ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। গত পর্ব থেকে শুরু হয়ে এ পর্বেও চলছে মানুষ হিসেবে লিভিংস্টোন কেমন তার বর্ণনা। তরজমা স্বাতী রায়
যদি তাঁর চরিত্রের ধর্মীয় দিকটি বিবেচনা না করি, ডাঃ লিভিংস্টোনকে জানা সম্পূর্ণ হবে না। তাঁর ধর্ম তাত্ত্বিক ধর্ম নয়, বরং এ এক ধ্রুব, অকপট, আন্তরিক অনুশীলন। কাউকে দেখানোর জন্যও না, উচ্চকিতও না, শান্ত, ব্যবহারিক জীবনে এই সদাজাগ্রত বোধের প্রকাশ। একেবারেই আক্রমণাত্মক নয়। এই বিষয়টা কখনও কখনও বিরক্তিকরও বটে, যদি অপ্রাসঙ্গিক না হয়। তাঁর মধ্যে ধর্মের মাধুর্য বিরাজমান; কেবল ভৃত্যদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারই না, স্থানীয় গোঁড়া মুসলমান বাসিন্দাদের প্রতি, তাঁর সংসর্গে আসা সকল মানুষের প্রতি আচরণেই তাঁর ধর্মভাবের প্রকাশ। তীব্র মেজাজ, উদ্যম, প্রাণবন্ত স্বভাব আর সাহসের অধিকারী লিভিংস্টোন এটা ছাড়া অবশ্যই নিঃসঙ্গ, কঠোর প্রভু হয়ে উঠতেন। ধর্ম তাঁকে পোষ মানিয়েছে, তাঁকে একজন খ্রিস্টান ভদ্রলোক বানিয়েছে: অমার্জিত, একগুঁয়েমিকে পরিমার্জিত, অবদমিত করেছে; ধর্মের প্রভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন একজন অতি কাম্য সঙ্গী ও অতি-প্রশ্রয়দাতা প্রভু - এমন একজন মানুষ হয়েছে যাঁর সঙ্গ বেশ ভাল মাত্রায় উপভোগ্য।
প্রায়শই ভৃত্যদের মধ্যে আমাদের দুজনের যোগ্যতা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হতে শুনেছি। আমার ভৃত্যরা লিভিংস্টোনের চাকরদের বলত, "তোদের কর্তা একজন ভালো মানুষ - খুব ভালো মানুষ; সদয় হৃদয়, সে তোদের মারবে না। কিন্তু আমাদেরটি - ওহ! সে ভয়ানক ধারালো - আগুনের মতো গরম - সূর্যের মতন উজ্জ্বল।’’ উজিজিতে প্রথম আসার পর আরব, মিশ্রজাতের লোকরা তাঁকে ঘৃণা করত। সব দিক দিয়ে তাঁকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। সার্বিক উদারতা ও মৃদু, প্রফুল্ল মেজাজ দিয়ে তিনি সকলের হৃদয় জয় করেছেন। লক্ষ্য করেছি যে সবাই তাঁকে সম্মান করেন। এমনকি মহামেডানরাও তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে অভিবাদন না জানিয়ে যায় না। বলে যায়, 'ঈশ্বরের আশীর্বাদ আপনার উপর রইল'। প্রতি রবিবার সকালে তিনি নিজের ছোট্ট দলকে জড়ো করে, অতি স্বাভাবিক, নির্বিকার ও আন্তরিক ভাবে প্রার্থনা করেন, বাইবেলের একটি অধ্যায় পড়েন। আর তারপর কিসাওয়াহিলি ভাষায় একটা ছোট বক্তৃতা দেন, যে বিষয় পড়া হল সেটা নিয়ে, সবাই সেটা সাগ্রহে, মন দিয়ে শোনেও।
তাঁর বইয়ের পাঠক ও তাঁর অভিযানের ছাত্রদের লিভিংস্টোনের চরিত্রের আরও একটি বিষয় সম্পর্কে জানার কৌতূহল থাকবে, এবং তা হল, তাঁর মধ্য আফ্রিকার ভয়ঙ্কর জলবায়ু সহ্য করার ক্ষমতা আর ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা। মনের জোর ব্যাপারটা তাঁর ও তাঁর জাতির নিজস্ব। অ্যাংলো-স্যাক্সন চেতনার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য, যেমন অধ্যবসায়, লেগে থাকা আর জেদের নিরিখে তিনি একটা খুব ভাল উদাহরণ; তবে জলবায়ু সহ্য করার নিরিখে তাঁর ক্ষমতা কিন্তু শুধু তাঁর জন্মগত সুস্বাস্থ্যের জন্য নয়, বরং তাঁর কঠোর সংযমী জীবনযাপনের কারণে। একজন মাতাল, বদ-অভ্যাস-ওলা মানুষ কখনই মধ্য আফ্রিকার জলবায়ুকে সহ্য করতে পারত না।
উজিজিতে আসার পরে দ্বিতীয় দিনে, আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম যে তাঁর কি কখনো দেশে ফেরার ইচ্ছা করে না, ছয় বছরের অনুসন্ধানের পর একটুও বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে হয় না? তিনি যে উত্তর দিলেন সেটাই তাঁর সম্যক পরিচয় প্রকাশ করে। তিনি বলেছিলেন: “খুবই ইচ্ছে করে বাড়ি যাই, বাচ্চাদের আবার একবার দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু যে কাজটা হাতে নিয়েছি, তার প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে তাকে ছেড়ে যেতে মন চায় না। আমি নীল নদের যে সত্যিকারের উৎসটা আবিষ্কার করেছি, তাকে স্থানীয়রা চৌয়াম্বে বলে। এবার সেটা সাদা নীলনদের পেথেরিক বর্ণিত শাখা নাকি ডঃ সামুয়েল বেকারের বলা অ্যালব্যার্ট এন'ইয়াঞ্জা তা খুঁজে বার করতে আর মাত্র ছয়-সাত মাস লাগবে। যে কাজটা এখনই করতে পারি, সেটা এখন না করে, কাজটা শেষ হওয়ার আগেই কেন বাড়ি যাব, সেক্ষেত্রে যখন আবার ফিরে আসতে হবে?'
জানতে চাইলাম, “যে কাজটা করতেই হবে বলেছেন সেটা শেষ না করেই তাহলে কেন এতদূর ফিরে এলেন?”
‘‘সে তো বাধ্য হলাম বলেই। আমার লোকেরা আর একপাও এগোবে না। তারা বিদ্রোহ করেছিল, আর গোপন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে - যদি আমি এরপরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করি - তাহলে তারা এলাকায় একটা অশান্তি বাধাবে, আর তারপর আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। সে ক্ষেত্রে তো আমি মরেই যেতাম। আরও এগিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক ছিল। ছ'শ মাইল নদী অববাহিকা খুঁজেছি, সব বড় বড় শাখাগুলো খুঁজে পেয়েছি যেগুলো জল নিষ্কাশনের মূল ধারায় জল এনে ফেলে, কিন্তু যখন শেষ একশ মাইলের কাজ শুরু করলাম, আমার লোকদের মন ভেঙ্গে গেল, আর সবরকমভাবে তারা অসহযোগ শুরু করল। এইবার শুধু জিনিসপত্রের নতুন সরবরাহ পেতে আর নতুন দলবল জোগাড় করতে সাতশো মাইল ফিরে এসে, আমি প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছি, আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য বেঁচে থাকার রসদ আছে। শরীর-মনে অসুস্থও হয়ে গেছি।'
এখানে আমি একটু থামতে চাই আর কোন সাহসী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতে চাই যে এমন একটি সংকটে তিনি নিজে কেমন আচরণ করতেন। ক্রম-অন্বেষণ ও আবিষ্কারের খবর সকলকে জানাতে আর তাদের ফেরার অপেক্ষা কাতর পরিবার, বন্ধুদের উদ্বেগ মুক্তির জন্য, অনেকেই বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করতেন। রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির বৈজ্ঞানিক সহযোগীদের মনে যেসব প্রশ্ন ছিল, তার সমাধানের জন্য অবশ্যই যথেষ্ট কাজ হয়েছে। এ তো কোন নেতিবাচক অন্বেষণ নয়। কঠিন, বহুসময়সাধ্য আন্তরিক শ্রম, আত্মত্যাগ, অসীম ধৈর্য, এমন সমুন্নত দৃঢ়তা - এ কোন সাধারণ মানুষের কর্ম না।
ধরুন, লিভিংস্টোন, অন্যান্য অভিযাত্রীদের রীতি অনুসরণ করে, ব্যাংওয়েওলো হ্রদ আবিষ্কারের পরেই ভৌগোলিক বিশ্বকে খবরটা জানানোর জন্য তড়িঘড়ি উপকূলে ছুটে এলেন; তারপর আবার মোয়েরো আবিষ্কারের জন্য ফিরে গেলেন আর আবার ছুটে এলেন; তারপর আরও একবার ফিরে গেলেন শুধু কামোলোন্ডো আবিষ্কার করতে আর আবার দৌড়ে ফিরে এলেন। এটা ঠিক লিভিংস্টোনের চরিত্রানুগ হবে না। তাঁর তো কাজ কেবল চাম্বেজি, লেক ব্যাংওয়েওলো, লুয়াপুলা নদী, লেক মোয়েরো, লুয়ালাবা নদী ও কামোলোন্ডো হ্রদ আবিষ্কার করাই না, এই হৃদ-সঞ্জাত নদী ব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপটি বোঝার জন্য তাঁকে অক্লান্তভাবে এগিয়ে যেতে হবে। সাধারণ অভিযাত্রীদের উদাহরণ অনুসরণ করলে, তিনি আরও অন্বেষণের বদলে সকলকে খবর জানানোর জন্য বারবার সামনে-পিছনে দৌড়তেন; আর প্রতিটা হ্রদ আবিষ্কারের উপর এক এক খণ্ড বই লিখতেন আর তার মারফত অনেক টাকা কামাতে পারতেন। তাঁর বইগুলো মাত্র কয়েক মাসের কোনো অনুসন্ধানের ফলাফল নয়। তাঁর মিশনারি ট্রাভেল বইটা ষোল বছর সময়কাল নিয়ে লেখা; জাম্বেজির উপর তাঁর বইটি পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা; আর যদি মহান অভিযাত্রী বেঁচে বাড়িতে ফেরেন, তাঁর তিন নম্বর বইটি, যা কিনা তাঁর শ্রেষ্ঠতম বই হবে, তাতেও আট- নয় বছরের অভিজ্ঞতা ধরা থাকবে।
যা করতে শুরু করেন সেটা ভালভাবে করাই লিভিংস্টোনের নীতি; বাড়ি ফেরার তাঁর প্রবল আকাঙ্ক্ষা আর সেটা মাঝে মাঝে প্রবল-ব্যাপ্ত হয়। তা সত্ত্বেও কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে তিনি একরকমের তৃপ্তি - যদি সুখ নাও বলি - খুঁজে পান। অন্য ধাঁচের মানুষরা আফ্রিকার বর্বরদের মধ্যে দীর্ঘ বসবাসের কথা ভাবলেই ভয় পাবেন, লিভিংস্টোনের মন কিন্তু তার মধ্যেই দার্শনিক গবেষণার রসদ আর আনন্দ খুঁজে নেবে।
আদিম প্রকৃতির বিস্ময়, বিশাল অরণ্য ও মহান পর্বতমালা, সদা-জলময় নদী ও বিপুলাকার হ্রদের উৎস, পৃথিবীর অযুত বিস্ময়, দিনে-রাতে গ্রীষ্মমন্ডলীয় আকাশের সমারোহ - পার্থিব-অপার্থিব ঘটনাসমুহ এধরনের আত্মত্যাগী, পরোপকারে নিবেদিত মানুষের কাছে অমৃতবত। তিনি ইথিওপের কৃষ্ণ শিশুদের আদিম সরলতায় মুগ্ধ হতে পারেন, তাদের সঙ্গে তিনি তাঁর জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়েছেন; তাদের ক্ষমতার উপর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস; অন্যরা যেখানে বর্বরতা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পায় না, তিনি তাদের মধ্যেও বিবিধ গুণ দেখতে পান। তাদের মধ্যে যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি এই ঈশ্বর-খেদানো মানুষদের উন্নত করার চেষ্টা করেছেন।
(ক্রমশ…)