ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে উগান্ডা হয়ে কুইহারা পৌঁছনোর বর্ণনা। তরজমা স্বাতী রায়
পরের দিনেও আমরা ওখানেই ছিলাম, এখানে এত বিভিন্ন রকমের পশুর সমাবেশ যে শিকারের পিছনে ধাওয়া করার জন্য আমি খুবই উৎসুক। সকালের কফিপানের পর আমার বন্ধু সেই অ্যামোনিয়া-বোতল খ্যাত মামান্যারার জন্য উপহারসহ কয়েক জনকে পাঠানো হল। তারপরই আমি আরও একবার মাঠের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। শিবির থেকে পাঁচশো গজ দূরেও যাইনি, হঠাৎ আমি ও আমার দলবল খুব কাছেই, সম্ভবত পঞ্চাশ গজ বা তার চেয়েও কম দূরত্বে, একটা সমবেত গর্জন শুনে থেমে গেলাম। তিনটে সিংহ একসঙ্গে। নিজের অজান্তেই আমার আঙ্গুল বন্দুকের ঘোড়াদুটো তুলে দিল, একটা সিংহ যদি বা ছুটে পালায়, তিনটেই পালাবে এটা তো আর বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাই একটা শুভসূচনা আশা করেছিলাম। তীক্ষ্ণ নজরে খুঁজতে গিয়ে আমি দেখতে পেলাম, রাইফেল-গুলির সহজ নাগালের মধ্যে, একটা সুন্দর হার্টেবিস্ট এক গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে মাথা গুঁজে কাঁপছে, যেন তার গলায় সিংহ কামড়ে ধরেছে। প্রাণীটা আমার দিকে পিছন ফিরে রয়েছে, ভাবলাম একটা গুলি হয়ত এর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে লাগতে পারে আর এক মুহুর্তেরও দ্বিধা ছাড়াই আমি লক্ষ্যস্থির করলাম আর গুলি চালালাম। প্রাণীটা সজোরে লাফ দিয়ে উঠল, যেন এটা গাছের মধ্য দিয়ে উড়ে যেতে চায়; কিন্তু তারপর সামলে নিয়ে এটা ঝোপ ঝাড়ের মধ্য দিয়ে ভিন্ন দিকে চলে গেল। আমার ধারণায় সেই দিকেই সিংহ ছিল। আর এটাকে দেখতে পেলাম না, যদিও এর রক্ত রাঙ্গা পদচিহ্ন থেকে জানলাম প্রাণীটাকে ঘায়েল করেছি। সিংহগুলোকেও আর দেখতে-শুনতে পেলাম না। তারপর যে কোন ধরণের শিকারের জন্য বহুদূর অবধি খুঁজলাম, কিন্তু ফাঁকা হাতে শিবিরে ফিরতে বাধ্য হলাম।
নিজের ব্যর্থতায় নিজেই বিরক্ত হয়ে, দুপুরের কিছু পরে মান্যারার উদ্দেশে রওনা দিলাম। সেখানে বন্ধুর আতিথেয়তা সহ অভ্যর্থনা জানানো হল। তিনি আমার কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন যে তার সাদা ভাই যেন বনের মধ্যে না থামেন , তার গ্রামেই আসতে হবে। সর্দারের থেকে মধু , খাবার-দাবার উপহার পেলাম। আমাদের তখনকার অবস্থায় সে উপহার অতীব স্বাগত । এইটা একটা উদাহরণ যে মধ্য আফ্রিকার সর্দাররা যারা আরবদের সাহচর্যে বিগড়ে যায় নি, তারা কেমন বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের। ডাঃ লিভিংস্টোনও বাবিসা বা বাউলঙ্গনের মধ্যে সেই জিনিস দেখেছিলেন। মান্যুয়েমাতেও। মামান্যারার সর্দারের যেমন ব্যবহার পেলাম, সেই একইরকম বন্ধুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি আমি উন্যানয়েম্বে অবধি ইমরেরা, উকাওয়েন্দির ইত্যাদি সব জায়গার সর্দারদের থেকেই পেয়েছি।
১৪ তারিখে উগান্ডায় এসে পৌঁছালাম। সেখানকার সর্দার আমাদের ব্যবহারের জন্য একটা কুঁড়েঘর ধার দিয়েছিল। সেখানে আরামে গুছিয়ে বসার পরপরই ফেরাজ্জি আর চৌপেরেহ ফিরে এল। তাদের সঙ্গে এল সরমিয়ান ও উলেদি মান্যওয়া সেরা। হয়ত মনে থাকবে, এই দুই সৈন্যকে চিঠি দিয়ে জাঞ্জিবারে পাঠানো হয়েছিল, শ'র রোগের ওষুধের জন্য। আর সরমিয়ান কাকে বেঁধে নিয়ে এসেছে? সেই পলাতক হামদাল্লাহ ছাড়া আর কেই বা! সেই হামদাল্লা যে আমরা যখন উজিজির পথে, তখন মান্যিয়ারাতে শিবির ছেড়ে পালায়। মনে হয় এই লোকটা কিগান্ডুতে থেমেছিল আর গ্রামের সর্দার ও ওঝাকে জানিয়েছিল যে মাবরুক সালিমের নিরাময়ের খরচ বাবদ সেখানে রেখে যাওয়া কাপড় নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে সাদা লোকটি পাঠিয়েছে । আর সরল সর্দার তার নিছক কথার উপর বিশ্বাস করে সেসব তার হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। ফলে অসুস্থ লোকটা মারা গিয়েছিল। সেইসঙ্গে আরেকজনও, যাকে আমি উন্যানয়েম্বেতে রেখে গিয়েছিলাম।
জাঞ্জিবার থেকে সারমিয়ান উন্যানয়েম্বেতে পৌঁছায় আমাদের অভিযান উজিজির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রায় পঞ্চাশ দিন পর। তখন সে খবর পায় যে শ্বেতাঙ্গ লোকটি (শ) মারা গেছে; আর হামদাল্লাহ নামের যে লোকটা নিজেই এসে আমার দলের গাইড হিসাবে যোগ দিয়েছিল সেও রয়েছে উন্যানয়েম্বেতে। সে কদিন পরেই ফিরে এসেছিল। ফেরাজ্জি ও তার সঙ্গীরা হাজির না হওয়া অবধি সরমিয়ান তাকে কিচ্ছু বলেনি। তারা আসতে একবারে, দল বেঁধে, তার কুঁড়েঘরের উপর চড়াও হয় আর তাকে বন্দী করে। তার উৎসাহের দরুণ আমার দলের দশজনের মধ্যে তাকে সবাই আলাদা করে চিনত। সরমিয়ান একটা ত্রিশূলের মত লাঠি জোগাড় করেছিল, সেইটা দল-পালানো লোকটার ঘাড়ে রেখে একটা লাঠি আড়ে দিয়ে ভাল করে বেঁধে দিয়েছিল। এমনই বাঁধা যে লোকটার আর ছাড়ান-ছোড়ন নেই।
জাঞ্জিবার থেকে চিঠিপত্র আর খবরের কাগজ যা এসেছিল, তা সাত প্যাকেটের কম ছিল না। আমার অনুপস্থিতিতে উন্যানয়েম্বেতে এসে সেসব জমা হচ্ছিল। এগুলো সময়ে সময়ে বিভিন্ন কাফেলার সর্দারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কনসালের কাছে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে, তারা বিশ্বস্তভাবে সেগুলো পৌঁছে দিয়েছিল। ডাঃ কার্কের থেকে আমার জন্য একটা প্যাকেট ছিল। সেটাতে ডঃ লিভিংস্টোনের জন্য দু- তিনটে চিঠি ছিল। সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হল, সঙ্গে অভিনন্দনও জানালাম যে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে পুরোপুরি ভুলে যাননি। একই প্যাকেটে আমার কাছে ডাঃ কার্কের একটা চিঠিও ছিল, ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৮৭১ তারিখে লেখা। উন্যানয়েম্বে থেকে আমি আমার আপাত আশাহীন কাজে রওনা দেওয়ার পাঁচদিন পরে লেখা। এই চিঠিতে আমাকে লিভিংস্টোনের জিনিসপত্রের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল আর তার কাছে সেসব পাঠানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেও বলা হয়েছিল। এতে উকেরেওয়ে হ্রদের পাশ দিয়ে একটা অসম্ভব পথ ধরার জন্য কিছু উদ্ভট উপদেশও রয়েছে, তবে চিঠির স্বরটা ভাল, সহৃদয়ও।
"দেখুন, ডাক্তার," লিভিংস্টোনকে বললাম, "ইংরেজ রাজদূত আমাকে অনুরোধ করেছেন যে আমি যেন আপনার সব সামানপত্র আপনার কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি। আমি দুঃখিত যে আমি তো এর আগে এই কর্তৃত্ব হাতে পাইনি, তাহলে আমার সেরকম চেষ্টা করা উচিত ছিল; কিন্তু সেরকম নির্দেশের অভাবে আমি আপনার কাছে পণ্য পৌঁছানোর বাবদে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। পর্বত মোহাম্মদের দিকে যায়নি বটে, তবে মোহাম্মদ পাহাড়ের দিকে এগোতে বাধ্য হয়েছে।"
তবে ডক্টর লিভিংস্টোন ততক্ষণে দেশের থেকে আসা চিঠিপত্রতে খুব গভীরভাবে মগ্ন হয়ে গেছেন, সেগুলো যতই এক বছরের পুরোন হোক না কেন।
আমিও নিউ ইয়র্ক থেকে কিছু ভাল, কিছু খারাপ খবর পেলাম। ভাল খবরের কথা পরে ছিল। শুধু খারাপ খবরটাই পেলে যে সব অনুভূতি জাগত, ভাল খবরটা সেসব মুছে দিল। তবে নিউইয়র্ক, বোস্টন ও লন্ডনের প্রায় শতাধিক খবরের কাগজ সেই দারুণ বিস্ময়কর খবরে ভরা ছিল । প্যারিস কমিউন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সেন্ট-আঁতোয়ানের দুষ্কৃতীরা টুইলেরিস, ল্যুভর ও প্রাচীন শহর লুটেসিয়া প্যারিসিওরাম আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে! ফরাসী সৈন্যরা নারী-পুরুষ-শিশুদের হত্যা করছে। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহরে যথেচ্ছ শয়তানের রাজত্ব চলছে। সেখানে প্রতিশোধস্পৃহা যেন মূর্তমান! ভদ্রমহিলাদের দানব বানানো হচ্ছে, অভব্য সৈনিকরা তাদের রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নির্মম মৃত্যুর দিকে। পাইকিরি হারে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হচ্ছে। কচি বাচ্চাদের মাটিতে চেপে ধরে বেয়নেট গিঁথে দেওয়া হচ্ছে। পুরুষদের, নির্দোষ হোক বা না হোক, গুলি করে, গলা কেটে, ছুরি বিঁধিয়ে, টুকরো টুকরো করে, ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। পুরো শহরটা একটা বিক্ষুব্ধ, বেপরোয়া, নৃশংস বাহিনীর তীব্রতম অন্যায়ের মুখে ! হায়, ফ্রান্স! হায়, ফরাসি লোকেরা! বর্বর মধ্য আফ্রিকার প্রাণকেন্দ্রেও এমন জিনিস দেখা যায় না। খবরের কাগজ লাথি মেরে সরিয়ে দিলাম। অসুস্থ হৃদয়ের শান্তির জন্য 'পাঞ্চ'-এর নিরীহ পাতায় আঁকা পৃথিবীর মজাদার দিকগুলোর ছবির দিকে তাকালাম। বেচারা পাঞ্চ! ‘ভালো-মনের, দয়ালু স্বভাবের পাঞ্চ!' এক পথিকের আশীর্বাদ রইল তোমার উপর! তোমার কৌতুকগুলো স্বাস্থ্যকর। তোমার নির্দোষ ব্যঙ্গগুলো মনে হাসির ফোয়ারা তোলে।
কৌতূহলী দেশিরা এসে দরজায় ভিড় করেছে। তারা বিশাল বিশাল কাগজের পাতার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তাদের প্রায়ই "খবর-ই-কিসুঙ্গু" - সাদা মানুষের খবর - এই শব্দগুলো বলতে শুনেছি, এত এত খবর কেমন কেমন ধারার তা নিয়েও তাদের আলোচনা করতে শুনেছি। তাদের বলতে শুনেছি যে "ওয়াসুঙ্গু খুব "এমবিয়া সানা", খুব "এমকালি; " এর মাধ্যমে তারা বলতে চেয়েছিল যে শ্বেতাঙ্গরা খুব দুষ্টু, এবং খুব বুদ্ধিমান, ও চালাক; যদিও দুষ্টু শব্দটা প্রায়ই উচ্চ প্রশংসা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
১৮ই ফেব্রুয়ারি, আমাদের উগান্ডা থেকে রওনা হওয়ার চার দিনের দিন, উজিজি থেকে পথ চলার পঞ্চাশতম দিনে, পতাকা উড়িয়ে, বন্দুক ছুঁড়ে কুইহারা উপত্যকায় হাজির হলাম। যখন ডাক্তার ও আমি আমার পুরোন আবাসের ফটকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমি তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্যানয়েম্বেতে, সেই সঙ্গে আমার বাড়িতেও স্বাগত জানালাম। অসুস্থ ও নিজের জীবন নিয়ে প্রায় ক্লান্ত অবস্থায় তবু আমার যাত্রার উদ্দেশ্য সফল হবেই এই উচ্চাশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যেদিন আরবদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, সেদিনের থেকে একশত একত্রিশ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ে বারোশ মাইল পথ পেরিয়েছি। ভাগ্যের কী কী অস্থিরতা সহ্য করতে হয়েছে তা পাঠক জানেন। যে অলীক স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করে আমি মহাপ্রান্তর পাড়ি দিয়েছিলাম তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আর জীবিত মানুষটি যখন আমার হাত ধরে আমারই পুরোন ঘরে পা রাখলেন, তার চেয়ে বেশি বাস্তব আর কিছু হয় না। আমি তাকে বললাম, "ডাক্তার, শেষ পর্যন্ত বাড়িতে পৌঁছালাম!"
(পঞ্চদশ অধ্যায় শেষ। পরের পর্বে শুরু হবে ষোড়শ অধ্যায়। ক্রমশ… )