এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • বস্তার-দুঃশাসনীয় (পঞ্চম পর্ব)

    অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ০৮ জুলাই ২০১৬ | ১৫০৩ বার পঠিত
  • যত ঘুরছি, কথা বলছি, জানছি, শিখছি, একটা বিষয় পরিস্কার হচ্ছে। ফৌজি-কৃত ভায়োলেন্স এবং মাইনিং-এর মধ্যে একটা আলবাৎ-কোরিলেশান রয়েছে। যে সব জায়গায় মাইনিং আরম্ভ হয়, সেই সব অঞ্চলে তার আগ-আগ দিয়ে বন-বাদাড় সাফ করে গড়ে ওঠে আধাসামরিক ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে মূলতঃ কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলায় বর্ডার সিক্যুরিটি ফোর্স এবং সশস্ত্র সীমা বল এবং বস্তার, দান্তেওয়াড়া, সুকমা, বীজাপুর জুড়ে সি-আর-পি-এফ, মূলতঃ তাদের ‘এলিট’ শার্প-শ্যুটার কোব্রা ব্যাটেলিয়ন। বস্তার সম্ভাগ দেশের কোনো বর্ডারের ধারেকাছে নয়, তাই বি-এস-এফ বা সশস্ত্র সীমা বল এ’খানে কি করছে তা সভ্রেনেরই মালুম। 

    সম্প্রতি একটা তথ্যানুসন্ধান দলের রিপোর্টে প্রতিভ, সমগ্র বস্তারে গড় ৫ কিলোমিটার দূরে দূরে ফৌজি ক্যাম্প, এবং কাঁকের ও নারায়ণপুর জুড়ে সেই যে রাওঘাট পাহাড়, যেখানে অজস্র গ্রাম হটিয়ে, স্থানীয় মানুষদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও গড়ে উঠছে ভিলাই স্টিল প্ল্যাণ্টের লোহার খণি ও তদসংলগ্ন মালগাড়ি-র রেলপথ, সেইখানে ২ কিলোমিটার দূর দূর বি-এস-এফ অথবা এস-এস-বি-র ক্যাম্প। সমগ্র রাওঘাট জুড়ে তাই অসংখ্য ক্যাম্প, এবং সেই সব ক্যাম্পের আসেপাসের এক থেকে দেড় কিলোমিটার জঙ্গল সাফ করা। এর প্রভাবে, আঞ্চলিক গ্রামগুলো থেকে ভেসে আসছে একের পর এক ফৌজিকৃত যৌনহিংসার খতিয়ান। এ’বিষয়ে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন এই সব গ্রামের মানুষেরা। জানাজানি হলে অত্যাচার হবে প্রবল। 

    ভানুপ্রতাপপুর ছাড়িয়ে রাওঘাটের দিকে কিছুদূর এগোলেই বি-এস-এফ-এর বোড়েনার ক্যাম্প, যার এক পাশ ঘেঁষে তৈরী হচ্ছে সেই মালগাড়ির রেলপথ। এর কাছের দুটো গ্রাম ঘোটুলবেড়া ও সারেণ্ডি থেকে ভেসে আসে চাপা ফিসফিস – কিছু একটা যেন হয়েছে, কিছু একটা ভয়ঙ্কর। আবার আরেকটা গ্রামের এক মেয়ে ও সেই মেয়ের রেপচাইল্ড ও তার বাপেরবারি আপাতত পুলিশের দেওয়া রফা-প্রস্তাব অনুসারে, চুপ থাকার বদলে পাঁচ অঙ্কের একটা অফার পেয়েছেন, অনেকটা ‘…an offer they can’t refuse’-এর ধাঁচেই হয়তো। এরকমই আরেক ভয়থমথম বি-এস-এফ ক্যাম্প হুরে পিঞ্জোরি। আমাবেড়া যাওয়ার রাস্তায়, লিঙ্গোবাবার থান সেমারগাঁওর কাছেই একটা অদ্ভুত সুন্দর ঝর্ণা-ধোয়া বনে ঢাকা গভীর শান্ত চাররে-মাররে ভ্যালি। সেইখানে অবস্থিত এই ক্যাম্পের ফৌজিদের বিরুদ্ধে উঠেছে একের পর এক যৌন হিংসার অভিযোগ। একসাথে একবার ৪-জন মহিলা, অ্যালেজেডলি, গণধর্ষণের শিকার হন, একজনের মৃত্যুও হয়। এর কাছেই পাহাড়ে সেঁটে থাকা এক গ্রামের গল্প। মাইনের দাপটে প্রায় গোটা গ্রাম ঘরছাড়া, কেবল দুই’ঘর মানুষ ভিঁটে আঁকড়ে পড়ে ছিলো মুটি-আঁট প্রতিরোধে। ছাড় পেলেন না এই দুই ঘরের মহিলারাও। অথচ এখানেও মানুষ ভয় পাচ্ছে, কারণ ঘাড়ের কাছেই এখনো নিঃশ্বাস ফেলছে সেই কুখ্যাত ক্যাম্প। 

    আবার কাঁকের-রোড-এর কাছেই রয়েছে বুধিয়ারমাড়ি গ্রাম। এইখানে প্রায় ১৩.২০২৫ হেক্টেয়ার এলাকা জুড়ে মাইনিং করছে কেশকাল জি-এন মাইনস অ্যাণ্ড মিনারেলস লিমিটেড এবং বাগমার বক্সাইট কোম্পানী। সেখানেও মানুষেরা খুব ভালো নেই। 

    এই সব খবর কাগজে বেরোয় না, যে’মন বেরোয় না এই তথ্য যে বীজাপুর জেলার যে কুকনার গ্রামকে সম্প্রতি নন্দিনী সুন্দর যাওয়ার পর থেকেই ঘিরে রেখেছে পুলিশ, সেই গ্রামে ৩১ হেক্টেয়ার জায়গা জুড়ে চলছে কোরাণ্ডামের উৎখণন – যা কিনা জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রয়োজনীয়। 

    দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় সত্ত্বেও নির্বিকারে ধর্ষণ করে চলেছে ফৌজিবাহিনী। কখনো কখনো স্ট্র্যাটেজিক ভাবে গ্রাম হঠানোর জন্য এর’ম হচ্ছে, আবার কখনো মদোন্মত্ত লিপ্সার থাবা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আদিবাসী মেয়েদের উপর, হাটে, মেলাতে। খেতে কাজ করার সময় বা বনে মহুয়া তুলতে গিয়েও ফৌজিদের ভোগের শিকার হতে হচ্ছে এঁদের। এই অন্যায়ের বিহিত নেই, শাস্তিও নেই। বি-এস-এফ সি-আর-পি-এফের সাথে যাঁদের রেগুলার গেরস্থালী, তাঁরা যদি এদের বিরুদ্ধে থানায় নালিশ করে, তার পরিণামে কি বীভিষিকা নেমে আসবে এঁদের উপর, তা হয়তো নাগরিক যাপনে অভ্যস্ত আমাদের কাছে নেহাৎই কষ্টকল্পনা। 

    দুঃস্বপ্নের যেন ক্রমঃঘনীভবন হয়। ১৯৮৮ সালে অবুজমাড় পাহাড়ে নকশাল বেস তৈরী হতে থাকে। তার আগেই, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যে ছোট্ট টাউন নারায়ণপুর, সেখানে বিরাট অঞ্চলের জমি আদিবাসীদের থেকে হাতিয়ে নিয়ে আশ্রম ফেঁদে বসেছে রামকৃষ্ণ মিশন। ‘শিক্ষিত’ করার আছিলায় মাড়-পাহাড়িয়াদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে হীনমন্যতা। বুঝিয়েছে তাঁদের কেন ‘শিক্ষা’র প্রয়োজন, কেন মহিলাদের বক্ষদেশ ঢেকে রাখা বাঞ্ছনীয়, কেন অবুজমাড়িয়াদের সুপ্রাচীণ জীবনযাপন আদপে মুর্খামির নিদর্শণ। ইন ফ্যাক্ট, অবুজমাড়ের নাম অবুজমাড় হয়েছে কারণ এখানকার মাড়িয়ারা নাকি কিছু বোঝে না, নাকি অবুঝ। অবক্ষয়ের মুখে পড়ে অবুজমাড় সহ সমস্ত বস্তারের ঘোটুলগুলো নাগরিকদের পয়সা-ওড়ানোর শিকার হয়ে পরিণত হচ্ছিলো বাস্তবিক রেণ্ডিখানায়। আদিবাসী মহিলাদের পয়সার লোভ দেখিয়ে শরীরে দাঁত বসানো সন্দীপন-সুনীলের গল্পে বা সত্যজিতের সিনেমায় এক্সটিক দেখায়, বাস্তবে তা বিকট ও বিকৃত লালসার স্ফুরণ ছাড়া আর কিছু নয়। তাই, নব্বই-এর দশক জুড়ে যখন প্রথমে অবুজমাড়ে ও তারপর ধিরে ধিরে ইন্দ্রাবতী নদীর দক্ষিণ তথা বীজাপুর-অন্ধ্র সীমান্ত জুড়ে তথাকথিত মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠছিলো, তখনই এই সব তথাকথিত মুক্তাঞ্চলে ঘোটুলপ্রথাও বন্ধ করে দিলো নকশালবাহিনী। একই সাথে চেষ্টা করতে থাকলো গাইতা-মাঝি-দের দিয়ে তৈরী যে হাজার হাজার বছরের ট্রেডিশানাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেম। এক দিকে হিন্দুবাহিনীর তাণ্ডব, আরেকদিকে ‘কালচারাল রেভল্যুশান’ – সব মিলিয়ে মিশিয়ে বিপন্নতা যেন বেড়ে যেত থাকল। ১৯৯৮ সালে নারায়ণপুরে কাছারী-বাড়ির সামনে ঘটা ব্লাস্ট থেকে শুরু হল নকশালদের যুদ্ধবিগ্রহ। 

    টনক নড়তে কয়েক বছর লেগে গেল রাষ্ট্রের। তারপর শুরু হল কাউণ্টার ইন্সার্জেন্সি। ২০০৬ সালে শুরু হল সলওয়া জুড়ুম, ২০০৮ সালে গ্রীণ হাণ্ট। কোয়া আদিবাসীদের দিয়ে তৈরী স্পেশাল পোলিস ফোর্স, নাগা ব্যাটেলিয়ন, কাশ্মীরের ইখওয়ান-দের মত বস্তারের সারেণ্ডার্ড নকশালদের দিয়ে তৈরী বাহিনী – নানান ভাবে আদিবাসীদেরই লেলিয়ে দেওয়া হতে থাকলো আদিবাসীদের উপর। গ্রাম কে গ্রাম জ্বলে খাক। সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা বনগ্রাম ছেড়ে, ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিতে থাকলো হাইওয়ের ধারে তৈরী সারি সারি খাঁচার ভিতর। এদিকে নকশাল-দমনের অভিপ্রায়ে আনীত হল নতুন আইন – ছত্তিসগড় বিশেষ জন-সুরক্ষা অধিনিয়ম। ফলতঃ, খাকি পুলিশ বদলে গেল ক্যামুফ্লাজ পুলিশে, থানাগুলো বদলে ইণ্টেরোগেশন-চেম্বার সমন্বিত  ক্যাম্প হয়ে গ্যালো, নকশাল দমনের জন্য কেন্দ্র থেকে আসতে লাগল কাঁড়ি-কাঁড়ি আন-অডিটেড টাকা, অন্ধ্রের কুখ্যাত কাউণ্টার-ইন্সার্জেন্সি বাহিনী ‘গ্রেহাউণ্ড’-এর আদলে তৈরী হল পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স বা স্পেশালি ট্রেণ্ড ফোর্স (এস-টি-এফ), পুলিশের হাতেও চলে এলো এল-এম-জি, এ-কে ৪৭ প্রভৃতি। (সম্প্রতি কিছু ঘটনার ফলে জানা গিয়েছে যে দান্তেওয়াড়ার থানায় লাঠি নেই, আছে প্রচুর আধুনিক বন্দুক। তবে আপাতত বোধ হয় লাঠির অর্ডার দেওয়া হয়েছে কিছু)। কাতারে কাতারে ফৌজি মোতায়েন হল সমগ্র বস্তার জুড়ে, এখনো হয়েই চলেছে, ব্যাঙের ছাতার মত রাস্তার ধারে ধারে গড়ে উঠলো, উঠছে ফৌজি-ক্যাম্প – দিনভর চেকিং, রাতভর সার্চ-পার্টি। তার মধ্যে কল্লুরি, অঙ্কিত গর্গের মত বহুল-ভূষিত পুলিশ অফিসারদের পোস্ট করা হতে থাকলো বস্তারে – যে যত হিংস্র তার তত পদোন্নতি। 

    এদিকে আবার প্রতিদিন নাকি শ’য়ে শ’য়ে আদিবাসী সারেণ্ডার করছে, আর গদগদ হয়ে সেই সব খবর প্রকাশ করে চলেছে দৈনিক ভাস্কর (যাদের ছত্তিসগড়ের উপরিভাগে রয়েছে পাওয়ার প্ল্যাণ্ট ডি-বি পাওয়ার এবং তজ্জনিত ক্যাপ্টিভ কোল মাইন), হিতবাদ প্রভৃতি খবরের কাগজ। অথচ এখানে থেকে বিষদে খতিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে কিভাবে হচ্ছে এই স্যারেণ্ডার :– র‍্যাণ্ডম গ্রামবাসী, হয়তো আধুনিক সভ্যতার চোখে গরীব, ‘অনপড়’ – তাঁর কাছে উপস্থিত হল পুলিশ, দিলো হাজার দশেক টাকা, এবং বলল একটা কাগজে একটা টিপসই দিতে। ব্যাস। এতেই অবশ্য কাহিনী শেষ নয়, এই সব তথাকথিত সারেণ্ডার্ড মাওবাদীদের দিয়েই তো কাউণ্টার-ইন্সার্জেন্সির অভিপ্রায়ে তৈরী হয়েছে, এখনো হচ্ছে, স্থানীয় কম্যাণ্ডো-বাহিনী। 

    আসলে, যদিও দেশের কয়লা ফুরিয়ে এসেছে, এবং কয়লায় লগ্নী রাখা আর প্রফিটেবল নয় কারণ বিদেশ থেকে প্রচুর কয়লা আমদানীর বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, শিল্পায়িত লৌহযুগে লোহার চাহিদা ক্রমঃবর্ধমান, আর বক্সাইট ক্রমশঃ প্রফিটেবল হয়ে উঠছে। আর বস্তারের মাটির নীচে রয়েছে দেশের মোট আকরিক লোহার এক পঞ্চমাংশ এবং বিপুল বক্সাইট-সম্ভার। এখন তো সবে মাইনিং শুরু হয়েছে, তাও মূলতঃ সম্ভাগের উত্তরে – প্রধানতঃ কাঁকের জেলায়। ব্যাপারটা কোন দিকে এগোচ্ছে তা কল্পনাও বুঝি দুঃসহনীয়। আর এইসব ফ্যাসিলিটেট করবার জন্যই ল্য অ্যাণ্ড অর্ডার মেশিনারীকে নিজের হাতেই যেন ভেঙে ফেলছে রাষ্ট্র। এখানে পুলিশের জোর আদালতের চেয়ে অনেক বেশী। তাই এস-পি-র মনোমত জজমেণ্ট না দেওয়ার ফলে চাকরী যেতে পারে জজের – যে’রকম গেল সুকমা ট্রায়াল কোর্টের জাস্টিস গ্বাল-এর। 

    শুধু পুলিশ-মিলিটারির মত আল্ট্রা-মেগা-হেভিওয়েট ব্যাপারস্যাপারগুলিই নয়, এই রুল অফ ল্য অ্যাণ্ড দ্য কনস্টিটিউশান ভেঙে ফেলায় কমপ্লিসিট রয়েছে বিভিন্ন জেলার কালেক্টর, বিভিন্ন সদরের সাব-ডিভিশানাল অফিসা্‌র বিভিন্ন জনপদ পঞ্চায়েতের সি-ই-ও সহ স্বদেশী বিউরোক্র্যাসিও, এবং ছলে বলে কৌশলে বাধ্য করা হয়ে চলেছে বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের সরপঞ্চ এবং সচিবদেরও। ইতিমধ্যে একটি দূরাভাষ-কথোপকথন মারফৎ বস্তার জেলার কালেক্টর অমিত কাটারিয়া কাঁকেরের লব্ধপ্রতিষ্ঠ জার্নালিস্ট কমল শুক্লাকে ‘দো কৌড়ি কা ইনসান’ হিসেবে অভিহিত করে তাঁকে ‘কিড়া-মাকোড়া জ্যায়াসা মসল’ দেওয়ার কদিচ্ছা প্রকাশও করে ফেললেন কিছুদিন আগেই। আরও নানান চব্য চারিদিকে। 

    আগের কিস্তিতে তো আমরা রাওঘাটে ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের আকরিক লোহার মাইন, মালগাড়ির রেলরাস্তা এবং টাউনশিপের প্রকোপে বিপন্ন কিছু গ্রামের কথা জানলাম, এ-ও জানলাম কিভাবে কাঁকের জেলাভুক্ত কালগাঁও নামের একটা গ্রামে অন্তাগড় সদরের এস-ডি-এম কিভাবে বি-এস-এফের বন্দুকের নল জনগণের কপালে ঠেকিয়ে তাঁদের মনের অধিনায়িকা হতে চাচ্ছিলেন। 

    অনুরূপ এক প্রভাবিত গ্রাম ভৈঁসগাঁও পঞ্চায়েতের সচিব প্রশাসনের অনবরত চাপে তাঁর মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এই রকমের ২০টা গ্রাম মিলে সেই ২০১৪ সালেই ২০০৬ সালে প্রণীত অরণ্যের অধিকার কানুনের ফর্ম খ এবং গ অনুসারে যথাক্রমে সামুহিক ও বনোপজ-ব্যাবহারিক অধিকার (কমিউনিটি রাইটস এবং ইউসুফ্রাক্টরী রাইটস) দাবী করেছিলেন – তাঁদের দাবী গ্রাম সভা রেসলিউশান মাধ্যমে স-কোরাম গ্রামস্তরের ফরেস্ট রাইটস কমিউনিটি মারফৎ প্রণীত হয়েছিলো নির্দিষ্ট উপরমহল তথা সরকারী মহলে তথা সাব-ডিভিশানাল অফিসারের কাছে। তারপর বহুদিন কোনো সাড়াশব্দ নেই। নাছোড়বান্দা গ্রামবাসীগুলোর সাহস কি, চিঠি লিখেই চললো – তাঁকে, কালেক্টরকে, এমনকি রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় আদিবাসী মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় পরিবেষ মন্ত্রকেও! ব্যাপারটা তুঙ্গে উঠলে, মানে, এ’বিষয়ে পরিবেষমন্ত্রক ছঃগঃ সরকারকে চিঠি দিলে, উক্ত মহোদয়ীর স্বয়ং এবং ভানুপ্রতাপপুর তহসিলের তহসিলদার মারফৎ একাধিকবার একাধিক অ্যাপ্লিকেশানের জবাব অথবা ‘অফিসিয়াল অর্ডার’ মাধ্যমে এবং সাক্ষাতেও গ্রামবাসীদের জানানোর চেষ্টা করতে থাকলেন যে তাঁদের করা অধিকারের দাবী-গুলো আইনি প্রকরণের চোখে সিদ্ধ নয়। সরপঞ্চ ও সচিবদের চাপ দিতে থাকলেন পুরোনো আবেদনগুলো রেজল্যুশান-মারফৎ খারিজ করে নতুন করে আবেদন করতে। এ’বিষয়ে তাঁর এবং কালেক্টরের দৃঢ় অভিমত যে আলোচ্য আইন-লব্ধ প্রতিটা অধিকারের জন্য আলাদা আলাদা করে আবেদন দিতে হয় এবং সামুহিক ভাবেও কোনো গ্রামের গ্রামসভা ১ হেক্টেয়ারের বেশী জায়গা পেতে পারে না, গ্রামস্তরের অরণ্যের অধিকার সমিতির সদস্য গ্রামবাসীদের না হলেও চলে যদিও গ্রামের সরপঞ্চ, সচিব, বনদপ্তরের ফরেস্ট রেঞ্জার, রেভিন্যু দপ্তরের রেভিন্যু অফিসার ও পাটওয়ারি, এস-ডি-এম এবং কালেক্টরকে হতেই হয়, এবং সেই সমিতি গ্রামস্তরে না হলেও চলে এবং তার নাম নাকি অরণ্য অধিকার আইন অনুসারে ফরেস্ট রাইটস কমিটি না হয়ে পুরোনো অরণ্য সংরক্ষণ আইন অনুসারে বন প্রবন্ধন সমিতি তথা ফরেস্ট ম্যানেজমেণ্ট কমিটি হওয়া উচিৎ, ইত্যবিধঃ। এই সকল অভিমত কোথা হইতে আসিয়াছে প্রশ্ন করলে রাষ্ট্র হয়তো এই পুরাতন স্বরে উত্তর করিবে – ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের পকেট হইতে। 

    সরকারী মহল থেকে সরপঞ্চ সচিবদের চাপ ও প্রলোভন মাধ্যমে বারবার চেষ্টা করা হয়েছে গ্রাম সভার আয়োজন করে এই মর্মে রেসলিউশান পাশ করাতে যে পুরাতন সামুহিক ও ব্যবহারিক অধিকারের আবেদনগুলি খারিজ হওয়ার দরুণ গ্রামবাসী আবার নতুন করে অবেদন করবে বা করছে। নতুন আবেদনের অভিপ্রায়ে না ভরা আবেদন ফর্মে সরপঞ্চ-সচিবদের সই বসিয়ে সেই ফর্মগুলি দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে গ্রামসভা মারফৎ উক্ত মর্মে রেসলিউশান পাশ করাতে-ও কসুর করা হয় নি। 

    এ’দিকে গত ১৪ থেকে ২৪শে এপ্রিল, ২০১৬-তে ভীম কমরেডের জন্মদিন উপলক্ষে মোদি সরকার দেশব্যাপী গ্রাম সভার আয়োজন করে। কাঁকের জেলাতে রাওঘাট মাইন প্রভাবিত যে অন্তাগর সাবডিভিশান-ভুক্ত ভানুপ্রতাপ তহশিল-ভুক্ত অঞ্চল, সেইখানের গ্রামগুলিতেও হয়েছিলো। যদিও এ’বিষয়ে অধমদৃষ্ট কোনো গ্রাম পঞ্চায়েতের আপিসঘরেই নোটিশের নজির মিললো না, যদিও আইন বলে যে গ্রাম সভা আয়োজনের নির্দিষ্ট তারিখের সাত দিন আগে পঞ্চায়েতে নোটিশ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আইন এও বলে যে প্রতি গ্রামসভাতে সর্বসম্মতিক্রমে একজন করে অধ্যক্ষ নির্বাচিত হবে, যদিও এ’রকম কোনো নির্বাচন অধমদৃষ্ট একটিও সভায় হল না, যদিও একটিতে লোকাল এম-এল-এ-বাবু এসেছিলেন বলে তাঁর জন্য বানানো মঞ্চ থেকে বিনা-নির্বাচনেই ঘোষিত হল কোনো এক স্থানীয় মানুষের নাম অধ্যক্ষ হিসেবে। 

    আরও একটা কালান্তক ব্যাপার হচ্ছে, গ্রাম সভার রেজিস্ট্রি তথা হাজিরা-খাতায়, রেসলিউশানের জায়গাগুলো ব্ল্যাঙ্ক থাকা অবস্থাতেই গ্রামবাসীদের সই নেওয়া হতে থাকলো। এখন সেইসব ফাঁকা রেসল্যুশানের জায়গাগুলোতে ‘বাক্স না গরম না ছাগল’ লেখা হবে বোঝা যাচ্ছে না। অরণ্যের অধিকারের নতুন এবং গ্রামবাসীদের করা আবেদনগুলি নামঞ্জুর এবং কদ্যপি না করা আবেদনগুলি মঞ্জুর হয়ে গেলে, অবাক হওয়ার বিশেষ অবকাশ রাখা হয় নি। আফটার অল, মাইন না হলে, লোহা না এলে, দেশের চলবে কি করে? ইট’স আনাদার থিং যে আপাতত দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোহা, বক্সাইটের মতো অতিপ্রয়োজনীয় উৎখণিত আকরের একটা বিরাট অংশ নামমূল্যে চলে যাচ্ছে মাও ঠাকুরের আপন দেশে।  

    আগের কিস্তিতে প্রমিস করেছিলাম একটা মেলা দেখে এসে লিখবো কিরকম ব্যাপার-স্যাপার। ভেবেছিলাম ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টেরই আরেকটি মাইন – মহামায়া-দুলকি - রাজনন্দগাঁও জেলা ও বস্তার সম্ভাগের জংলা সীমান্তব্যাপী যে অঞ্চলে গড়ে উঠেছে, ব্যাপক-বিস্তীর্ণ হয়ে চলেছে অনবরত, তারই মধ্যে একটা গ্রাম – দুলকি-তে-ই মেলা দেখতে যাবো। 

    বিধি লিটারেলি বাম। কয়েক মাস আগে উক্ত অঞ্চলের পাল্লামাড়হি গ্রামে সারদা মাইনসের প্রাইভেট কয়লাখণির এক অ্যাসিস্ট্যাণ্ট জেনারেল ম্যানেজারকে ফৌত করে একগাদা গাড়িঘোড়া উড়িয়ে দিয়েছিলো। সেই থেকে গোটা অঞ্চলেই একটা জবুথবু ভয়ভয় ছায়া। ভীত বাতাসে খবর ওড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে – প্রায় পঁয়তাল্লিশ জন মানুষকে চোখে চোখে রাখছে আঞ্চলিক থানা ও ক্যাম্পগুলি। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার এই লোহা ও বক্সাইটের আকর-সমৃদ্ধ অঞ্চলে গজাতে থাকা খণিগুলির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছিলেন ইতিউতি। 

    তারপর, মেলার আগ-আগ দিয়েই, জনা সাতেক মানুষ পাল্লামাড়হির চার্জশীট মাধ্যমে, গ্রেফতার হলেন। মানে সাতজনের উপর নকশালী দাগা লাগল। এঁদের মধ্যে প্রায় সবাই এম-জি-এন-আর-ই-জি-এ মারফৎ বাৎসরিক ১০০ দিনের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন, মূলতঃ রাস্তা বানানোর। এঁদের আধারকার্ডও ছিলো। জানিয়ে রাখা ভালো, নকশালেরা সচরাচর রাষ্ট্রীয় জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে কাজ করেন না এবং আধারকার্ড রাখাও বিশেষ পছন্দ করেন না। তালেগোলেহট্টমূলে, আমার মেলা দেখা মাটি হল আপাতত। এবং সাতজন মানুষের একটু একটু করে সিস্টেমের হাতে ছিঁড়েফেটে জাওয়ার যাত্রাপথ খণিত হল। এরকম এত হতে থাকে পৃথিবীর এই সব স্থানে, যে, স্তালিনিয় সেই অমোঘ উচ্চ্বারণের গ্রোটেস্ক ম্যাকাবার অথচ ঘোরবাস্তব অনুকরণের মত করেই যেন, একের ট্র্যাজেডি বদলে যেতে থাকে বহুর স্ট্যাটিস্টিক্সে। 

    -- কাঁকের

    ১০-০৬-২০১৬

    রাত ০০-২৫  


    এই লেখার কোনো ব্যক্তিমালিকানা নেই। আমরা সকলে মিলে বস্তারকে চিনছি। সবাই পড়ো/পডুন/পড়িশ, ইচ্ছে হলে, ছড়িয়ে দিও/দিন/দিস এদিকে সেদিকে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৮ জুলাই ২০১৬ | ১৫০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aritry | ***:*** | ০৯ জুলাই ২০১৬ ০৯:৪৪81534
  • তথ্যানুকেন্দ্রিক লেখা এত ভাল খুব একটা দেখা যায় না। লেখার কথা গেল, এবার কাজের পালা
  • aranya | ***:*** | ১০ জুলাই ২০১৬ ০৬:৪৯81535
  • ৫ কিমি, ২ কিমি পরপর ফৌজি ক্যাম্প -পুরো নরক :-((
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন