ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে ফের শুরু হল উন্যানয়েম্বের জীবনের বর্ণনা ও লিভিংস্টোনের খবরাখবর। তরজমায় স্বাতী রায়
নবম অধ্যায়
(উন্যানয়েম্বের জীবন)
আরব প্রভাবশালীদের কখনই মনে হয়নি যে তাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগের কারণ আছে, বা যে মিত্র শুধু বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে তাদের হয়ে অস্ত্রধারণ করেছে, তাকে এমন জঘন্য ভাবে ফেলে চলে আসার জন্য আমি তাদের উপর বিরক্ত বোধ করতে পারি এও তারা ভাবেনি। পালিয়ে আসার পরের দিন সকালে এমন ভাবে তারা ‘সালাম’ জানাচ্ছিল যেন আমাদের মধ্যের সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মত কিছুই ঘটেনি।
তারা সবে মাত্র বসেছে, আমি তখনই বলতে শুরু করলাম যে যুদ্ধটা তো কেবল তাদের আর মিরাম্বোর মধ্যে। আর আমার ভয় হচ্ছে যে, প্রতিবার এইরকম ছোটোখাটো বাধা পেলেই যদি তারা পালিয়ে যায়, তাহলে তো যুদ্ধ শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। অত সময় আমি দিতে পারব না। আর তারা যেভাবে আহতদের মাঠে ফেলে রেখে পালিয়েছিল, সব দায় ঝেড়ে ফেলে অসুস্থ বন্ধুদেরও ফেলে চলে এসেছিল, তারা যেন আর আমাকে বন্ধু না ভাবে। আমি বললাম, “তোমাদের যুদ্ধ করার ধরণ দেখেই আমার বোঝা হয়ে গেছে যে, তোমরা যত কম সময়ে যুদ্ধ শেষ হবে বলে ভাবছ, তত তাড়াতাড়ি এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয়। শুনেছি যে মানওয়া সেরাকে হারাতে আর মেরে ফেলতে তোমাদের পাঁচ বছর লেগেছে, এক বছরের কমে কোনমতেই তোমরা মিরাম্বোকে হারাতে পারবে না। আমি একজন শ্বেতাঙ্গ, আমি অন্যরকম করে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত, আর আমি যুদ্ধের বিষয়ে কিছুটা জানিও, কিন্তু জিমবিজো থেকে আমাদের দল যেমন পালাল, অত তুচ্ছ কারণে যুদ্ধ শিবির থেকে লোকদেরকে কখনো পালাতে দেখিনি। পালিয়ে গিয়ে, তোমরা আসলে মিরাম্বোকে তোমাদের অনুসরণ করে উন্যানয়েম্বেতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালে; নিশ্চিত থাকো যে সে আসবেই।”
আরবরা একের পর এক প্রতিবাদ করছিল যে তারা আমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি, কিন্তু এমকাসিওয়ার ন্যামওয়েজিরা চেঁচাচ্ছিল যে ‘মুসুঙ্গু’ চলে গেছে, আর সেই চিৎকার শুনে সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিল, সেই ভয় দূর করা অসম্ভব ছিল। পরে সেদিনই আরবরা পালিয়ে এমফুটোর থেকে বাইশ মাইল দূরের তাবোরাতে চলে যায়। আমি ধীরে সুস্থে যাব বলে ঠিক করলাম, জিম্বিজো থেকে পালিয়ে আসার পরের পরের দিন, সব মালপত্র, বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে আমাদের অভিযান মাসাঙ্গিতে এল আর তৃতীয় দিনে কুইহারাতে পৌঁছল।
সেই লজ্জাজনক পশ্চাদপসরণের পরে আমার কী মনে হয়েছিল, কী ভেবেছিলাম তখন? আমার ডায়েরি থেকে নেওয়া নিচের অংশটা অন্য যে কোন নথির থেকে তা বেশি ভাল করে বুঝতে সাহায্য করবে।
কুইহারা। শুক্রবার ১১ই আগস্ট ১৮৭১- বোম্বোমাদের গ্রাম জিম্বিলি থেকে আজ এসে পৌঁছলাম। বেশ হতাশ হয়ে পড়েছি, প্রায় ভগ্নোৎসাহও বলা যায়। একটাই সান্ত্বনা যে আরবদের প্রতি আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি, আমাকে তারা যেরকম উদারভাবে গ্রহণ করেছিল সে জন্য আমি তাদের কাছে এই দায়িত্বপালনে ঋণী ছিলাম; তবে, এখন আমার দায়িত্ব শেষ, আর আমার নিজের পথে যেতে কোন বাধা নেই। আমি খুশি যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এতই কম খেসারত দিতে হয়েছে। এই কাজে অবশ্য যদি আমার জীবন যেত, সেটাই হয়ত আমার ন্যায্য শাস্তি হত। তবে আরবদের সাদর অভ্যর্থনার প্রত্যুত্তরে তাদের প্রতি কর্তব্য দেখানো যেমন আমার দায়িত্ব, সে ছাড়াও প্রতিটি সম্ভাব্য পথ ধরে লিভিংস্টোনের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করাটা আমার পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। মিরাম্বোর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এই যে রাস্তাটা বন্ধ হয়ে আছে, এই পথ ধরে লিভিংস্টোনের সম্ভাব্য অবস্থান মাত্র এক মাসের পথ। এবার আমি সাহায্য করলে রাস্তাটা যদি বেশি তাড়াতাড়ি খুলে যায়, আমি কেনই বা সাহায্য করব না? দ্বিতীয়বারের জন্য উজিজির পথ খোলার চেষ্টা করা হল- দু’বারই চেষ্টা ব্যর্থ। আমি এবার অন্য একটা পথ ধরে যাওয়ার চেষ্টা করব; উত্তর দিক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাটা বোকামো। সেদিকে ডাকাত টুটাদের মত মিরাম্বোর মিত্রপক্ষকে যদি নাও ধরি, তবু আমার আর উজিজির মধ্যে রয়েছে মিরাম্বোর মা, তার দলবল আর সুইরা। দক্ষিণের পথটাই সবচেয়ে কাজের। খুব কম লোকই দক্ষিণের এলাকার সম্বন্ধে কিছু জানে; যাদের এসব নিয়ে প্রশ্ন করেছি তারাই জলের অভাব আর ডাকাত জাভিরাদের ভয় দেখাচ্ছে। তারা এও বলেছে যে জনবসতি অল্প আর অনেক দূরে দূরে।
তবে এই নতুন পথে রওনা দেওয়ার আগে, নতুন এক দল লোক নিয়োগ করতে হবে, কারণ যারা আমার সঙ্গে এমফুটোতে এসেছিল তারা ধরে নিয়েছে যে তাদের কাজ শেষ। আর সত্যি বলতে দলের পাঁচজনের মারা যাওয়াটা তাদের বেড়ানোর সব উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছে। ন্যামওয়েজিদের কাজে লাগানোর আশা করা বৃথা, যুদ্ধের সময় কুলি হিসাবে কাফেলার সাথে যাওয়া তাদের রীতিবিরুদ্ধ। আমার অবস্থা খুবই সঙ্গিন। উপকূলে ফিরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ভাল অজুহাত আমার থাকলেও, এত টাকা খরচ করার পরে আর আমার উপর এত ভরসা করার পরে আমার বিবেক আমাকে ফিরে যেতে দেবে না। সত্যি বলতে কি, এই অবস্থায় ফিরে আসার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।
শনিবার, ১২ই অগাস্ট। যেমন ভেবেছিলাম, আমার লোকেরা সব চলে গেল; তাদের বক্তব্য এই যে তাদের মিরাম্বোর রাস্তা ধরে উজিজিতে যাওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। আর মাত্র তেরো জন আছে। এই ছোট্ট দল নিয়ে কোথায় যাব?
আমার ভান্ডারে একশোরও বেশি বোঝা রয়েছে। এছাড়া লিভিংস্টোনের কাফেলাও এখানে রয়েছে; তার মালপত্রের মধ্যে সতেরো গাঁটরি কাপড়, বারোটা বাক্স আর ছয় ব্যাগ পুঁতি রয়েছে। তার লোকরা তো এই দেশের সব সেরা সেরা জিনিস নিয়ে বিলাসে মেতে আছে।
লিভিংস্টোন যদি উজিজিতে থাকেন, তাহলে তিনি এখন আটকা পড়ে আছেন, ওখান থেকে বেরনোর খুব কম উপায়ই তাঁর কাছে আছে। আমিও নিজেকে উন্যানয়েমেম্বেতে বন্দি বলে ভাবতে পারি, মিরাম্বোর সঙ্গে এই যুদ্ধের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমিও মনে হয় না উজিজিতে যেতে পারব। লিভিংস্টোন তাঁর জিনিসপত্র পাবেন না, সেসব এখানে আমার সঙ্গে আছে। জাঞ্জিবারেও ফিরতে পারবেন না, আবার নীল নদের রাস্তাও আটকানো। যদি তাঁর সঙ্গে লোকজন আর রসদ পত্র থাকে, তাহলে তিনি সম্ভবত উত্তর মুখো হয়ে উরুন্ডির মধ্যে দিয়ে আর তারপর রুয়ান্ডা, কারাগওয়াহ, উগান্ডা, ইউনিওরো এবং উবারি থেকে গন্ডোকোরো হয়ে বেকারে পৌঁছাতে পারেন। কুলি পাবেন না, কারণ যে উৎস থেকে কুলির সরবরাহ আসে তা বন্ধ রয়েছে। এটা ভাবা ভুল হবে যে কোন দলবল আর বিক্রয়যোগ্য কাপড় ও পুঁতির যথাযথ সরবরাহ ছাড়াই লিভিংস্টোন আফ্রিকার মধ্য দিয়ে অভিযান চালাতে সক্ষম হবেন। ওঁর সমান প্রতিভাশালী কোন উদ্যমী মানুষই সেরকমটা পারবে না।
আজ একজন বলল যে লিভিংস্টোন যখন ন্যাসা লেক থেকে টাঙ্গানিকার দিকে যাচ্ছিলেন (সেই যখন সবাই তাকে মেরেই ফেলা হয়েছে বলে ধরে নিয়েছিল) সেই সময় সৈয়দ বিন ওমরের উলাম্বাগামী কাফেলার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। তিনি মোহাম্মদ বিন ঘারিবের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। এই আরবটি উরুঙ্গা থেকে এসেছিল। লিভিংস্টোনের সঙ্গে তার দেখা হয় চি-কুম্বি, বা কোয়া-চি-কুম্বিদের এলাকায় আর পরে লিভিংস্টোনের সঙ্গে মান্যুয়েমা বা মান ইয়েমা পর্যন্ত ছিল বলেই শুনেছি। মান্যুয়েমা ন্যাসার উত্তরপ্রান্ত থেকে চল্লিশ দিনের পথ। লিভিংস্টোন হাঁটছিলেন; একটা মার্কিনি চাদর গায়ে দিয়ে। নৌকায় চড়ে লিয়েম্বা লেক পেরনোর সময় তাঁর সব কাপড় হারিয়ে যায়। তাঁর সঙ্গে তিনটে ক্যানো ছিল; একটায় কাপড় চোপড় রেখেছিলেন, অন্যটায় বাক্সপত্র ছিল আর দলের কয়েকজনও ছিল, তৃতীয়টিতে দু'জন চাকর ও দু'জন জেলে নিয়ে তিনি নিজে ছিলেন। কাপড় বোঝাই নৌকাটা উলটে যায়। ন্যাসা থেকে লিভিংস্টোন উবিসায় যান, সেখান থেকে উয়েম্বা, আর সেখান থেকে উরুঙ্গুতে যান। লিভিংস্টোন একটা টুপি পরেছিলেন। তার সঙ্গে একটা ব্রীচ-লোডিং দোনলা রাইফেল ছিল, সেটা ভীষণ শব্দে গুলি উগরে দিচ্ছিল। এছাড়া তার হাতে দুটো রিভলবারও ছিল। লিভিংস্টোনের সঙ্গের হাইয়িও লোকটা আমার সংবাদদাতাকে এও জানিয়েছিল যে গোড়াতে প্রভুর সঙ্গে আরও অনেক লোক ছিল, তবে অনেকেই তাকে পরিত্যাগ করেছে।
(ক্রমশ...)