ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
পঞ্চম দিনের ভোরে ন্যাবিগ্মা দ্বীপের আশ্রয় ছেড়ে আমরা বেরলাম। এক ঘণ্টারও কম সময়ে কেপ কিতুন্ডাতে পৌঁছলাম। এই অন্তরীপটি স্তূপাকার বেলেপাথরের তৈরি একটা নিচু ছাদের মত। যে বিশাল বক্ররেখ পর্বতশ্রেণীর থেকে লুয়াবা বা তার অন্যান্য সঙ্গী নদীদের জন্ম, সেই শৈলশ্রেণীর গোড়া থেকে প্রায় আট মাইল দূর পর্যন্ত এই ছাদের মতন বেলেপাথুরে জমি বিস্তৃত। এরপর আমরা গভীর উপসাগর পেরিয়ে কেপ কাসোফুতে এলাম। লুয়াবার ব-দ্বীপ এই উপসাগরের মাথায়। এই চত্বরে অসংখ্য গ্রাম রয়েছে। মুকুঙ্গুর অবস্থান খুব সুন্দর। এখান থেকে পরপর কিগোঙ্গো, কাটুঙ্গা ও বুগুলুকা ইত্যাদি অন্তরীপ বা কেপগুলো সব দেখা যাচ্ছে। এখানে পৌঁছাতে সবকটা জায়গাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে।
পঞ্চম দিনে আমরা মুকুঙ্গুতে থেমেছিলাম, সেখানে আমাদের থেকে হঙ্গা বা নজরানা চাওয়া হল। যেসব কাপড় আর পুঁতির ভরসায় আমাদের নৌ-অভিযান চলছিল, সেগুলো আমার, তবে ডাক্তার, বয়সে বড়, আরও অভিজ্ঞ এবং দলের সকলের মান্যব্যক্তি হওয়ায়, এই সমস্ত দাবি পূরণের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। এই নজরানার নিষ্পত্তি করার বাবদে আমার অনেক সময়ই এমন ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর সব অভিজ্ঞতা হয়েছে যে এই অভিজ্ঞ অভিযাত্রীটি কীভাবে সেই কাজটি সম্পন্ন করেন তা দেখার বেশ কৌতূহল ছিল।
মুকুঙ্গুর মাটেকো (মুটওয়ারের নিচের ধাপের ব্যক্তি) আমাদের থেকে আড়াই ডটি চেয়েছিল। এই হল চাহিদা। অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের জানানো হল। ডাক্তার জানতে চাইলেন, আমাদের জন্য কিছু আনা হয়েছে কিনা। উত্তরে বলা হল, ‘না, এখন তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিছু পাওয়া যাবে না। তবে এখন নজরানা দিলে, আমরা যখন ফেরত আসব তখন কিছু না কিছু পাব।’ লিভিংস্টোন, তাই শুনে হাসলেন, মাটেকো তখন তার সামনেই ছিল, তাকে বললেন, ‘আচ্ছা, যদি এখন আমাদের জন্য কিছু না পাওয়া যায়, আর আমরা ফিরলে তখন দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে নজরানার ব্যাপারটাও ফেরার সময় অবধি মুলতুবী রাখা ভাল।’ এই শুনে মাটেকো পুরো হাঁ, সে মোটেই এসব মানতে রাজি না। তার অসন্তোষ দেখে আমরা তাকে একটা ভেড়া — একটা মোটে ছোট ভেড়া— নিয়ে আসতে অনুরোধ করলাম— আমাদের পেট তখন প্রায় খালি, দিনের অর্ধেকটারও বেশি সময় ধরে খাবারের অপেক্ষায়। এইবার সে শুনল। বুড়ো মানুষটা তাড়াতাড়ি আমাদের জন্য একটা বাচ্চা ভেড়া আর তিন গ্যালন মিষ্টি তেজালো জোগ্গা বা তাড়ি নিয়ে এসে হাজির হল। বিনিময়ে ডাক্তার তাকে আড়াই ডটি কাপড় দিলেন। মেষ শাবকটি তখনই মারা হল, আর, আমাদের হজমশক্তি তখন তুঙ্গে— ফলে মাংস ভালই হজম হল। কিন্তু, হায়, জোগ্গা বা তাড়ির প্রভাব তত সুবিধার হল না! সুসি, ডাঃ লিভিংস্টোনের অমূল্য সহায়ক আর বোম্বে, আমার কাফেলার সর্দার, এঁদের দু'জনের উপর ক্যানো পাহারার দায়িত্ব ছিল; কিন্তু, ঘোর নেশা-জমানো তাড়ি অনেকটা খেয়ে, এঁরা এমন জমিয়ে ঘুম দিয়েছিল! ফলে সকালে উঠে ডাক্তার ও আমাকে হায় হায় করতে হল— কটা বেশ দামি ও অপরিহার্য জিনিস গায়েব; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডাক্তারের ৯০০-ফ্যাদম জলের গভীরতা মাপার দড়ি, আমাদের অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য ৫০০ রাউন্ড পিন, রিম ও সেন্ট্রাল-ফায়ার কার্তুজ আর সেই সঙ্গে আমার নব্বইটা গাদা বন্দুকের বুলেট। এগুলো ছাড়াও, এক বড় ব্যাগ আটা আর ডাক্তারের সাদা চিনি যতটুকু মজুত ছিল, পুরোটাই হাওয়া। রুন্ডিদের দেশের প্রতিকূল পরিবেশে এগুলো যে কত অপরিহার্য ছিল! বোম্বের উপর ভরসা করে এই তৃতীয়বার বিশাল ক্ষতি হল। এই নিয়ে নিরানব্বইতম বার আমি স্পেক ও গ্রান্টের দারুণ প্রশংসার উপর ভরসা করার ফলে তিক্ত ভাবে আফসোস করলাম। নেহাতই এই বর্বর তস্করেরা স্বভাবতই এমন ভীতু যে গোটা নৌকা শুদ্ধ চম্পট দেয়নি, বোম্বে আর সুসিকেও তো ক্রীতদাস হিসেবে ধরে নিয়ে যেতে পারত! বেশ কল্পনা করতে পারলাম যে ডাক্তারের ওই চিনির ভাণ্ডার দেখে আর তার অপূর্ব স্বাদ চাখার পরে তারা যে কি দারুণ অবাক হয়েছিল বা শ্বেতাঙ্গদের অদ্ভুতরকম গোলাবারুদ দেখে তারা কেমন হাঁ হয়েছিল! আমার আন্তরিক প্রার্থনা যে তারা যেন ওই বিস্ফোরক গুলি বা রিম কার্তুজের আঘাতে আহত না হয়! ওই সব মারাত্মক জিনিসপত্রের প্রকৃতি সম্বন্ধে তো আর তারা কিছু জানে না! তাই বাক্স আর তার ভিতরের জিনিসপত্র যেন প্যান্ডোরার বাক্সের মতন তাদের বিপদের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়!
ক্ষতির কথা ভেবে খুব দুঃখ হল! তাও রোজকার মতন সময়েই আবার ষষ্ঠ দিনের নৌ যাত্রা শুরু করলাম। কিগওয়েনা, কিকুমা ও কিসুনওয়ে এইসব নদীর মোহনা পেরিয়ে পারের কাছ ঘেঁষে চলছি; আর যখন কোন খাঁড়ি দেখে বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হচ্ছে, তখন তার বাঁক ধরে নৌকা চালাচ্ছি। জলযাত্রার সময় - প্রতিটি দিন একই রকম দৃশ্য বয়ে আনে - আমাদের ডানদিকে রয়েছে উরুন্ডির পাহাড় , মাঝে মাঝেই গভীর গিরিখাত পড়ছে - তার মধ্য দিয়ে অনেক অনেক নদী, জলস্রোত বয়ে গিয়ে পড়েছে ওই বিশাল হ্রদে; পাহাড়ের পাদদেশে পলি বিছানো সমতল, পাম আর কলাঝাড়ে ভরা - গাছের ছায়ায় ছায়ায় দল বেঁধে রয়েছে অনেক অনেক গ্রাম। মাঝে মাঝেই আমরা লম্বা, সরু নুড়ি বিছানো বা বালুকাময় সমুদ্র সৈকত অতিক্রম করছি, সেখানে চটজলদি হাট বসেছে - মাছ আর সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর খাবার দাবার লেনদেন হচ্ছে। তারপরে বহুদূর অবধি ছড়ানো জলাভূমি পেরলাম, পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য ছোট ছোট নদী মিলে এই জলাভূমি তৈরি করেছে - সেখানে ম্যাটেটে আর প্যাপিরাসের রাজত্ব। এখানে পাহাড়গুলো জলের কাছে চলে এসেছে, জলের কিনারায় এসে তাদের ধারগুলো আচমকা নেমে এসেছে; তারপর গভীর ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে গেছে, এরপর তার গোড়ায় এক থেকে আট মাইল চওড়া একটি পলিবিছানো সমতল। প্রায় সবসময়ই আমরা দেখছি যে ঢেউয়ের খুব কাছেও নৌকায় জোরে জোরে দাঁড় বওয়া হচ্ছে, নৌকা উল্টে কুমীরে ভোজ হওয়ার বিপদের সম্ভাবনাকে একদম পাত্তা না দিয়ে। কখনও কখনও সামনে সামান্য দূরে এক একটা ক্যানো দেখা যাচ্ছে; তখন আমাদের লোকেরা, চীৎকার করে আর গান গেয়ে, তাকে পার হয়ে যাওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করছে। আমাদের কান্ড দেখে, স্থানীয়রাও নিজের কাজে মন দিচ্ছে, আর সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড় বাইছে, অবসরের তুলনামূলক শারীরবিদ্যা পাঠের প্রভূত সুযোগ! অথবা একদল জেলেকে দেখছি - ভারি স্বাভাবিক অলস ভঙ্গিতে সমুদ্র সৈকতে গা এলিয়ে বসে থাকতে , কৌতূহলী দৃষ্টিতে তারা পাশ দিয়ে যাওয়া ক্যানোগুলোকে দেখছে; তারপরে আমরা একরাশ নৌকা পেরিয়ে এলাম - তাদের মালিকরা তাদের কুঁড়েঘরে চুপচাপ বসে আছে, কেউ ছিপ- বঁড়শি নিয়ে ব্যস্ত - কেউ বা জলে জাল ফেলছে, জাল ভরে মাছ তোলার আশায় কয়েকজন লোক আবার বিশাল টানা জাল তীরের কাছেই জলে নামাচ্ছে - শিশুরা জলে অবিশ্রান্ত খেলাধুলা করছে, গাছের ছায়ায় বসে তাদের মায়েরা তাদের খেলা দেখছে , এইসব দেখে বুঝলাম যে বড় নদীগুলির আশেপাশে ছাড়া হ্রদে খুব একটা কুমির নেই।