আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। পঞ্চম অধ্যায় অবধি ছিল চুন্যু (চুন্যো) নামক জনপদে পৌঁছোনোর কাহিনি। এবার শুরু হল চুন্যু থেকে পথচলা। এ কিস্তিতে আছে এমভূমি অঞ্চল পার করার বর্ণনা, এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল দাগ দেওয়া পথের আশেপাশেই।— সম্পাদক
কাল থেকে আরও আট মাইল হাঁটা—পূর্ব এমভূমি থেকে পশ্চিম এমভূমি পর্যন্ত, যেখানে এই অঞ্চলের সুলতান থাকে। যত রকমের খাবার আমাদের ঘরে এসেছিল আর তার পরিমাণ দেখে বুঝলাম আগে উগোগোর উৎপাদন নিয়ে যা সব শুনেছি তা মোটেই ভুল না। ছাঁচ, দুধ, মধু, শিম, মাতামা, বাজরা, ভারতীয় ভুট্টা, ঘি, চিনাবাদাম ও খুব বড়ো পেস্তা বা বাদামের মতো এক ধরনের শিমের বিচি, তরমুজ, কুমড়ো, ফুটি আর শসা কেনা হল। মেরিকানি, কানিকি আর সাদা মেরিকানি পুঁতি ও সামি-সামি বা সাম-সামের বিনিময়ে।
সকাল থেকে রাত অবধি শিবিরে যেরকম বাণিজ্য-বিনিময় চলছে তা দেখে আমার গ্যালাস১ এবং অ্যাবসিনিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত রীতিনীতির কথা মনে পড়ল। পূর্ব দিকে, গ্রামবাসীদের থেকে জিনিসপত্র কেনার জন্য কাফেলাগুলো থেকে কাপড়সহ লোক পাঠাতে হত। উগোগোতে সেসব দরকার পড়ে না, সেখানে লোকেরা নিজের থেকেই তার হাতে বিক্রয়যোগ্য যা কিছু আছে সব নিয়ে শিবিরে চলে আসে। সাদা বা নীল কাপড়ের ক্ষুদ্রতম টুকরোও এখানে বিক্রি হয়— এমনকি বহুব্যবহারে জীর্ণ পরনের নেংটিও—সেটাও খোরাক কেনার কাজে লেগে যায়।
একদিন হন্টনের পরের দিন ছিল বিশ্রাম। আমরা ঠিক করেছিলাম যে এই দিন এমভূমির মহান সুলতানকে ভেট পাঠানো হবে। দূরদর্শী ও সতর্ক শেখ থানি ভোর ভোর এই দরকারি কাজটা শুরু করলেন। এটা বাদ পড়া মানে যুদ্ধের ইশারা। হামেদ এবং থানি দুজন বিশ্বস্ত দাসকে পাঠালেন—এরা গোগোদের২ সুলতানের খামখেয়ালিপনার সঙ্গে ভালোই পরিচিত, সুন্দর কথা বলে, ভালো তেলও মারতে পারে আর পূর্ব দিকের লোকেদের মধ্যে যেভাবে ব্যাবসা চলে সেটা ভালো বোঝে। ছয় ডটি কাপড় নিয়ে তারা রওনা দিল। তার মধ্যে মিহি ডাবওয়ানি৩ একটি ডটি আমার দেওয়া, বারসাতির একটি ডটিও আমারই দেওয়া, দুই ডটি মার্কিনি সাটিন দিলেন শেখ থানি আর শেখ হামিদ দিলেন দুই ডটি কানিকি, প্রথম কিস্তির ভেট হিসেবে। দাসরা পুরো এক ঘণ্টাও ছিল না, তারপর আরও জিনিসের দাবি বয়ে নিয়ে তারা ফিরে এল, তাদের কাকুতিমিনতিতে কোনো লাভই হয়নি। শেখ থানি আমাকে বলল—“উফ! এই সুলতান ভারী খারাপ লোক, খুব খারাপ। সে বলেছে, সাহেব খুব বড়ো মানুষ। আমি তাকে সুলতান বলি; সাহেব খুব ধনী, তার বেশ কয়েকটা কাফেলা আগেই চলে গেছে; সাহেবকে অবশ্যই চল্লিশ ডটি কাপড় দিতে হবে আর আরবদেরও প্রত্যেককে অবশ্যই বারো ডটি করে কাপড় দিতে হবে কারণ তাদের সঙ্গেও মালবোঝাই অনেক কাফেলা রয়েছে। সবকটা মিলে একটাই কাফেলা এসব বলে কোনো লাভ নেই, তাহলে এতগুলো পতাকা আর তাঁবু কেন? যাও, যাও ষাট ডটি কাপড় নিয়ে এসো, তার কমে হবে না।”
এইরকম গলাকাটা দাবি শুনে শেখ থানিকে বললাম যে আমার হাতে যদি উইনচেস্টারের রিপীটিং রাইফেলওলা বিশজন সাহেব থাকত, তাহলে সুলতানই হয়তো আমাকে ভেট দিতে বাধ্য হতেন। তবে থানি আমাকে সাবধান হওয়ার জন্য অনুরোধ করল যাতে এই সব রাগের কথা শুনে সুলতান আরও বিরক্ত না হন আর দ্বিগুণ নজরানা দাবি না করেন, সেও তার পক্ষে করা সম্ভব; “আর আপনি যদি যুদ্ধ চান,” সে বলল, “আপনার কুলিরা সবাই পালাবে; আপনি ও আপনার কাপড়চোপড় পড়ে থাকবে গোগোদের সামান্য দয়ার উপর।” তার ভয় দূর করার জন্য আমি তড়িঘড়ি তার সামনেই বোম্বেকে ডেকে বললাম যে গোগোরা এমন দাবি যে করতে পারে সেটা আমি আগেই ভেবেছিলাম আর একশো কুড়ি ডটি ভেট দেওয়ার কাপড় আলাদা করেই রেখেছিলাম, সুলতান চাইলে আর তাকে চল্লিশ ডটি কাপড় দিলে যাতে আমাকে তেমন পরে কোনো অসুবিধায় না পড়তে হয়। কাজেই সে যেন ওই নজরানার কাপড়ের গাঁটরিটা খোলে আর শেখ থানিকে সুলতানের পছন্দ হবে এমন কাপড় বের করে নিতে দেয়।
অনেক ভেবে আর হামিদ আর বিশ্বস্ত দাসদের সঙ্গে মাথা ঘামিয়ে শেখ থানি ঠিক করল যে আমি যদি বারো ডটি কাপড় দিই যার মধ্যে তিনটে উলিয়াহর মানের তাহলে সুলতান হয়তো বা দয়া করে আমাদের ভেটটা গ্রহণ করবেন। হয়তো বিশ্বস্ত দাসরা বক্তৃতা করে তাঁকে বোঝাতে পারবে যে সাহেবের সঙ্গে শুধু মাশিবা (নৌকা) ছাড়া আর কিছুই নেই আর যাই হোক না কেন, নৌকা তাঁর কোন কাজে লাগবে না,—এই সমীচিন পরামর্শের অন্তর্লীন প্রজ্ঞা দেখে সাহেবও একমত হল।
কাজের সাফল্যের জন্য আমাদের শুভকামনা সহ দাসেরা তিরিশ ডটি কাপড় নিয়ে আমাদের শিবিরাঞ্চল ছেড়ে রওনা হল। এক ঘণ্টার মধ্যে তারা খালি হাতে ফেরত এল, তাদের যাত্রা অসফল। সুলতান সাহেবের থেকে ছয় ডটি মার্কিনি আর এক ফান্ডো বুবু চেয়েছেন। সেই সঙ্গে আরবদের ও অন্যান্য কাফেলা থেকে আরও বারো ডটি চেয়েছেন। তৃতীয়বারের মতো দাসেরা সুলতানের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হল, তাদের সাথে আমার তরফ থেকে ছয় ডটি মার্কিনি ও বুবুর একটি ফান্ডো আর আরবদের কাছ থেকে দশটি ডটি নিয়ে গেল। আবার তারা ফিরে এল, সঙ্গে সুলতানের বার্তা—যেহেতু সাহেবের ডটি ছোটো মাপের আর আরবদের কাপড়গুলো খুবই খারাপ মানের, সাহেবকে পুরোমাপের আরও তিন ডটি পাঠাতে হবে আর আরবদের পাঠাতে হবে পাঁচ ডটি কানিকি। আমার তিনটে ডটিকে একবারে সবথেকে লম্বা হাত দিয়ে মাপা হল—কিগোগোর মাপ মতো—আর বোম্বে সেটা নিয়ে গেল, কিন্তু তুমুল হতাশায় আরবরা ঘোষণা করল এসব দাবি মেনে নিলে তারা একদম জানে মরে যাবে। পাঁচ ডটি কাপড়ের দাবির জায়গায় মাত্র দুই ডটি পাঠাল, আর সেই সঙ্গে সুলতানের কাছে মিনতি করে পাঠাল যে তিনি যেন যা দেওয়া হয়েছে সেটাকেই ঠিক ও নায্য দাবি বলে মেনে নেন— আর কিছু না চান। তবে এমভূমির সুলতান এসব কথা শোনার বান্দাই নন। তিনি ঘোষণা করলেন যে তাঁর অবশ্যই তিন ডটি কাপড় চাই—তার মধ্যে দুটো মিহি কাপড় আর একটা কিতম্বি৪ বারসাতি৫। তিনি এগুলো পাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অগত্যা শেখ হামেদের তুমুল অভিশাপ বর্ষণের মধ্যে আর শেখ থানির হতাশ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সেগুলো পাঠানো হল।
উগোগোর এক-একটা এলাকার সুলতান হওয়া খুবই লাভজনক, একেই তো যতক্ষণ সুলতানকে ভীতু আরব বণিকদের সামলাতে হয় ততক্ষণ এমনিতেই কোনো কাজকর্ম থাকে না, ভারী মজা। যে-কোনো স্বাধীন আর আত্মনির্ভর মানুষকেই এই ভীতুর দল ভয় পায়, পাছে তাদের কাপড় খেসারৎ দিতে হয়। একদিনে একটা শিবির থেকে সুলতান সাতচল্লিশ ডটি কাপড় পেল, তার মধ্যে মার্কিনি, কানিকি, বারসাতি আর ডাবওয়ানি আছে, তাদের মোট দাম ৩৫.২৫ ডলার। এ ছাড়াও আছে সাত ডটি খুব উচ্চ মানের কাপড়, রেহানি, সোহারি আর মিহি ডাবওয়ানি আর এক ফান্ডো বুবু, যার দাম কিনা ১৪ ডলার, সব মিলিয়ে ৪৯.২৫ ডলার, একজন গোগো প্রধানের জন্য বেশ একটা দারুণ আমদানি।
ক্রমশ...
এই লেখার নতুন নতুন পর্বগুলোর জন্য সাগ্রহ অপেক্ষা থাকে, খুব ভালো একটা কাজ।
Kitambi মানে চেক বা স্ট্রাইপ এর সঙ্গে রঙ্গি (আমাদের রং থেকে !)যোগ করলে পাবেন কালার্ড ক্লথ
অতএব পুরো কথাটা হবে কিতাম্বা চা রঙ্গি !