ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে উজিজির পথে এগিয়ে চলার বর্ণনা। এ পর্বে কাফেলার সদস্যদের কথা এবং এক নির্জলা হ্রদে পৌঁছনর কাহিনি। তরজমায় স্বাতী রায়
আসমানি আমাদের পথপ্রদর্শক। তার বিশাল চেহারা, ছয় ফুটের ওপরে লম্বা, ঘাড়ে-গর্দানে - একেবারে হারকিউলিস। পথপ্রদর্শক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সে একজন ফান্ডিও, কখনও কখনও তাকে ফান্ডি আসমানি বা শিকারি বলা হয়। কুসংস্কারের ঢিবি একটা লোক। সে তার বন্দুকের খুব যত্ন নেয়, আর তার তাবিজের বিনুনি পাকানো দড়িটা আজ পর্যন্ত সে যত প্রাণী মেরেছে সবার রক্তে চোবানো। সিংহকে খুব ভয় পায়, যেখানে সিংহ থাকতে পারে বলে জানা সেখানে সে কখনই বেরোবে না। আর সব প্রাণীকেই সে শিকার হিসাবে দেখে এবং তাদের ধাওয়া করতে তার কোন ক্লান্তি নেই। মুখে হাসি ছাড়া তাকে খুব কমই দেখা যায়, তবে দিলখোলা হাসি নয়, একটা কুণ্ঠিত অবিশ্বাসী হাসি। যে কারুর গলায় ছুরি বসাতে বসাতেও সে হাসতে পারে।
চৌপেরেহের বয়স তিরিশের কাছাকাছি। বলিষ্ঠ ছোটখাটো মানুষ। খুব ভাল স্বভাবের, রসিক মানুষ। চৌপেরেহ যখন শুকনো রসিকতায় ভরা মার্ক টোয়েন স্টাইলে কথা বলে, তখন গোটা শিবিরের সবাই হেসে ওঠে। আমি চৌপেরেহের সাথে কখনো ঝগড়া করিনি, কখনো না। চৌপেরেহকে একটা মিষ্টি কথা বললে সে তার উত্তরে একটা ভাল কাজ করবে। সবচেয়ে শক্তিশালী, স্বাস্থ্যবান, বন্ধুত্বপূর্ণ, বিশ্বস্ত এক মানুষ। একজন ভাল দলের লোক কেমন হতে হয় সে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
খামিসি বছর কুড়ির একজন পরিপাটি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছোকরা, হেঁড়ে গলার চটপটে লোক, হামবড়াই করতে ভালবাসে আর ভিতুর তস্য ভিতু। সুযোগ পেলেই চুরি করবে। সারাক্ষণ ভালবেসে বন্দুকটাকে আঁকড়ে ধরে আছে। সবসময় চিন্তা এই বুঝি একটা স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেল বা একটা চকমকি ঠিকমত আগুন জ্বালাতে পারল না, তবে সে যেমন কাঁপে যে আমার সন্দেহ হয়, সে আদৌ শত্রুর দিকে তার বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়তে পারবে তো? খামিসি বরং তার ছোট ছোট সুন্দর পা দিয়ে দৌড়ে পালাবে।
আম্বারীর বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। সে স্পেকের ‘বিশ্বস্তদের’ একজন এবং আমারও খুব বিশ্বাসভাজন। শত্রুর উপস্থিতি বা আসন্ন ব্যক্তিগত বিপদ ছাড়া সে আমার পাশ থেকে পালাত না। বেশ বুদ্ধিমান, তবে নেতা হওয়ার মত বুদ্ধি নেই তার ঘটে— একটি ছোট দলের দায়িত্ব নিতে পারে আর তাদের সম্পর্কে খুব ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে পারে। একটু অলস, আর ভাল করে জীবনযাপন করতে ভালবাসে। হাঁটতে ভারি অপছন্দ করে, এক যদি না তার কাছে বন্দুক ছাড়া আর কিছু বহন করার না থাকে।
জুমাহ্ দলের সব থেকে বেশি নির্যাতিত মানুষ। আমি নির্যাতন করিনি, আমার সঙ্গে তার খুব কমই ঝগড়া হয়েছে, কারণ তার একটা বুড়িদের মতন স্বভাব আছে, সেই ধারা অনুসারে সে আমার জন্য যথাসাধ্য করতে প্রস্তুত, যদিও নিজের ভাগ্যকে ভয়ানক দোষ না দিয়ে, খুনখুন করে কান্নাকাটি না করে সে এক পাউন্ড ওজনও বইবে না। আমার কাছে সে এক আবেগপ্রবণ বেচারা: কাফেলার এলেবেলেদের কাছে সে কঠোর আর আপসহীন। তবে সত্যি কথা বলতে, জুম্মা না থাকলেও বিশেষ কিছু এসে যেত না: একটা অকম্মার ঢেঁকি, শোধরানোর অতী্ত - যা কাজ করে তার থেকে বেশি খায় আর সারাক্ষণ শুধু গজরগজর আর ঝগড়াঝাঁটি করে বেড়ায়, বোকা একটা।
উলিমেঙ্গোর বয়স তিরিশ। আমার দলের সবচেয়ে পাগল ও হঠকারী লোক। রাম-ভীতু, কাপুরুষ, এদিকে মুখেন মারিতং জগত। তবে যদিও সে আনন্দ করতে, মজা করতে ভালবাসে, কাজ করতে মোটেই পিছপা না। তার মত একশটা লোক পেলে গোটা আফ্রিকা ঘুরে আসতে পারতাম, অবশ্য যদি না যুদ্ধ করতে হত। এটা মনে রাখতে হবে যে মিরাম্বোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এনগোয়ানার যুদ্ধ-গান গাইতে গাইতে সেই অবশ্য আমার ছোট সেনাদলকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, আবার যখন পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তখন আমার দলের লোকদের মধ্যে সেই প্রথম এমফুটোর দুর্গে পৌঁছেছিল। খুব জোরে ছুটতে পারে, আর ভাল শিকারি। মাঝে মাঝেই আমার ভাঁড়ারে তার দৌলতে নতুন নতুন খাবার জমা হত, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ ।
ফেরাজ্জি, স্পেকের দলের বাসন-মাজত, আমার দলে ছিল রাঁধুনি। বন্দর সালাম দল ছেড়ে যাওয়ার পরে তার এই পদোন্নতি। আবদুল কাদের তো সবসময়ই কোন কোন না শারীরিক সমস্যায় ভুগত। থালা-বাসন মাজার জন্য কাপড়ের অভাবে ভুট্টার খোসা, কচি ডালপালা, একগোছা পাতা বা ঘাস যা পেত তাই দিয়েই কাজ সারত। একটা থালা চাইলাম, আর তারপর যদি একটা কালো তেলতেলে ভুসোকালির দাগের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাই, তাহলে সে ভাবে একটা আঙুলের ঘষা দিয়ে সেটা তুলে দিলেই তো যথেষ্ট । যদি বলি যে চামচটা নোংরা, ফেরাজ্জির ধারণা যে খানিকটা লালা দিয়ে তার নেংটি কাপড়ে ঘষে দিলেই সবচেয়ে খুঁতখুঁতে লোকেরও আর কিছু বলার থাকার কথা না। আফ্রিকায় আমার খাওয়া প্রতি পাউন্ড মাংস, আর প্রতি তিন চামচ পরিজের প্রত্যেকটাতে অন্তত দশদানা করে বালি ছিল। তাকে হুমকি দিয়েছিলাম যে জাঞ্জিবারে পৌঁছানর পরে সেখানকার মহান ইংরেজ ডাক্তারকে আমার পেট কাটতে বলব আর গুনব যে কটা বালির দানা মেলে, প্রত্যেকটা বালিদানার জন্য ফেরাজজিকে এক ডলার করে দিতে হবে। সে তো জানত যে আমার পেটে অনেক বালি আছে, অতএব ক্ষতিপূরণের পরিমাণও অনেক হবে, ফলে সে মাঝেমাঝেই মন খারাপ করে থাকত। এ ছাড়া, ফেরাজ্জি একজন ভাল রাঁধুনি, ততটা সুদক্ষ না হলেও, খুবই পরিশ্রমী। হাঁটতে হাঁটতে থামার হুকুম দেওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই সে এক কাপ চা, সেই সঙ্গে তিন- চারটে গরম প্যানকেক তৈরি করে ফেলত, সে জন্য আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, কারণ লম্বা হাঁটার পরে আমার প্রায় সবসময়ই পেটে আগুন জ্বলত। ফেরাজ্জি আনইওরোতে বোম্বের বিরুদ্ধে, বারাকার পক্ষে ছিল আর স্পেক যখন সেই প্রশ্নে বোম্বের পক্ষ নিয়েছিলেন, ফেরাজ্জি বারাকাকে এতই ভালোবাসতো যে মাইনের মায়া ত্যাগ করে সে স্পেকের কাজ ছেড়ে দেয়!
মাগাঙ্গা ছিল একজন ন্যামওয়েজি, এমকোয়েনকওয়ের বাসিন্দা, খুবই বিশ্বস্ত চাকর, চমৎকার কুলি, একেবারে নিখুঁত মেজাজের লোক। পথ চলার সময় সে-ই সবসময় ন্যামওয়েজি কুলিদের গান শুরু করত। বন্য, চনমনে গান। আর যতই গরম বা যতই লম্বা পথ হোক না কেন, সেই গানই সকলকে চাগিয়ে তুলত। সেই সব সময়ে সবাই মিলে গাইত, মাইল-মাইল দূর থেকে শোনা যাবে এমন গলা ছেড়ে গাইত - বিরাট বিরাট বনগুলো সুরে ঝমঝম করত, চারপাশের অনেক দূর অবধি ছোট-বড় প্রতিটা প্রাণী চমকে উঠত। একটা গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছালে, জানা নেই তো যে সে গ্রামের লোকেরা আমাদের শত্রু না কি, মাগাঙ্গা তখন তার গান শুরু করত, পুরো দল একসঙ্গে গেয়ে উঠত, তার থেকে আমরা বুঝতাম সেখানকার লোকেরা আমাদের বন্ধু না শত্রু। যদি শত্রু হয় বা আমাদের ভয় পায়, তাহলে গেটগুলো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেত, এবং ভিতর থেকে কালো মুখগুলো আমাদের দিকে কটমট করে তাকাত; আর বন্ধু হলে, তারা আমাদের স্বাগত জানাতে বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্ভাষণ জানাতে সদর দরজার বাইরে ছুটে আসত।
আমার পরে অভিযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হল সেলিম, আরব যুবক, জেরুজালেমের খ্রিস্টান। মহান বিশপ গোবাটের কাছে তার পড়াশোনা। যদি তার স্কুলের সব আরব ছেলেরাই সেলিমের মত কাজের হয়, তাহলে বিশপ গোবাট অবশ্যই তাঁর মহৎ কাজের জন্য সর্বোচ্চ প্রশংসার দাবিদার। সেলিম না থাকলে আমি এমফুটোতেই মারা যেতাম। সেলিম ছাড়া আফ্রিকার অভ্যন্তরের আরব-প্রধানদের সঙ্গে এত ভাল বন্ধুত্ব হত না, এত ভালভাবে তাদের সঙ্গে কথাও বলতে পারতাম না, কারণ আমি আরবি বুঝলেও বলতে পারতাম না। এই ছেলেটিকে ১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে নিয়োগ করেছিলাম। সেই সময় থেকে সে আমার সঙ্গে দক্ষিণ রাশিয়া, ককেশাস ও পারস্য ভ্রমণ করেছে। আমার সেবায় জান লড়িয়ে দেয়, খুব সৎ ও বিশ্বস্ত, একেবারে ভয়হীন। এত যে প্রশংসা করছি, তবু মনে হয় তার থেকে যে সেবা পেয়েছি তার কাছে এসব নেহাতই তুচ্ছ।
কালুলু কীভাবে আমার দলে এসে জুটেছিল আর কীভাবে তার বর্তমান নামকরণ হয়েছিল তা আগেই বলেছি। শীঘ্রই বুঝলাম যে সে কত চটপট সব কিছু শিখে নিচ্ছে, যার ফলে, তাকে আমার ব্যক্তিগত খানসামা করে দিলাম। এমনকি সেলিমও কালুলুর তৎপরতার সঙ্গে তাল রাখতে পারত না। খাওয়ার টেবিলে আমার কি লাগবে না লাগবে সে দিকে কালুলুর সজাগ দৃষ্টি। তার ছোট্ট কালো চোখগুলো ক্রমাগত খাবারের উপর ঘুরত , আরও কী কী দরকার বা কিসের কোন আর দরকার নেই সেদিকে তার পুরো নজর।
ওই যে জায়গাটা একটা দমবন্ধ করা সংঘর্ষের প্রায়-সাক্ষী হতে যাচ্ছিল, সেই জায়গাটা ছাড়ার প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পরে জিওয়ানিতে পৌঁছলাম। জিওয়ানি, বা হ্রদে কোন জল ছিল না, এক ফোঁটাও না, যতক্ষণ না আমার লোকেদের শুকনো জিভ তাদের মনে করিয়ে দেয় যে জলের জন্য মাটি খুঁড়তে তাদেরই এগিয়ে যেতে হবে । শক্ত মজবুত সুচালো মুখের লাঠি দিয়ে কাজ হচ্ছে, খোঁড়া চলছে শুকনো শক্ত দলা হয়ে যাওয়া হ্রদের তলদেশে। ছ ফুট খোঁড়ার পরে তাদের শ্রমের পুরস্কার মিলল। কয়েক ফোঁটা ঘোলাটে তরল গা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল - প্রচণ্ড তৃষ্ণায় সেই জলই সাগ্রহে খেয়ে নিলো। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় বালতি, লাউ এর খোল ইত্যাদি বিবিধ রকমের জলপাত্র নিয়ে দক্ষিণে রওনা দিল, সেখানে উকাম্বার 'টঙ্গোনি' নামের একটা জনহীন ফাঁকা জায়গা আছে। প্রায় তিন ঘণ্টার মধ্যে তখন-তখন ব্যবহারের জন্য অনেকটা ভাল ও পরিষ্কার জল নিয়ে তারা ফিরে এলো।
(ক্রমশ)