বস্তার সম্ভাগ, রাজ্য ছত্তিসগড়, দেশ ভারত। হালে ছয়টি জেলায় বিভক্ত – কাঁকের, বস্তার, দান্তেওয়াড়া, সুকমা, বিজাপুর ও নারায়ণপুর। বস্তার নামটি যদিও, মধ্যযূগের গোড়ার দিকে, অন্ধ্র-তেলেঙ্গানার কাকাতিয়া রাজাদের রাজত্বকাল থেকে প্রচলিত। শব্দের বাঙলা করলে অর্থ দাঁড়ায় – ‘বাঁশতলা’।
মূল অধিবাসী বলতে ৪২টি উপজাতিতে বিভক্ত গোঁড় আদিবাসীরা। রুক্ষ পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা বস্তারের অজস্র বন-গাঁয়ের বাসিন্দা এরা, স্বতন্ত্র স্বশাসনে অভ্যস্ত। গাঁয়ের মূল সভা বা জমায়েতের নাম ‘নার বুমকাল’, এবং এর সভাধিপতি ‘নার মাঁঝি’ তথা ভূমিয়ার ঠাকুর। এছাড়া, গাঁয়ের মূখ্য পুরুত – গাইতা – যিনি গাঁয়ের অধিষ্ঠাতা-অধিষ্ঠাত্রী দেব-দেবীদের তুষ্ট রাখেন – যে সকল দেবদেবী গ্রামের হাওয়া-বাতাস-বৃষ্টি-মেঘ-কৃষি-মাটি-জলাভূমিকে ভালো রাখবে, পালন করবে। গ্রামের প্রাশাসনিক অধিকারীর পদনাম – পটেল, যিনি নানাবিধ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রামের আইনকানুন যাতে সুনির্দিষ্ট ভাবে পালিত হয় সেই দিকে নজর রাখবেন, পল্লীসমাজের ঐক্য অটুট রাখবেন। তাছাড়াও, ঐশ্বরিক বিষয়-আসয়ের তত্বাবধানে থাকেন মাঁঝি-পরিবারের সিরহা তথা ভগৎ, এবং গ্রামের সমস্ত ছোটো-বড় ঘটনার খবর রাখবেন, সেই সকল বিষয়ে গ্রামের সকলকে জানাবেন, প্রয়োজন হলে ঢেরা পিটিয়ে – কোটোয়ার।
এই ভাবে মাঁঝি-পরগনা মারফৎ স্বশাসনে অভ্যস্ত বস্তারের গোঁড় আদিবাসীরা হাজার হাজার বছর বেঁচে থেকেছে। গ্রাম-পাহাড়-জঙ্গল-নদীর উপর নজর রেখেছে তাঁদের দেবদেবীরা। ঠিকঠাক নজর না রাখতে পারলে মানুষেরা মিলেই তাদের শাস্তি দিয়েছে – ‘দেওতাওঁ কি পঞ্চায়েৎ’ গঠন করে। উদাহারণ – যখন বছরের পর বছর বৃষ্টি হয় না, তখন হয়ত মেঘ-বৃষ্টির দেবীর বরাতে জুটেছে মৃত্যুদণ্ড, গড়িয়ে গিয়েছে দেবীমুর্তি অবুজমাড়-পাহাড়ের ঢাল বয়ে। আবার নানান পরব-জোহার-পাণ্ডূমের মহুয়া-মৌতাতে রঙিন থেকেছে জনজীবন – কখনো গ্রীষ্মের প্রারম্ভে আমের বোল ফুটলে আমপুজো, আবার প্রবল দাবাদহে বৃষ্টির জন্য আকুল হয়ে মানুষ দিয়েছে ব্যাঙ-বেঙীর বিয়ে – আসন বেঁধে, বরবধুকে ছোট্ট-ছোট্ট টোপর পড়িয়ে, তাঁদের রাতভর ঘ্যাঙরঘ্যাঙের চোটে মেঘে ছেয়ে গিয়েছে বস্তারিয়া আসমান; আবার বীজ-বপনের কালে বীজ-পাণ্ডূম, আশ্বিন মাসে ১৯১০ সালের বুমকাল-বিদ্রোহের শহীদদের স্মরণে উল্লসিত মোচ্ছব মনে করিয়ে দিতে থেকেছে স্বাধীনতার মর্ম, দশেরার সময় পঁচাত্তর দিন ধরে পার্বণের উল্লাস। সমগ্র উপমহাদেশেই তো আসলে বারো মাসে তেরো পার্বন!
দ্রোহচেতনা কি ছিল না? মানুষমাত্রেই থাকে। তাই ১৮৬০ সন নাগাদ নিজামের কাঠ-ব্যাবসায়ীদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠলো – “একটি গাছের বিরুদ্ধে একটি মাথা”; তারপর সন ১৯১০-এ বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে বস্তার-জুড়ে গর্জে উঠলো মানুষ – সংঘটিত হল বুমকাল বিদ্রোহ; যার পুরোভাগে ছিলেন বিপ্লবী গুণ্ডাধুর, এবং পদলকোট-পাখাঞ্জুরের হালবি রাজা গেঁদ সিং। তাঁদের শাহাদাৎ বস্তার ভোলে নেই। তাই আজও, রাষ্ট্রবাহিনীর বারবার হামলা সত্ত্বেও, অবুজমাড় রাঙিয়ে ওঠে বুমকাল-উদযাপনে।
তারপর, ‘দেশ’ ‘স্বাধীন’ হল, এবং এই স্বাধীনতার দেড় দশকের মধ্যেই খচিত হল বস্তারের গোঁড়দের পরাধীনতার দলিল। প্রতিবাদ করেছিলেন বস্তারের প্রজাহিতৈষী খ্যাপা-রাজা প্রবীর চন্দ্র ভঞ্জদেও, প্রশ্ন তুলেছিলেন কেন সাহেবদের বানানো সিস্টেমের প্রহরী কালেক্টর হবেন বস্তারের মানুষদের দণ্ডমুণ্ডের হর্তা-কর্তা-বিধাতা? কেন বুমকাল-মাঝি-গাইতাদের সরিয়ে দিয়ে সাদা-সাহেবদের বানানো, বাদামী সাহেবদের চালানো সিস্টেমের দাস হতে হবে বস্তারের অধিবাসীদের? এই সব প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্র দিয়েছিলো স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতিতে। ১৯৬৬ সালের ২৪শে এপ্রিল যখন এই অক্সফোর্ডফেরত সৌম্যকান্তি পাগলারাজার বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা লাশ লুটিয়ে পড়ল জগদলপুরে তাঁর নিজের প্রাসাদেরই প্রাঙ্গনে, তখন প্রাসাদ-চত্ত্বর রক্তে ভেসে গেছে, চারিদিকে থিক থিক করছে অগুনতি আদিবাসী মানুষের লাশ; এঁরা সবাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর বন্দুক-কামান থেকে তাঁদের প্রিয় রাজাকে বাঁচাতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো তীর-ধনুক হাতে, বুক পেতে নিয়েছিলো বৃষ্টির মত নামতে থাকে শেল, বুলেট।
প্রবীরখ্যাপাকে বস্তারের আদিবাসী মানুষ ভোলে নি। শুধু বস্তার নয়, সংলগ্ন ওড়িষা, মহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্র-তেলেঙ্গানার অসংখ্য গোঁড় মানুষের বাড়িতে, ঠাকুর-দেবতা রাখার সিন্দুরচর্চিত কুলুঙ্গিতে ঠাকুরদেবতার পাশাপাশি ফ্রেমের ভিতর থেকে চোখ-নাক-দাঁড়ি-গোঁফ-শুদ্ধু হাসতে থাকছে পাগলারাজার ফোটো। এইভাবেই, আদিবাসী না হওয়া সত্ত্বেও, অনাবিল ভালোবাসা পেয়েছে কিছু মানুষ, যেরকম এক পাগলা অ্যালোপাথি ডাক্তার, যিনি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ওষুধ খাইয়ে খাইয়ে মহামারী সারিয়েছিলেন। প্রথমে আদিবাসীরা খেতে চাইছিলো না, তাই তিনি তাঁর জম্পেশ ছড়িখানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ম্যাজিক-মন্ত্রের জিকির তুলে ওষুধ খাইয়েই ছেড়েছিলেন। এখন তাই অবুজমাড়ে তাঁর পুজো হয়, মন্দিরে রাখা আছে, কোনো মুর্তি বা ছবি না, সেই অমোঘ বেতের ছড়ি। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জনপ্রেমী ডাক্তারদের পুজো প্রচলিত হত; একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জনপ্রেমী ডাক্তারদের জেল হয়। কারণ এখন বস্তার বা ছত্তিসগড় বা কোথাওই শাসনব্যাবস্থা আদিবাসীদের হাতে নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বস্তারের মানুষ কোনোদিনই নিজেকে ছত্তিসগড়ের অংশ মনে করে নি, একটা স্বতন্ত্র পরিচয় ছিলো বস্তারের। মোগল যুগে গোঁড়দের সাম্রাজ্য সুবিস্তৃত ছিলো সমগ্র মধ্যভারত জুড়ে। ভোপালের কাছে যে রাণী তালাও, তাও এই সাম্রাজ্যেরই এক রাণী খণন করান। সমগ্র মধ্য ভারত জুড়ে বাহান্নটি গড় গড়ে ওঠে গোঁড়দের। তবে ‘গড়’ শব্দটা পাহাড় অর্থেও ব্যবহৃত হয়, তাই এখানে ‘গড়’ অর্থে পাহাড় না দূর্গ এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে। সে তার মত থাকুক, ক্রমে রাজপুত ও মারাঠা অগ্রাসনে সমতল ছেড়ে পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নিলো গোঁড়রা। অথছ গড়নাম থেকে গেল জনস্মৃতিতে। তাই ২০০০ সালে যখন মধ্যপ্রদেশ রাজ্য ভেঙে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় বানানো হল, তখন গোঁড়-সাম্রাজ্যের সেই বাহান্নটি গড়ের ষোলোটি পড়ে রইলো মধ্যপ্রদেশে, আর ছত্রিশটি গেল ছত্তিসগড়ে। অথচ এই ছত্রিশটি গড়ের একটিও বস্তারে নয়। তাই বস্তার সম্ভাগের ছত্তিসগড়ে অন্তর্ভুক্তি একপ্রকার জোর করেই।
ইতিমধ্যে, দেশভাগের ফলে হিন্দু স্মরণার্থিদের ভিড়ে থিকথিক করছে কলকাতা সহ সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ। উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালীরা ঠাঁই খুঁজে নিল দক্ষিণ কলকাতায়, দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে, আর দলিত মানুষগুলোকে ট্রেণে ঠেলেগুঁতিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল বস্তারের ‘দণ্ডকারণ্য’তে – অর্থাৎ অবুজমাড়-অন্তাগড় ছাড়িয়ে অধুনা নারায়ণপুর জেলার ভানুপ্রতাপপুর টাউন-সংলগ্ন পাখাঞ্জুর-কোয়েলিবেড়া-পদলকোট অঞ্চলে। অচিন গাঁয়ে জঙ্গুলের রুক্ষ প্রকৃতিতে অনভ্যস্ত দলিত বাঙালিরা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি যখন বাঙলায় ফেরত আসতে চাইলেন, তখন তাঁদের ঢালাও আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন যুক্তফ্রণ্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তারপর সেই দশকের শেষপাদে যখন তাঁদের একটা বড় অংশ উপস্থিত হল সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি সহ কিছু দ্বীপে, ততদিনে বামফ্রণ্ট সরকার এসে গিয়েছে। তারপরে কি হ’ল তা অনেক শ্যামলালই জানেন।
ইতিমধ্যে বস্তারের রাজাকে সরিয়ে গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে উপস্থিত হল ভারতরাজা। ক্ষতস্থানে প্রলেপ দেওয়ার নাম করে জনহিতৈষী কলেক্টর বি-ডি শর্মা এলেন, এবং কিছুকাল সত্যিই মানুষদের জন্য কাজ করলেন। কিন্তু যেখানে সিস্টেম বিরূপ, সিস্টেম যে ভাষা, বিচারব্যবস্থা, যুক্তিপদ্ধতি ও ন্যায়বোধে চালিত সেইখানে আদিবাসী মানুষদের কোনো জায়গা নেই, সেইখানে ‘ওয়েলফেয়ার’ শব্দটা হাস্যকর। ওয়াকিবহাল মাত্রেই জানবেন যে রেশনপ্রদত্ত হাইব্রিড চালের ঠেলায় আদিবাসীদের ব্যবহৃত কত অজস্র ধান-চালের স্ট্রেইন পর্যন্ত চিরকালের মত হারিয়ে গিয়েছে ‘ভালো-করার-রাজনীতি’র পরিণাম হিসেবে। আবার ইন্দিরা গাঁধী জবরদস্তি হাল-বলদ জুতিয়ে দিয়ে হালচাষে বাধ্য করেছেন অজস্র শিফটিং-কাল্টিভেশান, জুম-চাষ, ‘স্ল্যাশ-&-বার্ণ’-এ অভ্যস্ত আদিবাসী মানুষকে, যাঁদের কাছে হাল চাষ করা মানে পৃথিবী-মা-র স্তনকে ক্ষতবিক্ষত করা।
ইতিমধ্যে, নব্বইয়ের দশকে, বাঙ্গলা-বিহার-অন্ধ্র টপকে নকশালবাড়ির ফুলকি ছিটকে এলো বস্তারে। পাহাড়ে-জঙ্গলে জ্বলে উঠলো রাষ্ট্রদ্রোহের আগুন। ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’-এ কিছু মানুষের যাপন ও মননের আয়নায় জেগে উঠলো অধিকারবোধ, আবার কিছু মানুষের জীবন হয়ে গেলো ছারখার। ‘দলম’-এর ‘জনগণ-সরকার’এর শাসন-পদ্ধতি কিন্তু আদিবাসীদের শাসনপদ্ধতির মত ছিল না কোনোদিনই। নকশালবাদের ফলে বস্তারের মানুষদের সামগ্রিক উপকার হয়েছে কি অপকার তার বিচার ইতিহাস করুক; সে ধৃষ্টতা অধমের নেই।
এদিকে সরকারের টনক উঠলো নড়ে। নকশালবাদ চিহ্নিত হল ‘সিঙ্গল বিগেস্ট থ্রেট’ হিসেবে। শুরু হল পালটা মারের পালা। কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলে দ্রোহদমনের উদ্দ্যেশ্যে অঞ্চলের মানুষদের নানান গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার টেকনিক তথা ডিভাইড অ্যাণ্ড র্যুল আজ সুবিদিত। উনবিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশকে সাঁওতাল হুল দমন করার জন্য পুলিশের হাতে পাকড়াও হওয়া সাঁওতালদের দিয়েই বাহিনী গঠিত হয়েছিলো বিদ্রোহীদের গুপ্ত-ডেরাগুলিতে হানা দেওয়ার জন্য। আবার বিংশ শতকের আশির দশকে খলিস্তান আন্দোলন দমনের জন্যও এই পদ্ধতির ইস্তেমাল হল, নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীরের আজাদীকামী মানুষদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় হিংস্র বন্দুকধারী রেনেগেড-বাহিনী ‘ইখওয়ান’ – যে শব্দটির অর্থ ‘অন্ধ’।
একই পদ্ধতিতে, নকশাল-দমনের উদ্যেশ্যে সন ২০০৬তে সালওয়া জুডুম কম্যাণ্ডো-বাহিনী গঠিত হয় বস্তার সম্ভাগে।এই বাহিনীর পুরোভাগে ছিলেন ভা-ক-পা বিতাড়িত কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মা। বাহিনীর সদস্য হল ছোটো ছোটো আদিবাসী কিশোরেরা। তাদের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হতে লাগল এবং দুই সপ্তাহের ট্রেণিং দেওয়া হতে লাগল, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হল বস্তারের জংলা গাঁ-গঞ্জে যখন তখন হানা দেওয়ার, যত খুশি লুট, খুন, ধর্ষণ ও গৃহদাহ সংঘটিত করার। গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বলে ছাই হয়ে গেলো। তটস্ত আদিবাসীরা পাহাড়ি জঙ্গল ছেড়ে নেমে এলো পাকা-রাস্তা তথা হাইওয়ের দুইধারে খাঁচার মত করে তৈরী ‘ক্যাম্প’-গুলিতে। পাশাপাশি ‘কোয়া’-উপজাতির আদিবাসী কিশোর যুবকদের দিয়ে তৈরী হল কোয়া-কম্যাণ্ডো। একই ধরণের কার্য্যকলাপের উদ্দ্যেশ্যে। এই সবের জন্য টাকাপয়সা সহ সমস্ত সুবন্দোবস্ত করে দিলো সরকার।
এই সব ‘স্থানীয় কম্যাণ্ডো’-বাহিনীর পাশাপাশি জোরকদমে ‘মিলিটারাইসেশান’। স্থানীয় থানাগুলির হাতে চলে এল প্রচুর অর্থ, ক্ষমতা ও ক্ষমতার উৎস তথা ভয়াল অস্ত্রশস্ত্র। বস্তারজুড়ে প্রায় সমস্ত থানা পরিণত হল কাঁটাতার পাঁচিলে ঘেরা ক্যাম্পে। এবং একের পর এক আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হতে থাকল অঞ্চলে, অজস্র গ্রামকে ঘিরে ফেললো সি-আর-পি-এফ, বি-এস-এফ, কোব্রা ব্যাটেলিয়ন নাগা ব্যাটেলিয়নের ক্যাম্প। শক্ত নজরদারীতে ঘেরবন্দী হয়ে গেলো বস্তারের মানুষেরা। তার পাশাপাশি অন্ধ্রের কুখ্যাত নকশাল-দমক গোষ্ঠী ‘গ্রেহাঊণ্ড’ এসে করে যেতে লাগল একের পর এক এনকাউণ্টার। ২০০৮-এ যখন অপারেশান গ্রীণ হাণ্ট আরম্ভ হয় তখন থেকে আজ অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ২০১৬ অবধি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছে বস্তারে। ২০১৩র অক্টোবরে, মানে ছত্তিসগড় রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে আগে দ্য হিন্দুর শুভজিত বাগচীর প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে
বিজাপুর জেলার যে’সব অঞ্চলে নকশাল-বনাম-রাষ্ট্র সংঘাত চরম ভাবে প্রকট, সে’সব অঞ্চলে ফৌজি বনাম সাধারণ মানুষের সংখ্যাগত অনুপাত ১:২। শ্রীবাগচির এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আঠাশ মাস কেটে গিয়েছে। আরো আরো ফৌজি মোতায়েন করা হয়েছে অঞ্চলে। তাছাড়াও গড়ে উঠেছে পুলিশের ‘স্পেশালি ট্রেইণ্ড ফোর্স’ বা ‘এস-টি-এফ’। ভিলাই থেকে বস্তারে নজর রাখার জন্য ওড়ানো হয়েছে ড্রোণ। এবং, যদিও সুপ্রীম কোর্ট ২০১১ সালেই সলওয়া জুড়ুমকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছিলো, তবুও, কোয়া কম্যান্ডো-বাহিনীর পাশাপাশি, এই ২০১৬র মার্চ মাসেই, ছত্তিসগড় সরকার ঘোষণা করেছে যে ‘স্থানীয়’ কম্যাণ্ডোবাহিনী গঠন করা হচ্ছে নকশালদমনের অভিপ্রায়ে।
ইতিমধ্যে, ২০১৫-১৬ সাল জুড়ে বস্তারের বিভিন্ন টাউনে, মূলত জগদলপুর ও দান্তেওয়াড়া শহরে, পুলিশের প্রত্যক্ষ মদত ও ইন্ধনে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ‘ভিজিলাণ্টে’ বাহিনী, যথা – ‘সামাজিক একটা মঞ্চ’, ‘নকশাল পীড়িত সংঘর্ষ সমিতি’ প্রভৃতি। এই সকল বাহিনীর মাথায় রয়েছেন সলওয়া জুড়ুমের বিভিন্ন নেতা, এবং এই সকল গোষ্ঠী যদিও নিজেদেরকে বস্তারের অধিবাসী দাবী করে, খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে এই সকলের সদস্য ও ‘সভ্য’-বৃন্দ উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ, তেলেঙ্গানা থেকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আগত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত টাউনবাসী। আসলে টাউন অঞ্চলের ফর্মাল বা এমন কি ইনফর্মাল আর্থনৈতিক কাঠামোতেও আদিবাসীদের স্থান নেই, যদিও বস্তারের জনসংখ্যার প্রায় ৭০%ই গোঁড় আদিবাসী। তো, এই বাহিনীগুলির আপাতত মূল কাজ হল এই সব টাউনের শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন যে’সব অ্যাক্টিভিস্ট, মানবাধিকার রক্ষক, উকিল ও সাংবাদিকেরা নকশালদমনের নামে আদিবাসীদের উপর নেমে আসা বিভীষিকার প্রতিবাদে মূখর হয়েছেন, তাদের ভয় দেখানো, কুশপুত্তলিকা দাহ করা, বাড়িতে ঢিল ছোঁড়া, শুনিয়ে শুনিয়ে চেতাবনী-মূলক স্লোগান আওড়ানো, মৃত্যুভয় দেখানো প্রভৃতি; এবং এই সকল গোষ্ঠির বিভিন্ন কার্য্যকলাপের সময় উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে কখনো বস্তার সম্ভাগের পুলিসের ইন্সপেক্টর জেনারেল কল্লুরিকে, কখনো বা বস্তার ও দান্তেওয়াড়া জেলার পুলিশের সুপারিণ্টেণ্ডেন্টকে।
বলা বাহুল্য, এ’সবের ফলে সমগ্র বস্তার জুড়ে আদিবাসী মানুষদের উপর নেমে এসেছে চরমতম বিভীষিকা। ২০১১ সাল থেকে আজ অবধি নকশাল-দমনের নামে যে সকল নারকলীলা গুলজার করেছে রাষ্টড়বাহিনী, তার মধ্যে নিদারুণতম কয়েকটির ফিরিস্তি দেওয়া হল –
১) সন ২০১১র মার্চ ১১ থেকে মার্চ ১৬ অবধি সি-আর-পি-এফ-এর বিশেষ প্রশিক্ষিত বাহিনী কোব্রা ব্যাটেলিয়ন এবং কোয়া কিশোর-যুবকদের দিয়ে তৈরী ‘কোয়া ব্যাটেলিয়ন’ সুকমা এবং দান্তেওয়াড়া জেলার চিন্তালনাড় থানার অন্তর্ভুক্ত তাড়মেটলা ও মোরপল্লি গ্রামে তাণ্ডবলীলা চালায়। ৩০০র বেশী বাড়ি সংলগ্ন খেতি সমেত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তিনজন গ্রামবাসীকে খুন এবং তিনজন মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। সংবাদমাধ্যমকে আটকানোর জন্য কোয়া ব্যাটেলিয়ন গ্রামগুলি ঘিরে ফেলে। দান্তেওয়াড়া প্রশাসন যখন রিলিফের জন্য ট্রাকভর্তী রেশন পাঠায়, তখন এই বাহিনীর সদস্যরা ড্রাইভারকে বেদম প্রহার করে ট্রাকটি লুঠ করে।
২) ২০১২ সালের ২৮ ও ২৯শে জুনের রাত্রে সুকমা জেলার সার্কেগুড়া, কোট্টাগুড়া ও রাজপেণ্টা গ্রামের গ্রামবাসীরা জমায়েত হয়েছিলেন বীজ-বপনের উৎসব ‘বীজ-পাণ্ডুম’ উদযাপনের প্ল্যান করতে। সি-আর-পি-এফ বাহিনী গ্রামতিনটি চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে বেপরোয়া গুলি চালায়। ১৯জন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয় এবং অসংখ্যজন আহত হন।
৩) একই ভাবে ২০১৩র জুন মাসে বিজাপুর জেলার এডাস্মেটা গ্রামে রাষ্ট্রবাহিনীর বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ৮জন গ্রামবাসী প্রাণ হারান এবং ৪জন গুরুতর ভাবে জখম হন।
৪) ২০১৪ সালের ২৮শে জুলাই সি-আর-পি-এফ এবং পুলিশের যৌথবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান সুকমা জেলার রামারাম এবং পিড়মেল গ্রামের অধিবাসী ভেট্টি হাড়মে ও মরকম ইড়মল। গ্রামবাসীরা একত্রে জানাচ্ছেন, জানিয়েছেন, এঁরা কোনোপ্রকার নকশাল কার্যকলাপের সাথে কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না।
৫) ডিসেম্বর ২, ২০১৪ তারিখে নারায়ণপুর জেলার নেলনার জঙ্গলে মাছ ধরতে গিয়েছিলো লখমু, বিজন ও রামসাই। রাষ্ট্রবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান। রাষ্ট্র তাঁদের ছিপ দেখে ঘোষণা করে যে তাঁরা প্রবল রাষ্ট্রদ্রোহী ছিলেন কারণ তাঁরা ছিপের মত ভয়াল অস্ত্র হাতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন।
৬) ২৮শে জুলাই ২০১৫ পুলিশ, কেন্দ্রীয়-বাহিনী এবং রেনেগেড-নকশালদের এক বিরাট যৌথবাহিনী উপস্থিত হয় দান্তেওয়াড়া জেলার অরণপূর থানাভুক্ত নাহাড়ি গ্রামে। ঘর থেকে ঘর গিয়ে গ্রামবাসীদের পেটানো শুরু করে। নিস্তার পান না অন্তঃসত্বা মহিলারাও। হেমলা পোড়িয়া নামের এক গ্রামবাসীকে ১০০মি রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা হয়। তার রক্তে ধোয়া মাটি খুঁড়ে তুলে নেওয়া হয়। তাঁর বোনকে শাসানো হয় জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলা হবে বলে, মা ও বউকে বেধড়ক পেটানো হয়। ১৮-জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশি বয়ানে, এঁরা সবাই নকশাল। আসলে এরা আসেপাসের গ্রামের একটি সাংস্কৃতিক দলের যুবক-যুবতী ও শিশু।
৭) ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০১৫। দান্তেওয়াড়া জেলার দরভা থানাস্থ বদ্রিমারু গ্রামের কিছু মানুষকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিলো। সেই বিষয়ে খবর করতে সেইখানে উপস্থিত হন সাংবাদিক সন্তোষ যাদব; বাদানুবাদের ফলে সেই একই মামলায় মিথ্যা চার্জ বানিয়ে সন্তোষ যাদবকে অ্যারেস্ট করা হল। এর আগেও নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য তাঁকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, থানায় বিবস্ত্র করে পেটানোও হয়েছে।
৮) ২০১৫ সালের অক্টোবর ২০ থেকে অক্টোবর ২৪। বিজাপুর জেলার বাসাগুড়া থানার অন্তর্গত চিন্নেগেল্লুর, পেড্ডাগেল্লুর, গুণ্ডাম, পেগডাপল্লি ও বুরগিচেরু গ্রামে উপস্থিত হয় সি-আর-পি-এফ। শুরু হয় লাগাতার গণধর্ষণ। ৪০-এর বেশী আদিবাসী মহিলা ধর্ষিতা হন। তার মধ্যে কিশোরী থেকে অন্তঃসত্ত্বা, প্রৌঢ়া, কেউ-ই বাদ জান নি। মেয়ের ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে নেমে ধর্ষিতা হন মা। ১৪ বছরের এক কিশোরী গরু চড়াতে গিয়েছিলো। সি-আর-পি-এফের বেশ কিছু বীর জওয়ানেরা মিলে তাকে ধাওয়া করে, মাটির সাথে ফেলে চোখ বেঁধে দেয়, বারংবার গণধর্ষণে সংজ্ঞা হারায় সে। আরেক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে ধর্ষণ করে পাহাড়ি নালায় ফেলে দেওয়া হয়। বহু মহিলাকে বিবস্ত্র করে থাইয়ে প্রহার করা হয় এবং যোনীতে লঙ্কার গুঁড়ো ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। দুই সদ্য মা-র স্তন কছলে দুধ বের করে দেশসেবক বীরপুঙ্গবেরা। সদ্য-মা হওয়া বহু নারীকে শিশুসমেত বেদম প্রহার করা হয়, চুল ছিঁড়ে দেওয়া হয় টেনে টেনে এবং ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। খাদ্যশস্য ও মশলাপাতির কিছু দিয়ে রাষ্ট্রবাহিনী নিজেদের জন্য খাবার বানায়, কিছু লুঠ করে নেয়, বাকি নষ্ট করে দেয়। সমস্ত ঘর থেকে পয়সাকড়ি লুঠ করে নেওয়া হয়। বুর্গিচেরু গ্রামের একটি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
৯) তেশরা নভেম্বর ২০১৫। সুকমা জেলার কুখ্যাত ক্যাম্প-থানা দোর্ণাপালের অন্তর্গত অর্লমপল্লী গ্রামের তিন নাবালক – দুধি ভিমা, ভেত্তি লাচ্চু ও সোধি মুয়া বেরিয়েছিলো জঙ্গল থেকে মহুয়াফুল সংগ্রহে। এমন সময় পুলিশবাহিনী চড়াও হয়ে এদের মধ্যে একজনকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। সে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। বাকি দুইজনকে বলা হয় তাদের বন্ধুর লাশ বয়ে নিয়ে যেতে পোলমপল্লী থানা অবধি। থানার কাছাকাছি যখন তারা পৌঁছোয়, তাদেরও গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
১০) ১২ই জানুয়ারী ২০১৬। সুরক্ষাবাহিনীর এক বিরাট দল উপস্থিত হল সুকমা জেলার কুকানার থানাস্থ কুন্না ও তার পার্শবর্তী কিছু গ্রামে। ভয়ের চোটে বেশ কিছু মানুষ আশ্রয় নিলেন নিকটবর্তী জঙ্গলে। যাঁরা পরে রইলেন তাঁদের মধ্যে পুরুষদের কপালে জুটল বেদম প্রহার, নারীদের ধর্ষণ। একজন পুরুষ মারের চোটে প্রাণ হারালেন, আরেকজন হারালেন চলৎশক্তি। সাতাশজন মহিলাকে একটি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করা হল।
১১) ১১ই থেকে ১৪ই জানুয়ারী ২০১৬। বিজাপুর জেলার বাসাগুড়া থানার অধীন বেল্লামনেন্দ্রা গ্রাম। হামলে পড়ল বিপুল সুরক্ষাবাহিনীর। দুই রাত জুড়ে চলল লুঠতরাজ। রেশনের চাল-ডাল-তেলনুনলকড়ি ছিনিয়ে নেওয়া হল। কিছু মহিলাকে পেটানো হল, বাকিদের গণধর্ষণ। একজন মহিলাকে মশারি দিয়ে জালবন্দী করে রেপ করল পুলিশ ও জওয়ানেরা। পাঁচজন জওয়ান মিলে একটা ঘরে ঢুকে মা ও মেয়েকে পাশাপাশি ফেলে বারংবার ধর্ষণ করল। মোটমাট জনা ১৩ গ্যাংরেপের ঘটনা সামনে এসেছে; তাছাড়াও প্রবলভাবে শাসানো হয়ছে গ্রামবাসীদের এবং মারের চোটে বেশ কিছু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। জঙ্গলের দিকে তাক করে দুই রাউণ্ড ‘ব্লাইণ্ড ফায়ারিং’-ও করা হয়। অভিযোগ জানাতে বেশ কিছু মহিলা বিজাপুরে গিয়েছিলেন, কিন্তু গুণ্ডাবাহিনী ‘নকশাল পীড়িত সংঘর্ষ সমিতি’র শাসানিতে অভিযোগ না জানিয়েই তাঁরা ফেরৎ আসতে বাধ্য হন।
১২) ১৭-২০শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৬। জগদলপুর টাউনে বারংবার ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’, ‘নকশাল পীড়িত সংঘর্ষ সমিতি’ প্রভৃতির হামলা, গাড়ি ও বাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া, কুশপুত্তলিকা দাহ প্রভৃতির শিকার হয়ে, এবং পুলিশের বারবার বাড়িওয়ালা ও গৃহকর্মীদের থানায় তুলে জেরা করার কারণে সপরিবার বস্তার ছাড়তে বাধ্য হলেন সাংবাদিক এবং রেড ক্রস ইণ্টার্ন্যাশানালের প্রাক্তন প্রধান মালিনী সুব্রমনিয়াম, যিনি ফৌজি কর্তৃক গণধর্ষণ-গুলির কথা সংবাদমাধ্যমের আলোয় এনেছিলেন। একই সাথে এবং একই কারণে জগদলপুর ছাড়তে বাধ্য হলেন জগদলপুর লীগাল এড গ্রুপ (জ্যাগল্যাগ)-এর ঈশা খাণ্ডেলওয়াল এবং শালিনী গেরা। জগদলপুর লীগাল এড গ্রুপ ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে বস্তার সম্ভাগে ‘দেশদ্রোহ’র চার্জ খাওয়া এবং কাস্টডিতে, লকাপে, জেলে বিনা অথবা নামমাত্র বিচারে আণ্ডার-ট্রায়াল অবস্থায় বছরের পর বছর যে সকল গরীব আদিবাসীরা পড়ে থাকতেন, এবং, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই, বহু বছরব্যাপী প্রহসনী বিচারের পর সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে নির্দোষ ঘোষিত হতেন, তাঁদের আইনী সহায়তা দিত। জগদলপুর/বস্তার ও দান্তেওয়াড়ার ট্রায়াল কোর্টের অন্যান্য উকিলদের একটা বড় অংশ কোমোড় বেঁধেই ছিলেন ওঁদের উৎখাত করার জন্য, ২০১৫র মাঝামাঝি সময় এই দুই কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশান এই মর্মে রেসল্যুশান বের করে যে এঁদের প্র্যাক্টিস করতে দেওয়া হবে না। ১৭-২০শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পর পুনরুদ্যমে বস্তার বার অ্যাসোসিয়েশানের কিছু উকিল জানান যে এর পর যদি কোনো ঘটনার ফলে এঁরা আহত হন, বস্তার বার অ্যাসোসিয়েশান তার দায়িত্ব নিতে পারবে না। ২০শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যে নাগাদ বস্তারের আই-জি এস-আর-পি কল্লুরির বিরুদ্ধে এস-সি এস-টি (প্রিভেনশান অব অ্যাট্রোসিটিস) আইন অনুসারে নালিশ রুজু করার বিফল প্রয়াসের পর যখন দান্তেওয়াড়ার গীদম টাউন থেকে নিজের গ্রাম সামেলির দিকে যাচ্ছিলেন বস্তারের জননেত্রী তথা জ্যগল্যাগেরই এক ক্লায়েণ্ট সোনি সোরি, তখন তাঁর মুখে তীব্র কেমিকাল পদার্থ ছুঁড়ে মেরে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায়ে অজ্ঞাতপরিচয় কিছু বাইকারোহী, তাঁকে বলা হয়, কল্লুরির পিছনে লেগে তিনি বিরাট ভুল করেছেন।
আহত সোনিকে ভর্তি করা হয় দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে। দেশজুড়ে তীব্র নিন্দার ঝড় উঠলে ছত্তিসগড় সরকার ও বস্তার পুলিশের আই-জি উক্ত কল্লুরি তড়িঘড়ি ইনভেস্টিগেশান টীম বানায়। অভিযোগের ভিত্তিতে ন্যাশানাল হিউম্যান রাইটস কমিশন থেকেও দল যায় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। ইনভেস্টিগেশান টীমের তরফ থেকে, এবং তাঁদেরই পাশাপাশি কল্লুরি, বস্তার জেলার কলেক্টর অমিত কাটারিয়া এবং ঐ অঞ্চলের প্রাইম মিনিস্টার্স রুরাল ডেভেলপমেণ্ট ফেলো অরিব অহমেদ বারংবার প্রেস কনফারেন্স, ফেসবুক প্রভৃতির মাধ্যমে যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন বিভিন্ন সময় তা হল –
ক। সোনি সোরি আদৌ আহত হন নি, তিনি অভিনয় করছেন
খ। সোনি সোরির আঘার গুরুতর নয়
গ। সোনি সোরির আক্রমণের পিছনে হাত রয়েছে তাঁর জামাইবাবু অজয় এবং ভাগ্নে লিঙ্গারামের
ঘ। মালিনীর বাড়িতে ও গাড়িতে, তাঁর দুই নাবালিকা সন্তানের উপস্থিতিতে ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’র গুণ্ডাদের পাথর ছোঁড়া এবং ভয় দেখানো স্লোগানগর্জন করা ছিলো নকশালদের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের শান্তিকামী মানুষদের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ।
ঙ। সোনি, লিঙ্গারাম, মালিনী, শালিনী, ঈশা, এবং এঁদের সমর্থনে সওয়াল তোলা দেশ ও বিদেশ ব্যাপী সংবাদমাধ্যমসমূহ – যথা টাইমস অব ইণ্ডিয়া, ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য হিন্দু, বি-বি-সি, আল জাজীরা, দ্য টেলিগ্রাফ – সবাই হয় নকশাল নয় নকশাল সিম্প্যাথাইসার।
ইত্যাদি।
সোনির উপর হওয়া এই হামলার তদন্তের নামে ১লা মার্চ ২০১৬তে এক দিনের জন্য সোনির জামাইবাবু অজয় মরকমকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ৯-১০ই মার্চ আবার তোলা হয় অজয়, তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ সোনির বোন ধানি, এবং অজয়ের দুই বন্ধুকে। অজয়কে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মারধোর করা হয়। ওঁদের বারবার চাপ দেওয়া হয় স্বীকার করে নিতে যে সোনির উপর হামলা করেছেন সোনির ভাগ্নে লিঙ্গারাম এবং অজয় স্বয়ং। ছেড়ে দেওয়ার সময় শাসানো হয় এই মর্মে যে এই জেরার কথা কাউকে বললে তাঁদের আবার উঠয়ে নেবে পুলিশ। যখন এই জেরা চলছিল তখন কল্লুরির সাথে দেখা করতে যান সোনির বৃদ্ধ পিতা তথা বস্তার সম্ভাগের বহুদিনের নিষ্ঠাবান সি-পি-আই সদস্য মুণ্ড্রারাম কোড়োপি, অজয়ের মা পালি মারকাম ও বোন জ্যোতি সোরি। উক্ত বস্তার পুলিশের আই-জি তাঁদের নিকৃষ্ট ভাষায় গালিগালাজ করে শাসানি দেয় যে সোনি ও লিঙ্গাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে এবং সমস্ত পরিবারকে ধ্বংস করে ফেলবে সে।
১৩) ২১শে মার্চ ২০১৬। বস্তার সম্ভাগ জুড়ে সন্তোষ যাদব, মালিনী সুব্রমনিয়ামদের মতোই নির্ভীক সাংবাদিকতার মাধ্যমে পুলিশি ও ফৌজি বর্বরতার বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছিলেন প্রভাত সিং। এর জন্য কল্লুরির কুনজরে পড়ে যান তিনি। ২০১৫ সালের এক সাংবাদিক সম্মেলনে কল্লুরি জানায় যে প্রভাতের ‘কুণ্ডলী’ তার কাছে আছে এবং প্রভাতকে উচিৎ শিক্ষা দেবে সে। তারপর, ২১শে মার্চ ২০১৬ প্রভাতকে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কাস্টডিতে তাঁর আঙুলে, হাতে তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। ইনফর্মেশান টেকনলজি আইন লঙ্ঘণের দায়ে তাঁর চার্জশীট খচিত হয় এবং বেল আবেদন খারিজ করা হয় আদালত থেকে – ‘রিম্যাণ্ডেড টু জ্যুডিশিয়াল কাস্টডি’, অর্থাৎ, আণ্ডার-ট্রায়াল বন্দী হিসেবে জেলে চালান করা হয়। এখন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ২০১৬ রাত ২২:২৩ অবধি তিনি জেলেই আছেন। যেইদিন প্রভাতকে অ্যারেস্ট করা হল, সেইদিন সকালেই প্রভাতকে ‘লেটার অব টার্মিনেশান’ পাঠায় তাঁর প্রাক্তন আপিস – সর্ববিদিত ই-টি-ভি।
১) থেকে ১৩) অবধি যে’সকল ঘটনার কথা লেখা হল, সেগুলি বিক্ষিপ্ত নয়। এইরকম অজস্র ঘটনা নিয়ত ঘটে চলেছে বস্তারে সন ২০০৬ থেকে আজ অবধি। সবকটা প্রচারমাধ্যমের গোচর হয় না, এবং যেগুলি হয় সেগুলিও নানান মিডিয়া নানান উদ্দ্যেশ্যে প্রণোদিত হয়ে নানান রঙে রাঙিয়ে তুলে ধরে। সবকটির বিষয়ে লিখতে বসলে এই লেখা্র আয়তন শ্রী দুর্গাদাস বসু প্রণীত বারো খণ্ডের ‘কন্সটিটিউশান অব ইণ্ডিয়া’ অপেক্ষা বিপুলতর আকার ধারণ করবে।
এই সকল ঘটনায় বিভিন্ন নাম বারবার সামনে আসে। যে’রকম বস্তার সম্ভাগের বর্তমান পুলিশ আই-জি এস-আর-পি কল্লুরি। ২০১১ সালের তাড়মেটলা হত্যালীলার মূল কাণ্ডারী ছিল এই অবতার, দান্তেওয়াড়ার এস-এস-পি হিসেবে। তারও আগে যখন উত্তর ছত্তিসগড়ের সরিগুজা অঞ্চলে এক থানার ও-সি ছিলেন তিনি, তখন তাঁর তত্ত্বাবধানে লেধাবাঈ নাম্নী এক আদিবাসী মহিলাকে দিনের পর দিন লকাপে উলঙ্গ অবস্থায় রাখা এবং পুনঃপুনঃ গণধর্ষণ করা হয়। তারপর দান্তেওয়াড়ার এস-এস-পি এবং অবশেষে সমগ্র বস্তার-পুলিশের প্রধান হিসেবে তার একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কীর্তিকলাপ সামনে আসতে থাকে। প্রকাশ্যে সোনি সোরি, লিঙ্গারাম কোড়োপি, প্রভাৎ সিং প্রমূখকে হুমকি দিতে থাকেন, কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই বিভিন্ন ঘটনার ‘মাস্টারমাইণ্ড’ হিসেবে সোনি ও লিঙ্গার নাম করতে থাকেন তিনি। নানান প্রোমোশান ও সম্মাননায় ভূষিত তিনি। এইরকম আর এক অবতার অঙ্কিত গার্গ, যার তত্ত্বাবধানে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসের ৮ থেকে ১১ তারিখ অবধি সোনি সোরিকে কাস্টডিতে জেরার নামে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়, বিবস্ত্র করে গণধর্ষণ করে তাঁর যোনিতে পাথর গেঁথে দেওয়া হয়। এই বীরপুঙ্গবের শৌর্য্যবীর্যের সম্মাননায় তাঁকে সোনার মেডেলে ভূষিত করেছেন দেশের রাষ্ট্রপতি। এদের, বা এদের হুকুম তামিল করতে থাকা পুলিশেরা, এবং আধাসামরিক ও লোকাল কম্যাণ্ডো-বাহিনীর খুনী-ধর্ষকদের মধ্যে একজনেরও আজ অবধি শাস্তি হয় নি কোনো।
আসলে, এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে হলেও তো তা করতে হবে পুলিশের কাছেই। আর পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে যেই যাবেন তিনিই তৎক্ষণাৎ পুলিশের নজরে পড়ে যাবেন, তারপর যেকোনো একদিন তাঁকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হবে কাস্টডিতে, নকশাল-কেস লাগিয়ে দেওয়া হবে, নয়তো এনকাউণ্টার।