শেষ আপডেট দিয়েছিলাম বেশ কিছু সপ্তাহ কেটে গেছে। প্রচণ্ড খরায় বস্তার সম্ভাগের একখানা শহর, খানকতক টাউন-গঞ্জ মিলিয়ে মিশিয়ে, এবং জনগণনাত্তীর্ণ অযুত-অর্বুদ গ্রাম ধুঁকছে। সেন্সাস-ডেটায় বস্তারের সমস্ত গ্রাম ধরা পরে না। আর কাঁকের, নারায়ণপুর, দান্তেওয়াড়ার মত আধা-টাউন আধা গঞ্জ এলাকাও দেখলে এবং শুনলে মালুম হয় যে এ’গুলো বছর বিশেক আগেও গ্রামই ছিলো, আপাতত ‘নগর পালিকা’ সংক্রান্ত আইন বানিয়ে, এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিত্তবান অনাদিবাসী ব্যাবসায়িদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসনের আর্থ-সামাজিক ফিউডাল খাঁচায় ফেলে, টেনে হিঁচড়ে এগুলোকে ‘টাউন’ বানানো হচ্ছে। তাই হাটবারের সময়ের পুরোনো হিসেবগুলোও ঘেঁটে গিয়ে এই সব টাউনে হাট বসছে রবিবারে এবং অন্যান্যদিনেও নির্দিষ্ট হাট অঞ্চলগুলিতে বাজার বসতেই থাকছে।
এই সব তথাকথিত টাউনে যারা হোমড়া চোমড়া, তাদের মোটমাট প্রত্যেকেই অনাদিবাসী, গরিষ্ঠাংশের তেল—বনোপজ-লকড়ির ব্যবসা। (নুনটা জঙ্গল থেকে লুঠ করা ব্যবসায়িক-ভাবে অপ্রয়োজনীয়, কারণ আপাতত বিশ্ব-বাজার ছেয়ে আছে সৈন্ধবলবণে, জঙ্গলের বিভিন্ন গ্রামে থাকা আদিবাসীদেরও মুখিয়ে থাকতে হয় সমুদ্র থেকে তোলা নুন কবে বাজারে আসবে, তার উপরে। বস্তারের ধারেকাছে তো সমুদ্র নেই। বস্তারিয়া কৌম-প্রাকৃত ফুড সিস্টেমে ইতিহাসের কতটা স্রোত-ঢেউ-বাতাসিয়া-লুপের ফলে, মলয়াদ্রি বা সহয়াদ্রির উপকুলবর্তী জঙ্গল থেকে আসা মানুষেরা সৈন্ধব লবণ নিয়ে এসেছিলো, অথবা কত শতাব্দী-সহস্রাব্দের সৈন্ধব লবণের খাদ্য-প্রাকৃতিক বা ফুড-কালচারাল হেজিমনির বশবর্তী হয়ে রক-সল্ট ছেড়ে সৈন্ধব লবণ দিতে শুরু করল রান্নায়, আন্দাজ দুষ্কর।) তবে এই সমস্ত হোমড়া চোমড়ারা কেউই বস্তার তো ধূস্তরি মায়া, এক বা ম্যাক্সিমাম দুই জেনারেশন আগে কেউই হালের ‘ছত্তিসগড়’ এলাকাতেও থাকতোও না, থাকত মূলতঃ উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা বা মহারাষ্ট্রতে, অথবা নর্মদা নদীর উত্তর উপকুলের টেবল-টপ-সমতলময় ডেকানিয় উত্তর-মধ্যপ্রদেশে, মানে যেইখানে গোণ্ডওয়ানাল্যাণ্ড মিশে গ্যালো অ্যাংগোরাল্যাণ্ড, সেইখানে।
ইংরেজ শাসন শেষ হলে, যখন সমগ্র আদিবাসী অঞ্চল জুড়ে শিল্পায়ণের বিভীষিকা লেলিয়ে দেওয়া হল, রৌরকেলা, ভিলাই প্রভৃতি জায়গায় ইউরোপিয় সহায়তায় বিরাট কারখানা তৈরী হল এবং পাশাপাশি লার্জ স্কেল মেকানাইসড মাইনিঙের হিড়িক-ও বেড়ে গ্যালো, তখন থেকে এইসব হোমড়া-চোমড়ারা বা তাদের পিতৃ-পুরুষগণ বস্তারে এসে বসে গেছে, আদিবাসিদের জমি অর্থে ছলে বলে কৌশলে ও অ্যালকোহলে বেমালুম সালটিয়ে সাজিয়ে নিয়েছে তাদের জমিদারি। আদিবাসীদের যারা জাতিগতভাবে ‘মাতাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভাবতে অভ্যস্ত, তারাই কিন্তু জাতিগতভাবে আদিবাসীদের গলায় অ্যালকোহল ঢেলে গেছে। ইতিহাসের ফাঁকে ফোঁকরে কান পাতলে শোনা যায় কিভাবে ইংরেজ ফরেস্টর ও কুঠিবাবুরা গ্রাম থেকে মুখিয়াদের কাছাড়িতে ডেকে পেটি পেটি ইংলিশ-মদ দিয়ে গেছে, কিভাবে উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে বড় বড় মদের পিঁপে গড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইংরেজ কোম্পানিবাবু ও তাদের ম্যানেজারবাবুদের তত্ত্বাবধানে। সমগ্র উপমহাদেশের আদিবাসী অঞ্চল থেকে যে সব আলো-আঁধারিরা, ফিশফিশ চাপা স্বর, শব্দ ও নিঃশব্দেরা খেলে বেড়ায় সেই সবখানে কান পাতলে, চোখ পাতলে প্রতিভাত হয়, এককালে আদিবাসীদের কাছে মদ্যপান ছিলো কৌমগত উদযাপনের মাধ্যম, একক মাতলামোর নয়, কেবল মেলা-মোচ্ছব-পার্বণের সময় কম্যুনিটি রিচুয়াল হিসেবেই সেবিত হত হাঁড়িয়া-লেন্ধা, মহুয়া, সালফি, ফুল্লিরা – এবং বিভিন্ন ফুল (যেরকম মহুয়া, রডোডেণ্ড্রণ ইত্যাদি), ফল (সালফি), লতা-পাতা-শিকড় (যে’রকম হাঁড়িয়া বা লেন্ধার ফার্মেন্টেশানের জন্য ব্যবহৃত প্রায় ২৭-টা আর্ব দিয়ে তৈরী ডিককশান, যার ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে নাম ‘বাখড়’) দিয়ে তৈরী এই সব মদ পেট, মন এবং শারীরিক নিউট্রিশানের হিসেব – তিনকেই রাখত শান্ত ও সুস্ত। একা একা মদ খাওয়া ও টিভি দেখার বুকোবস্কি-খচিত মার্কিন-রোম্যাণ্টিকতাকে আদিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে – প্রথমে ইংরেজরা, তারপরে ইংরেজদের কুঠিয়াল ও ব্যবসায়ীদের যে সকল সাহুকার-সুদখোরেরা টাকা ধার দিত তারা, এবং আপাতত তাদের বংশধর ও অনুগামীরা।
এই সকল বংশধর-অনুগামীদের দাপটেই আজকের দিনে বস্তার সহ উপমহাদেশের সমস্ত আদিবাসী কৌম-প্রাকৃত যাপন অপসৃয়মাণ। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের ধার দিতেন জামশেদজী-টাটার বাবা – তাই তাঁর বংশধরেরা ব্যবসা বিস্তার করেছে পূর্ব ও মধ্যভারত জুড়ে, লুঠ করেছে প্রচুর আদিবাসীর জমি, জল, জঙ্গল সহ সকল প্রাকৃত-সম্পদ, লুঠ করেছে প্রাজ্ঞ কৌমদর্শন। ইংরেজ ব্যাবসায়ীদের ধার দিতেন সঞ্জীব ও জি-পি গোয়েঙ্কার দাদু। এদের একজন সকল নাগরিক চা-মোদীদের দেড়শো বছরের কেনা গোলাম চা-শ্রমিকদের না খাইয়ে মারছে, আরেকজন আদিবাসীদের হঠিয়ে তৈরী বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ-তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুষে চুষে শহরের শিক্ষাভিমানীদের বিদ্যুতের আলোয় সিনেমা দেখাচ্ছে, গ্রাম ডুবে থাকছে অন্ধকারেই। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের ধার দিতেন ‘প্রিন্স’ দ্বারকানাথ ঠাকুর। আদিবাসী অঞ্চল বীরভূমে তার ছেলের জমিদারীতে আপাতত তার নাতির অনুগামীরা আদিবাসীদের হঠিয়ে বা ট্যুরিসম-ভিলেজ ও মিউসিয়ামে পুরে, চিরহরিতের বনে দনাদ্দন বিদেশ থেকে আমদানী আকাশমণি ও ইউক্যালিপ্টাস গাছ পুতে মাটি, কৃষক ও জলস্তরের সর্বনাশ সাধিত করে, বিভিন্ন কৌম-প্রাকৃত উদযাপনকে পৌষমেলা-বসন্তোৎসব-রূপী নাগরিকতার কো-অপ্টিভ ফাঁদে আত্মসাৎ করে ড্যাঞ্চিবাবুসুলভ ছুটিছাটা কাটায়।
বস্তার আপাতত এইসবের একটা ম্যাগ্নিফায়েড ভার্শান। এখানকার বহিরাগত ব্যবসায়ীরা, মোটা চাঁদা, মোটা শিখি, মোটা টিকি প্রভৃতি ভক্তিচিহ্নের মাধ্যমে নাগপুর তথা আর-এস-এস ঘনিষ্ট। তাই উক্ত সম্ভাগের সবকটা জেলার সবকটা সদর-গঞ্জেরই একই দশা। চারিদিকে মন্দির, গেরুয়া পতাকা উড়ছে পতপত, রামনবমীতে গোচর – তলোয়ার হাতে গেরুয়া বাইকবাহিনীর উচ্ছ্বাস - বহিঃস্ফুর্তির ভাব হিংস্র। অথচ আদিবাসীদের তির ধনুক টাঙি তো ছাড়, পরম্পরাগত প্রথায় মাড়িয়াদের বাইসন-শিঙা শিরস্ত্রাণও রাখতে দেওয়া হয় না। জপ্তি হলেই আর্মস অ্যাক্ট, তথা নকশাল-চার্জ। এর আগের একটা আপডেটে তো লিখেওছি কিভাবে ভারি বাসন বা ছিপ থেকেও এই চার্জ লাগতেই পারে। সমগ্র ভারতে লেফট-উইং-এক্সট্রিমিসম প্রভাবিত অঞ্চলের সমস্ত থানা বৎসরান্তে প্রায় দেড়-দুই শত কোটি আন-অডিটেড/ আন-অডিটেবল টাকা পায় নকশাল পাকড়াওয়ের জন্য, যার ঠেলায় আদিবাসীরা কোনো ধাতব ধারালো বস্তু রাখতে পারে না। হিন্দুরা পারে। এবং, ২০০৮-এর ‘এক্সট্রিমিসম আফেকটেড’ এলাকাগুলির ‘ডেভেলপমেণ্টাল চ্যালেঞ্জেস’ এর বিষয়ে প্ল্যানিং কমিশান রিপোর্ট বেরিয়েছিলো। সেইখান থেকে বোঝা যায় কিভাবে বস্তারের সমস্ত টাউনের এমনকি ইনফর্মাল সেক্টরের ইকনমিও সবর্ণ ও অসবর্ণ হিন্দু মানুষদের হাতে। শুধু কাঁকের টাউনে বনোপজ, মূলতঃ বিভিন্ন ফুল ও শস্য থেকে নিষ্পেষণ করা তেলের ব্যবসা এবং হালে রিয়েল এস্টেট প্রোমোটারীতে ইসলামবলম্বী মানুষদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। পারিবারিক সূত্রে এরাও বস্তারে বহিরাগত – মূলতঃ উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে আগত ও অধিকাংশে তেলী সম্প্রদায়ভুক্ত। ওয়াকিবহাল মাত্রেই জানেন কিভাবে উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মে বর্ণাশ্রমধর্মের ভেদবুদ্ধি দুষ্টবীজ ছড়িয়েছে, আর কাস্ট-সিস্টেম নামক এই বিষবৃক্ষ শাখা প্রশাখায় ছড়িয়ে কিভাবে জন্ম দিয়েছে তেলী, জোলা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের, যাঁদের ইসলাম-অবলম্বন-ও ঘোচাতে পারেনি সামাজিক অসূচি-জ্ঞাপক শূদ্র-অভিধার কলঙ্ক। স্ব স্ব রাজ্য থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন সময় ধরে, নিজামের কাঠব্যবসায়িকদের মতোই, এই সব পরিযায়ী মানুষেরাও এসে গেছে কাঁকের অঞ্চলে, তারপর, বর্তমান কালের ভিরকুটি-মারা ধারায় এরাও নাম লিখিয়েছে উঠেছে আদিবাসী মানুষদের জমি-ডাকাতদের রেজিস্ট্রি-খাতায়।
আর সমস্ত মঃপ্রঃ ছঃগঃ জুড়েই মোটামুটি সত্তর আশির দশক থেকেই হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতাচর্চার রবরবা। প্রথম পর্বে লিখেছিলাম ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর হাতে প্রবীর চন্দ্র ভঞ্জদেওর মৃত্যুর কথা। তার পর পর সেইখানে কালেক্টর হিসেবে উপস্থিত হন, অত্যন্ত কোমলহৃদয়, উদারচেতা এক আই-এ-এস অফিসার। বি-ডি শর্মা। গোটা সত্তরের দশক জুড়ে সমগ্র বস্তার সম্ভাগ – যা তখন ছিলো ভারতের সবচেয়ে বড়ো জেলা – জুড়ে তিনি নানান জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিতে উদ্যমী হন। কিন্তু তারপরে দেশে এলো উত্তর-এমার্জেন্সি হিন্দুত্ববাদী সরকার – জনতা পার্টি। একই সঙ্গে, ১৯৭৮ সালেই, মধ্যপ্রদেশেও এসে গেলো তাদের সরকার। নাগপুরের আর-এস-এস হেডকোয়ার্টার্সের প্রত্যক্ষ মদতে বস্তারের জনতার উপর ক্ষমতামত্ত হিন্দুত্ববাদী অগ্রাসনের গতি গেল তুমুল বেড়ে। তখন থেকেই ভারতের বিভিন্ন অনাদিবাসী মানুষ এসে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় আদিবাসীদের জমি ধরে টানাটানি শুরু করে। এখানেও ড্যাঞ্চিবাবু-প্রবণতা লক্ষণীয়। জলের দরে জমি পাওয়া যেতে লাগল কাঁচা কাঁচা টাকা আর ঝাল ঝাল মদ উড়িয়ে। ঘাড়ের কাছেই ভিলাই রইলো এক এই সব ড্যাঞ্চিবাবুদের কাছে আশার উসকানী। সেইখান থেকে ৫০-এর দশকেই, সোভিয়েত দেশের সহায়তায় প্রগতি ও বিকাশের দামামা বাজিয়ে আদিবাসী উৎখাত সফল হয়েছিলো, কপাল ফিরেছিলো অনেক বহিরাগত অনাদিবাসীর। আর বস্তারেও ১৯৬৫ সাল থেকেই বৈলাডিলা আয়রণ ওর মাইন চালু হয়েই গিয়েছে।
বৈলাডিলা শব্দের অর্থ সহজ – বৈল বা মোষের ডিলা বা কুঁজ। এই মাইন যতদিনে চালু হয়েছিলো, বস্তারের রাজা প্রবীর চন্দ্র ভঞ্জদেওকে নানান ভাবে গৃহবন্দী ও জেলবন্দীও করা হয়েছিলো। নারায়ণ সান্যালের ‘দণ্ডক শবরী’ থেকে এ-ও জানা যায় যে কিভাবে রাজাকে বাঁচাতে গিয়ে লোহাণ্ডিগুড়া থানায় গুলি খেয়ে মরে গিয়েছিলো জনা সতেরো-আঠারো আদিবাসী সেই ১৯৬২ সালেই। আপাতত টাটাবাবুরা সেইখানে মাইনিং করছেন। পরপর বহুবার নকশাল-দমনের নামে আদিবাসী মারা হয়েছে উক্ত লোহাণ্ডিগুড়ায়।
ফিরে আসি মোষকুঁজো পাহাড়ের গল্পে। অধুনা দান্তেওয়াড়া জেলার বাচেলি আর কিরণ্ডৌল নামের দুটো গ্রামের মাইন-লিজের নাম করে চারটে টুকরো করে ফেলে তুলে দেওয়া হল ন্যাশানাল মিনারেল ডেভেলপমেণ্ট কর্পোরেশনকে। ২৫৫৮.৪২৪ হেক্টেয়ার জমি্র উপর সেই থেকে চালু হল গোটা দেশে যত আকরিক লোহা রয়েছে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ যে বস্তারের মাটির নীচে, বিকাশ ও প্রগতির নামে সেই বস্তারের লুণ্ঠন; সেই ট্রেডিশান সমানে চলেছে। বারবার এক্সটেনশান পেয়ে বৈলাডিলা খণিতে ওরা অনবরত মাটি খুঁড়ে চলেছে যেইসব মানুষদের দিয়ে, তাঁদের বিভিন্ন মেশিন ও দেওয়ালের ফাঁকফোকড় দিয়ে দেখা পাওয়ার অবকাশ নেই, কারণ সেই ’৬৫ সাল থেকেই এই অঞ্চলে তুলে দেওয়া দেওয়াল ও গেটসমূহ ঘিরে ভারতরাষ্ট্রের অতন্দ্র ফৌজি প্রহরা। প্রতি বছর গড়ে ২৯ মিলিয়ন টন করে আকরিক লোহা তুলে চলা হচ্ছে মোষের কুঁজের তলা থেকে। তবুও যেন প্রগতি-বীভৎসার খাঁই মেটে না। এখন চালু হয়েছে ‘ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেণ্ট’-এর তোড়জোড়। এই ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেণ্ট প্রজেক্টের ড্রাফট এনভায়রণমেণ্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেণ্ট রিপোর্ট থেকে মালুম, ২০২০-সালের মধ্যে নাকি ১০০ মিলিয়ন টন লোহা তোলার টার্গেট রাখা হয়েছে। মোষ-কুঁজ পাহাড়ের উপর নেমে আসে এই বিষম লৌহাপদে ধৌত নদীগুলোর অবস্তা হয়েছে সঙ্গীন। দান্তেওয়াড়া দিয়ে বয়ে চলা শঙ্খিনী ও ডঙ্কিনী নদীর জল বিষ ঢেলে চলেছে আঞ্চলিক কৌমপ্রাকৃতে। আর সেই যে মোষকুঁজ পাহাড়, তার কোল ঘেঁষে আরও একটা নদী বয়ে চলত। পাঁচ দশক ধরে সেইখান দিয়ে মাইন থেকে উজানস্রোতে বয়ে আনা কাঁচা লোহার আকরে আকরে সেই নদীর জল আজ ভীষণ লাল। নদীটার আসল নাম আর জানা যায় না। লোকমুখে তার নাম হয়ে গেছে লাল-নদী। তার আগে কি নাম ছিলো তা সেই পাহাড়ি গ্রামগুলোর যে মানুষগুলো জানতো তারা হয় নদীতে বয়ে আনা বিষের প্রকোপে ভিটেমাটি ছেড়েছে, নয় ছেড়েছে নকশাল-দমনের নামে ফৌজি উৎপীড়নে। এইখানে যে সকল বিদ্বজ্জন ‘স্যান্ডুইচ থিয়োরি’ টাইপের গালভরা নামধাম নিয়ে আসবেন, তাঁদের সবিনয় জানানো যাক যে নকশালেরা রেপ করে না।
সরকারের সাথে জমি হাতিয়ে হাতিয়ে খনি, খনির জন্য মালগাড়ির রেলপথ, পাওয়ার প্ল্যাণ্ট, এবং হালে নকশাল-দমনের নামে অজস্র ফৌজি ক্যাম্প তৈরী হওয়া, থানাগুলোর হোলসেল-রেটে ক্যাম্প তথা ইণ্টেরোগেশান সেণ্টারে পরিণত হওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে বস্তার সম্ভাগকে, তার কৌম ও ভৌম প্রাকৃত সমেত টুকরো টুকরো করে বিকাশ-দানোর ভোগে চড়ানো, এই সবকিছুই যেন আশির দশক থেকেই চাগিয়ে উঠলো বস্তার জুড়ে। আর একই সাথে চাগিয়ে উঠলো গেরুয়া ঝাণ্ডার জিকির।
১৯৭৮ সালেই জনতা সরকার ও আর-এস-এস-এর সম্মিলিত সাম্প্রদায়িক লিপ্সাদুষ্ট থাবা পড়তে থাকে প্রশাসনে আর সেই দেখে সভরেন স্টেট প্রদত্ত শাসনদণ্ড ত্যাগ করে, কালেকটর পদ থেকে ইস্তাফা দিয়ে, আই-এ-এস অফিসারদের প্রাপ্য সমস্ত সুযোগসুবিধা ত্যাগ করে, পথে, প্রান্তরে বাসে ট্রেণের জেনারেল ডাব্বায় সওয়ার হয়ে বি ডি শর্মা চললেন আরেক অলীক সাধনপথে – মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। একজন কালেক্টরের একজন আদিবাসীদের দাবীতে সোচ্চ্বার সামাজিক কার্য্যকর্তায় পরিণত হওয়ার সত্যি-গল্প-গুলো আদতেই রোম্যাণ্টিক হয়। অথচ ঘোরবাস্তব সচরাচর অনুরূপ রোম্যাণ্টিক হয় না। তাই তাঁর ইস্তাফার দশক ঘুরতে না ঘুরতে, ১৯৯২ সালে সুন্দরলাল পাটবা সরকারের মদতপুষ্ট সংঘী গুণ্ডারা তারই একদা কাছারি-সদর জগদলপুরময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ঘোরালো।
অবশ্য তিনিও এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি কাজ করে চললেন মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ আদিবাসী অঞ্চল জুড়ে। দেশে এমন দুটো চলতি আইন আছে যার বুনিয়াদ গড়েছে তাঁর অভিজ্ঞান – ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট ও পঞ্চায়েৎ এক্সটেনশান টু শ্যেড্যুল্ড এরিয়াস অ্যাক্ট। এমন কি নতুন সহস্রাব্দেও, নকশালদমনের নামে আদিবাসী-পীড়ন যখন তুঙ্গে উঠতে থাকলো, বারেবারে বিভিন্ন মঞ্চে আওয়াজ উঠিয়েছেন তিনি, গত বছর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে অবধি।
বসেছিলাম বস্তারের উপর মাইন আর হনুমানভক্তদের উৎপাতের বিষয়ে লিখতে, মাঝখান দিয়ে শর্মা-জ্বী তাঁর উপস্থিতি জানিয়ে গেলেন আমাদের ভুলতে থাকা বিভিন্ন অদ্ভুত মানুষদের প্রতিনিধি হিসেবে।
যে জেলায় একজন মানুষ সকলের প্রিয় কালেক্টার ছিলেন সেই জেলারই সদর টাউনে তাঁর ইস্তফা দেওয়ার এক দশকের মাথায় হেনস্থা করতে পারল সংঘিরা, কারণ ততদিনে বস্তারে এক দেড় প্রজন্ম ধরে অনবরত আদিবাসীদের জমি-হড়পানোর খেলায় তারা হয়ে উঠেছে পোক্ত, ক্রমে ক্রমে ফেঁদে বসেছে তাদের নয়া-সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী। গেরুয়া ক্রমবর্ধমানে পুষ্ট। তারই নজির দেখলাম উত্তর বস্তার জেলার কাঁকের সদর আর ভানুপ্রতাপপুর টাউনে রামনবমীর তলোয়ারি আস্ফালনে।
শুধু ঘা কাটতেই নয়, তাতে নুনের ছিটে দিতেও এরা এক্সপার্ট। এখন তাই ছত্তিসগড়ের উত্তরে কোরিয়া জেলা থেকে একটানা দক্ষিণে বস্তার সম্ভাগের মধ্যিখান দিয়ে, দণ্ডকারণ্যর মধ্যে দিয়ে চলে যাবে তীর্থপথ – রাম বন গমণ পথ। পথে বহু স্থানে তৈরী হবে আশ্রম ও মন্দির, বিশেষতঃ যেখানে যেখানে রামচন্দ্র রাক্ষস বধ করেছিলেন। রামের বিষয়ে সরকারী আদিবাসী ইস্কুলগুলোতে, ক্যাম্প গুলোতে জোরকদমে পড়ানো হয় রাজ্যজুড়ে, কোয়া সহ বিভিন্ন গোঁড় সম্প্রদায়ের জন্য রামগাথা লেখা হয়েছে বৈধ এবং আর-এস-এস ফাণ্ডেড অ্যাকাডেমিয়ার বদৌলতে। ১৬ই এপ্রিল দৈনিক ভাস্কর নামের হিন্দি কাগজের কাঁকের-পৃষ্ঠায় এই বিষয়ে একটা ফিচার বেরিয়েছিলো। রামনবমী স্পেশাল। এই ফিচারটি শুরু হয়েছিলো ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ দিয়ে, এবং লেখক বিভিন্নভাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন যে রাম বনবাসে গিয়ে এক্স্যাক্ট ‘এলাহাবাদ কে আস পাস’ থেকে ঐ পথ দিয়েই, উত্তর ছত্তিসগড়ের সীতামাড়হি হয়ে অম্বিকাপুর-মেনপাট-ধরমজয়গড় অঞ্চলে তিন বছর কাটিয়ে, মধ্য ছত্তিসগড়ের রাজিম, সিহাবা ইত্যাদি অঞ্চলে বছর পাঁচেক কাটিয়ে বস্তারে হাজির হলেন, দণ্ডকারণ্য-জুড়ে বধ করলেন অজস্র রাক্ষস দান্তেওয়াড়া, সুকমা, চিত্রকুট জুড়ে অজস্র রাক্ষস মেরে হাম্পি, নাশিক প্রভৃতি অঞ্চলে চলে গেলেন। এইধরণের পিলে চমকানো তথ্য জানিয়ে লেখাটি শেষ হয়েছে নিম্নখচিত ডিস্ক্লেমার দিয়ে – সত্যযুগ থেকে হালের কলিকাল অবধি বহুবার টেকটনিক প্লেট শিফট হওয়ার কারণে রামচন্দ্রের চলাফেরা সঠিক পথ নির্ণয় সম্ভব নয়।
এইসব ভুঁইফোঁড় রামভক্তদের অর্থ বল ও প্রতিপত্তি-প্রসূত উপদ্রবে এইসব মন্দির ও তীর্থপথ তৈরী হচ্ছে, টাউন ও গঞ্জ অঞ্চলে দেড়’শো দুইশো মিটার দূর দূর তৈরী হচ্ছে হনুমান, শিব, সন্তোষী, শীতলা প্রভৃতির মন্দির, গোঁড় আদিবাসীদের যুগ-যুগ ধরে আরাধ্যা দেবী চিখলা নামসাদৃশ্যের কারণে পরিণত হচ্ছে হিন্দু দেবী শীতলায় যার মন্দির মাথা তুলছে গ্রামে গ্রামে। প্রাকৃত ইশ্বরচেতনার দৃকপট বিরাট, এবং কখনোই পৌত্তলিক নয়, ছিলো না; মধ্যভারতের আদিবাসীরা পূজো করত, করে নিয়মরাজা, রাওরাজা-দের, বুঢ়া দেও প্রভৃতি পাহাড়-পর্বত-কে, আম, মহুয়া সহ বহুধা-বিচিত্র ফল, ফুল, খাদ্যশস্য-কে, শাল ও অন্যান্য বিরাট বনস্পতিকে, ডোঙ্কিনী-শঙ্খিনীর মত নদীদের, খাণ্ডাধার জলপ্রপাতের অধিষ্ঠাত্রি খণ্ডকুমারী দেবীকে, করে চাঁদকে, সূর্যকে, রাতের তারাদের, অথবা ধূসর ইতিহাসের ক্যানভাস জুড়ে যাঁরা খররোধে দাঁড়িয়েছিলেন আর্য অগ্রাসনের বিপ্রতীপে – সেইসব বালি, রাবণ, শম্বুক, মহিষাসুরদের, অথবা লিঙ্গবাবার মত মানুষ অথবা মানুষী ধারণাদের – যাঁদের প্রজ্ঞার শান্ত ভক্তিচ্ছায়া জীবনে ও যাপনে মধ্যভারতের অগণন আদিবাসী আনন্দ খুঁজে নিয়েছে পাহাড়-অরণ্য-নদীখাতের নিবিড় কোল থেকে। তাই মুণ্ডারিক নৃগোষ্ঠির সরনা-আচারে চাঁদ হয় চান্দু বোঙা, সুর্য হয় সুজ্জা বোঙা, গল্পবলা সোসো-গাছ হয় সোসোবোঙা, এবং সততঃ-শাশ্বত কস্মিক তথা আদিতম ইশ্বরচেতনায় প্রতিভ হয় ‘বোঙা’। একই ভাবে, কোয়া গোণ্ডিদের ‘পেন’ – এই যাপন-চেতনিয়া পাঠে রয়েছে নয়-খণ্ড পৃথিবী ও চাঁদ-সূর্য-তারা-ধূমকেতুতে ঠাসবুনোট ষোলো খণ্ড মহাজগতের কথা।
এইসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন পাহাড়ের ঢলে ঢলে যাপনের উচ্ছ্বাস – মেলায় মেতে ওঠে গোটা বস্তার সমস্ত বছর ধরে। এখানে বারো মাসে তেরো পার্ব্বণ বললে কম বলা হয়। প্রতি দিনই যেন বস্তার সম্ভাগের কোথাও না কোথাও মেলা – কখনো আমের প্রথম ফল ধরলে আমা যোগানী, কখনো বা বীজ বপনের কালে বীজা-পাণ্ডুম, আবার কখনো বা রাওরাজার থানে রাওঘাট-মেলা, কখনো লিঙ্গোবাবার পুজোয় আমাবেড়া-সেমারগাঁও-এর লব্ধপ্রতিষ্ঠ লিঙ্গো-মেলা। বলা বাহুল্য, এই সব মেলার থানগুলো ক্রমাগত হিন্দুত্ববাদের প্রভাবে হয়ে উঠেছে মন্দির-প্রতিম, এবং নিরবয়ব নিরাকার সমবেত ঈশ্বরচেতনার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মুর্তিপুজো।
হালে এই সব মেলায় শ’য়ে শ’য়ে ফৌজি মোতায়েন করা হয়। কখনো সখনো সেখানে আছড়ে পড়ে বুলেটের বন্যা, খাতায় কলমে ‘এনকাউণ্টার’। এক বীজ-পাণ্ডুম উপলক্ষেই গত চার বছরে ঘটে গিয়েছে এ’হ্যানো দুটো মাস-এনকাউণ্টার। তাই গ্রামবাসীরা ক্রমে ক্রমে এইসকল মেলায় যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। নাচ-গান-আনন্দ ফুরিয়ে আসছে, উচ্ছ্বাস ক্রমে স্তিমিত। ফৌজি মোতায়েন ও কাউণ্টার ইন্সার্জেন্সির চণ্ড কোপ পড়ে গিয়েছে সমগ্র বস্তারের যূথ-যাপনের উপর, আদিবাসী অরণ্যসন্তান-সন্ততীদের উপর। গঞ্জ এলাকার আদিবাসীরা আর গোণ্ডি-ভাষা জানে না বিশেষ। আবার হালবি গোঁড় আদিবাসীরা পৈতে পরে বামুন হচ্ছে, অন্যান্য আদিবাসীদের ‘নীচু-জাত’ গণ্য করছে। নকশাল এবং ফৌজিদের বদান্যতায় বন্ধ হয়ে গেছে মাড়িয়া কিশোর-কিশোরীদের জীবন-পাঠের ও কৌমযাপনের পাঠশালা তথা ঘোটুল, আদিবাসী বাচ্চাদের পড়ানো হচ্ছে রাস্তার ধারে ‘পোটা-কেবিন’-নামধারী কিছু শিশুরোধ খাঁচায় পুরে। ফৌজিদের রেপ-চাইল্ডের সংখ্যা বেড়ে চলেছে বনে বনে, গ্রামে গ্রামে। যেন ক্রমাবলুপ্তির পথে এগোচ্ছে প্রাচীণ প্রাজ্ঞ গোঁড় সভ্যতা।
-- কাঁকের
১০-০৬-২০১৬
রাত ০০-২৫
এই লেখার কোনো ব্যক্তিমালিকানা নেই। আমরা সকলে মিলে বস্তারকে চিনছি। সবাই পড়ো/পডুন/পড়িশ, ইচ্ছে হলে, ছড়িয়ে দিও/দিন/দিস এদিকে সেদিকে।