ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে চলছে উজিজির পথে রওনা হয়ে উগান্ডা গ্রামে পৌঁছনর বর্ণনা। তরজমায় স্বাতী রায়
বেশ, মিস্টার শ, আমারও এটাই সিদ্ধান্ত যে তোমার ফিরে যাওয়াই ভাল। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। আমি খুবই চেষ্টা করেছিলাম এইসব সযত্ন-লালিত ছোটখাটো ক্ষুদ্র দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে তোমাকে তোলার। তুমি হাইপোকন্ড্রিয়ায় ভুগছ। নিজেকে অসুস্থ ভাবছ, এবং দেখাই যাচ্ছে যে, কিছুতেই বুঝতে রাজি নও যে তুমি অসুস্থ না। আমার কথাগুলো ভাল করে শুনে রাখ- উন্যানয়েম্বেতে ফিরে যাওয়ার অর্থ মরা! কুইহারাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে এমন কে আছে যে জানে কিভাবে ওষুধ দিতে হয়? ধর, তুমি প্রলাপ বকছ, সৈন্যদের মধ্যে কে জানবে যে তোমার কী লাগবে, বা তোমার জন্য কী উপকারী, তোমার কী দরকার? আবারও বলছি, যদি ফিরতে চাও তো মরবে!
“হে ভগবান; এই অভিযানে আসার কাজটাই যদি না করতাম! ভেবেছিলাম যে আফ্রিকার জীবন এর থেকে অনেক আলাদা। আপনি অনুমতি দিলে আমি ফিরে যেতেই চাই।’’
পরের দিন যাত্রা স্থগিত ছিল, শ'কে কুইহারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। একটি শক্তপোক্ত ডুলি তৈরি করা হল, আর তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিগান্ডুতে দলে নেওয়া চারজন পালোয়ান কুলিকে লাগানো হল। রুটি সেঁকা হল, এক পাত্র-ভরা ঠান্ডা চা দেওয়া হল, আর রাস্তায় খাওয়ার জন্য একটা বাচ্চা-ছাগলের ঠ্যাং রোস্ট করে দেওয়া হল।
শ’র চলে যাওয়ার আগের রাতটা আমরা একসঙ্গে কাটালাম। শ অ্যাকর্ডিয়ানে কিছু সুর বাজাল, এই অ্যাকর্ডিয়ানটা আমিই তার জন্য জানজিবারে কিনেছিলাম; মাত্রই দশ-ডলারের ব্যাপার, সেই রাতে যন্ত্র থেকে উদ্ভূত ঘরোয়া সুরগুলো মনে হচ্ছিল যেন ঐশ্বরিক। রাতের আসর ভাঙ্গার ঠিক আগে শেষ সুর বাজাল 'হোম, সুইট হোম'; মনে হল যে এই সুরের মহিমায় আমাদের পারস্পরিক মনের ভাব অনেকটা নরম হল।
২৭ তারিখ সকালে আমরা সবাই খুব ভোরে উঠলাম। সকলের চলাফেরায় বেশ চনমনে ভাব। সেদিন আমাদের সামনে বিশাল লম্বা হাঁটা; তবে কিনা সব অসুস্থ, কাতরদের পিছনে ফেলে যাচ্ছি। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবান লোকরা, যারা দ্রুত লম্বা পথ পাড়ি দিতে পারে, তারাই এখন আমার সঙ্গী। মাবরুক সেলিম রয়েছে একজন দেশীয় ডাক্তারের দায়িত্বে, যে একটা কাপড় উপহার পাওয়ার বিনিময়ে তাকে ওষুধ দিত, সেই কাপড় আমি তাকে আগেই দিয়ে দিয়েছিলাম।
যাত্রার শুরুর শিঙা বেজে উঠলো। শ ডুলিতে করে তার বাহকদের কাঁধে চেপে বসল। আমার লোকেরা দুই সারিতে দাঁড়িয়ে; পতাকা তোলা হল; জীবন্ত মানুষের দুই সারির মধ্যে দিয়ে, উজ্জ্বল উড়ন্ত পতাকার নীচ দিয়ে, শ উত্তর মুখে রওনা দিল। এই পতাকাগুলো শ আবার দেখতে পাওয়ার আগে এগুলো টাঙ্গানিকার জলের উপরে ভাসবে। আমরাও দ্রুত চটপটে পায়ে দক্ষিণে রওনা হলাম, মনে হল যেন আমাদের ঘাড়ের উপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।
গিরিশিরার গা ভরে বিশাল বিশাল সায়ানাইট পাথর খোঁচা খোঁচা বেরিয়ে আছে। পাথরগুলো এতই বড় যে বেঁটেখাটো গাছের জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। সেই গিরিশিরা বেয়ে আমরা উঠছিলাম। এরকম দৃশ্য আগেও অন্যান্য জায়গায় দেখেছি। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে প্রসারিত একটা সীমাহীন বিশাল ঢেউয়ের মত জঙ্গল- অরণ্যাবৃত শৈলশিরা ধীরে ধীরে একে অপরকে ছাড়িয়ে উপরে উঠছে যতক্ষণ না তারা দূরের আবছা বেগুনি-নীলে মিলিয়ে যায়। একটা উষ্ণ মেঘমত ভাসছে তাদের উপরে, আমাদের আশেপাশে সবকিছু যথেষ্ট পরিষ্কার দেখা গেলেও দূরের সবকিছু যেন একটা দুর্ভেদ্য নীল চাদর দিয়ে মোড়া। গাছে ঠাসা জঙ্গল, পাতা-ভরা ডালপালা, মাথার উপর সবুজ, বাদামী, বা মরা পাতার রঙের পাতার ছাতা, একের পর এক বন উঠছে, নামছে, দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে- যেন এক পাতার সাগর। সব জায়গা থেকেই দিগন্ত একই রকম লাগে, দূরে একটা পাহাড়ের অস্পষ্ট রূপরেখা, বা এখান-সেখানে এক একটা লম্বা গাছ বাকিদের উপরে মাথা তুলে আছে, স্বচ্ছ আকাশের গায়ে তার দৃষ্টিনন্দন অবয়ব স্পষ্ট- শুধু এইটুকুই যা ব্যতিক্রম, এছাড়া সব এক- একই ঝকঝকে আকাশ বনের গহনে নেমে যাচ্ছে, একই বহিরাবয়ব, একই বন, একই দিগন্ত, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ চোখের সামনে রয়েছে; আমরা তাড়াতাড়ি করে একটি শৃঙ্গের চূড়ার দিকে এগিয়ে যাই, যদি অন্য কিছু চোখে পড়ে সেই আশায়, কিন্তু বিশাল দূরত্বের উপর দিয়ে এক ঝলক তাকিয়ে ক্লান্ত চোখ অবিলম্বে কাছের চারপাশে ফিরে আসে, কোথাও কোন বদল নেই। কার্লাইল, তার লেখায় কোথাও একটা বলেছেন, ভ্যাটিকান দুর্দান্ত হলেও, তারা-ঝলমলে আকাশ, যে আকাশের থেকে স্বাতী নক্ষত্র, কালপুরুষ অনিমেষে চিরদিন তাকিয়ে থাকে, তার কাছে ভ্যাটিকান একটা ডিমের খোলার টুকরো মাত্র। আর আমি বলি যে, যদিও নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের কুঞ্জবন আর সব বড় বড় শহরের অনিবিড় উপবনের তুলনায় অপরূপ, যদিও উইন্ডসর এবং নিউ ফরেস্ট অপূর্ব সুন্দর বলে ইংল্যান্ডে বিখ্যাত, তবুও তারা উন্যামওয়েজির এই অসীম বনের তুলনায় শুকনো কাঠের আঁটির মতন।
তিন ঘণ্টা হাঁটলাম - তারপর জলখাবারের জন্য থামা হল। বুঝতে পারছিলাম যে লোকেরা খুব ক্লান্ত, এখনও টানা কদিন ধরে লম্বা পথচলার জন্য তারা অভ্যস্ত নয়। বা বলা যায়, কুইহারাতে দীর্ঘ বিশ্রামের দরুন ফের কঠোর পরিশ্রমের জন্য তাদের শরীর ঠিক তৈরি হয়নি। যখন আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম, তখন বেশ কয়েকবার বদমেজাজ ও ক্লান্তির প্রকাশ দেখা গেল। তবে তাদের আলস্য নিয়ে কিছু সহৃদয় মন্তব্য তাদের নিজেদের ধাতে ফিরিয়ে আনল। আরো চার ঘন্টা ছোটার পরে দুপুর দুটোয় আমরা উগান্ডায় পৌঁছলাম।
উগান্ডা জেলা উন্যানয়েম্বের দক্ষিণ সীমান্তের লাগোয়া। সেখানকার একটা বড় গ্রাম উগান্ডা। গ্রামে সম্ভবত চারশো পরিবার বা দুহাজার লোকের বাস। গ্রামটা তিন ইঞ্চি পুরু কাঠের লম্বা, শক্ত খুঁটি দিয়ে বেড়া দেওয়া, ভালভাবেই সুরক্ষিত। কিছুটা দূরে দূরে বেড়ার উপরে মাচার মতন করা, সেখানে কাঠের গায়ে ছোট ছোট ফুটো, অব্যর্থ-সন্ধানীদের বন্দুকের নলের জন্য। শত্রু আক্রমণ করলে এই বাক্সের মত মাচাতে বসে তারা শ্ত্রুদলের নেতাদের উপর আঘাত হানে। ভিতরদিকে পরিখা কাটা, মাটি বা বালি বেড়ার গা দিয়ে তিন-চার ফুট উঁচু করা, গ্রামের রক্ষক দলের প্রধান সুরক্ষা এই পরিখা। তারা পরিখার ভিতরে হাঁটু গেড়ে বসে, ফলে বড় বাহিনীর মোকাবিলা করতে পারে।
গ্রামের বাইরের দিকে এক বা দুই মাইল পর্যন্ত গাছপালা, ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখা হয়, শত্রু হানা দিলে তারা বন্দুকের গুলির সীমানার মধ্যে আসার আগেই তীক্ষ্ণ-দৃষ্টি পাহারাদারদের চোখে পড়ে আর সবাইকে প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য সতর্ক করে। এই প্রবল রকমের সুরক্ষিত গ্রাম দখল করার জন্য দু-তিন বার ব্যর্থ চেষ্টা করার পরে মিরাম্বো তার ডাকাতদের দলকে সরিয়ে নিয়েছিল। মিরাম্বোর মতন এমন দুর্ধর্ষ লুঠেরা উন্যামওয়েজি বহু প্রজন্মে দেখেনি। সেই মিরাম্বোকে হঠিয়ে দিতে পারার জন্য গান্ডারা তখন থেকেই নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছে।
মূল গ্রামটি ঘিরে প্রায় তিন হাজার একর জমি চাষ হয়, তাতে যে শুধুমাত্র তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্যই যথেষ্ট ফসল হয় তাই নয়, উফিপা ও মারুঙ্গুমুখো যত কাফেলা এই পথ দিয়ে যায়, তাদের সকলের জন্যও যথেষ্ট শস্য উৎপাদন হয়।
তবে গান্ডারা নিজেদের গ্রামের চারপাশের শক্ত ঘেরের মধ্যে যতই সাহসী হোক না কেন, যুদ্ধের সময় একজন ন্যামওয়েজির মনে যে নিরাপত্তা-হীনতার বোধ জাগে, তার থেকে তারা রেহাই পায় না। এইখানেই সাধারণত কাফেলারা কুলির ঝাঁক থেকে তাদের প্রয়োজনমত কুলি বেছে নেয়, তারা স্বেচ্ছায় কাফেলার সঙ্গে দূর দক্ষিণের হাতির দাঁতের দেশে যায়; কিন্তু আমি একটা লোককেও আমার সঙ্গে যেতে রাজি করতে পারিনি, মিরাম্বো আর তার রুগা-রাগাদের তারা এতই ভয় পায়! আসন্ন যুদ্ধ নিয়ে তারা প্রচুর গুজব ছড়াচ্ছে। জোর দিয়ে বলছিল যে এমবোগো একহাজার কোনোঙ্গোকে নিয়ে উগান্ডার দিকে আসছে, জাভিরারা চার মাস আগে একটা কাফেলা আক্রমণ করেছিল, সিম্বা হিংস্র ভাড়াটে সৈন্যদল নিয়ে সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এই রকম আরও কত গুজবই না ছড়াচ্ছিল, একই ধাঁচের আর একই উদ্দেশ্যে।
(ক্রমশ...)