ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে শিকার অভিযান। তরজমা স্বাতী রায়
জেব্রা দুটোর খাওয়ার যোগ্য অংশটা দাঁড়িপাল্লায় তুললে দেখা গেল, ডাক্তারের হিসেব মতে, ভাল মাংস মিলেছে ৭১৯ পাউন্ড - মানে চুয়াল্লিশ জনের মধ্যে ভাগ হলে প্রত্যেকের ভাগে ১৬ পাউন্ডের একটু বেশি জুটবে। বিশেষ করে বোম্বে তো খুবই খুশি, সে আসলে একটা স্বপ্ন দেখেছিল, সেটাতে আমিই নায়ক – আমি নাকি ডানদিক বাঁদিকে টপাটপ গুলি করছি আর প্রাণী মারছি। তাই আমাকে সেই আশ্চর্য রেইলি রাইফেলটি নিয়ে বেরোতে দেখে আমার সাফল্যের বিষয়ে তার একটুও সন্দেহ ছিল না, আর সেই মত, লোকদের নির্দেশ দিয়েছিল যে যেই গুলির শব্দ শুনবে অমনি যেন আমার পিছনে ছোটে।
নিচের লেখাটুকু আমার ডায়েরি থেকে নেওয়া:
২০ জানুয়ারি, ১৮৭২। আজ আমাদের যাত্রা স্থগিত ছিল। শিকারের জন্য বেরোতে গিয়ে দেখি এগারোটা জিরাফের একটা পাল। এরকম একটার চামড়া পেলে কী ভালই না হত! এমপোকওয়া নদী পেরিয়ে আমি তাদের একজনের দেড়শ গজের মধ্যে আসতে পেরেছিলাম আর এটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাই; কিন্তু, এটা আহত হলেও, পেড়ে ফেলতে পারিনি।
বিকেলে আমি গ্রামের পূর্ব দিকে গেলাম, আবার ছটা জিরাফের একটা পালের কাছে এলাম। একটাকে ঘায়েলও করেছিলাম, কিন্তু আমার চেষ্টা সত্ত্বেও সেটা পালিয়ে গেল।
কী অসাধারণ প্রাণী ! অপূর্ব বড় বড় নির্মল চোখ! শপথ করে বলতে পারি যে দুটো গুলিই লক্ষ্যে লেগেছিল, কিন্তু তারা দ্রুতগামী ঘোড়ার মত রাজকীয় ভঙ্গিতে পালিয়ে গেল । যখন তারা দৌড়চ্ছিল তখন তারা বিচ্ছিরি ভাবে কোমর দুলিয়ে ছুটছিল, খানিকটা ভারতীয় নাচ বা থেবান নর্তকীদের দুলুনির মতো - একটা ঘোরলাগা , ঢেউয়ের মতন নড়াচড়া, তার লেজ, তার কালো লম্বা কেশর সবই যেন সেই দুলুনিতে অংশ নিচ্ছে।
ডাক্তার জানতেন কিভাবে একজন উদগ্রীব অথচ হতাশ তরুণ শিকারিকে সান্ত্বনা দিতে হয়। তিনি আমার ব্যর্থতার জন্য সীসার গুলিকে দায়ী করলেন। জিরাফের পুরু ত্বক ভেদ করার পক্ষে এটা খুব নরম । তিনি আমাকে বললেন যে আমার জিঙ্ক ক্যান্টিনগুলোকে গলিয়ে তাই দিয়ে সীসাকে শক্ত করতে বললেন। এই জন্যেই ডাক্তারকে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে দারুণ বলে ভাবি! আর তেমন ভাবার মতন ঘটনা এটাই প্রথম, তাও তো নয়। কেমন সুন্দর করে একজনকে দুর্ভাগ্যের দরুন সান্ত্বনা দিতে হয় বা তাকে কিভাবে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করতে হয় তা মনে হয় কেউই এতটা ভালভাবে জানত না! আমি যদি একটি জেব্রাকে মারতে পারি, তাহলে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার শিকারি বন্ধু অসওয়েল ও তিনি নিজেও কি অনেক আগেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন না যে আফ্রিকায় জেব্রার মাংসই হল সবচেয়ে স্বাদু? যদি একটা মহিষকে গুলি করি, তবে সে তো নিশ্চিত ভাবে তার গোষ্ঠীর সেরা মহিষ আর কি দারুণ মোটা! নমুনা হিসেবে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য তার শিংগুলিও দারুণ মূল্যবান! আর যদি আমি কিছু ছাড়াই খালি হাতে ফিরে আসি, তাহলে তো অবশ্যই শিকারটি খুব বন্য ছিল, বা লোকজনেরা আওয়াজ করেছিল বলে শিকার ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কেই বা ভীত-শঙ্কিত পশুদের পিছনে ধাওয়া করে? আসলে, তিনি একজন অত্যন্ত বিবেচক সহচর ছিলেন। আর আমি তাঁকে আক্ষরিক অর্থে সত্যবাদী বলে জানতাম। তাই সফল হলে আমি তার প্রশংসায় গর্বিত হতাম, আর ব্যর্থ হলে তখন সহজেই সান্ত্বনা পেতাম।
ইব্রাহিম হল আমার সেই বুড়ো কুলি, উকাওয়েন্দিতে যার বহু পুরোনো কিবুয়ু ভেঙ্গে গিয়েছিল বলে যে ভারি মনে দুঃখ পেয়েছিল। উজিজি ছেড়ে যাওয়ার সময় সে তার সব কাপড় মান্যুয়েমার একজন ক্রীতদাসের উপর চাপিয়েছিল। সেই দাসের নাম হল "উলিমেঙ্গো" , যার অর্থ "বিশ্ব" । এমপোকওয়ার কাছাকাছি এসে, উলিমেঙ্গো তার মালিকের পুরো সম্পত্তি নিয়ে পালিয়ে গেল। সম্পত্তি বলতে কটা কাপড় ও এক ব্যাগ লবণ - এগুলো সে ব্যবসা করবে বলে উন্যানয়েম্বে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিল। ইব্রাহিমের দুঃখের সীমা-পরিসীমা নেই। প্রতিদিন নিজের ক্ষতির জন্য এমন কাতর সুরে বিলাপ করতে লাগল যে সবাই তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার বদলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করেছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন-ই বা সে এমন একজন দাস কিনেছিল আর যতদিন একসঙ্গে ছিল, কেনই বা তাকে ঠিক করে খাওয়ায়নি? সে কড়া গলায় উত্তর দিল, "সে কি আমার গোলাম নয়? যে কাপড় দিয়ে আমি তাকে কিনেছিলাম সেটা কি আমার নিজের নয় ? কাপড়টা যদি আমার নিজের হয়, তাহলে কি তা দিয়ে আমার পছন্দের যা কিছু জিনিস কিনতে পারি না? এমন কথা বলছেন কেন?"
সেদিন সন্ধ্যায় লবণ ও কাপড় নিয়ে উলিমেঙ্গো ফিরে এলো। ইব্রাহিম ভারি খুশি। এই একচোখো বুড়ো মহা আনন্দে নেচে উঠল। আর তড়িঘড়ি আমাকে খুশির খবর দিতে এলো। "এই দেখ, 'বিশ্ব' ফিরে এসেছে। ঠিক ফিরে এসেছে। আমার নুন আর কাপড়ও তার সঙ্গে আছে। অবশ্যই আছে।" উত্তরে আমি বলেছিলাম, ভবিষ্যতে যেন সে তাকে আরও ভাল করে খাওয়ায় দাওয়ায় , কারণ দাসদেরও তাদের প্রভুদের মতোই খেতে লাগে।
রাত দশটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ডাক্তার ক্যানোপাস নামের তারাটিকে পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তার থেকে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে উকোনঙ্গোর উটান্ডা এলাকার এমপোকওয়া আসলে দক্ষিণ অক্ষাংশ ৬° ১৮' ৪০" অবস্থানে অবস্থিত। আমার ম্যাপে আন্দাজে বসানো অবস্থানটির সঙ্গে সত্যিকারের অবস্থান তুলনা করে দেখতে পেলাম যে মাত্র তিন মাইলের তফাৎ। আমি জায়গাটাকে ৬° ১৫' দক্ষিণ অক্ষাংশে রেখেছিলাম।
পরের দিনও যাত্রা নাস্তি. ডাক্তারের পা এতই ফোলা ও এতটাই ব্যথা যে তিনি আর জুতো পরার কথা ভাবতে পারছিলেন না। আমার গোড়ালিও কাহিল, হাঁটাচলায় সুবিধার জন্য আমার জুতোর তলায় বড় ছ্যাঁদা করে নিয়েছিলাম।
আমার দস্তার জলপাত্রগুলোকে বুলেটে বদলে নিয়েছিলাম। তার সঙ্গে একটা বড় চাপাতি নিয়ে, ও বন্দুক-বেয়ারাকে সঙ্গে করে, আমি কিছু না কিছু শিকার নিয়েই ফিরব এইরকম মনস্থ করে এমপোকওয়া নদীর পশ্চিম পারের সমতল ও চমৎকার পার্কের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সমতলে কিছুই না দেখতে পেয়ে, একটা পাহাড় টপকে লম্বা ঘাসে ঢাকা একটি প্রশস্ত গোলাকার উপত্যকায় এসে পৌঁছলাম। এখানে-ওখানে খেজুর গাছের জটলা, মাঝে সাঝে এক একটা পথহারা মিমোসা বা সেরকম কোন গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। একদল জিরাফ দেখলাম ওই দ্বিতীয় ধরণের গাছের ডালপালা চিবুচ্ছে। তারপরে ঘাসের মধ্য দিয়ে তাদের পিছনে ধাওয়া করলাম। লম্বা ঘাসের মধ্যে মধ্যে গজানো বড় বড় পিঁপড়ের ঢিবির আড়ালের সুবিধা নিয়ে যাতে আমি এই সতর্ক প্রাণীদের কাছে যেতে পারি। তাদের মহান চোখ দিয়ে তারা আমাকে আবিষ্কার করার আগেই। এই কৌতূহল জাগানো টিলাগুলোর আড়াল আড়ালে জিরাফের দলের ১৭৫ গজের মধ্যে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম; এর বাইরে ঘাস এত পাতলা আর ছোট ছোট যে কোনো মানুষ হামাগুড়ি দিতে পারে না। একটা বড় শ্বাস নিলাম, কপালের ঘাম মুছলাম, কিছুক্ষণ বসে রইলাম; আমার কালো সহকারীদেরও, আমারই মতো, পরিশ্রমে প্রায় দম বেড়িয়ে গেছে - রাজকীয় পশুর পালের এত কাছে উপস্থিতিতে সবারই মনে প্রবল আশা জেগেছে। ভারী রেইলিটা নিয়ে খানিকটা ভালবেসে নাড়াচাড়া করলাম , কার্তুজগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিলাম, তারপর রাইফেল প্রস্তুত করে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম; তারপর ভাল করে দেখে লক্ষ্য স্থির করলাম; তারপরে আবার বন্দুক নামিয়ে নিলাম ঠিক মত লক্ষ্যস্থির করার জন্য, আরও একবার উপরে তুললাম - তারপর আবার নামালাম। একটা জিরাফ তার শরীরের অর্ধেকটা ঘুরিয়েছিল ; শেষবারের মতো বন্দুক তুললাম, তার হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি এলাকায় দ্রুত তাকালাম আর গুলি চালালাম। সে থমকে গেল, টলমল করল, তারপর ছোট একটা দৌড় দিল; কিন্তু তার ক্ষতর থেকে ঘন স্রোতের মতন রক্ত ঝরছিল, শ'দুয়েক গজ যাওয়ার আগেই সে শেষবারের মত থেমে গেল, তার কানগুলো টান টান হয়ে গিয়েছিল। আর সেই সুযোগে আমি তার বিশ গজের মধ্যে গিয়ে একটা মস্তিষ্ক ভেদী জিঙ্ক বুলেট ছুঁড়লাম, সে মারা গেল।
"আল্লাহু আকবর!" খামিসি, আমার কসাইটি, তীব্রভাবে চিৎকার করে উঠল। "কর্তা, মাংস!'
এতো সুন্দর প্রাণীটাকে আমার সামনে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে বেশ দুঃখই হল। তাকে যদি জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতাম, তো মনে হয় সেটাই করা উচিত ছিল। ভেবেছিলাম যে এত সুন্দর একটা প্রাণী, আফ্রিকার মানুষের সেবার কাজে এত সুন্দরভাবে মানিয়ে নেয় ওরা, তাও এদের খাবার ছাড়া আর কোনও কাজে লাগানো যায় না। খুবই দুঃখের কথা! এই রোগগ্রস্ত অঞ্চলে ঘোড়া, খচ্চর, গাধারা মারা যাচ্ছিল ; যদি জিরাফ ও জেব্রাকে পোষ মানিয়ে অভিযাত্রী ও ব্যবসায়ীদের কাজে লাগানো যেত তো আফ্রিকার জন্য কতো বড় আশীর্বাদ-ই না হত! একটা জেব্রার পিঠে চড়লে, একজন লোক বাগামোয়ো থেকে এক মাসের মধ্যে উজিজিতে পৌঁছে যাবে, অথচ এই দূরত্ব যেতে আমার সাত মাসেরও বেশি সময় লেগেছে!