ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। অবশেষে উজিজিতে লিভিংস্টোনের মুখোমুখি। তরজমা স্বাতী রায়
‘কী! ডঃ লিভিংস্টোন এখানে?’
‘জি হুজুর’
‘এই গ্রামে?’
‘জি, হুজুর।’
‘ঠিক বলছিস?’
‘অবশ্যই, ঠিক, হুজুর। আমি তো এক্ষুনি তাঁর কাছ থেকেই এলাম।’
‘শুভ সকাল, হুজুর,’ আরেকটা গলা বলে উঠল ।
‘হ্যালো,’ বললাম, ‘এ কি আরেকজন ?’
‘আজ্ঞে কর্তা।’
‘আচ্ছা, তোর নাম কী?’
‘আমার নাম চুমাহ, কর্তা।’
"কী! তুই চুমাহ, ওয়েকোটানির বন্ধু? "
‘হ্যাঁ কর্তা।’
‘আর ডাক্তার ভাল আছেন?’
‘খুব ভালো নেই, হুজুর।’
‘তিনি এতদিন কোথায় ছিলেন?’
‘মান্যুএমাতে’
‘এখন, সুসি, ছুটে যা আর ডাক্তারকে বল যে আমি আসছি।’
‘হ্যাঁ, হুজুর,’ বলেই সে পাগলের মতো ছুটে চলে গেল।
তবে যতক্ষণে আমরা গ্রামের দুশ গজের মধ্যে পৌঁছলাম, জনতার ভিড় আরও ঘন হয়ে উঠছিল, আমরা যেন আর প্রায় এগোতেই পারছি না । আমাদের পতাকা, স্ট্রিমারগুলো ভিড়ের বাইরে ছিল; আরব ও এনগোওয়ানারা মনে করে আমরা তাদেরই দলে, তাই আমাদের অভিবাদন জানানোর জন্য তারা স্থানীয়দের ভিড় ঠেলে কাছে আসছিল। কিন্তু সবার থেকে বড় আশ্চর্য ছিল, ‘আপনি কিভাবে উন্যানয়েম্বে থেকে এলেন?’
সুসি শিগগিরি দৌড়ে ফিরে এলো, আর আমার নাম জানতে চাইল; সে ডাক্তারকে বলেছে যে আমি আসছি, কিন্তু ডাক্তার খুবই অবাক। তাকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না, আর ডাক্তার যখন তাকে আমার নাম জিজ্ঞাসা করেছেন, তখন সুসি থতমত খেয়ে গেছে।
তবে কিনা, সুসির অনুপস্থিতিতে, ডাক্তারের কাছে খবর পৌঁছে গেছে যে, বন্দুক ছুঁড়তে ছুঁড়তে আর পতাকা উড়িয়ে একজন সাদা মানুষই নিশ্চয় আসছে; আর উজিজির সব তাবড় তাবড় আরবরা— মোহাম্মদ বিন সালি, সৈয়দ বিন মজিদ, আবিদ বিন সুলিমান, মোহাম্মদ বিন ঘারিব, আরও অনেকে— ডাক্তারের বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে। ডাক্তারও তার বারান্দা থেকে নেমে এসে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছেন আর আমার আসার অপেক্ষা করছেন।
ইতিমধ্যে, মিছিলের মাথাটা থমকে গেছে। কিরঙ্গোজি দল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে, তার পতাকা উঁচু করে ধরে রাখা। সেলিম আমাকে বলল, ‘ডাক্তারকে দেখতে পেয়েছি, কর্তা। ওহ্, কী বুড়ো! সাদা দাড়ি।’ আর আমি - একটুকরো নির্জনতার জন্যে আমি তখন কি না দিতে পারতাম, যেখানে, সবার চোখের আড়ালে, নিজেকে নির্বোধের মতন আঁচড়ে-কামড়ে, একটু ডিগবাজি খেয়ে, গাছের গায়ে চাবুক চালিয়ে, মানে বিভিন্ন রকম পাগলামি করে আমার মনের ফুর্তিটাকে একটু বাইরে বের করতে পারতাম— এই প্রায়-বাঁধন-ছেঁড়া উত্তেজনা-ভরপুর অনুভূতিগুলোকে একটু কমানোর জন্য। বুকটা কি দ্রুত ধুকপুক করছে, তবে আমার মুখ দেখে যেন আমার মনের মধ্যে কী হচ্ছে তা বোঝা না যায়, পাছে এমন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়া একজন সাদা মানুষের মর্যাদাহানি হয়।
এই অবস্থায় যা করলে সব থেকে ভাল হয়, সেটাই করলাম। জনতাকে পিছনে ফেলে, পিছন দিক থেকে সামনে এগিয়ে, সারি সারি মানুষের মধ্যে দিয়ে আরবদের জটলার দিকে হেঁটে গেলাম। সেই জটলার সামনেই ধূসর দাড়িওয়ালা সাদা লোকটি দাঁড়িয়ে। আমি যখন তাঁর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম যে তিনি ভারি ফ্যাকাসে, ক্লান্ত আর রোগজীর্ণ, তাঁর গোঁফ-দাড়ি ধূসর, তাঁর মাথায় একটা নীলচে কাপড়ের টুপি যার চারপাশে একটি লাল জমিনে বিবর্ণ সোনালি গোল দাগ। পরনে একটা লাল হাতা ওয়েস্টকোট, আর ধূসর টুইডের ট্রাউজার। তাঁর কাছে ছুটেই যেতাম, কেবল এত লোকের মাঝখানে সেটা করার সাহস ছিল না, তাঁকে জড়িয়ে ধরতাম, তবে কিনা, তিনি তো ইংরেজ , জানি না তিনি কীভাবে আমাকে নেবেন; * তাই ভীরুতা আর মিথ্যা অহংকারের দাস হয়ে আমি ধীরে ধীরে তার দিকে হেঁটে গেলাম, মাথার টুপি খুলে তাঁকে বললাম: 'ডঃ লিভিংস্টোন, তাই তো?'
‘হ্যাঁ,’ তিনি মৃদু হেসে বললেন, নিজের টুপিটি সামান্য তুলে।
আমি নিজের মাথায় ফের টুপিটা বসালাম, আর তিনিও ফের টুপি পরলেন, আর আমরা দু'জনের হাত আঁকড়ে ধরলাম, তারপর আমি জোরে জোরে বললাম: ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ডাক্তার, আপনার সঙ্গে দেখা হল।’
তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমিও খুশি যে আপনাকে এখানে স্বাগত জানাতে পারছি।’
আরবদের দিকে ফিরলাম, তাদের সমবেত সম্ভাষণ 'ইয়াম্বোস' এর জবাবে টুপি খুলে তাদের প্রত্যভিবাদন জানালাম। ডাক্তার তাদের কাছে আমার নাম বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর, ভিড়ের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে, আমার দলের যারা এতদিন ধরে আমার সব বিপদের সঙ্গী হয়েছে, তাদের কথাও ভুলে গিয়ে, আমরা মানে লিভিংস্টোন আর আমি, তাঁর বাড়ির দিকে মুখ ঘোরালাম। তিনি বারান্দার দিকে ইঙ্গিত করলেন, অবশ্য বারান্দা না বলে বলা ভাল চওড়া, ঝুলে থাকা ছাজার তলার মাটির বেদীর দিকে ইঙ্গিত করলেন; তার নিজের বসার জায়গার দিকে দেখালেন, সেটা যা দেখলাম তার বয়স ও আফ্রিকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানানসই,
আদতে একটা খড়ের মাদুর, তার উপরে ছাগলের চামড়া বিছানো, আর আরেকটা চামড়া দেওয়ালে আটকানো যাতে তার পিঠে ঠান্ডা দেওয়ালের ছোঁয়া না লাগে। আমি ওঁর আসনে বসতে চাইলাম না, ওটা ওঁকেই আমার চেয়ে অনেক বেশি মানায়, কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই শুনবেন না : আমাকে ওখানেই বসতে হবে।
দু'জনেই বসলাম - ডাক্তার আর আমি - বেশ করে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। আরবরা আমাদের বাম দিকে বসা। হাজারেরও বেশি আদিবাসী আমাদের সামনে রয়েছে, পুরো চত্বরে লোক থিকথিক করছে , নিজেদের কৌতূহল পূরণ করছে, আর সেই সঙ্গে উজিজিতে আসা দুই সাহেবের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আলোচনা করছে - একজন সাহেব পশ্চিম দিক থেকে এসেছে, মান্যুএমা থেকে, অন্যটি পূর্বের থেকে, উন্যানয়েম্বে থেকে।
* “পরে যা খুঁজে পেলাম, এই ইংরেজ ভদ্রলোক একজন সামরিক বাহিনীর সদস্য, ভারত থেকে দেশে ফিরে যাচ্ছিলেন , এবং প্যালেস্টাইনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে এই অংশে মরুভূমি পেরচ্ছিলেন। আমার কথা ধরলে, আমি সিধা ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলাম, আর তাই এখানে নিজের নিজের যাত্রা শুরুর জায়গার থেকে প্রায় অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে শেষে এই বিজন প্রদেশে আমাদের উভয়ের দেখা হল। যতই একে অপরের কাছে আসছিলাম, আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরতে লাগল যে আমাদের কথা বলা উচিত কিনা; মনে হয়েছিল যে হয়ত অপরিচিত মানুষটি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইবে, এবং তেমনটি করলে, আমি আমার স্বভাবমতো যতটা সম্ভব মিশুকে ও আড্ডাবাজ হতে তৈরি ছিলাম; কিন্তু তবুও তাকে বলার মত বিশেষ কিছু ভেবে উঠতে পারিনি; অবশ্যই সভ্য মানুষের মধ্যে, কিছু বলার নেই বলে কথাই বলব না এমনটা হওয়া দস্তুর না, তবে কিনা আমি লজ্জিত, আর গেঁতো ধরণের, আর এই নির্জন জায়গায় আমার থামার আর সকালের দর্শনার্থীদের মতন বকরবকর করার কোন মহৎ ইচ্ছা হয়নি। ভ্রমণার্থী বোধহয় আমার মতই ভেবেছিলেন, তাই এক শুধু নিজেদের মাথার টুপি তোলা ছাড়া, আর সৌজন্য -বাবদে দুজনে হাত নাড়ালেও, একে অপরকে এমনভাবে পেরিয়ে গেলাম যেন আমাদের বন্ড স্ট্রিটে দেখা হয়েছিল।” - কিঙলেকের ইওথেন।
আলেকজান্ডার উইলিয়াম কিংলেক যিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ইতিহাস লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন, ইওথেন তাঁর লেখা একটি ভ্রমণকাহিনী। ১৮৩৪ সালে পশ্চিম এশিয়ার ভূমধ্যসাগরের পূর্বপারের লেভান্ত এলাকার ভ্রমণের বিবরণ। )
(ক্রমশ...)