ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে ফের শুরু হল উন্যানয়েম্বের জীবনের বর্ণনা ও উজিজির দিকে এগিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু। তরজমায় স্বাতী রায়
৪ সেপ্টেম্বর। শ আজ বেশ ভাল আছে, তার মতে। এদিকে সেলিম আবার জ্বরে পড়েছে। আমার বাহিনী ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, যদিও আমার কিছু পুরানো সৈন্য দল থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। উমগারেজা অন্ধ; বারুতির খুবই বাজে রকমের গুটিবসন্ত হয়েছে; বিলালীর একটা অদ্ভুত রোগ হয়েছে, পিছন দিকে একটা আলসার জাতীয় কিছু, সাদালা মুকুনগুরু বা পালাজ্বরে ভুগছে।
৫ সেপ্টেম্বর। আজ সকালে বারুতি মারা গেল। সে আমার সেরা সৈন্যদের একজন ছিল; এবং মিশরে স্পেকের সঙ্গে যারা এসেছিল, সে ছিল তাদের মধ্যে একজন। জাঞ্জিবার ছাড়ার পর যারা মারা গেছে তাদের তালিকায় বারুতি সাত নম্বরে।
যে জায়গাটা দিয়ে আমি যাব, সেই জায়গাটার বিষয়ে আজ আরবরা আমার কানে অনেক বিষ ঢেলেছে। রাস্তা খারাপ; সব নাকি বন্ধ; জঙ্গলে রুগা-রুগারা ঘুরছে। মিরাম্বোকে সাহায্য করতে দক্ষিণ দিক থেকে কোনোঙ্গোরা আসছে; শেনসিরা এক দল আরেক দলের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত। আমার লোকেরা হতাশ হয়ে পড়ছে, আরব ও ন্যামওয়েজিদের ভয় আমার লোকদের মধ্যেও ঢুকে গেছে। বোম্বেও ভাবছে যে আমার এ যাত্রায় উপকূলে ফিরে যাওয়াই ভাল। পরে আবার চেষ্টা করা যাবে।
আমার বাড়ির কয়েক গজ পশ্চিমে বটগাছের ছায়ায় বারুতিকে পুঁতে দিলাম। সাড়ে চার ফুট গভীর ও তিন ফুট চওড়া একটা কবর। নীচে একপাশে একটি সরু নালা কাটা হয়েছিল, তার দেহটা সেখানে এক কাতে শুইয়ে দেওয়া হল, তার মুখ মক্কার দিকে ফেরান। মৃতদেহকে দেড় ডটি নতুন মার্কিন চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। ওই সরু বিছানায় ঠিকভাবে শুইয়ে দেওয়ার পরে, যাতে গায়ে মাটি না লাগে তাই কাঁথা-কানি-চট দিয়ে ঢাকা একটা চালি দিয়ে দেহ ঢেকে দেওয়া হল। তারপর কবরে মাটি দেওয়া হল। সৈন্যরা আনন্দে হাসছিল। কবরের উপরে পোঁতা হল একটা ছোট গাছ, আর হাত দিয়ে একটা ছোট গর্ত খুঁড়ে তাতে জল ঢেলে দেওয়া হল যাতে স্বর্গে যাওয়ার পথে তার জলতেষ্টা না পায়; তারপর কবরে জল ছিটিয়ে দেওয়া হল আর লাউটা ভেঙ্গে ফেলা হল। এরপর এই অনুষ্ঠানের শেষে লোকেরা আরবি ফাত-হা পাঠ করে মৃত সঙ্গীর কবর পিছনে ফেলে চলে গেল, আর তার কথা ভাববে না।
৭ সেপ্টেম্বর। মহম্মদ নামের একজন আরব আজ আমাকে একটা বাচ্চা ছেলে-দাস উপহার দিয়েছে, তার নাম ‘এনদুগু এমহালি’ (আমার ভাইয়ের সম্পদ)। নামটা আমার পছন্দ হয়নি। কাফেলার সর্দারদের ডেকে বাচ্চাটার একটা আরও ভাল নাম দিতে বললাম। একজন বলল ‘সিম্বা’ (সিংহ), অন্য একজন বলল যে তার মনে হয় একটা বাচ্চা ছেলের নাম হিসেবে ‘এনগোম্বে’ (গরু) নামটাই ঠিক হবে, আরেকজন বলল যে একে ‘মিরাম্বো’ বলা উচিত, সবাই সেই শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। বোম্বে ভেবেছিল এই কালো বাচ্চাটাকে ‘বোম্বে এমডোগো’ নামটাই বেশ মানাবে। তবে বাচ্চাটার প্রাণচঞ্চল চোখ আর চটপটে চলাফেরা দেখে উলিমেঙ্গো বলল যে কা-লু-লা নামটি তার জন্য সেরা, ‘‘কারণ,’’ সে বলল, ‘‘শুধু ওর চোখের দিকে তাকান, কত উজ্জ্বল! তার চেহারার দিকে তাকান, এত ছিপছিপে গড়ন! ওর হাঁটাচলা দেখুন, কী দ্রুত! হ্যাঁ, কালুলুই ওর জন্য ঠিক নাম।’’ ‘‘হ্যাঁ, বানা,’’ অন্যরাও বলল, ‘‘ওর নাম কালুলুই হোক।’’
কালুলু কিসাওয়াহিলি শব্দ, ব্লু-বাক (পারপুসিলা) অ্যান্টিলোপের বাচ্চাদের এই নামে ডাকা হয়।
‘‘আচ্ছা, বেশ’’, আমি বললাম। একটা বড় টিনের পাত্রে জল আনা হল। সেলিম, বাচ্চাটার গডফাদার হতে রাজি। সে তাকে জলের উপরে ধরে রাখল, আর বলল, ‘‘এখন থেকে এর নাম হল কালুলু, আর কেউ এর থেকে এই নাম কেড়ে নিতে পারবে না’’। এইভাবে মোহাম্মদের ছোট্ট কালো ছেলেটার নাম কালুলু হয়ে গেল।
অভিযানের সদস্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এখন দলে রয়েছে:
২ জন শ্বেতাঙ্গ, ১ জন আরব ছেলে, ১ জন হিন্দের লোক, ২৯ জন এনগোওয়ানা, ১ জন লন্ডা (কাজেম্বের) থেকে আসা ছেলে আর একজন উগান্ডার ছেলে। আর ১ জন লিয়েম্বা বা উয়েম্বার ছেলে।
অন্ধকার নামার ঠিক আগে বেশ শঙ্কিত হওয়ার মত একটা ঘটনা ঘটল। তাবোরাতে অনেক গুলি ছোঁড়াছুঁড়ির শব্দ শোনা গেল। আমরা তো ভাবলাম এরপরই কুইহারাতে আক্রমণ হবে নিশ্চয়। পরে অবশ্য জানা গেল যে উন্যানয়েম্বের সুলতান এমকাসিওয়ার সঙ্গে দেখা করতে সুলতান কিতাম্বি এসেছিল। তাকে সম্মান জানাতেই এই গুলি ছোঁড়ার শব্দ।
৮ সেপ্টেম্বর। রাতের দিকে শেখ বিন নাসিবের কাছে এমফুটোর এক আরবের একটা চিঠি এল, তাতে লেখা যে মিরাম্বো এবং তার টুটা মিত্ররা সেখানে আক্রমণ করেছে। চিঠিতে কুইহারার জনগণকেও প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল। কারণ মিরাম্বো যদি একবার এমফুটো দখল করতে পারে, তাহলে সে সরাসরি কুইহারার দিকে রওনা দেবে।
৯ সেপ্টেম্বর। গতকাল এমফুটো আক্রমণ করতে গিয়ে মিরাম্বো হেরে গেছে আর তার মারাত্মক ক্ষতিও হয়েছে। একটা ছোট ন্যামওয়েজি গ্রাম আক্রমণ করতে গিয়ে সে সফল হয়েছিল, কিন্তু যখন এমফুটো দখলের চেষ্টা করে, সে নিজের তিন প্রধান সহকারীকে হারায় আর পিছু হটতে বাধ্য হয়। তার সৈন্যদের আক্রমণ ঠেকানোর পরে, বাসিন্দারা বেরিয়ে এসে উমান্ডার জংগল অবধি তার পিছনে ধাওয়া করে , সেখানে তাকে আবার সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে দেয়, সে ল্যাজ গুটিয়ে মাঠ ছেড়ে পালায়। যুদ্ধে মারা যাওয়া মিরাম্বোর সর্দারদের মাথা কুইকুরুতে এমকাসিওয়ার পাঁচিল-ঘেরা বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।
১১ সেপ্টেম্বর। শ বড্ড আবেগে চলে, তার চালচলন যেন অনেকটা জোসেফ সারফেসের মতন। মাঝে মাঝেই মানবজাতির, বিশেষ করে ধনীদের দোষ নিয়ে বিশাল বক্তৃতা দিতে শুরু করে। এই বিষয়ে তার ফিলিপিক্স শোনার জন্য আমার থেকে অনেক ভাল শ্রোতা তার পাওয়া উচিত।
ওর একটা আত্ম-নিমগ্ন হয়ে থাকার অভ্যাস আছে- খুবই অদ্ভুত স্বভাব, জ্যাক বানসবির একেবারে বিপরীত। দিগন্তের দিকে তাকানোর বদলে সে তার পায়ের তলার মাটির দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন বলতে চায় যে, কোথাও কিছু একটা ভুল আছে, আর আমি কোথায় যে ভুলটা আছে আর কীভাবে তা সংশোধন করা যায় সেটা খুঁজে বার করতে চেষ্টা করছি।
আমাকে শ আজ বলল যে তার বাবা ইংল্যন্ডেশ্বরের নৌবাহিনীতে একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন, আর সে নাকি রানী ভিক্টোরিয়ার চারটে দরবারে হাজির ছিল। এটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ আমি কল্পনাও করতে পারি না যে নৌবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনের ছেলে এতই লেখাপড়ায় অজ্ঞ হবে যে নিজের নামটাও লিখতে জানবে না! আর আমি তো চিরকালই জানি সেন্ট জেমসের দরবার হল ইউরোপের মধ্যে সব চাইতে অভিজাত- সেখানে তাকে কি করে রানীর কাছে নিয়ে যাওয়া হল তা তো আমি বুঝতেই পারছি না।
আমি তাকে নিয়ে হাসাহাসি করি বলে সে অবশ্য আমার উপর খুবই খাপ্পা। এইমাত্র আমার উপর এমন আবেগের বন্যা বইয়ে দিল যে আমি তো প্রায় বিরক্তিতে কাঁদতে বসলাম যে কেন আমি এই গাধাটাকে সঙ্গে নিয়েছি।
১৪ সেপ্টেম্বর। আমার সঙ্গের আরব ছেলেটা, মানে সেলিম, অবিরাম জ্বরে প্রলাপ বকছে। শও ফের অসুস্থ। এই দুটো ব্যাপারই আমার বেশিরভাগ সময় দখল করে রেখেছে। আমি একজন সবসময়ের নার্সে পরিণত হয়েছি, কারণ তাদের সেবাশুশ্রূষার কাজে আমাকে সাহায্য করার মত কেউ নেই। আমি যদি আবদুল কাদেরকে কি করে কাজে সাহায্য করা যায় তা শেখাতে যাই, তবে তার মাথা উন্যামওয়েজি তামাকের ভয়ানক ধোঁয়ায় এমনই ধূমাচ্ছন্ন যে যতক্ষণ না আমি এত বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ি যে ঘন্টা খানেকের জন্য আমার মনের শান্তি উবে যায়, ততক্ষণ সে হাঁ করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, থালা-বাসন ভেঙ্গে ফেলে, রান্না করা সুখাদ্যগুলোকে ঘেঁটে নষ্ট করে। যদি ফেরাজ্জি, আমার বর্তমানের রাঁধুনিকে সাহায্য করতে বলি, সে তার কাষ্ঠবৎ মোটা মাথায় কোন কথাই বুঝতে পারেনা, আর তাই আমিই রাঁধুনির ভূমিকাও পালন করতে বাধ্য হই।
তার দুই-পাউন্ডের কামানে গোলা আর আঙুরের মত লোহার গুলি আর লোহার ছোট ছোট দানা বোঝাই করে দিলাম, আর তাকে বলে এলাম যে মিরাম্বোর দলবল একেবারে দরজায় এসে পৌঁছানোর আগে যেন কামান না ছোঁড়ে।
বিকেল চারটে নাগাদ শুনতে পেলাম যে মিরাম্বো তাবোরার উত্তর-পশ্চিমে কাজিমাতে চলে গেছে।
২৬ আগস্ট। আরবরা আজ সকালে কাজিমাতে ঝটিতি-আক্রমণ শানাতে গিয়েছিল, তবে মিরাম্বো তাদের কাছে একদিনের বিরতি চেয়েছিল। তাদেরই থেকে চুরি করে আনা গরুর মাংস খাওয়ার জন্য। তাই তারা আর আক্রমণ করেনি। মিরাম্বো নাকি বেহায়ার মত তাদের পরের দিন সকালে আসতে বলেছিল, বলেছিল যে তখন নাকি সে আরবদের যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দেবে।
কুইহারাতে আবার শান্তি ফিরে এল, ভীত হতাশ শরণার্থীরা আর এই ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করছে না।
২৭ আগস্ট। মিরাম্বো রাতের বেলা পিছু হটেছে; আরবরা যখন সদলবলে কাজিমা গ্রাম আক্রমণ করতে গেল, দেখে যে গ্রামটা খালি।
আরবরা আজকাল যুদ্ধের মন্ত্রণাসভা করে- যুদ্ধ নিয়ে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, এসব তাদের খুব পছন্দ। কিন্তু কাজের বেলা বেজায় ঢিমে তালে চলে। তারা উত্তরের তুতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেষ্টা চালাচ্ছিল, কিন্তু মিরাম্বো তাদের আগেই দোস্তি পাতায়। দ্বিতীয়বার মিরাম্বোর এলাকা আক্রমণ করা নিয়ে কথা চলছিল, কিন্তু মিরাম্বো আগুন আর তলোয়ার সহ ইউন্যানয়েম্বে আক্রমণ করেছিল, অনেক পরিবারকেই মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে আর মহত্তম আরবদের সে মেরে ফেলেছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা আরবরা কথা বলে, তর্ক করে, এদিকে উজিজি ও কারাগওয়াহের রাস্তা আগের থেকেও বেশি শক্তভাবে বন্ধ। প্রকৃতপক্ষে অনেক প্রভাবশালী আরবরাই জাঞ্জিবারে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে, তারা বলছে যে ‘উন্যানয়েম্বে শেষ হয়ে গেছে।’তাদের প্রতি আমার কোন শ্রদ্ধা নেই।
যাইহোক, এরমধ্যে ন্যামওয়েজি কুলি আর মোটেই পাব না বুঝে আমি আমার সঙ্গে উজিজিতে যাওয়ার জন্য উন্যানয়েম্বেতে বসবাসকারী এনগওয়ানা বিদ্রোহীদের দলে নিতে শুরু করলাম। তিনগুণ দামে। মাথা পিছু ৩০ ডটি করে দেব বলে বলছি। এমনিতে কুলিদের উজিজি পর্যন্ত সাধারণ ভাড়া মাত্র ৫ থেকে ১০ ডটি। পঞ্চাশ জন লোক চাই। এখানেই প্রায় ষাট-সত্তরটি বোঝা রেখে যাব বলে ভেবেছি। একজন প্রহরীর দায়িত্বে। একটা ছোট পোর্টম্যান্টো ছাড়া সমস্ত ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও রেখে যাব।
(ক্রমশ...)