ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এ পর্বে শুরু হলো পঞ্চদশ অধ্যায়— উজিজি থেকে উন্যানিয়েম্বে যাত্রা। তরজমা স্বাতী রায়
নিজেদের কালো ভালুক-চামড়া, উজ্জ্বল পারস্য দেশীয় কার্পেট ও পরিষ্কার নতুন মাদুরের উপর গুছিয়ে বসে ভারি আরাম হল। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে আরামসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমাদের পিকনিকের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে গল্প শুরু হল। লিভিংস্টোন আমাদের রুসিজির যাত্রাকে পিকনিকই বলে থাকেন। মনে হচ্ছিল পুরোন সুখের স্মৃতিচারণ করা দিনগুলো ফিরে এসেছে। যদিও আমাদের বাড়িটা নেহাতই সাধারণ, চাকরবাকরেরাও নেহাতই সামান্য, নগ্ন, বর্বর; তবু উন্যানিয়েম্বে থেকে সেই ঘটনাবহুল যাত্রার পর এই বাড়ির কাছেই আমার লিভিংস্টোনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল— এই বারান্দাতে বসেই টাঙ্গানিকা হ্রদের পশ্চিমপারের বহুদূরের, মনোমুগ্ধকর জায়গাগুলোর সম্বন্ধে তাঁর বিস্ময়কর গল্পগুলো শুনেছিলাম; ঠিক এই খানেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়; আর সেই থেকে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়েই চলেছে আর তিনি যখন বললেন যে আমার প্রহরায়, আমার খরচে আর আমারই পতাকার তলায় তিনি উন্যানিয়েম্বে যেতে চান, আমি তো সপ্তম স্বর্গে পৌঁছে গেলাম। এই পুরানো মাটির দেয়াল, ন্যাড়া কড়িবর্গা, পুরোন খড়ের চাল, আর এই অদ্ভুত দেখতে পুরানো বারান্দা যতদিন বেঁচে থাকব আমার কাছে এক ঐতিহাসিক স্মৃতি হয়ে থাকবে। ছবি আকঁতে পারি তাই, তুচ্ছ পুরানো বাড়িটাকে অমর করে রাখতে একটা ছবি এঁকে রাখলাম।
এখনই বললাম যে লিভিংস্টোনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ক্রমবর্ধমান। এটা সত্যি। আর দশজন বিখ্যাত লোকের যেমন সাক্ষাৎকার নিই, তাঁদের স্বভাবের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার জন্য বা তাঁদের বিশিষ্ট মতামত তুলে ধরার জন্য, সেরকমই শান্তভাবে, প্রসন্নচিত্তে যে লোকটির সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলাম, তিনি আমাকে সম্পুর্ণ জয় করেছেন। বলবো, আমি ঠিক কি করতে এসেছিলাম? এটা একদম খাঁটি কথা যে আমি তাঁর সাক্ষাতকার নিতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম তিনি কী বললেন তার উপর একটা বড় প্রতিবেদন লিখব, তাঁর ছবি আর জীবনের ঘটনাবলী বর্ননা করে।তারপর তাঁকে ‘‘ও র্যেভোয়া’’( বিদায়) জানিয়ে ফিরে যাব। আমার ঘোর ধারণা ছিল যে তিনি খুব তেঁড়েটে আর খ্যাচখেঁচে হবেন, ফলে তার সঙ্গে আমার ঝামেলা বাঁধতে দেরি হবে না। তাছাড়াও, তিনি একজন ইংরেজ -সম্ভবত এমনই একজন যিনি পরকলা ব্যবহার করেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি আমার দিকে কটমট করে বা শীতল চোখে তাকাবেন — দুটোই তো একই ব্যাপার —আর অ্যাবিসিনিয়ার সিন্ধে ঘোড়ার তরুণ কর্নেটের মতো, কয়েক পা পিছিয়ে, ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে প্রশ্ন করবেন,‘‘কার সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হচ্ছে আমার?’’ বা সেই সেনাফের প্রাচীন জেনারেল, স্যার-এর মতো ঘোঁত ঘোঁত করে বলবেনন, ‘‘আচ্ছা, মশাই, কে আপনি? এখানে কি চান?’’ সত্যি , ইংরেজ ভদ্রলোকদের সঙ্গে আমার পরিচয়ের অভিজ্ঞতা এমন যে, তিনি যদি বলতেন, ‘‘আমি কি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি, স্যার, আপনার কাছে কি আমাকে দেওয়ার মত কোন পরিচয়পত্র আছে?’’ টাঙ্গানিকা হ্রদের তীরে এইরকম প্রশ্ন করলে! আমি শুধু উজিজির ওপারের পাহাড়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিতাম; সেখানে দু'দিন বিশ্রাম নিয়ে, তারপর ফিরে যেতাম, বিশ্বকে জানাতাম যে কীভাবে আমার থোঁতা মুখ ভোঁতা করা হয়েছে। কিন্তু লিভিংস্টোন একজন সত্যিকারের খ্রিস্টান, মহৎ হৃদয়, উদার মনের, খোলামেলা মানুষ—একজন নায়কের মতো ব্যবহার করেছিলেন। আমাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, বলেছিলেন যে তিনি আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন। যেন তাঁর নিজের কথা – ‘‘আমি তাঁকে নতুন জীবন দিয়েছি’’ - এটাই প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যখন আমি পালাজ্বরে অসুস্থ হয়ে, জীবন ও মৃত্যুর মাঝে পাক খাচ্ছি, তখন তিনি বাবার মতো আমার সেবাযত্ন করেছেন। আর এখন তো প্রায় এক মাসেরও বেশি আমরা এক সঙ্গে আছি। আশ্চর্য আর কি যে আমি এই লোকটিকে পছন্দ করি, তার মুখ তার প্রকৃতির প্রতিফলন, তাঁর হৃদয়ে মূলত শুভবোধ, তাঁর লক্ষ্যগুলি এতটাই উচুঁ, যে আমি মাঝে মাঝে আচমকা বলে বসতাম:‘‘কিন্তু এটাও ভাববেন, ডাক্তার, যে আপনার পরিবারও তো আপনাকে দেখতে চায়। খুব তীব্র ভাবেই দেখতে চায়। আপনাকে আমার সঙ্গে বাড়িতে ফিরতে অনুরোধ করছি। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, উপকূলের পথে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপের দায়িত্ব আমার । উন্যানিয়েম্বেতে, চড়ার জন্য সবচেয়ে ভালো গাধার ব্যবস্থা করব। যা দরকার মুখের কথা খসালেই সেগব মেটাব। নীল নদের উৎসসন্ধান এখন ছাড়ুন। বাড়িতে এসে বিশ্রাম করুন; তারপর, এক বছর বিশ্রামের পরে, স্বাস্থ্য ফিরলে, আবার ফিরে আসবেন আর কাজ শেষ করতে পারবেন।’’
কিন্তু কখনও তাঁর উত্তর ছিল, ‘‘সত্যিই তো! আমার পরিবারকে দেখতে যাওয়াই উচিত। সন্তানদের চিঠিগুলো পড়লে তো ভারি মন কেমন করে! তবে এখন বাড়িতে গেলে হবে না; আগে নিজের কাজ শেষ করতে হবে। কেবলমাত্র জিনিসপত্রের অভাবে কাজটা আটকে আছে। বেকারস হ্রদের সঙ্গে বা নীল নদের পেথেরিকের শাখার সঙ্গে সংযোগের সুতো ধরে এর মধ্যেই আমার নীল নদের উৎস খুঁজে বার করে ফেলা উচিত ছিল। আর মাত্র এক মাস চলতে পারলেই আমি বলতে পারতাম, ‘কাজ শেষ।’ কিন্তু ডক্টর কার্ক আমাকে খালি দাসের পরে দাস পাঠাচ্ছেন; তার তো জানা উচিত, দাসেরা ঠিক কেমন! কেন যে তিনি লোকের খোঁজে বেনিয়াদের কাছে যান, তা বুঝি না বাপু।’’
যে লোকগুলো ডাক্তারকে তার আকর্ষণীয় আবিষ্কারের মুখ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল, তাদের কয়েকজন তখনও উজিজিতে ছিল। তাদের হাতে তখনও সেই গভর্নমেন্টের দেওয়া এনফিল্ড রাইফেল। মজুরি না মেটানো অবধি সেগুলো তারা ছাড়বে না। আর তারা জাঞ্জিবারে চুক্তি করেছিল যে তাদের প্রভু যেখানেই যেতে বলবেন সেখানেই তাদের যেতে হবে আর সেই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ইংরেজ কনসালের থেকে প্রত্যেকে ৬০ ডলার করে অগ্রিম পেয়েছিল। অথচ যেখানে যাওয়ার দরকার সেখানে তারা যায়ইনি। বরং ডাক্তারকে বোকা বানিয়ে, তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল। তাই এটা একেবারেই মেনে নেওয়া অসম্ভব যে ওই লোককটা বোম্বাই সরকারের দেওয়া অস্ত্রগুলি ফেরত না দিয়ে ডাক্তারের উপর টেক্কা দেবে। ডাক্তারের বন্ধু আরব শেখদের কথা শুনছিলাম, ওদের ত্যাগ করার জন্য তাদের হালকা পরামর্শ দিয়েছিলাম। বিদ্রোহীদের গোঁয়ার্তুমিও তখন প্রত্যক্ষ করলাম; এবং তখনই, সাইদ বিন মাজিদের বাড়ির বুরজানিতে, আমি এই বিষয়ে মুখ খুললাম, শুধুমাত্র একগুঁয়ে দাসদের সুবিধার জন্য নয়, আরবদের সুবিধার জন্যও; সেই সঙ্গে এটাও বলতে বাধ্য হলাম যে লিভিংস্টোনকে জীবিত ফেরত পেয়েছি এটা খুবই ভাল কথা, তার মাথার একটি চুলেও আঘাত লাগলে আমি উপকূলে ফিরে যেতাম আর দলবল নিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফিরে আসতাম।
লিভিংস্টোনের হাতে তাঁর বন্দুকগুলো ফেরত দেওয়া হবে এই আশাতেই প্রত্যেকদিন বসে ছিলাম, বলপ্রয়োগের আর দরকার হবে না। কিন্তু এক মাসেরও বেশি কেটে গেল, তখনও অস্ত্রগুলো ফেরত এল না। আমি সেগুলো ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করার অনুমতি চাইলাম। সেটা মঞ্জুর হল। একটুও দেরী না করে, ডাঃ লিভিংস্টোনের সাহসী সেবক সুসিকে প্রায় এক ডজন সশস্ত্র লোক দিয়ে সেই উদ্ধারকার্যে পাঠালাম। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে সেগুলো আমাদের দখলে এল। কোনওরকম ঝামেলা ছাড়াই। সুসি যদি অপদার্থ চোর না হত, তাহলে ওর নিজের ওজনের সমান রূপো দিয়ে ওর দাম মাপা হত।
ডাক্তার আমার সাথে উন্যানিয়েম্বে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১ নভেম্বর, ১৮৭০ সালে জানজিবার থেকে ব্রিটিশ কনসাল তার জন্য যেসব জিনিসপত্র পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো নেওয়ার জন্য তার যাওয়া। যেহেতু আমার হাতে সেই রসদসকলের প্রহরার দায়িত্ব ছিল, তাই উজিজি থেকে উন্যানিয়েম্বে যাওয়ার রাস্তাগুলো ভালভাবে জানাবোঝাও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এমন একজন মানুষকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটার সঙ্গে সঙ্গে যা যা অসুবিধা ও দায়িত্ব জুড়ে ছিল, সে সম্পর্কে আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাছাড়াও এর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতিও জড়িয়ে গিয়েছিল। আমার কোনো অবিবেচনার ফলে, আমার সঙ্গে থাকাকালীন যদি লিভিংস্টোনের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগে, তাহলেই সঙ্গে সঙ্গে বলা হবে, "আহ! স্ট্যানলির সঙ্গে না থাকলেই, তিনি এখন বেঁচে থাকতেন।"