবদের দেখতে। হাতের আঙুল গুনতে যতটুকু সময় লাগে, তারমধ্যেই যেসব বন্দুক বুম বুম করে গুলি ছুঁড়ে দেবে! হট্টগোল করা বুনোরা এমন ভিড় করেছিল যে আমি একমুহুর্তের জন্য ভেবেছিলাম যে এমনি কৌতুহল ছাড়াও এই হট্টগোলের আর রাস্তার পাশে এত লোক জড়ো হওয়ার পিছনে বুঝি আরও কিছু কারণ আছে।
চলা থামিয়ে জানতে চাইলাম কী হয়েছে, কী চাই আর কেন তারা এত শব্দ করছে?
একটা ষণ্ডা-গুন্ডা বদমাশ আমার প্রশ্ন শুনে ধরে নিল যে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করছি, আর তড়িঘড়ি ধনুক বের করল, তবে কিনা যতই তাড়াতাড়ি সে ধনুকের ছিলায় তির লাগাক, আমার বিশ্বস্ত তেরোটা গুলি পোরা উইনচেস্টারও প্রস্তুত, কাঁধে উঠে গেছে, আর সীসের মৃত্যুদূতকে জনতার উপর ঢেলে দেওয়ার আগে ধনুক থেকে তীর বেরনোর অপেক্ষা। সেই দেখেই ওই ষণ্ডা থেরসাইট-মশাই২ আর তাঁর দু-তিনজন অস্থিরমতি স্বজাতীয় সঙ্গীকে আমার রাইফেলের গুলির সীমানায় ফেলে, বাকি জনতা ভাগলবা, যত জলদি জমা হয়েছিল, ততটাই তড়িৎগতিতে। এক মুহূর্ত আগেও সেখানে গাদা গাদা লোক ছিল, সেখান থেকে এমনই আকস্মিক পলায়ন যে, বীরপুরুষদের ল্যাজ গুটিয়ে পালানো দেখে আমি রাইফেল নামিয়ে হা হা করে না হেসে পারলাম না। আরবরা, এইসব প্রবল জিদ্দিবাজি দেখে ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়েছিল। এবার তারা সন্ধি স্থাপন করতে এগিয়ে এল। তার ফলে অবশ্য সকলেই সন্তুষ্ট হল। পুরো ব্যাপারটা অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা হল আর জনতা আগের চেয়েও বেশি সংখ্যায় ফিরে এল; ও জনতার চাপে, ক্ষণিকের অশান্তির কারণ থেরসাইটসরা লজ্জায় পালাতে বাধ্য হয়েছিল। এবার একজন প্রধান এগিয়ে এল, পরে জানলাম যে তিনি স্বরুরুর ডান হাত, অচেনা সাদা মানুষের সঙ্গে তাদের ব্যবহার নিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে একটা বক্তৃতা দিল।
জোর গলায় বলল, 'গোগোরা, তোমরা জান না, এই মুসুঙ্গু একজন সুলতান (এমটেমি - সর্বোচ্চ উপাধি)। তিনি উগোগোতে কোনোনগোদের (আরবদের) মত হাতির দাঁতের ব্যবসা করতে আসেননি, এসেছেন আমাদের দেখতে আর ভেট দিতে। কেন তাঁকে ও তাঁর লোকদের অসম্মান করছ? তাদের শান্তিতে যেতে দাও। যদি তাঁকে দেখতে চাও তো কাছে যাও, তবে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করো না। তোমাদের মধ্যে যে প্রথম কোনও ঝামেলা তৈরি করবে, সে কিন্তু জেনে রেখ: আমাদের মহান এমটেমি কিন্তু জানতে পারবেন তোমরা তার বন্ধুদের সঙ্গে কীরকম আচরণ করেছ। প্রধান এই বক্তৃতাটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধ শেখ থানি সেটা আমাকে অনুবাদ করে শোনাল; সেটা বুঝতে পেরে আমি শেখকে বললাম প্রধানকে জানাতে যে, আমার বিশ্রাম নেওয়ার পরে প্রধান যেন আমার তাঁবুতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন।
উগোগোর শিবিরের এলাকা সর্বত্রই বড় বড় বাওবাব গাছ দিয়ে ঘেরা থাকে। সুলতানের বসতি থেকে আধামাইল দূরের খাম্বিতে এসে পৌঁছালাম। তখনও এত বিপুল সংখ্যায় লোক শিবিরের গায়ে সেঁটে আছে দেখে শেখ থানি ঝামেলাটা মেটানোর বা বন্ধ করার চেষ্টা করার সংকল্প নিলেন। নিজের সেরা পোশাকে সেজে তিনি সুলতানের কাছে গেলেন, তার দলের লোকদের সুরক্ষার আবেদন জানালেন। সুলতান মদে চুর হয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘কী চাও, চোর? এসেছেন তো আমার হাতির দাঁত বা কাপড় চুরি করতে! ভাগো, চোর কোথাকার! ' কিন্তু সেই বুদ্ধিমান সর্দার, যিনি অল্প আগেই লোকদের সাহেবদের প্রতি ব্যবহারের জন্য বকছিলেন, কণ্ঠস্বর সবেমাত্র ওয়াসুঙ্গুর চিকিত্সার জন্য লোকদের তিরস্কার করতে শোনা গেছে, থানিকে টেম্বে থেকে বেরিয়ে আসতে ইশারা করলেন, আর তার পরে খাম্বির দিকে এগিয়ে গেলেন।
শিবিরে তখন হুলুস্থুলু চলছে; প্রায় প্রতিটা ইঞ্চি জায়গা কৌতূহলী গোগোর দল দখল করে ফেলেছে; নড়াচড়া করারও জায়গা নেই। ন্যাময়েজিদের সঙ্গে গোগোদের ঝগড়া লেগে গেছে, সোয়াহিলি চাকররা চেঁচামেচি করছে যে গোগোরা তাদের তাঁবু ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে- মালিকদের জিনিসপত্র সব বিপন্ন; আমি অবশ্য তখন আমার তাঁবুতে নিজের ডায়েরি নিয়ে ব্যস্ত , যতক্ষণ এইসব ঝুটঝামেলা, হল্লাবাজি গোগো, ন্যাময়েজি আর এনগোওয়ানাদের মধ্যে হচ্ছে ততক্ষণ আমার কিছু যায় আসে না।
সর্দার শিবিরে হাজির হতেই সব চেঁচামেচি থেমে গেল। কোন জাদুবলে এমনটা সম্ভব হল সেটা বুঝতে আমাকে তাঁবুর বাইরে আসতেই হল। সর্দার সংক্ষেপে আসল কথাটি বলে দিল। বলল, “ওহে গ্রামবাসীরা, গোগোরা - শোন! কেন কোনোঙ্গোদের সঙ্গে ঝামেলা করছ? এসব কী ! নিজের গ্রামে ফিরে যাও- যাও! খাবার-দাবার বা গবাদি পশু বিক্রি করার উদ্দেশ্যে ছাড়া আর একজনও গোগোকে যদি শিবিরে দেখা যায়, তাহলে তাকে হুজুরকে কাপড় বা গরু দিতে হবে। বুঝেছ? ব্যস ভাগো!’ এই বলে, সে একটি লাঠি ছিনিয়ে নিয়ে শত শত লোককে শিবির থেকে তাড়িয়ে দিল, লোকগুলোও সন্তানসম বাধ্যতায় তার কথা মেনে নিল। এর পরের যে দু'দিন আমরা মুকনডোকুতে ছিলাম, আর কোথাও কোন ভিড়ভাট্টা নেই – শান্তিই শান্তি।
সুলতান স্বরুরুর নজরানার ব্যাপারটা অল্প কথায় মিটল। যে সর্দার সুলতানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে ভাল মানের এক ডটি রেহানি পেয়েই আহ্লাদিত, সাধারণভাবে যেমন নিয়ম সেই ছয় ডটি নজারানাই নিলেন, যার মধ্যে একটা প্রথম শ্রেণির কাপড়। মুকনডোকু-র পরে ভেট দিতেই হবে এমন আর কেবল একজন সুলতানই বাকি রইলেন। আর সে হল কিওয়েহের সুলতান, তার আবার এতই বদনাম যে যেসকল কাফেলামালিকদের নিজের কুলিদের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে, তারা কদাচিৎ কিওয়েহের পথ দিয়ে যায়- কিওয়েহের সুলতানের অশিষ্টতা আর বেমক্কা জুলুমবাজির তুলনায় নির্জন প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটার শ্রান্তিও ভালো! তবে কিনা কুলিদের তো আর নিজের মালটুকু বওয়া ছাড়া আর কোন কিছু ভাবতেও হয় না, অন্য কোন দায়িত্বও নিতে হয় না, কোন ঝামেলা হলেই তারা পিঠটান দিতে পারে- তারা দীর্ঘ জলহীন পদযাত্রার ক্লান্তি আর তৃষ্ণা সহ্য করার তুলনায় কিওয়েহের পথ ধরে চলতে বেশি পছন্দ করে। আর প্রায়শই কুলিদের পছন্দেই কাজ হত, বিশেষ করে যখন শেখ হামিজের মত ভিতু, দুর্বলচিত্ত লোক তাদের মালিক হত।
ক্রমশ...
চমৎকার। চলুক , দেখতে থাকি উনবিংশ শতাব্দীর আন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্ৰিকা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের চোখ দিয়ে।
স্ট্যানলি আফ্রিকাকে অন্ধকার মহাদেশ বলে ঘোষণা করার আগে অবধি এই অনচলে আলো হাওয়ার অভাব ছিল না। গ্রীক রোমান কেউই অন্য চোখে দেখেন নি। Through the dark continent বইটি লিখে সেই যে তিনি আফ্রিকাকে কালো রংটি দিলেন সেটি টেকসই হয়ে গেল । অতএব আলো দেবার জন্য দাস তামা হীরে ডাকাতির জন্য শ্বেত মানুষের আবির্ভাব!