পাক্কা ১১টায় আমরা দুয়ারসিনি ছাড়লাম। ফেরার পথে ফের পাঁচলিটার জলের বোতল নিজের টিউকল থেকে ভরে দিয়েছিলেন রবীন্দর। সোনির জলের ম্যাজিক দেখার পর আমরা আর বাজারের জল কিনিনি। গাড়ি চলছিল সেই অসাধারন পথেই। যাঁরা ভ্রমন পিপাসু এবং দেখতে পারেন তাঁরা জানেন রাস্তাটি একই হলেও যাওয়া আর আসার পথ কখনও অবিকল এক হয়না কারন দেখার মাত্রাটা বদলে যায় আর বদলে যায় প্রকৃতিও। এখন রোদ আরও ঝলমলে, আকাশ আরও উজ্জ্বল, পাহাড়গুলোকে আরও সবুজ মনে হচ্ছে। চড়াই উৎরাইয়ের পথে চড়াইয়ের দুপাশের দৃশ্য যতটা স্পষ্ট দেখা যায় উৎরাইয়ের দুপাশটা ততটা স্পষ্ট হায়না কারন গাড়িটা তখন ছলকে ছলকে নামতে থাকে। তখন যেটা উৎরাই ছিল এখন সেটা চড়াই, দুপাশের দৃশ্য প্রাণ ভরে দেখি। একটু আগেই পেরিয়ে আসা গ্রামগুলো উল্টো পথে পুরো নতুন লাগছে। রুশতি আমার কানের কাছে গুনগুন করে অনুযোগ করলেন, "আপনি যে বলেছিলেন দুয়ারসিনিতে মেয়েদের শাড়ি পরতেই হবে না'হলে ঢুকতে দেয়না। আমরা একটা প্ল্যান করেছিলাম ওদের কাছ থেকে তাহলে শাড়ি কিনব। কই তেমন কিছু হলনা তো?" আমি হাসলাম। বললাম, "তাহলে কেমন হত বলুন। মনে করুন আমরা একটা গ্রামে যাচ্ছি। গ্রামটা খুব কনজারভেটিভ অথবা তাঁরা তাঁদের গ্রামের অথবা দেবস্থানের পবিত্রতা বজায় রাখতে চায়। যেমন আমরা জুতো পরে মন্দিরে উঠতে দেইনা ঠিক তেমনই ওরাও ওদের গ্রামে শাড়ি ছাড়া মেয়েদের আর ধুতি ছাড়া পুরুষদের ঢুকতে দেয়না!" আসলে আজ রুশতিকে জিন্স আর শার্ট পরতে দেখেই দুষ্টু বুদ্ধিটা চাগাড় দিয়েছিল। ভাবলাম ওঁকে একটু টেনশন দিয়ে রাখি। দুয়ারসিনি নামটার সঙ্গে মিলেও গেল বিষয়টা। আদিবাসীদের গ্রাম, রুশতি নিশ্চিত ভাবল এরকমটা হতেই পারে। কিন্তু টেনশন তো নেয়নি বরং বোন রিয়ানের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বেশ একটা উপায় ভেবে রেখেছিল। আমি মনে মনে ভাবছি ওরা তো শাড়ি পরতে অভ্যস্ত কিন্তু যদি আমাকে ধুতি পরতে হত?
এতক্ষণে আমরা পাটমহুলিয়া ছাড়িয়ে ফের ১৮ নম্বর জাতীয় সড়কে উঠে পড়ে সার্ভিস রোড ধরে ফুলডুংরি পাহাড়টার কলে। এবার আমাদের আন্ডারপাস গলে ডানদিক বা দক্ষিণ দিকে যেতে হবে। সেইমত শহরটার ভেতরে ঢুকে কলেজ রোড ধরা গেল। রাগিনী আর ঝিলমিল গুগল ট্র্যাক করে আমাদের সোজা রেলের ফ্লাইওভার ক্রস করিয়ে ডানহাতি নামিয়ে দিল তারপর আরও কিছুটা গিয়ে বাঁহাতি রাস্তায় ডাহিগোড়ার সেই প্রবাদ প্রতিম গৌরীকুঞ্জ। ফের ৩৭বছর পর এসে দাঁড়ালাম আরণ্যক স্রষ্টার বাড়ির সামনে। জায়গটার ভোল অনেকটাই পাল্টে গেছে। অবশ্য তার কৃতিত্ব সরকারের নয়। স্থানীয় কিছু মানুষ মিলে গৌরী কুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি বানিয়ে নিজেদের উদ্যোগে রক্ষনাবেক্ষন করছেন। অবশ্যই তাঁরা বাঙালি। আরও কয়েকজন পর্যটক এসেছেন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন গৌরী কুঞ্জ উন্নয়ন সমিতির এক সদস্য প্রদীপ ভদ্র নামে যুবকটি। দিনটি রবিবার কোথাও একটা রক্তদান শিবির করছেন তাঁরা। সেখান থেকেই এলেন। ঘরের দরজা খুলে দিলেন। মোট তিনটি ঘর। শয়ন, বিশ্রাম ও রান্নার জন্য। বিশ্রাম কক্ষেই বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখালেখি করতেন। তাঁর বনদপ্তরের সেই পোশাক, সাদা ধুতি আর খাঁকি চাপকান সযত্নে রাখা আছে। এছাড়াও রয়েছে লেখালেখির সরঞ্জাম দোয়াত, খাগের কলম। আরণ্যকের হাতে লেখা পান্ডুলিপি, চাঁদের পাহাড়ের পান্ডুলিপি ইত্যাদি। গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর মাত্র এক বছরের বিবাহিত জীবন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্যাসের মত অবস্থা হয় তাঁর। পরের বিয়ে ২২ বছর পরে। সন্তান তারাদাস জন্মের মাত্র ৫বছরের মাথায় এই বাড়িতেই মারা যান তিনি। সেই মহাপ্রয়াণ সহ প্রচুর আলোকচিত্র এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। প্রদীপ বাবুরা এই বাড়িটিকে সরকারের অধিগ্রহনের দাবির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে ঝাড়খন্ডের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা করার দাবিতে লড়াই করছেন। বাড়িটি রক্ষনা বেক্ষনের জন্য আপনি কিছুটা সাহায্য করে আসতে পারেন। গৌরী কুঞ্জর প্রাঙ্গনে একটি খোলা মঞ্চ করা হয়েছে তরাদাস মঞ্চ নামে। এখানে বাংলা সংস্কৃতি চর্চা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি হয়। রয়েছে 'অপুর পাঠশালা'র একটি অপূর্ব উদ্যোগ, প্রতি রবিবার বিনে পয়সায় বাংলা ভাষার পাঠদান। আমরা যখন ওখানে পৌঁছাই তখন বেশ কিছু যুবককে দেখলাম বইপত্র নিয়ে পড়াশুনা করছেন। কী আর করা যাবে? এখানে বাংলা পড়লে চাকরি বাকরি জুটবেনা। সরকারি কামে কাজেও লাগবেনা তাই সবাইকে ইংরেজি ও হিন্দি পড়তে হয়। যাঁরা বাংলা ভাষার চর্চা করতে চান তাঁরা রবিবার সকাল ১০টা থেকে ১২টা অবধি পড়তে আসেন। সমিতির কিছু সদস্য পড়ান। বাংলার একেবারে গায়ে বাংলাকে বাঁচানোর কী করুন মরীয়া প্রচেষ্টা! প্রাঙ্গনে আর রয়েছে একটি আমগাছ। ভাই নুটুবিহারী দাদা বিভূতি ভূষণের আম খাওয়ার জন্য এই আমগাছটা লাগিয়েছিলেন। ১২ই সেপ্টম্বর লেখকের জন্মদিন। ওই দিন ব্যারাকপুর থেকে কবির পরিবারের সদস্যরা আসেন। এখানে অনুষ্ঠান হয়।
গৌরী কুঞ্জ থেকে ফের প্রধান সড়কে উঠে এবার আমরা চললাম রাজস্টেটের দিকে। ঘাটশিলা রাজার রাজবাড়ি অবশ্য তেমন কিছু দেখার নেই। আমরা ভেতরে ঢুকলামনা। ঘাটশিলা থানা, রঙ্কিনী মন্দির পেরিয়ে এবার যাত্রা দক্ষিণ পশ্চিমে চিত্রকুট পাহাড়। আসলে একটা উঁচু টিলা। ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড় বড় সাদা পাথর, বিশালাকার। ওঠার জন্য কংক্রিটের চওড়া পথ রয়েছে। একটা শিব মন্দির। আগেই বলেছি রাজ স্টেটের মধ্যে অবস্থিত এই জায়গায় রাজারা একসম়য় বাতাস সেবন করতে আসতেন। আজ রাজাও নেই, রাজত্বও নেই। পড়ে আছে মস্ত টিলাটা। আর আমরা পেছনে ফিরবনা, ঘাটশিলার ভেতরে ঢুকবনা। এরই গা দিয়ে যাওয়া পিচের রাস্তা ধরে আরও পশ্চিমে নেমে যাব ওখানে ১৮ নম্বর জাতীয় সড়ক আমাদের অপেক্ষায়। আমরা পাহাড়ের চূড়া থেকে শেষ বারের মত ঘাটশিলা শহরটাকে দেখি। দেখি শহর ছাড়িয়ে আদিগন্ত বিছানো সবুজ ক্ষেতের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুবর্ণরেখা। ৩৭ বছর আগে কোনও এক শীতের বেলায় দেখেছিলাম নদীটার পেটের ভেতর থেকে মাথা তুলে রয়েছে মিশকালো পাথরের দল। হাজার হাজার বছর ধরে পাথর কেটে কেটে এগিয়েছে নদীটা। এখন ভরা জলে তার পেট উপচে কল্লোলিনী স্রোত। সে পাথর দেখা যায়না। ওদিকে ফের আকাশে কালো মেঘ, ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামার আভাস। কড়কড় করে বাজ পড়ছে কোথাও! পাহাড়ের ওপর বাজ বড় বিপদজনক। আমরা নেমে আসি। এবার গাড়ি ছুটবে তেঁতুলডাঙা হয়ে চিরুগোড়ার পথে। ওখানেই রেলের লেভেলক্রসিং পেরিয়ে জাতীয় সড়ক কে চুমু খেয়েছে রাস্তাটা।
এবার ফেরার পালা! এখান থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার ধলভূমগড়। একসম়য় এই পুরো এলাকাই ধল রাজাদের। তাঁদের উপাস্য দেবী রঙ্কিনী। সিনি অন্তে যেমন দেবী, কিনী অন্তেও তাই। রঙ্কিনী আসলে রণ্ কিনী। দেবী যুদ্ধে পারদর্শীনী এবং দুধর্ষ। কারও কারও মতে তিনি দুর্বৃত্তদের দেবী। আমরা জাদুগোড়ায় দেবীর মন্দিরের কথা জেনেছি আর জেনেছি ঘাটশিলা রাজস্টেটে, থানার পাশেই। শোনা যায় দেবী আসলে আদিতে ছিলেন শিলদাতে। ঝাড়গ্রাম থেকে বিনপুর হয়ে বেলপাহাড়ি যাওযার পথে শিলদা। এখান থেকে বাঁকুড়ার ফুলকুসমা যাওয়ার রাস্তায় সামান্য কিছুটা গেলেই ওড়গোঁদা। এখানেই রয়েছে ভৈরব থান বা বাবা ভৈরবের অধিষ্ঠান। আগে এখানেই রঙ্কিনী থাকতেন কিন্তু তাঁর কিংবা তাঁর অনুগামীদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে অধিবাসীরা বাবা ভৈরবের স্মরনাপন্ন হলেন। বাবা ভৈরবের সঙ্গে রঙ্কিনীদেবীর যুদ্ধ শুরু হল। ভয়ংকর সেই যুদ্ধ। চারদিক কেঁপে উঠল সেই যুদ্ধে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রঙ্কিনীদেবী ধলভূমগড়ে পালিয়ে গেলেন। ধলভূমগড়ের রাজারা তাঁকে আশ্রয় দিলেন, আরাধ্যা করলেন। যদিও রঙ্কিনীদেবী বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। ভৈরব তখন মাটির তলায় অবস্থান করলেন আর সেখান থেকেই প্রকাণ্ড গর্জন করেন। সেই গর্জনের জন্য দেবী আসতে সাহস পাননা। বর্ষাকালে ভৈরব থানের নিচে কান পাতলে সেই গুড়গুড় ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এতো গেল লোককাহিনী। বিজ্ঞান হল যে এই দলমা এবং সংলগ্ন মালভূমির বহু অংশে এখনও সক্রিয় ফুটন্ত লাভা। প্রচন্ড বর্ষায় মাটির উপরিস্তরের জল যখন মাটি এবং পাথরের ফাটল ভেদ করে ওই অগ্নিকুণ্ডের ওপর পড়ে তখনই অমন গুড়গুড় আওয়াজ হয়। স্থান মাহাত্ম্যে ওই স্থান এখন দেবভূমি, বছরে একবার বড় করে মেলাও বসে। শিলদা নামেও যেমন বাস্তবেও তেমন। লাভা উদগীরণ করা বড় বড় গলিত শিলার চাঁই দেখতে পাওয়া যায়। যদি কখনও এ পথে এসব দেখতে ভুল করবেন না। আর আধুনিক কালে শিলদা অন্য একটি কারনে কুখ্যাত বা বিখ্যাত হয়ে আছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাওবাদীরা শিলদার ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস বা ইএফআর ক্যাম্প আক্রমন করে ২৪জন জওয়ানকে খুন করে। ভারতের ইতিহাসে মাওবাদীদের দ্বারা এটি একটি বড়সড় হত্যাকান্ড বলেই গন্য করা হয়ে থাকে। সেদিন রাত ৯টায় আমি শিলদা এসে পৌঁছেছিলাম কিন্তু সেকথা এখানে নয়।
ধলভূমগড় বললেই আমার সত্যজিৎ রায়ের 'অরন্যের দিনরাত্রি'র কথা মনে পড়ে যায়। এখানকার জঙ্গলেই শ্যুটিং হয়েছিল। এই সড়ক থেকে নেমেই হাতের স্টেটসম্যান পেপারটা ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিতে দিতে রবি ঘোষ বলেছিলেন, সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ। ইচ্ছা করল একবার ধলভূমগড়ের ভেতরের দিকটা চক্কর দিয়ে আসি। মৃত্যুঞ্জয়কে বললাম, গাড়িটা থামাও। সে গাড়ি থামালোও কিন্তু রাগিনী আর ঝিলমিল চেঁচিয়ে উঠল, আগে খাবো। এতক্ষনে টের পাওয়া গেল রবীন্দরের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে। তাছাড়া চিত্রকুটেও কম লাফানো ঝাঁপানো হয়নি। পেটে ছুঁচোর লম্বা ম্যারাথন। আশেপাশে যুৎসই ধাবা কিংবা হোটেল মিললনা। মৃত্যুঞ্জয়কে বললাম, সিধা বহড়াগোড়া চল। অতটা অবশ্য যেতে হলনা, বহড়াগোড়ার পাঁচ কিলোমিটার আগেই একটা ভালো ধাবা পাওয়া গেল। ওই বেচারারা অবশ্য ভালো রেস্টুরেন্ট খুঁজছিল কিন্তু আপাতত তা মিলবে বলে মনে হয়না। ওখানেই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম দুরে, অনেক দুর থেকে দলমার পাহাড়সারি আমাদের বিদায় জানাচ্ছে।
সমাপ্ত