ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এইবার সাংবাদিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ স্ট্যানলে, নথিবদ্ধ করছেন লিভিংস্টোনের মুখে শোনা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। তরজমা স্বাতী রায়
বাবিসা সর্দারের গ্রামে থাকাকালীন, হ্রদের পশ্চিম তীরের থেকে এক মিশ্র-বর্ণের আরব এসে পৌঁছায় ও খবর দেয় যে মাজিতুর একটা দল তার সব কিছু লুঠ করেছে। ঘটনাটা এমন একটা জায়গায় ঘটেছে যেটা তারা এখন যেখানে আছেন তার থেকে কমপক্ষে ১৫০ মাইল উত্তর-বায়ু (উত্তর-উত্তর-পশ্চিম) কোণে। ডাক্তার ও জোহানাদের সর্দার মুসা দু'জনেই সেটা খুব ভাল করে জানেন। মুসা খুব আগ্রহ নিয়ে আরবদের গল্প শুনেছিল আর সেটা পুরো বিশ্বাস করেছিল। তার অবশ্য অন্য কারণ ছিল, সেটা এখনই বলব। এই ভয়ঙ্কর বিবরণ বেশ করে মুখস্থ করে, সে ডাক্তারের কাছে এলো তাকেও শোনাতে। অভিযাত্রী ধৈর্য ধরে বর্ণনাটি শুনলেন, মুসা কোন খুঁটিনাটিই বাদ দেয় নি, আর তারপর মুসাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে সে এটা বিশ্বাস করে কিনা। 'হ্যাঁ,' অনায়াসে মুসা উত্তর দিল; 'সে আমাকে সত্যি বলেছে। আমি তাকে ভাল করে জিজ্ঞাসা করেছি, আর সে আমাকে সত্যি কথাই বলেছে।' ডাক্তার অবশ্য বললেন, তিনি এটা বিশ্বাস করেননি, কারণ মাজিতু শুধু একজনকে লুঠ করেই থেমে যেত না, তারা তাকে মেরেও ফেলত; তবে দলের অধস্তন মুসলমানদের ভয় দূর করার জন্য, সেই সঙ্গে এও পরামর্শ দিলেন যে তারা দুজনেই যে গ্রামে রয়েছেন, সেই গ্রামের সর্দারের কাছে যাবেন। সে একজন বিচক্ষণ মানুষ। সেই বলতে পারবে গল্পটা সত্যি না বানানো। দুজনে মিলে তারা বাবিসার সর্দারের কাছে গেলেন। সর্দার আরবের গল্প শুনে নির্দ্বিধায় আরবকে মিথ্যাবাদী বলে দিলেন। বললেন, গল্পটা ভিত্তিহীন। কারণ হিসাবে বললেন, যে যদি মাজিতু ইদানীং আশেপাশে থাকত, তবে তাহলে তার কানে সেকথা আগেই আসত।
কিন্তু মুসা বলে উঠল, 'না, না, ডাক্তার, না না না; আমি মাজিতুর কাছে যেতে চাই না। আমি চাই না মাজিতু আমাকে মেরে ফেলুক। আমি জোহানায় আমার বাবা, আমার মা, আমার সন্তানকে দেখতে চাই। আমি মাজিতুকে চাই না।' ঠিক এই কথাগুলোই মুসা বলেছিল।
তার জবাবে ডাক্তার বললেন, 'আমি চাই না যে মাজিতু আমাকে মেরে ফেলুক; কিন্তু, যেহেতু তুমি তাদের ভয় পাচ্ছ, আমি কথা দিচ্ছি যে মাজিতুর এলাকা না পেরোন অবধি আমরা সোজা পশ্চিমে যাব।'
মুসা সন্তুষ্ট হল না, হাহাকার করতে থাকল, ' আমাদের সাথে দুশ বন্দুক থাকলে আমি যেতাম; কিন্তু আমাদের ছোট দলকে তারা রাতের বেলা আক্রমণ করবে আর সবাইকে মেরে ফেলবে।'
ডাক্তার আবার তার আগের কথাই বললেন, 'কিন্তু আমরা তাদের কাছে যাব না; পশ্চিমে যাব।'
পশ্চিম দিকে মুখ ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গেই মুসা ও জোহানার লোকেরা একযোগে পালিয়ে গেল।
মুসার আচরণের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে, ডাক্তার বলেছেন যে মুসা ও আরেকটা নেতাকে তাঁর খুব গুলি করতে ইচ্ছে হয়েছিল। তবে তবুও, তিনি খুশি যে ওই লোকগুলোর ঘৃণ্য রক্ত তার হাত নোংরা করে নি। দু-একদিন পরে, সাইমন প্রাইস নামে দলের আরেকজন লোক মাজিতু সম্পর্কে একই গল্প নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছিল, কিন্তু তার দলের লোকের সংখ্যায় তখন এতই কম যে ডাক্তার এই ধরনের দল ছেড়ে পালানোর সকল প্রবণতা আর ভীতুমিকে কড়া ভাবে দমন করতে বাধ্য হলেন। ডাক্তার তাকে তক্ষুনি চুপ করিয়ে দিলেন আর মাজিতুর নাম আর উচ্চারণ করার ব্যাপারে কড়া নিষেধ জারি করলেন।
যে বন্য, পদচিহ্ন-বর্জিত জায়গায় তিনি ঢুকতে চলেছেন, স্থানীয়রা তাকে সাহায্য না করলে, সেখানে ঢোকার আশা ত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। 'সৌভাগ্যবশত,' যেমন ডক্টর উৎসাহ ভরে বললেন, ' নিয়াসার তীর ছেড়ে আসার পর, এখন আমি এমন একটা দেশে, যেখানে দাস-ব্যবসায়ীদের পা পড়েনি; একটা নতুন, অস্পর্শিত জায়গা, আর অবশ্যই, যেমনটা এইরকম সবসময়ই পেয়েছি, স্থানীয়রা খুবই ভাল ও অতিথিপরায়ণ। কাপড়ের ছোট্ট টুকরোর বিনিময়ে আমার মালপত্র গ্রাম থেকে গ্রামে পৌঁছে দিয়েছিল।' আরও বিভিন্ন উপায়ে ভ্রমণকারী, তার চরম দুর্ভোগের সময়েও, এখনও অপরিশীলিত, নিরীহ স্থানীয়দের থেকে সদয় আচরণ পেয়েছেন।
১৮৬৬ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এই আতিথেয়তা পূর্ণ অঞ্চল ছেড়ে ডাক্তার একটা দেশে এলেন যেখানে মাজিকু তাদের চেনা লুঠপাটের অত্যাচার চালাচ্ছিল। খাবার-দাবার, গবাদি পশু সব লুঠে নেওয়া হয়েছিল। মানুষজন সেই হিংস্র লুণ্ঠনকারীদের এলাকা ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছিল। আবার অভিযানের সবার কপালে তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণা লেখা ছিল ; কোন কোন জায়গায় বুনো ফল মিললে, তারা সেইগুলোই খেয়ে বাঁচছিল। মাঝে মাঝে কেউ কেউ দল ছেড়ে পালানোর ফলে এই দুঃখ কাতর দলের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিল। তারা একাধিকবার ডাক্তারের ব্যক্তিগত দ্রব্যাদি, জামাকাপড়, বিছানাপত্তর ইত্যাদি নিয়ে পালিয়েছে। কম-বেশি দুর্ভাগ্য তাঁর প্রতি পদক্ষেপে জড়িয়ে ধরলেও তিনি নিরাপদে বাবিসা, বোবেম্বা, বারুঙ্গু, বা-উলঙ্গু এবং লুন্ডা দেশগুলির উপর দিয়ে চলছিলেন।
লুন্ডা নামের দেশটাতে বিখ্যাত ক্যাজেম্বের বাস। পর্তুগিজ অভিযাত্রী ডক্টর ল্যাসেরদা তাঁকে প্রথম ইউরোপীয়দের কাছে পরিচিত করেছিলেন। ক্যাজেম্বে একজন ভারি বুদ্ধিমান রাজা; লম্বা, দৃঢ়চেতা মানুষ, লাল-রঙের ছাপা কাপড়ের এক অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরেন। একটা মস্ত বড় কিল্টের মতন। এইরকম রাজকীয় পোশাকে, রাজা ক্যাজেম্বে ডক্টর লিভিংস্টোনকে স্বাগত জানান। তাঁর সর্দাররা আর দেহরক্ষীরা তাঁকে ঘিরে ছিলেন। রাজা ও বয়োজ্যেষ্ঠরা শ্বেতাঙ্গ লোকটির সম্পর্কে সব কিছু জানার জন্য একজন সর্দারকে নিয়োগ করেছিল। সেই সর্দার এরপর সভার সকলের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে তাঁর তদন্তের ফলাফল জানালেন। তিনি শুনেছিলেন যে শ্বেতাঙ্গ লোকটি জল, নদী ও সমুদ্রের সন্ধান করতে এসেছে; যদিও সে বুঝতে পারে নি যে শ্বেতাঙ্গ লোকটি এইসব জেনে কী করবে, তবে তার কোন সন্দেহ নেই যে উদ্দেশ্যটা ভালই। তারপর ক্যাজেম্বে জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তার কী করবেন বলে ভাবছেন আর তিনি কোথায় যেতে চাইছেন। ডাক্তার উত্তর দিলেন যে তিনি দক্ষিণে যাওয়ার কথা ভাবছেন, কারণ তিনি শুনেছেন যে হ্রদ আর নদীগুলো সেই দিকে রয়েছে। ক্যাজেম্বে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনি কিসের জন্য সেখানে যেতে চান? জল তো এখানেই রয়েছে। এই এলাকায় অনেক অনেক হৃদ আছে।' সভা ভাঙ্গার আগে, ক্যাজেম্বে নির্দেশ দিলেন যে সাহেব যেন তার দেশের মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নে, নিরুপদ্রবে যেতে পারেন। বলেছিল, তিনিই প্রথম ইংরেজ যাকে সে দেখেছে, আর যাকে তার পছন্দ হয়েছে।
রাজার সঙ্গে আলাপের কিছুক্ষণ পরেই, রানী সেই বিশাল বাড়িতে এসে ঢুকলেন। সঙ্গে বর্শাধারী নারী যোদ্ধারা। রানী একজন দারুণ, লম্বা, সুদর্শন যুবতী। আর সে স্পষ্টতই ভেবেছিল যে সে গ্রাম্য-দর্শন সাহেবের মনে একটা ছাপ ফেলতে চলেছেন, কারণ সে ভারি রাজকীয় ঢঙ্গের পোশাক পরেছিল আর একটা জবরদস্ত বর্শা ছিল তার সঙ্গে। কিন্তু তার চেহারা - ডাক্তার যা ভেবেছিলেন তার থেকে এতই আলাদা যে ডাক্তার হেসে ফেলেছিলেন, তার উদ্দেশ্যটাই পণ্ড। ডাক্তারের হাসি এতটাই সংক্রামক ছিল যে রানী নিজেই প্রথমে তার দেখাদেখি হেসে ওঠেন আর তারপর তার সঙ্গী যোদ্ধারাও, যারা তার সভাসদের মতোই, তারাও হেসে উঠেছিল। এতে খুব বিরক্ত হয়ে রানী দৌড়ে চলে যান, সঙ্গে সঙ্গে তার বাধ্য মেয়ের দল - ডাক্তারের সামনে তার মহিমান্বিত আবির্ভাবের তুলনায় খুবই অগৌরবের পশ্চাদপসরণ, মোটেই রানীসুলভ না। তবে লিভিংস্টোনের এই দরবারে তার অভ্যর্থনা সম্পর্কে ও এই আকর্ষণীয় রাজা-রানী সম্পর্কে অনেক কিছু বলার আছে। যে ঘটনার সাক্ষী তিনি নিজে, যে ঘটনাগুলো একচেটিয়াভাবে তার নিজের, তা তিনি নিজে ছাড়া আর কেই বা এত ভালভাবে বর্ণনা করতে পারবে?
(ক্রমশ…)