বস্তার সম্ভাগের কাঁকের আর নারায়ণপুর জেলা। সেইখানে বহুযুগ ঠায় দাঁড়িয়ে রাওঘাট পাহাড়। ছত্তিসগড়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা আর মধ্যপ্রদেশ জুড়ে গোঁড় আদিবাসীরা থাকে। তাদের কাছে এই পাহাড় পবিত্র। আর এই রাওঘাটের পাথরের তলে তলে থাকথাক লৌহাকর। গন্ধে গন্ধে এসে গেছে মুনাফাকামীরা, উন্নয়নের জিকির তুলে।
ভিলাই স্টিল প্ল্যাণ্ট ভারতসরকারের প্রিয়তম প্ল্যাণ্ট। নবরত্নের এক। অথচ ১৯৫১ সালে তৈরী এই কারখানার কলকব্জা পুরোনো হয়ে আসছে। আউটপুট কমে আসছে। অতএব, আউটপুট বৃদ্ধি করতে হলে, চাই বিপুল পরিমানে ইনপুট। লোহার কারখানার মূল খনিজ ইনপুট আকরিক লোহা। তাই দান্তেওয়াড়ার বৈলাডিলা খণির ‘কেপ্যাসিটি এনহ্যান্সমেণ্ট’-এর পাশাপাশি, এই রাওঘাট থেকে প্রবল উদ্যমে লোহার আকর তোলার তোরজোড় আরম্ভ। রাওঘাট খনির মালিক স্টীল অথরিটি অব ইণ্ডিয়া লিমিটেড (সেইল), এবং নকশাল-জুজুর ভয়ে কাজ চলেছে ফৌজি-প্রহরায়। শিল্পায়নের ঐতিহাসিক ধারা অনুসারে, মাইনের পাশাপাশি গ্রাম উড়িয়ে পাহাড় গুঁড়িয়ে বনাঞ্চল সাফ করে গড়ে উঠছে রেলপথ।
সমস্ত অঞ্চলটাই আদিবাসী অধ্যুষিত। ২০১১র আদমসুমারী থেকে মাইনিঙের ফলে প্রকটতম-প্রভাবিত গ্রামগুলির আদিবাসী জনসংখ্যা তুলে দেওয়া হল –
গ্রাম |
মোট জনসংখ্যার মধ্যে আদিবাসী % |
---|---|
সালেভাট | ৯৬.৮১ |
পারলভাট |
৯৫.৫৫ |
পাতুরবেড়া |
৯৬.৯৮ |
সুপগাঁও | ১০০ |
পুসাগাঁও | ৮৭.৫৯ |
পাল্কী | ৮৩.১৯ |
মাহকা | ৯০.৩৪ |
অঞ্জ্রেল | ৯৬.৬৬ |
কর্লাপাল | ৯৬.৯৩ |
গঞ্জ নারায়ণপুর | ৪৮.৮ |
এর্কো | ৮৭.৬৫ |
ভারাণ্ডা | ৯২.৬৯ |
আতুরবেড়া | ১০০ |
ভৈঁসগাঁও | ৮৪.৯৮ |
বৈহাসালেভাট | ৭৪.২৩ |
তালাবেড়া | ৮৭.৯৪ |
মাংতাসালেভাট | ৮০.৯৪ |
মলমেটা | ১০০ |
কুমহারী | ৫৯.৬২ |
খোড়গাঁও | ৯৪.০৯ |
ফুলপাড় | ৯৮.৭৪ |
নিব্রা | ৯৯.৩০ |
কিলেনার | ১০০ |
হিকোনার | ১০০ |
কোহকা | ৯৫.০৬ |
তেম্রুগাঁও | ৬৪.৪১ |
পাল্লাকসা | ৯৯.২৪ |
সিতাপুর | NA |
টোটিনডাংরা | ১০০ |
ডাংরা | ৮১.৬৩ |
ছোটেজৈলপুর | ৭৯.৭২ |
এই গ্রামগুলি ছাড়াও, সমগ্র কাঁকের ও নারায়ণপুর জিলা জুড়ে ৩০০টি গ্রাম এই রাওঘাট মাইন ও তদসংলগ্ন রেলপথের কবলে পড়ে অস্তিত্ব-সংকটে আছড়ে পড়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে মাড়িয়া, মুড়িয়া, অবুজমাড়িয়া, নুরুটি সহ অজস্র গোঁড় উপসম্প্রদায়। এঁরা সকলেই অরণ্যনির্ভর মধ্যপ্রদেশ গেজেটিয়ার, বস্তার ডিস্ট্রিক্ট, ২০০০ জানাচ্ছে - “The whole tribal economy almost solely depends on agriculture and forest… the tribals could be said to form the bulk of agriculturists population and the numerically important of them consisted of Muria, Gond, Maria, Bhattra, Halba, Dhurwa and Dorla…
অরণ্য কৃপণ নয়। খাদ্যশস্য জুগিয়েছে অঝোরে। মূল যে’সকল খাদ্যশস্যর উপর নির্ভর করেছে এই অঞ্চলের অরণ্যসন্ততীরা, সেগুলি হল – ধান, জোয়ার, বজরা, কুলত্থ, কোড়োন-কুটকি, কোসরা, সাওয়া, মাণ্ডিয়া, নিক্কা, উদাদ, বিভিন্ন তৈলশস্য, পুটু, মানে ব্যাঙের ছাতা, আমলকি, হত্তুকি, বেল, তেন্দু-ফল, বুনোকলা প্রভৃতি। এইসব ছাড়াও, দৈনন্দিনের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষার জন্য অরণ্য তাঁদের দিয়েছে তেন্দুপাতা, শালপাতা, শালবীচি, মহুলপাতা, মহুয়া ও মহুয়ার ফুল, সরাই-পাতা, গালা, লাসা, কাদান-মূল, চারোটা, ঘুপ, তোরা, ভেলওয়া, মধু, ধোবোভাজা, বোহোরভাজা, মুএসলি, চার-চিরোঞ্জি, চারোটা, কুসুম, লাসা, কায়েভাতি, ফর্সা-পাতা, আরো কত কি। এই অরণ্যজ বৈচিত্র আঞ্চলিক আদিবাসীদের অনাদিকাল থেকেই দিয়ে এসেছে জীবন, জীবিকা ও পুষ্টির সুরক্ষা। যতটা প্রয়োজন হয়েছে, সকলে মিলে সেবন করেছে, উদ্বৃত্তটুকু বিক্রি হয়েছে হাটে, হাটবারে।
পুষ্টি ও খাদ্য ছাড়াও অরণ্য এঁদের দিয়েছে বিচিত্র বিরাট বনৌষধির সম্ভার। আন্ত্রিক, আমাশা, রক্তামাশা, রক্তাল্পতা, আঘাত, সর্দি-জ্বর, ম্যালেরিয়া, বহুমূত্র, দাবাদহে সান-স্ট্রোক, পেটব্যাথা, সাপের কামড়, ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো, পেট পরিস্কার করা, স্টেরিলাইসেশান প্রভৃতির প্রয়োজনে যে সকল বনৌষধি ব্যবহার করে এসেছে রাওঘাট পাহাড়, অবুজমাড় ও তার আশেপাশের অরণ্যসন্ততীরা তার একটা অসম্পুর্ণ তালিকা দেওয়া হল –
করমত্থ, সেগুণ, সরাই, সজা, বীজা, সলীহা, সাইমার, বোডাগা, ডোডেরা, মকাইয়া, বুনো হলুদ, ধাবদা, আম, মহুয়া, কররা, হররা, বাইহদা, কুসুম, ফর্সা, তেঁতুল, বটফল, জাম, ছিন্দ, সালফি, সুর, থাদি, রামফল, কোলিয়ারি, বৈর, বিরিয়া, তেন্দু, চারোটা, চার, বাউস, কসাহি, মুঙ্গা, সালিয়া, কাঁঠাল, কারাত, কাজু, নীম, বুনো কলা, কূরূ, পিপূল, বেল, ভেলওয়া, কুরঞ্জ, জফুল, গোলাপ, কাগক, কমলফুল, চামেলি, লিলী, সেবন্তী, রথরাথ্রী, গন্ধা, সদাবাহার, তিল, ডুমুর, পেঁপে, ধুতরো, নারকেল, ফুলহদ, সিহাদি, গঙ্গাকোরাঈ, বাগারাণ্ডা, নীলগিরি, আমলকি, চার, করোওধা, কদাহি, লেবু, কমলালেবু, আঙুর, মুএসলি, সাদা মুএসলি, সামের, বাবুল, সিঁদুর, লতা, ফাংলতা, সিয়াধিলতা, চাহা-মুরাল, কেবতিলতা, আলতিলতা, আইমেলতা, শিম, বরবটি, পটলকুমড়ো, তুমা, বজ্রদন্তী, ভেজরী, পাটঝুড়ি, পর্সা, মুঙ্গা, রসনা, ভাসামপাত্রি, ভারহা-কান্দা, পোটার, হর্দি-ফুল, ভুঁইনীম, নীমপাতা, ধুব, মোগ্রালতা, কদ্রুপান, লজ্জাবতী-লতা, সিতাফল, তুলসি, ফুড়ল, কোসাকান্দা, কাউকান্দা, কারুকান্দা, তরঙ্গায়কান্দা – এবং আরো আরো অনেককিছু ।
রাওঘাটের খাদান-কোপে এই সব গাছ-পালা-লতা-পাতা শেষ হয়ে গেলে এই সব আদিবাসীদের বাঁচার কোনো উপায় কি আর পড়ে থাকবে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দিনমজুর হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ছাড়া?
আঞ্চলিক আদিবাসীদের মধ্যে অবুজমাড়িয়ারা, নৃতত্বের ভাষায় যাকে বলে ‘প্রি-এগ্রেরিয়ান’। এরা সম্পূর্ণ অরণ্যনির্ভর, শিফটিং ও জুম-চাষ করে পাহাড়ের ঢাল জুড়ে, নানান ফলমূল, টিউবার ও ভাতের উপর নির্ভর করে অবুজমাড়িয়াদের পুষ্টি-সুরক্ষা। জঙ্গল সরে গেলে, এঁদের আর বাঁচার কোনো পথ পড়ে থাকবে না।
মাইন হলে, পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, শাল-তমাল-মহুয়ার মত মহীরুহ-বনস্পতিদের সাথে সাথে, তাদের ছায়ায় লালিত এই সব শস্যগুলো, ফলমুলশাকপাতা-গুলো, বনৌষধি - ফুরিয়ে যাবে। এমনিতেই, উন্নয়নের আক্রমণে বিপুল অরণ্যনাশের ফলে সমগ্র বস্তারে ফি বছর আগের বছরের চেয়ে কম বৃষ্টি পড়ে, বেশী গরম পড়ে, কম শীত পড়ে।
খাতায় কলমে ৮৮৩.২২ হেকটর জঙ্গল গিলে নেওয়া এই রাওঘাট মাইন কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এবং ছত্তিসগড় সরকারের ছাড়পত্র পায় ২০০৯ সালে। এই ছাড়পত্র নেওয়ার আগে, স্বভাবসিদ্ধ বেআইনী প্রথায়, আঞ্চলিক আদিবাসীদের এ’ বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়ার কোনো চেষ্টা করে নি সরকারপক্ষের কেউ।
সংবিধানে যে সকল এলাকা পঞ্চম তফসিলভুক্ত – মানে যে সমস্ত জায়গার জনসংখ্যার গরিষ্ঠাংশ বাসিন্দা আদিবাসী, সেই সকল এলাকায় পঞ্চায়েতি রাজ জারি করা হয়েছে ১৯৯৬ সালে প্রণীত পঞ্চায়েৎ একস্টেনশান টু শ্যেড্যুল্ড এরিয়াস (পেসা) অ্যাক্ট মাধ্যমে। উক্ত কেন্দ্রীয় আইন, ২০০৬ সালের দ্য শ্যেড্যুল্ড ট্রাইবস অ্যাণ্ড আদার ট্রেডিশিনাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স রেকগনিশান অব ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট (এফ-আর-এ) এবং রাজ্য ছত্তিসগড়ে প্রযোজ্য ছত্তিসগড় পঞ্চায়েতি রাজ অধিনিয়ম ১৯৯৩ অনুসারে কোনো আরণ্যক গ্রামের মানুষের ব্যাবহারযোগ্য ব্যক্তিগত জমি মানে ভিটেমাটি, খেতি-আবাদী এবং গ্রামের নিস্তারী, মানে সেখানকার দেবদেবীদের থান, উৎসবের জায়গা, শ্মশান, গোচারণভূমি – সমস্ত কিছু যদি ‘বিকাশ’-এর ধ্বজিত উদ্দেশে হাপিস করতে হয়, তাহলে প্রভাবিত সমস্ত গ্রামের গ্রাম সভার মাধ্যমে রেসল্যুশান পাস করতে হবে, গ্রামবাসীদের গরিষ্ঠাংশের সম্মতি প্রয়োজন। এছাড়াও, উক্ত এফ-আর-এ আইন অনুসারে আরণ্যক গ্রামের গ্রামবাসীরদের নানাবিধ অধিকার-জ্ঞাপক পাট্টা দেওয়া হয় – যেমন বসবাসের অধিকার, খেতি-আবাদির অধিকার, খাদ্য হিসেবে আহৃত ফল-মূল-ব্যাঙের ছাতা, পানীয় হিসেবে আহৃত মহুয়া, সালফি প্রভৃতি, জীবিকার উদ্দ্যেশ্যে আহৃত তেন্দু পাতা, গালা, ধুপ বানানোর রেসিন-সমূহের অধিকার, পরম্পরা-নির্দিষ্ট স্থানে পুজো, উৎসব অন্ত্যেষ্টাদি সকল রিচুয়াল-উদযাপনের অধিকার, অরণ্য ও জীব-বৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখার অধিকার ইত্যাদি। এই পাট্টার আবেদন-ও করা হয় উক্ত গ্রাম-সভা মারফৎ। আবেদনগুলি যৌথ অরণ্যাধিকার সমিতি মারফৎ তেহসিল বা ব্লক স্তরে সাব-ডিভিশানাল ম্যাজিস্ট্রেটের এর কাছে যায়, এবং তারপর যুক্ত বন-প্রবন্ধন সমিতি বা জয়েণ্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেণ্ট কমিটি (জে-এফ-এম-সি)-র কাছে, যেটির তত্ত্বাবধানে থাকেন সংশ্লিষ্ট জেলার কলেক্টর, গ্রামবাসীদের তরফ থেকে সরপঞ্চ অথবা সচিব, প্রমূখ। এই আইনগুলি ছাড়াও, আরও বহু রাজ্যের মত ছত্তিসগড় ভূ-রাজস্ব সংহিতার ধারা ১৭০খ মাধ্যমে আইন করা হয়েছে যাতে কোনো আদিবাসীর জমি কালেক্টারের লিখিত সম্মতি ব্যাতিরেকে অনাদিবাসীর হাতে না চলে যায়। আবার নিয়মগিরি-কেস-এ সুপ্রীম কোর্ট জজমেণ্ট দিয়েছে যে আদিবাসীদের কাছে পবিত্র ও পূজ্য পাহাড়-জঙ্গল এলাকায় মাইনিং করা যাবে না।
উপরের প্যারাগ্রাফের আইনী কচকচানিতে জাওয়া হল কারণ এইবার, রাওঘাটের পরিস্থিতির থেকে বোঝা যাবে কিভাবে এই সব আইনগুলি লঙ্ঘণের মাধ্যমে স্বীকৃত। একই পরিস্থিতি অন্যত্রও। জিন্দালের মাইনী অত্যাচারে একদা বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে পূর্ণ জিলা রায়গড় পরিণত হয়েছে ধূ-ধূ মরুভূমিতে, আবার সরগুজা জিলার হাঁসদেও জঙ্গল ও নদী চলে গিয়েছে আদানীর কয়লাকলুষ কবলে। ফিরে আসি রাওঘাটে।
কাঙ্কের থেকে ভানুপ্রতাপপুর হয়ে, অবুজমাড়-পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা চলে গিয়েছে রাওঘাটের দিকে। এই রাওঘাটের পাস ধরেই মারাঠা আক্রমণ হয়েছিলো বস্তারে একদা। এখন, রাস্তার দুইদিকে চাইলে দেখা যায়, অজস্র বনস্পতির মৃতদেহ – কোনোটার কাণ্ড তাকিয়ে রয়েছে ঠাঠা রোদ্দুরে, কোনোটার গুড়ির দিকে তাকালে বোঝা যায় – একদা এইখানে একটা বিশাল গাছ ছিলো। আমাদের শপিংমল-পুষ্ট চেতনায়, অশিক্ষিত মূর্খ দরিদ্র আদিবাসীরা গাছ কেটে বন নষ্ট করে। বাস্তব হল, আদিবাসীরা গাছ পুজো করে, জঙ্গল বাঁচায়, নিজামের কাঠ-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বস্তারের গোণ্ডি আদিবাসীরা উনবিংশ শতাব্দীতে স্লোগান তোলে – ‘একটি গাছের বদলে একটি মাথা’। উপমহাদেশে গাছকে ‘টিম্বার’ বা ‘লকড়ি’ হিসেবে দেখতে শিখিয়েছে উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশ।
নিয়মগিরির যে’রকম নিয়মরাজা, রাওঘাটের সে’রকম রাজা রাও, যার থান রয়েছে রাও-দেবীর মন্দিরে। ফি বছর মোচ্ছব লাগে। গত হাজার হাজার বছর ধরে লেগেই চলেছে। এই বছর লাগবে আগামি উনিশে এপ্রিল। আশেপাশের প্রায় ৩০০টা গ্রাম থেকে মানুষ ঢলে পড়বে। যাত্রা হবে ঘোর। যদিও মাইন সম্পূর্ণ হলে, এই মেলা শেষ হয়ে যাবে। রাওদেবীর থান, পাহাড়ের যে ঢাল ধরে মেলে বসে সেই এলাকা, সমস্তই পড়েছে রাওঘাট খাদানের লিজ-এলাকার মধ্যে। তাছাড়াও পড়েছে ঘাট-মাড়িয়ার মন্দির, মৌলি মাতার মন্দির, এবং পাহাড়ের কোলে যে গুহায় রাত্রে ঠাঁই নেয় রাজা রাও সহ সমস্ত দেবদেবীরা সেই গুহাটা। মাইনের কবলে পড়বে বস্তার সম্ভাগের কাঁকের জিলার অন্তাগড় তহসিল এবং নারায়ণপুর জিলার নারায়ণপুর তেহসিল। এর মধ্যে থেকে কুড়িটা গ্রাম ২০১৪ সালের অক্টোবর-নভেমবর জুড়ে এফ আর এ আইন অনুসারে সামুহিক বন-অধিকার পাট্টার আবেদন জানিয়েছিলো। আবেদনগুলি তেহসিল-আপিসে পড়ে আছে ১৭ মাস ধরে। বারবার সাক্ষাতে ও ডাকযোগে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেষমন্ত্রক, আদিবাসী মন্ত্রক সহ কেন্দ্রীয়, রাজ্যস্তরীয়, জেলাস্তরীয় ও ব্লকস্তরীয় বিভিন্ন সরকারি দরজায় কড়া নেড়েছে গ্রামবাসীরা। এ বিষয়ে কোনো প্রাশাসনিক নড়ন-চড়ন দেখা যায় নি অদ্যবধি। এই কুড়িটা গ্রামের নাম হল – ছোটে জৈনপুরী, তহসিল-ডাংরা, টোটীন-ডাংরা, কুমহারী, ভ্যাইসগাঁও, পোটেবেরা, কুরসের, গোঁড়বিনাপাল, আনুরবেড়া, ফুলপাড়, বড়ে জৈনপুরী, তারলকাট্টা, চিপৌণ্ডি, চিংনার, সিরসাঙ্গী, জৈতনবাগাঁও। রাওঘাটের খনি এদেরকে গিলে নেওয়ার আয়োজন করেছে মহাসমারোহে।
সেই আয়োজনের অংশ হিসেবেই, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে অঞ্চলের গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর কাঙ্কেরের কালেক্টর ও অন্তাগড়ের এস-ডি-এম আপিস থেকে চাপ বাড়তে থাকে পুরোনো পাট্টা-প্রক্রিয়া চলা সত্ত্বেও নতুন করে ফাঁকা পাট্টা ফর্মে সই ও ছাপ্পা লাগিয়ে পঞ্চায়েত-গ্রাম সভার রেজিস্টারে সই মেরে লিখে দিতে যে পাট্টা-প্রদান-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। কারণ আইন বলে, এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হলে বনাঞ্চলের জমিকে বিকাশের হাঁড়িকাঠে চাপানো যাবে না। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এস-ডি-এম বিভিন্ন গ্রামের মুখিয়া-সরপঞ্চ-সচিবদের ডেকে জানায়, ১৪ থেকে ২৪শে এপ্রিল গ্রাম সভা হবে, তখন যেন গ্রাম সভার রেজিস্টারে দেখানো হয় যে পাট্টা-প্রদান-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। ততদিন তাদের মাইনে দেওয়া হবে না। অথচ ২০১৪র সেই পাট্টার আবেদনগুলো ১৮ মাস হয়ে গেলো, এস-ডি-এম অফিসেই ধুলো খাচ্ছে। এদিকে গতকাল, অর্থাৎ ৮ই এপ্রিল জগদলপুরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়। মিটিঙের সভাপতিত্ব করেন বস্তার সম্ভাগের কমিশনার দিলীপ বাসনেকর, কাঁকের জিলার কালেক্টর শাম্মী আবিদী, উক্ত জেলার পুলিশ কমিশনার জিতেন্দ্র সিং মীণা, উক্ত জেলার সংযুক্ত কলেক্টরদ্বয় এস-পি মাঁঝী ও অরবিন্দ শর্মা, ভানুপ্রতাপপুরের এস-ডি-এম ইন্দ্রজিৎ সিংহ, ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের জেনারেল ম্যানেজার এ কে মিশ্র, সাউথ-ইস্ট-সেণ্ট্রাল রেলওয়ের তরফে আই-এ খান, মহেশ কুমার আগরওয়াল, জিতেন্দ্র প্রসাদ, রাওঘাট মাইনের তরফ থেকে সি দয়ানন্দ প্রমূখ। সভাপতি শ্রী বসনেকর বলেন যে সম্পূর্ণ বস্তার সম্ভাগের উন্নয়নের খাতিরে যত শীঘ্র সম্ভব, মাইন ও রেলপথের কাজ শেষ করতে। এছাড়াও বলা হয়েছে যে অন্তাগড় টাউনে শিক্ষার বিস্তারের জন্য দয়ানন্দ আদর্শ বিদ্যামন্দির স্থাপন করা হবে। প্রসঙ্গতঃ, কাঁকের টাউনে উক্ত আর্যসামাজিকেরা আঞ্চলিক অনার্যদের উত্থানের অভিপ্রায়ে বেশ কিছু দশক ধরেই ইস্কুল খুলে রেখেছে। এ’ভাবেই, মাইনিং সুনিশ্চিৎ করতে খরকাগাঁও, তালবেড়া, সুলেঙ্গা, কর্লাপাল সহ বিভিন্ন গ্রামের সচিব-সরপঞ্চদের ভয়, প্রলোভন, মাইনে আটকে দেওয়া প্রভৃতি উপায়ে হাত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নকশাল-কেসের জুজু তো বস্তারে এমনিতেই সহজেই দেখানো যায়। ভুয়ো ‘নো-অবজেকশান-সার্টিফিকেট’, পাট্টা ইত্যাদিতে সই করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। ছলে বলে কৌশলে সমস্ত আইনি প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে এইভাবেই অনলনিঃশ্বাসী রথে উন্নয়ন আসছে বস্তারে।
মাইন শুধু একা রাওঘাটই নয়, রয়েছে আরো অসংখ্য। সমগ্র ভারতবর্ষে যত আকরিক লোহা রয়েছে, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই রয়েছে বস্তার সম্ভাগ জুড়ে। সম্ভাগের উত্তরাংশে, যেখানে বালোদ ও রাজনন্দগাঁও-এর দক্ষিণাংশ ছুঁয়ে দিয়েছে উক্ত সম্ভাগের কাঁকের জেলার উত্তুরে মাথা, সেইখানে ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টেরই মহামায়া ও তার হালে বাড়তে থাকা দূলকি মাইন – সেও ঐ জঙ্গল কেটেই তৈরী। তারপর শুরু হয়ে যায় অজস্র মাইন – আকরিক লোহা ও বক্সাইটের। নানান প্রাইভেট মুনাফাকামীদের কামড় সেখানে – হাজির হয়েছে নিক্কো জয়সওয়ালের মত মাঝারি ও হরি-মিনারেলস-এর মত ছোটো সাইজের মাইনিং কোম্পানীরা। তার সাথে পাল্লা দিয়ে ছত্রাকের মত গড়ে উঠেছে প্যারামিলিটারি ক্যাম্প, এবং উপরোক্ত রেলপথ। বালোদ-রাজনন্দগাঁও-জেলার দক্ষিণ-পা তথা কাঁকের জেলার উত্তর মাথা থেকে যদি সরাসরি অবুজমাড়-পাহাড়ের তলদেশের উপত্যকা তথা কাঁকের জেলার অন্তাগড় ব্লকের সাথে যেখানে নারায়ণপুর জেলা মিশেছে সেইখান অবধি সরাসরি দাগ কাটা জায়, তাহলে সমগ্র অরণ্য উপত্যকা জুড়ে রয়েছে তিরিশের কাছাকাছি ক্যাম্প, এবং চলতি বছরে গড়ে উঠবে আরো ২৮-২৯টার মত। এই সংখ্যাগুলো সব স্থানীয়দের মতামত অনুসারে – এ বিষয়ে আর-টি-আই করলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণে তার জবাব দেওয়া হবে না এবং ঘুরে ঘুরে গুণলে গণৎকারের পরিণতি খুব একটা মধুর না হওয়াই স্বাভাবিক।
অন্তাগড়ের এরকমই একটা গ্রাম। নাম নাহয় থাক, কারণ গ্রামে যে দুটো বাড়ি এখনো পড়ে রয়েছে সেই গ্রামের উপরেই গড়ে ওঠা বক্সাইট মাইনের তাণ্ডব সত্ত্বেও, সেখানকার মানুষেরা চাইছে না এই কথা প্রকাশ্যে আসুক। না চাওয়ার কারণ, কিছুদিন আগে তাঁদের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে, সেই ঝড় আবার বইতে পারে যেকোনো দিন। সেই মাইনের অ্যাপ্রোচ রোডের সামনেই, মুনাফা ও উন্নয়নের সমস্ত আক্রমণ সত্ত্বেও প্রবল প্রতিরোধে ভিটেমাটি কামড়ে পড়েছিলো সেই দুই পরিবার। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ফৌজিরা দুটো ঘরেই ঢোকে, দুই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বেদম পেটায়, মহিলা সদস্যদের ধর্ষণ করে।
এইবার আসা যাক উপরে বারবার যে রেলপথটার কথা লিখেছি সে’টার বিষয়ে। ২৯.০৫.২০১৪ সালে ছত্তিসগড় সরকার ছাড়পত্র দেয় এই রেলপথটিকে। আপাতত দল্লি রাজারার সাথে রাওঘাটকে জুড়বে এই রেলপথ। নির্মাণ চলছে। খাতায় কলমে, মানে উক্ত ছাড়পত্রে লেখা রয়েছে ৮৩.১২ হেক্টেয়ার ‘অতিরিক্ত’ বনভূমি যাবে এই রেলপথের পেটের ভিতর। সঙ্গে যাবে অজস্র গাঁ-গঞ্জ। এন-জি-টি-তে চালু মোকদ্দমায় রেলওয়ে দাবী করেছে যে রেলপথের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও নাকি কোনো গ্রাম নেই। অথচ চাক্ষুষ, একটা গ্রামের শ্মশানের উপর দিয়ে চলে গেছে রেলের জন্য মাপা সীমানা। এও চাক্ষুষ – একটা বিরাট সর্পিল এলাকা জুড়ে কাতারে কাতারে গাছ মাটিতে পড়ে আছে মুখ থুবড়ে, আর তার মাঝে মাঝে ভিরকুটি মেরে তাকিয়ে আছে কিছু কাণ্ড-খোয়ানো বনস্পতির গুঁড়ি।
রাওঘাটের মাইন আর রেলপথ ছাড়াও, মাইনের অফিসারবাবুদের জন্য ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্ট রেসিডেনশিয়াল টাউনশিপ বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে ভানুপ্রতাপপুর টাউন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত কলগাঁও গ্রামে। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি আঞ্চলিক প্রশাসন ও ফৌজিবৃন্দ। ২০১৫ সালের দোসরা অক্টোবর গ্রাম সভার আয়োজন করা হয় এই গ্রামে। পঞ্চায়েতের পদাধিকারীবৃন্দ ছাড়াও, সভায় উপস্থিত ছিলেন গ্রামের ৩০-৩৫ জন লোক। বনাধিকার পাট্টার আবেদন ও বণ্টন এবং মনরেগা-য় লভ্য কাজ নিয়ে আলোচনা চলছিল। এমন সময় সেইখানে উপস্থিত হন অন্তাগড় সাব-ডিবিশানের এস-ডি-এম ইন্দিরা দেবহারী। তিনি বলেন যে ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্ট টাউনশিপ বানাবে গ্রামে। সরকারী প্রকল্প, তাই জেন-তেন-প্রকারেণ জমি দিতেই হবে গ্রামবাসীদের, নৈলে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। এই অবধি বলে তিনি উপস্থিত পঞ্চায়ত-সচিবের হাত থেকে গ্রাম সভার রেজিস্টার ছিনিয়ে নিয়ে তাতে লিখে দেন – ‘গ্রামবাসীরা ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের টাউনশিপের জন্য জমি দিতে সম্মতি প্রকাশ করেছে’।
পরিস্থিতি দেখে চরম রাগে ফেটে পড়েন উপস্থিত গ্রামবাসীরা। কাছেই প্যারামিলিটারি ক্যাম্প ছিলো। এস-ডি-এম সেইখান থেকে ফোর্স ডাকেন। বিপুল সংখ্যায় আধাসামরিক বাহিনী চড়াও হয় গ্রামে। বন্দুক তাক করে ঘিরে ধরে গ্রামবাসীদের। বন্দুকের নল ঠেকিয়ে সই নেওয়ানো হয় তাঁদের – এই মর্মে যে তাঁরা ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের জন্য জমি দিতে সম্মত। বন্দুকের নলই যে সমস্ত ক্ষমতার উৎস তা গত দশ বছর ধরে সমস্ত বস্তার সম্ভাগ জুড়ে প্রমাণ করে ফেলেছে ছত্তিসগড় সরকার।
গত ৭ই এপ্রিল ২০১৬-তে, গ্রাম সভা ও ভুয়ো পাট্টা-জনিত বিষয় খতিয়ে দেখতে কিছু বন্ধুর সাথে অধম উপস্থিত হয়েছিলো কুরসেল, গোঁড়বিনাপাল, ভৈঁসগাঁও ও কুমহারীতে। গ্রামবাসীরা পরিস্থিতিতে বেজায় খাপ্পা। প্রতিরোধে চোয়াল শক্ত। কিন্তু প্রতিরোধ করবার সমস্ত গণতান্ত্রিক পন্থাগুলি বন্ধ হয়ে এসেছে। প্রায় কয়েক কিলোমিটার যেতে না যেতেই একটা করে ফৌজি-ক্যাম্প চোখে পড়ে। রাস্তা জুড়ে সার বেঁধে টহল দিতে থাকে এল-এম-জি, এক-৪৭ হাতে আধাসামরিক বাহিনী। বস্তার সম্ভাগ জুড়ে ফৌজায়ন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা চাক্ষুষ না করলে সত্যিই অনুধাবনের বিন্দুমাত্র উপায় নেই। এসব খবরে ছাপে না। গ্রাম সভাগুলিতে কি হবে তা গ্রাম সভায় উপস্থিত থেকে জানার, জানানোর চেষ্টায় রইলাম।
এ’বার ফিরে আসা যাক মাইনিং-জনিত সর্বনাশের প্রসঙ্গে। গোঁড় আদিবাসীদের মধ্যে একটি সম্প্রদায় হল নুরুটি। নুরুটি-গোঁড়েরা রাওঘাট ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যুগযুগান্ত ধরে থেকে এসেছে। তাঁদের বস্তারিয়া সংগঠন নুরুটি গোঁড় মহাপঞ্চায়ৎ গতবছরের রাওরাজার মেলার সময় দাবীপত্র জারী করে – নুরুটি ও অন্যান্য গোঁড় গোষ্টির কাছে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়-ভাবে মহাগুরুত্বপূর্ণ রাজারাওয়ের মেলা এবং রাওঘাট পাহাড়ের মন্দির-থানগুলির ঐতিহ্য যেন মাইন মারফৎ নষ্ট না করে ফেলা হয়। দাবীপত্রে আঞ্চলিক পূজারী-মুখিয়ায়দের সই পড়েছে। ওড়িষাতে নিয়মগিরি পাহাড় বেদান্তের কবলে আসার সময়েও এইভাবেই মোচ্ছব-পার্বণ ঘিরে, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধে একত্র হয়েছিলো ডোঙ্গারিয়া-কোঁধ সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। এই প্রতিরোধে এরা ভীষণ একা। একদিকে মাওবাদীরা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জিকির তুলে পরম্পরাগত গাইতা-মাঝি-মোড়লদের বিস্তীর্ণ পরগনায় পরগনায় ব্যাপ্ত যুগযুগান্তের স্বশাসন-পদ্ধতিতে ইতিহাসবিমূখতার কলুষ লেপেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের সমর্থনে আর-এস-এস-বাহিনী বস্তার সম্ভাগ সহ সমগ্র পঞ্চম তফসিলী বিস্তার-জুড়ে গনেশ-হনুমান-সতী প্রভৃতি মন্দির তুলে আদিবাসীদের বুঝিয়েছে যে তারা আসলে হিন্দু, অন্যদিকে যিশুর নাম নিয়ে পাদ্রীরা অদিবাসীদের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে সভ্যতার আলোয় উত্থিত করতে করতে প্রবল আর্থ-সামাজিক চাপে গাছ-দেবতাদের কেটে ফেলতে হচ্ছে বলে বিবেকদংশনে ক্লীন্ন আদিবাসীদের মননে প্রলেপ লাগিয়েছে এই বলে যে অন্ধকার প্রকৃতিকে পরাস্ত করে সভ্যতার আলোয় আসাই প্রগতির পথে উত্তরণ (প্রকৃতি = অন্ধকার, পিছিয়ে থাকা; সভ্যতা = আলো, অগ্রগতি; এই ইকুয়েশানটার যথার্থতার বিষয়ে মনু-মুশা-ইশা-মহম্মদ-মার্ক্স-লেনিন-মাও সকলের অন্ধভক্তেরাই একমত); আবার অন্য দিকে ভারতরাষ্ট্রের আইনব্যবস্থায় কোনো জায়গা রাখা হয় নি আদিবাসীদের, আদমসুমারীতে ধার্য্য করা হয়েছে হিন্দু বা খ্রীশ্চান হিসেবে। তাই বস্তারের গেজেট সহ জনগণনা-বিষয়ক দস্তাবেজ দেখলে বোঝা যায় ইতিহাসে এক কুটিল মিথ্যা সরকারী তকমা পেয়েছে – যে বস্তার সম্ভাগের গরিষ্ঠাংশ মানুষই নাকি হিন্দু।
রাওঘাটের খনির কবলে পড়বে টোটীন-ডোংরী গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা চন্দ্রীবাহার নদী, জৈতপুরী গ্রাম ছুঁয়ে চলে তুমীরকশা ও ওটাএকেট্টা নদী, মেণ্ডকী নদী, ঝরণাগুণ্ডি ঝর্ণা এবং অসংখ্য তালাও ও কান্দর। রুক্ষ তাপে হয় শুকিয়ে যাবে, নয় স্বচ্ছতোয়া পরিণত হবে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট-বাহী নর্দমায়। রায়গড় জেলা জুড়ে তাই তো হয়েছে। এই সব নদীতে স্থানীয় মানুষেরা মাছ, কাঁকড়া, সুতাই, গুগলি, ধোন্দী ধরে, স্নান করে, গরু-মোষেদের স্নান করায়, জল খাওয়ায়, আর জীববৈচিত্রে ভরপুর অরণ্যানীর পশুপাখিরাও বেঁচে আছে এই নদী-নালা-জলাশয়গুলির উপর নির্ভর করে। অরণ্য সরে গেলে, নদী লুঠ হলে, একে একে, দলে দলে, তারাও উন্নয়নপুজোরই ভোগে লাগবে।
আইন অনুসারে, এই সব প্রজেক্ট করার আগে এনভায়রণমেণ্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেণ্টের প্রয়োজন। করাও হয়েছে, ন্যাশানাল এনভায়রণ্মেণ্টাল এঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিট্যুট (নীরি) থেকে। সেই অ্যাসেসমেণ্টে ধরা পড়েছে মাইন-প্রভাবিত অঞ্চলের বিপুল জৈববৈচিত্র –
৮০-টা প্ল্যাণ্ট ফ্যামিলির ৪৬৫ প্রজাতির প্ল্যাণ্ট বা উদ্ভিদ গজায় সমস্ত অঞ্চল জুড়ে। আর গজায় ১৩৭ প্রজাতির গাছ, ১০৩ প্রজাতির গুল্প (শ্রাব) ও ২২৫ ধরণের লতা/গাছড়া(আর্ব)। বনৌষধিগুলোর আঞ্চলিক নাম উপরে করছি। নীরি-কর্তৃক অ্যাসেসমেণ্টে ধরা পড়েছে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটার বৈজ্ঞানিক নাম –
Achyranthesaspera, Alocasiaindica, Aloe indica, Aloe vera, Argemonemexicana, Arum colocasia, BlumeaLaciniata, Boerhaaviadiffusa, Chenpodium album, Chlorophytumtuberosum, Chlorophytumarundinaceum, Crysopogonfluvuc, Curculigoorchioides, Curcuma angustifolia, Curcuma longa, Elephantopusscaber, Eleucineindica, Evolvulusalsinoides, Gynandropsispentaphylla, Heliotropiumsupinum, Hygrophillaschulii, Microcholaindica, Mimosa pudica, Nymphaea lotus, Ocimum album...এবং আরো অসংখ্য। ভৌগলিক বিস্তারে রাওঘাটের মাইনকবলিত এলাকার আয়তন সমগ্র ছত্তিসগড় রাজ্যের আয়তনের ০.২৩%, অথচ সমস্ত রাজ্যের উদ্ভিত-বৈচিত্রের ১৩.২৬%ই ধারণ করেছে এই আরণ্যক অঞ্চল।
আলোচ্য অ্যাসেসমেণ্টে প্রতিভ আঞ্চলিক পশুদের নাম – রাওঘাট ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অঢেল সংখ্যায় রয়েছে নেকড়ে, বুনো শুয়োর, স্লথ-ভালুক, গৌড়-বাইসন, চিতল-হরিণ এবং ময়াল-সহ বিভিন্ন প্রজাতির অগণন সাপ। পোকামাকড়দের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের প্রজাপতি, ড্র্যাগন-ফ্লাই, মৌমাছি, ডাঁশ, পিঁপড়ে, ঘাসফড়িং, গঙ্গাফড়িং, ঝিঁঝিঁ, রেশম-মথ, গুবরে, উই ও আরো নানানকিছু। তাছাড়াও এখানকার নদী-নালা-জলাশয়ে সাঁতরে বেড়ায় অজস্র মাছ – তারমধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক ‘দুদুম’, ‘ভগম’ ইত্যাদি। এদের সকলের সাথেই যুগান্তরের গেরস্থালী রাওঘাট-অবুজমাড়ের গোঁড় আদিবাসীদের। মাইন এসে শেষ করে দেবে এই জীব-বৈচিত্র, যেরকম দিয়েছে রায়গড়ে, কোর্বাতে, রৌরকেলায়, ঝার্সুগুড়ায়, জামশেদপূরে, রাণীগঞ্জে, দূর্গাপূরে – দেড়শো বছরের শিল্পায়িত কায়েমী ইতিহাস।
এই কায়েমী ইতিহাসের কোপ পড়ে মানুষী কৌমপ্রাকৃতের যে স্তরে তাকে ধরার মত কোনো শব্দ আর্য্যভাষায় ধরা পড়ে নি। আর্য্যনন্দনে একটা শব্দ আছে – ‘সংস্কৃতি’। এর বিপ্রতীপে, যুগান্তের আদিবাসী যাপনের ক্ষেত্রে, এই স্তরটির নাম রাখা যাক – ‘প্রাকৃতি’। এর যে বিনাশ চলে আসছে উপমহাদেশে শ’দেড়েক বছরের ইউরোপিয় ঔপনিবেশিক এবং হাজার পাঁচেক বছরের আর্য্য ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ক্যানভাস জুড়ে, তাকে ‘ইকো-কালচারাল জেনোসাইড’ বলা চলে। রাওঘাট খনি ও রেলপথের ফলে আলোচ্য অঞ্চলের মানুষদের উপর যে প্রাকৃত-লুণ্ঠণ আছড়ে পড়বে লোহালক্কড়ী দাঁত-নখ চাগিয়ে, তার একটা পল্লবগ্রাহীতাদুষ্ট হিসেব নেওয়া যাক –
যুগ যুগ ধরে জঙ্গল মেতে উঠেছে, নানান পার্ব্বণ-মোচ্ছব-জোহার-মাড়াই উপলক্ষে নানান গানে গানে – তার মধ্যে রয়েছে গোড়ি, মাসি, বিহব প্রভৃতি গান, রয়েছে মোহরি, নেশান, দাপ্রা, কোধান, সারেঙ্গি, পিটাকো, টোরি, গোগো ঢোল, পারাং-ঢোল সহ অগুনতি বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছন্দিত চিটকোলি-নাচ, মোক্সা-নাচ, রেলা-নাচ, মন্দ্রি-নাচ হুলকি নাচের সাথে সাথে চাল-গুঁড়ো, হলুদ, কাদামাটি ও পোড়া কয়লার অপুর্ব নিপুণ মিশ্রণে গাঁ-গঞ্জের বাড়িঘর সেজে ওঠে আশ্চর্য্য রঙিন আলপনায়, নানান বেশ ও ভূষায় সজ্জিত হয় মানুষের শরীর – সাদা প্যাগোডা, কাচোরা-ধুতি ছাড়াও, বাঁশের চিরুণি, বেল-মেটালের কর্ণাভরণ, পুঁথির মালা, চুলের কাঁটা, পাগড়িতে গুঁজে রাখা হয় সৌখিন তামাক-কৌটো গুডা, ট্যাঁকে গোঁজার কাঠের তামাক কৌটা বাণ্ডাল, মারিয়াদের গৌড়-শিঙা শিরস্ত্রাণ পরে নাচ, আর পুজো উপলক্ষে মণ্ডপ-থান সেজে ওঠে নারকেল, মুসুরির ডাল, নুন, হলুদ, চাল – সঙ্গে থাকে অঙ্গোপেন বা কুরুং-তুল্লা – শালকাঠের দেবমুর্তি, গলায় পুঁথির মালা, চারকোনে ময়ুর পালকের ঝুঁটি – চতুর্দোলার মত দেবস্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়, উৎসবের দিন চারজন বাহক কাঁধে করে নিয়ে চলে – প্রাকৃত-বৈচিত্রের এই যে ছবি দিলাম, এটা বলা যেতে পারে ‘স্ক্র্যাচিং অ্যাট দ্য সার্ফেস’। গভীরে গিয়েছিলেন গ্রিয়ার্সন, ভেরিয়ার এল্যুইন, যাচ্ছেন নন্দিনী সুন্দর। বাঙলাপাঠিজন এর আমেজ পাবেন নারায়ণ সান্যালের দণ্ডক-শবরী-তে। প্রাজ্ঞ আরণ্যক অন্ধকারে সুলালিত এই মানুষী প্রাকৃতি – যা এঁদের শিখিয়েছে কিভাবে বাঁশ, পীর প্রভৃতি গাছাগাছালী দিয়ে তৈরী কৌটো বানিয়ে বীজ সংরক্ষণ করতে হয়, কিভাবে বাগাই, সিহাদি, বট, কেকথি প্রভৃতি গাছ থেকে কিভাবে দড়ি বানাতে হয়, ছোড়িয়া সিলিয়ারি, বাঁশ সিলিয়ারি প্রভৃতি দিয়ে কিভাবে মাছ ধরার ছিপ বানাতে হয়, কিভাবে গোণ্ডলি, ছিন্ধ ইত্যাদি গাছের ফাইবার গাছের আঠা দিয়ে জুড়ে জুড়ে বা গাছের আঁশ দিয়ে সেলাই করে করে মাদুর বানাতে হয়ে, কিভাবে ধোনা-পুডগা, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে রান্না করার বাসন-কোসন বানাতে হয় – স্বয়ং-স্বম্পূর্ণ ও যথার্থ স্বাধীন যাপনের এই ভৌম প্রজ্ঞা দ্রুতগতিতে ছাই হয়ে যাচ্ছে – একাধারে কাতারে কাতারে ফৌজি ক্যাম্প, পাশাপাশি মাইন-রেলপথ প্রভৃতির শিল্পায়িত আগুনে। এই সব কিছু ছিনিয়ে নিতে নিতে বিভিন্ন আরণ্যক সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া কি জেনোসাইড নয়? নাগরিক প্রগতিময় জীবনের জিকির তুলে, এই সব মাইন-কলকারখানার উপর নির্ভরশীল থেকে, জি-ডি-পি-র ল্যাজ ধরে উঠতে থাকা আপওয়ার্ডলি মোবাইল আমরাই কি এই জেনোসাইডের কাণ্ডারী নই?
এইভাবেই হাঁগ্রাসে এগোচ্ছে রাওঘাটের মাইনদানো ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা, গিলে নেবে আঞ্চলিক মানুষদের, তাঁদের বাড়ি, খেত-খামার-জলাশয়-পুকুর-নদী-গাছপালা সব, নেবে তাঁদের রাওরাজাকে, অন্যান্য সমস্ত আরণ্যক দেবদেবীদের, নেবা মেলা ও মেলাপ্রাঙ্গণ, খেলার মাঠ, শ্মশানঘাট, হাল-বলদ-গোরু-মোষ, গোঠান, বিবাহ-মণ্ডপ, খাদ্যশস্য, ঘোটুল, নিস্তারি, উনুনের জ্বালানি কাঠ, খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, – সর্বোপরি, কেড়ে নেবে তাঁদের প্রাগ-ইতিহাস কাল থেকে আপন করে নেওয়া জঙ্গল – ভয়ংকরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘেরবন্দী তিনশোর বেশী গ্রামের গোঁড় আদিবাসীরা।
আপাতত দেখা যাক আগামি ১৪ থেকে ২৪শে এপ্রিল ২০১৬ তে যে গ্রামসভাগুলি হবে, সেগুলির অলীক কুশাসন রঙ্গ কোন দিকে যায়, এবং তারই মধ্যে ১৯শে এপ্রিল রাওরাজার মেলায় কিভাবে একপাহাড় দুঃখ ঠেলে এই বিকাশের যূপকাষ্টে গলা ঠেকানো হবু ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ মানুষগুলো কোন ব্যাখ্যাতীত আনন্দে মাতে... এ’গুলোর গল্প আগামী খণ্ডে বলার জন্য অধির রইলো অধম।
কাঁকের
০৯-০৪-২০১৬
রাত ১১:১৫
এই লেখার কোনো মালিকানা নেই। সবাই পড়ুন, দিকে দিকে ছড়িয়ে দিন।