প্রাগ-ইতিহাস কালের সেই যে লিঙ্গো-‘পেন’, যাঁর দর্শন আজ বস্তারিয়া আদিবাসী যাপনের ভাঙা-মেলার ধুলোট হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বস্তরিয়া কৌমের রেডার হারানো, ভোরের চিহ্ন দেখতে না পাওয়া নদী-পাহাড়-জঙ্গলে – কে ছিলেন সেই অদ্ভুত মানুষ? হাজার দশেক বছর কি তারও আগে থেকে তাঁর মানবমহিমার উপরে পড়েছে এত এত অলৌকিকের পরত, যে সেই সব সরিয়ে মানুষটার কাছে পৌঁছোনোর প্রজ্ঞা –যাত্রা – সে তো বিরাট মহাজীবনের যুগ-যুগান্তোত্তীর্ণ কাজ। অধমের সামর্থ সীমিত। যতটা জানছি, লিপিবদ্ধ করে রাখি।
লিঙ্গো-‘পেন’-এর গল্প
নারায়ণপুর-কাঁকের জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাওঘাট পাহাড়। গভীর অরণ্যানীর কোলে হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে মানুষেরা এইখানে। খুব বেশীদিন থাকবে না বোধ হয়। রাওঘাট মাইন-এর গল্প তো এত পর্বে এতবার করেছি। সমস্ত পাহাড়টাই ছিনিয়ে নিয়েছে ভিলাই স্টিল প্ল্যাণ্ট ও সেইল মিলে, এন-এম-ডি-সি তথা বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সহায়তায়, এবং বসে গেছে আজ অব্ধি পঁয়ত্রিশটা ভয়াল ধর্ষোণ্মত্ত ফৌজি ক্যাম্প।
যে সময়কার কথা, তখন না ছিলো মাইন, না ছিলো রাষ্ট্র, না ছিলো এ-কে ৪৭। এইসবের অনেক অনেক আগে, কুয়াশাঢাকা কোন গণোনোত্তর অতীতে, থাকত সাত ভাই। সাত ভাই বড় হতে থাকল সেই গাঁয়ের বনে ঢাকা শান্ত ছায়ায়। বড় ছয় ভাই ছিলো দামাল দুরন্ত অরণ্যসন্তান। ছোটোটি ধির-স্থির, শান্ত-শিষ্ট, জ্ঞানগম্ভীর। তার গভীর কাজলচোখে ছায়া পড়ে অরণ্যের, আকাশের ও মননের আয়নায় ফুটে ওঠে প্রজ্ঞাঋদ্ধ তারারাজি। আর তার রক্তে রক্তে বইতো গানের তরঙ্গলহরী বুঝি। এক সাথে বারো রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারত সে। বনের গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়েরাও বুঝি শান্ত হয়ে শুনতো সেই বাজনা, ভেসে যেতো সুরের প্রবাহে।
বাকি ছয়ভাই খেত-খামারের কাজ করতে লাগল দিনভর, বয়ঃক্রমে ঘর বাঁধলো, বিয়ে করল। পড়ে রইলো লিঙ্গো। অথচ তার গান-বাজনায় এতই মুগ্ধ ছিলো তার দাদাবৌদিরা, যে তাকে ঘরের কাজ, বনের ফল-কাঠ-বীজ-শিকার জোগাড়, খেতি-বাড়ির কাজ, এমনকি রান্না-বান্নার কাজ করার জন্য বকুনি দিতে মন সইতো না কারুরই। সে এ’সবের ধার ধারতো না, শুধুই গাইতো আর বাজাতো। ক্রমে ক্রমে তিক্ত হয়ে উঠলো তার ছয় দাদার গৃহী মন।
দাদারা যখন বনে যেতো, ক্ষেতে যেতো, ছোটো ভাইটা তখন সারাদিন আপন খেয়ালে ডুবে যেতে যেতে সুরের অলীক ঝর্ণা বইয়ে চলত তারই নিজের হাতে বানানো সেই বারোটা বাজনা থেকে, আর সেই সুরের মুর্চ্ছনায় মুগ্ধ হতে থাকত তার ছয় বৌদি। দাদারা ক্রমে উঠলো চটে। সারাদিন খেটেখুটে বন-ক্ষেতি থেকে ফিরে তারা দেখত নাওয়া নাই খাওয়া নাই পাগলা ভাইটা বাজিয়ে চলেছে, আর ঘরের সব কাজ ফেলে বউগুলো বাজনা শুনে চলেছে। তারা বউদের বলতে লাগল – “তোমরাই লাই দিয়ে মাথায় তুলছো অপদার্থটাকে!” বাঁধল বিতণ্ডা ঘোর।
অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও তারা পারল না লিঙ্গোর গানবাজনা বন্ধ করে তার মন সংসারে ফেরাতে। তাই গোপনে ফন্দি আটল – ‘শালাটাকে মেরেই ফেলা যাক’। প্ল্যানমাফিক, নিয়ে চলল তারা লিঙ্গোকে শিকার করা শেখাতে গভীর জঙ্গলের ভিতর। জঙ্গলের ভিতর ছিল এক শালপ্রাংশু বীজা গাছ। সেই গাছটা দেখিয়ে তারা লিঙ্গোকে বলল –“ওই দ্যাখ, ওটার কোটরে তক্ষক লুকিয়ে আছে, উঠে গিয়ে ছুরি দিয়ে মার ব্যাটাকে, তোর বৌদিরা আচ্ছাসে ঝোল রেঁধে খাওয়াবে”। প্রসঙ্গতঃ উল্লেক্ষ্য তক্ষক বা গোসাপ (মনিটর লিজার্ড)-এর মাংস অত্যন্ত উপভোগ্য, এবং ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টের শিকার-বিরোধী উৎপাত ও তারপর পুলিশ-প্যারামিলিটারির আর্মস-অ্যাক্ট তথা নকশাল-কেস জনিত উপদ্রব আরম্ভ হওয়ার আগে বস্তারের ঘরে ঘরে এর মাংস রান্না এবং তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া হত। ফিরে আসি গল্পে।
তো, তক্ষক মারতে লিঙ্গো উঠে পড়ল সেই বীজা-গাছে, আর কোটরে কোটরে, ডালে-ডালে খুঁজতে লাগল তক্ষককে। ইতিমধ্যে ছয় ভাই তীর ধনুক তাক করে ঘিরে ফেলল গাছটাকে। ধনুকের ছিলা টেনে মারল এক তীর ভাইকে লক্ষ করে সটান! অথচ তীর গিয়ে লাগলো বীজা-গাছের ডালে। সেই গাছের আঠা হয় লাল রঙের। টুপটুপ করে গাছের লাল রস নীচে পড়তে দেখে দাদারা ভাবল “লক্ষ্যভেদ করেছি বটে!”
ভাইকে রেখে ছয় দাদা পত্রপাঠ চোঁ-চাঁ দে-দৌড় গ্রামের বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছে হাঁপ ছাড়লো – ‘যাক! বাঁচা গেলো! আপদ বিদেয় হয়েছে!’ তারপর বৌদের সামনে নাকিকান্না জুড়লো –
‘অমন সোনার ভাইটা আমাদের গো! কোন জন্তু এসে নিয়ে গেলো গো!’
এদিকে বীজা গাছ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো তক্ষকের দেখা মিলল না। সে একমনে শিকার খুঁজছিলো, আর তিরটাও দাদারা ছুঁড়েছিলো তার আগোচরেই। হঠাৎ লিঙ্গো দেখতে পেলো, অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে; চারিদিক শুনশান, দাদাদের দেখা নেই, সাড়া নেই। অবাক হল সে। তড়তড় করে গাছ থেকে নেমেএসে মেঠপথে হাঁটা দিলো বাড়ির দিকে। কাছাকাছি এসে শোনে ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে কান্নার রোল।
পা টিপে টিপে খিড়কি দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। নিঃসাড়ে কান পেতে শুনলো সব কথা, বুঝলো কারসাজি। রাগে দুঃখে বুঁজে এসেছে তার গলা। টুঁ শব্দটি করল না তবু। মাথা ঠাণ্ডা রাখলো। চুপচাপ নিজের ঘরে এসে বসে থাকল সে। সহসা তাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো তার দাদাবৌদিরা। একঘর বাকরুদ্ধ ফ্যাল-ফ্যাল চোখের সামনে নির্বিকার লিঙ্গো তান দিতে লাগল তার বাদ্যযন্ত্রে, সুরের ঢেউ ছুটে চলল অন্ধকার বনের বুকে ঢেউ তুলে যে’মত সেই।
দিন যায়, রাত যায়। ক্রমে লিঙ্গোর বিয়ে ঠিক হল এক ‘সিরহা’ বা তন্ত্রমন্ত্র জানা ম্যাজিক-হীলার তথা শামান পরিবারে। তার বউও জানত জাদুটোনার নানান উপায়-পন্থা, নানান বীজমন্ত্র। ঘরে মন টেঁকে না নতুন দম্পতির। রোজ দাদাদের গঞ্জনা, দৈনন্দিনের কলুর ঘানি – তাতে কি আর সহজে মন টেঁকে সেই ভাবুক বাজনাদার বা তার যাদুকরী বউয়ের? দাদাদেরও কি আর তার অকর্মণ্য ভাইয়ের প্রতি খুনী রাগ সহজে মেটে? একদিন দাদারা মিলে বলেই বসল –
‘তোমাদের আর পুষতে পারবো না আমরা। তোমাদের জন্য সবার অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তোমরা বাপু এই গ্রাম এই পরগনা ছেড়ে পাড়ি দাও ভিনমুলুকে। বিষয়সম্পত্তির বাটোয়ারা পাবে না, আগেই বলে রাখলাম। এই একটা চুম্বকের লকেট দিচ্ছি পরিবারের স্মৃতি হিসেবে। ব্যাস, আমাদের আর দায়দায়িত্ব খতম, নিজেদেরটা নিজে বুঝে নাও গে’
সেই চুম্বক সম্বল করে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিলো বর-বৌ। ক্রমে গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে, পরগণার সীমানা ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল তারা বনের ভিতর দিয়ে। পথ যেনো ফুরোতে চায় না। খিদে, তেষ্টায় জুড়িয়ে আসে শরীর, চলতে চায় না পা। তবুও, গাছের ফল-মূল খেয়ে, খড়কী নদীর, মেণ্ডকী নদীর জল, চাররে মাররে জলপ্রপাত ও অন্যান্য বুনো ঝোড়া ও কাঁদরের জল খেয়ে কোনো রকমে ভুখ-পিপাসা মেটাতে থাকলো তারা। অবশেষে একটা শিমুলগাছের ছায়ায় ঢাকা গ্রামে এসে পৌঁছোলো তারা। দেখলো, একটা গোলায় পড়ে আছে অজস্র ধানের শীষ – ঢেঁকিতে ঝাড়াই-মাড়াই করে অনেক আগেই চাল নিয়ে নেওয়া হয়েছে সেই সব শীষ থেকে।
সেই দেখে তারা সিদ্ধান্ত করল যে সেই শূন্য শীষ বা পোয়াল থেকেই ভিজিয়ে ভিজিয়ে কিছুটা হলেও চাল বের করে নিতে পারবে তারা। যে চাষীঘরের গোলায় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই চাষীকে গিয়ে বলল তাদের দুঃখের কাহিনি। সেই দুঃখ উথলে উঠলে শিমুলগাঁয়ের সেই চাষীর মন। বলল – ‘তোমরা ঐ পোয়ালগুলো ভিজিয়ে নাও, যা চাল বেরোবে, সব তোমাদের’।
এই শুনে বরবৌ করল কি – সেই গ্রামের মাঠিতে বসালো তাদের সেই চুম্বক-লকেট। রেখে বলল –
‘তুমি আমাদের একমাত্র অবশিষ্ট কূলচিহ্ন। যদি এই পোয়াল ভিজিয়ে পর্যাপ্ত চাল বের করতে পারি আমরা, তাহলে তোমাকে মানব, তোমার প্রতিষ্ঠা করব কূলদেবতা হিসেবে। নৈলে তোমার উপর হেগে মুতে ছুঁড়ে ফেলে দেবো তোমাকে’
এমন বলে ভেজাতে লাগল সেই শুকনো পোয়ালগুলো। ততক্ষণে সেইখানে জড়ো হয়ে গেছে গ্রামের বেশ কিছু কৌতূহলি মানুষ। সবার বিস্ফারিত চোখের সামনে – পোয়াল থেকে চাল বের হতে লাগল। এত চাল এত চাল যে এক পাত্রে কুলোয় না। আরও বড়ো পাত্র আনা হল। তাও পড়ল উপচে! গাঁয়ের লোকে বলল – ‘চমৎকার! চমৎকার! অদ্ভূত ক্ষমতাধারী এক দম্পতি এসেছে আমাদের মধ্যে’
সেইদিন ধূমধাম করে সেই শুকনো পোয়াল থেকে বেরোনো চাল থেকে ভরপেট খেলো গ্রামবাসী। শিমুল-গাঁ, মানে গোঁড়ভাষায় যা হল ‘সেমারগাঁও’ – সেইখানেই প্রতিষ্ঠা হল সেই চুম্বক-লকেট – লিঙ্গোর কূল-কৌলক টোটেম। যুগ-যুগান্ত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়ে, গোঁড় আদিবাসীদের ভক্তির আদর পেয়ে, সেই টোটেম হয়ে উঠেছে সমস্ত গোঁড় আদিবাসীদের আদি-পিতার চিহ্ন। আজও সেমারগাঁয়ে ধূম ধাম করে পুজো হয় এই থানের – রাখা হয় পূতঃপবিত্র আঙ্গা-পেন, মানে পেন-ইয়ায়া-দের নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট্টো কাঠের পালকি। আসে, থুড়ি, আসত সমস্ত বস্তারের, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, ওড়িষা, মধ্যপ্রদেশ থেকে ঢলে ঢলে আদিবাসীরা, পাহাড় রাঙিয়ে ওঠে, থুড়ি, উঠতো গানে, নাচে, রঙিন পোষাকে, বেতের চুপড়ি, বেতের বাঁশীতে, পাঁপড়ভাজা আর মহুয়ার ম’ম মৌতাতে।
পাস্ট টেন্স কেন ব্যবহার করলাম মেলার কথা আসতেই? কারণ আজ শিমূলগাঁয়ের এই মেলা ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে আসছে এত এত ফৌজি মোতায়নের ফলে। আশেপাশের পঁয়ত্রিশ-টা ক্যাম্প থেকে বন্দুকধারীরা এসে ঘেরবন্দী রাখে মেলাপ্রাঙ্গণ। যেখানে এই গ্রাম, সেইখানেই আজ আমাবেড়া সংলগ্ন বক্সাইট মাইন, আবার সেই জায়গাটাই আজ হুররা-পিঞ্জোরীর ধর্ষোণ্মত্ত বি-এস-এফ-এর ক্যাম্প-আচ্ছন্ন ভয়জড় গ্রামাঞ্চল – প্রায় প্রতিটা গ্রামেই আজ ফৌজিরা ঢুকে ঢুকে ধর্ষণ করে এসেছে, আসছে। আশেপাশের বেশ কিছু গ্রাম – পাল্লাকসা, অঞ্জরেল, আরও কত নাম-না-জানা, নাম-না-বলা গ্রাম ফাঁকা হয়ে গেছে ফৌজি আর মাইনিং কোম্পানীর তাণ্ডবে। অজস্র খুনের ধর্ষণের রক্তকথা সন্তর্পণে, ফিসফিসিয়ে ছড়ায় বনের পাতায় পাতায়।
লিঙ্গোবাবার অলৌকিক হয়ে ওঠার গল্প সেই চাল বের করার আখ্যাণ থেকেই শুরু। সেই গ্রামেরই প্রান্তে এক ছায়াঘন অঞ্চলে পর্ণকুটীর বানিয়ে থাকা শুরু করল সেই আশ্চর্য্য দম্পতি। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে যায় তাদের অলৌকিক কার্য্যকলাপের কথা, তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করা শুরু করল রাওঘাট-অবুজমাড় ছাড়িয়ে আরও দূরদূরান্তের মানুষেরা। ক্রমে ক্রমে লিঙ্গো উদ্ভব করল আরও সব বাদ্যযন্ত্র, প্রচলন করল ঘোটুল প্রথা। ঘোটুলের প্রথম গোঁড় কৌমজ নৃত্যগীতি মানে ‘কোলাঙ’ – ও তারপরের প্রথম শিকার-অভিযানের – নেতৃত্ব দিলেন এই সাধক। সঙ্গে সঙ্গে চলল এক প্রমাণ সাইজের পোষা কেঁদোবাঘ।
এদিকে তার দাদাদের কানে পৌঁছোলো এই সব কাহিনী। ঈর্ষা পরিণত হল দ্বেষে, চাগিয়ে উঠলো সেই পুরোনো ভ্রাতৃঘাতী ইচ্ছাটা। ধেয়ে এলো তারা লিঙ্গোকে মারতে। বারোটা গাড়িতে বলদ জুতিয়ে তারা সংগ্রাহ করল ঢালাও জ্বালানী কাঠ। অগ্নিসংযোগ করল তাতে। ইচ্ছা, ভাইকে ধরে বেঁধে এনে সেই আগুনে ফেলে পুড়িয়ে মারা। দেখতে দেখতে ধকধক করে বনের মাথা ছাপিয়ে উঠলো লেলিহান শিখা। কিন্তু ওমা! সেই আগুনের মাথায় নাচছে কে? ও যে তাদের ভাই লিঙ্গো। তাণ্ডব নাচছে যেন! অথচ কি ফুর্তি তার! ঐ দেখো! সে যা আঠারোটা বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছিলো, সবকটা একসাথে বাজিয়ে চলেছে নাচতে নাচতে!
সেই আঠারোটা বাজনা বস্তারের গোঁড় আদিবাসীরা আজও বাজিয়ে চলে, সেই সব যন্ত্রে সুরসংযোগই যে তাদের আগুন-জয়ী লিঙ্গোবাবার সাধনা! যন্ত্রপগুলোর নামগুলো টুক করে জেনে রাখি আমরাও এই মওকায় – ১) মাদল; ২) ঢুড্রা/কোটোড/টুডকা/কোটোডকা; ৩) বাঁশী; ৪) মাঁদরী (মন্দিরা); ৫) পরাঁগ; ৬) কচ টেহেণ্ডোর; ৭) চিটকোলী; ৮) পক টেহেণ্ডোর; ৯) ধুশীর/চিকারা; ১০) আকুম/তোড়ী; ১১) গুজ্রী-বর্গা/তিরডুড্ডী/ঝুমকা-বড়গী/ঝুমকা-বড়গা; ১২) হুলকি; ১৩) টুণ্ডোডী (ডুগডুগি); ১৪) ঢোল; ১৫) বিড়িয়া ঢোল; ১৬) কিরকিচা; ১৭) কীকিড়; ১৮) সুলুড।
এই সবে বাজনার বুনো সুর বুলেটের, ড্রিল মেশিনের হিংস্র গর্জনের তলায় চাপা পড়ে ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে যাবে একদিন খুব সম্ভবত, যখন রাওঘাটের খণি এসে গিলে নেবে এই সব বন জঙ্গলের সুখ-দুখানিয়া কাহিনীগুলো, ঠাকুমার বুকের ওমে মুখ গুঁজে অবাকচোখা কিশোরী আর শুনবে না লিঙ্গোবাবার অলিপিত রূপকথাগুলো, ঘোটুলের মতই হয়তো আমাদের সামগ্রিক বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে লিঙ্গোবাবা আর তার ছয় ভাইয়ের অলীকগাথা।
এই ছয় ভাইয়ের নাম উত্তর-বস্তার-কাঁকের জেলার মুরাডোংরী গ্রামের প্যাটেল তথা ‘খাণ্ডা মুখিয়া’, অর্থাৎ উপরবর্ণিত আঙ্গা-পেন-এর পুজারী ধীরেসিং মাণ্ডাবীর মুখে শুনে লিখে রেখেছেন ডঃ কে আর মাণ্ডাবী তাঁর ‘পুস কোলাং পারক্কি’ নামের প্রবন্ধে –
১) উসে মুদয়া; ২) পাটোয়ান ডোকরা; ৩) কণ্ডা ডোকরা; ৪) (?)ডোকরা; ৫) কুপারপাট ডোকরা এবং ৬) মুহ ডোকরা। তারপর এদের ছোটো ভাই লিঙ্গো-ডোকরা। এবং এদের এক বোন কোহলা কাসসো। একসাথে এদেরকই সমগ্র গোঁড় জনজাতির আট আদিগুরু মানা হয়, সপ্রেম বিশ্বাসে, জনজাতির সকল সদস্য এদেরই বংশধর।
কাঁকের
১৪-০৭-২০১৬
এই লেখার কোনো ব্যক্তি মালিকানা নেই। আমরা সবাই মিলে লিখছি, পড়ছি, চিনছি বস্তারকে।