বস্তারে বৃষ্টি এলো। চার মাস চড়া রোদ্দুরে ধুঁকে সেঁকে খয়েরী হয়ে গিয়েছিলো এই অপসৃয়মান অথচ বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। তারপর হঠাৎ যেন চোখের সামনেই ঝাড়া দিয়ে উঠছে সবুজের অভিযান। ক্লোরোফিলে ক্লোরোফিলে মরুবিজয়ের কেতন। সবুজ পাহাড় ঘিরে রেখেছে মেঘের পরদা। শুখা নালা-নদীখাত দিয়ে হুহু করে ছুটে চলেছে জল, ক্ষেতে ক্ষেতে হিল্লোল, বনস্পতি, ঝোপ-ঝাড় সবেতেই নতুন স্পন্দন। তার সাথেই ডানায় ডানা মিলিয়ে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য অজস্র প্রজাপতি – কোনোটার হলুদ পাখা, কোনোটার সবুজ, কোনোটার কালো পাখায় হলদে সাদা ছিট-ছিট।
শাল, আসন, কুসুম, মহুয়া, অর্জুন, গরাঞ্চি, পিয়াশাল, ধাওরা, কেন্দু, জাম, খারপাত, আমলকি, হত্তুকী, পোলা, কুমকুম, অমলতাস, চিরোঞ্জি সহ ১৩৭ ধরণের বনস্পতি, ৮০-টা ফ্যামিলির ৪৬৫ প্রজাতির লতাগাছ, ১০৩ রকমের গুল্ম (শ্রাব) এবং ২২৫ প্রজাতির আর্ব – সমস্তই বর্ষার অঝোরধারে জীবনের ছোঁয়া পেয়ে দেখতে দেখতে ডাল-পালা-শিকড়-বাকড় বিস্তার করে সমস্ত বস্তারকে কোলে তুলে নিলো। এই সব গাছপালার মধ্যে ৩৫ শতাংশই বনৌষধি।
এই হিসেবটা রাওঘাট মাইনিং প্রজেক্টের নিরিখে ন্যশানাল এনভায়রনমেন্টাল এনজিনিয়ারিং রিসার্চ ইন্সটিট্যুটের দেওয়া, এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতীত হয়েছি – হিসেব অসম্পুর্ণ। উপরোক্ত গাছপালা ছাড়াও এখানে বেড়ে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বেড়ে উঠছে শেগুন, বীজা, কাসাহি, সালীহা, শিমুল, পলাশ, তমাল, ঢোঢেরা, মোকইয়া, বুনো হলুদ, ধাওরা (রেশম – যে গাছের পাতা খেয়ে রেশম-মথেরা তশর সিল্ক বানায়), বেহাদা বা বিভীতক, কররা, ফলসা, বট, তেঁতুল, জাম, ছিন্দ (খেজুর-গোত্রীয়), সালফি, তাড়ি, নোনা, কোলিয়ারি, বোইর, বিরিয়া, তেন্দু, আম, বুনো কলা, চার, চারোটা, বাঁশ, কসহী, বকফুল, কাঁঠাল, করাট, পিপুল, বেল, কুররু, কাজু, নীম, ভেলোয়া, করচ, জ-ফুল, গোলাপ, কাগজ-ফুল, পদ্ম, চামেলী, লিলি, সেবন্তী, নয়নতারা, গাঁদা, সদাবাহার, ডুমুর, শিশু, পেঁপে, ধুতরো, নারকেল, ফুলহড়, সীহাড়ী, গঙ্গাকোরই, বাগারাণ্ডা, করোদা, কাড়হী, আঙুর, কমলা, বাবলা, সিঁদুর, টিমসা, করমচা, খৈরী, চিল্লা, পেণ্ড্রা, কমলা, ভারদা, গিরডৌল, কুকুর জাম, কুচিলা, গাম্বার, পুঁই, ফাংলতা, শিয়ালি-লতা, চাহা-মুরাল, কেউটি-লতা, মাধবী-লতা, আলতী-লতা, মে-লতা, শীম-লতা, বরবটি-লতা, পাতাল কুমড়ো, বোদেলি, কোড়ওয়াড়ী লতা, করু-তুমা প্রভৃতি।
এই তালিকাটিও সম্পুর্ণ নয়। কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলার জঙ্গলে ঢাকা গ্রাম গ্রামাঞ্চল ঘুরে যতটুকু জেনেছি, এই বিপুল উদ্ভিদ-বৈচিত্রের কথা, লিখে রাখলাম। এই সব গাছ-গাছালির নিবিড় আবরণ এইখানকের মানুষদের দিয়েছে সুখ ও সমৃদ্ধি – যার হিসেব আমরা যারা জিডিপি-মুখী সমৃদ্ধির হিসেবে অভ্যস্ত – আমরা পারব না, যে’রকম আমরা পারবো না বুঝতে কেন টাকা-পয়সা, জমি-জিরেৎ মিলিয়ে ব্যক্তিমালিকানার যে আয়তনটুকু, তার বাইরের বিশাল এই অলীক-লোকের ভালোথাকার খতিয়ান। এই ভালো থাকা গুলোকে জে-সি-বির তলায় পিশে দিলেই যে আমাদের ভালো থাকা শুরু হয়, মাটির তলা থেকে লোহা ওঠা, কয়লা ওঠে, যন্ত্রপাতিগুলোর চাকাচক্করগুলো ঘুরতে থাকে বন-বন-বন, আর আমরা ছুটতে থাকি ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’-এর পথে।
অরণ্য তার অগণন সন্ততীদের জন্য যুগ-যুগান্ত ধরে সাজিয়ে রেখেছে খাদ্য তথা পুষ্টি-সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য-সুরক্ষার ঢালাও আয়োজন। কাঁকের-নারায়ণপুরের গ্রামগুলিতে বনৌষধি হিসেবে কাজে লাগে আম, আমলকি, হত্তুকী, ভেলওয়া, বজ্রদন্তী, পাঠ-জড়ী, ফলসা, বকফুল, রসনা, ভাসাম-পাত্রী, ভরহা, পোটর, হলুদ ফুল, ভুঁইনিম, নিমপাতা, মোগ্রালাটা, কুমড়ো-পাতা, ভালু-মুএসলি, সাদা মুএসলি, চার, লাসা, ফুটু, বোডা, অর্জুন গাছের ছাল, বেল, লেজোমররা, ভুঁইকুমড়ো, পৈরা-ফুটু ও নানাবিধ ব্যাঙের ছাতা, পোকামাকড়ের শুকানো মাংস প্রভৃতি থেকে তৈরী হয় নানাবিধ ওষুধ। উপশমের উপাচারও নানাবিধ। কয়েকটা উদাহারণ দেখা যাক –
১) আমাশা হলে আমের ছাল পিষে জলে গুলে, কিম্বা জলে লেবু আর নুন মিশিয়ে, কিম্বা তেঁতুল আর মধু মিশিয়ে, কিম্বা তেন্দুফল থেঁতো করে জলে মিশিয়ে খেয়ে নিলে ওষুধের কাজ হয়
২) রক্তামাশা হলে আমের ছাল পিষে জলে মিশিয়ে অথবা শাল-গাছের রস জলে মিশিয়ে তা খেলে কাজে দেয়
৩) চোট-আঘাতে চুন-তামাক মিশিয়ে তার সাথে নুন আর লাল মরিচ মিশিয়ে লাগালে কাজে দেয়। আবার বাঁশের বাইরের অথবা ভিতরের সাদা পরতটা ছুলে নিয়ে ক্ষতস্থানে লাগালেও উপশম হয়
৪) টাগরায় চোট লাগলে ভেলোয়ার বীজ গরম করে চোটের জায়গাটার সাথে চেপে রাখলে কাজে দেয়
৫) জ্বর হলে শরীরে লাল পিঁপড়ের কামড় কাজে দেয়, অথবা লাল পিঁপড়ের চাটনী করেও খেয়ে নেওয়া যায়। আরেকটা উপায় হল যদি এক-হাঁড়ি জলে প্রমাণ-পরিমাণ কারসর পাতা ফেলে পাতাগুলো মিশে যাওয়া অবধি জলটা ফোটানো যায়, এবং তারপর সেই হাঁড়িটা অসুস্থ ব্যক্তির শরীরের কাছাকাছি রাখা যায় যতক্ষণ ধোঁয়া এবং তাপে দরদর করে ঘাম ঝরা শুরু হচ্ছে, তাহলে সেই ঘাম দিয়ে জ্বর সেরে যায়।
৬) সর্দী-জ্বর হলে সরসে এবং টোরার তেল একসাথে মিশিয়ে নাকে এবং শরীরে আচ্ছাসে মেখে নিলে কাজে দেয়, শুকনো নীল-পাতাও কাজে দেয়।
৭) গর্মী হলে ছিন্দ থেকে গুড় বানিয়ে খেলে শরীর ঠাণ্ডা হয়
৮) ম্যালেরিয়া হলে সুআ কান্দা (কান্দা অর্থে টিউবার), ভুঁই করলা বা ভুঁইনীম-পাতা কাজে দেয়
৯) মধুমেহর মোক্ষম দাওয়াই হল গোদো-চাল
১০) সাপ কামড়ালে ছেনা গাছের আঁশ চিবোলে বিষের প্রভাব কমে
১১) পেট পরিষ্কার করতে পুরোনো তেঁতুল ভিজিয়ে নিয়ে চিবোনো যায় বা জলে মিশিয়ে খাওয়া যায়
১২) পেট ব্যথা কমে দেশী মুর্গীর ডিমে
১৩) গ্যাস সারে ভস্ম-পাতার চাটনীতে
১৪) জণ্ডিসে ‘অমর’ বেল থেঁতো করে খেয়ে নিলে কাজ দেয়
এরকম আরও অজস্র অসংখ্য উদাহারণ রয়েছে। একটু একটু করে আমরা অরণ্য-নাম্নী প্রাকৃত-ডাক্তারকে চিনছি। কিন্তু শুধু ওষুধই তো নয়, খাবার-দাবার, পোশাক থেকে শুরু করে আদিবাসী জীবনের সমস্ত পরতে পরতে ছায়া ফেলেছে জঙ্গলের মায়া-স্পর্শ। নানান শাকসবজি যেইসব টিউবার, শিকড় ইত্যাদি থেকে আসে এবং খাদ্য ও পুষ্টি-সুরক্ষার বুনিয়াদ গড়ে তোলে, সে’সবের উদাহারণ শিখে নেওয়া যাক কিছু – কোসা কান্দা, কেউ কান্দা, কারু কান্দা, শিমুল-গাছের শিকড়, তরঙ্গায়া কান্দা, রাঙালু, রিঠা গাছের টিউবার, ডাঙরকান্দা, মোষডাঁটা গাছের টিউবার, ছিন্দ গাছের টিউবার, কচু (শাক ও শিকড়), উস্কা কান্দা, কুমড়ো, টিকরা কান্দা, বুনো হলুদ, কাঁচকলা, কাঁকড়ি, জগা, শিম, বুনোকলা, বরবটি, মডদী, বোদেল, বইহা কান্দা, ড্রডী, পাতাল কুমড়ো, মাটওয়াডী, কিসন্তা, বইহা, জড়ী কোসা, বড় ছিন্দ – এই সব দিয়ে সবজি বানানো হয়, আর শাকপাতার মধ্যে রয়েছে কোলিয়ারি, কাটিন, বুনো খেক্সীপাতা, খারকোল, পুঁই, ধোবা, কেনী, চাটী, গুডরু, বোহাড়, বুড়কাড়, পিকড়ী, কুরকুড প্রভৃতি। এছাড়াও জলে বাড়ে চুনচুনিয়া, গুডরু, কেসরুআ, ডীস-কান্দা, পানিফল, কুকড়ি, দুলওয়া ইত্যাদি। এগুলো খেয়ে এবং উদ্বৃত্তটুকু হাটবারের দিন বেচে দিয়ে প্রাগ-ইতিহাস সময় থেকে ভালোই ছিলো মানুষেরা। তারপর ঘনিয়ে এলো ভয়ঙ্কর।
সেই ভয়ঙ্কর নিয়ে আলোচনা করেছি, পরেও করব, আপাতত আমরা দেখছি কী ভাবে নিবিড় জঙ্গলের আশ্চর্য্য জৈব-বৈচিত্রের ভিতরে স্বয়ং-সম্পূর্ণ সিম্বায়োসিসের মাধ্যমে বেঁচে থেকেছে বস্তারের মানুষেরা। সিকিটাকার হিসেব নিকেশ এঁদের মধ্যে অনেক পড়ে এসেছে, আর সেখানেও, প্রাচুর্য্যের চাহিদা সীমিত, অন্তত বন-গাঁ-গুলোতে তো বটেই। হাটে উদ্ভিদ-আহৃত খাদ্যসামগ্রী কিছু আর তেন্দু-পাতা, শালবীজ, মহুয়া, শালপাতা, ব্যাঙের ছাতা, গাছের রেসিন (ধুপ-তৈরীতে কাজে লাগে), কিছু বনৌষধি-জাতীয় জড়িবুটি ইত্যাদি বিক্রী করে, পরিবার-পরিজন শুদ্ধ সমস্ত কৌম জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে। তাছাড়াও, বাঁশ এবং বেট অর্থাৎ পৈরা গাছ থেজে বানানো মোটা দড়ি দিয়ে বীজ সংরক্ষণের কৌটো বানিয়েছে, বগই, বটঝুড়ি, সিহাড়ি বা কেকতী গাছ থেকে দড়ি, কাঠের ঘানী দিয়ে পিষে কুসুম, শর্ষে, গরাঞ্চি, তিল ইত্যাদির তেল, বাঁশের ছিপ বা গাছের আঁশ বুনে বুনে মাছ ধরার জাল সহ আরও যা যা সামগ্রীর প্রয়োজন, সমস্তই দিয়েছে অকৃপণ অরণ্য। এবং অরণ্যকে এই সব মানুষেরা বাঁচিয়ে রেখেছে, করে তুলেছে সমৃদ্ধতর।
এই তো গেল উদ্ভিদ-জগতের হিসেব। বস্তারের জীব-বৈচিত্রের অংশীদার হিসেবে, মানুষের পাশাপাশি যে সকল চলিষ্ণু প্রাণ আরণ্যক গেরস্থালী করেছে তার একটা রাফ হিসেব করে নেওয়া যাক –
স্থলচর-খেচর প্রাণের মধ্যে রয়েছে শিয়াল, নেকড়ে, হায়না, বুনো শুয়োর, বুনো কুকুর, ভালুক, লাঙ্গুর-বানর, হনুমান, গোখরো, শঙ্খচূড়, পাইথন, কেউটে, পিট-ভাইপার, কাঠবিড়ালি, লেপাস, সজারু, গৌড়-বাইসন তথা বন-ভৈঁসা, চিতল, সম্বর, চিতা, বাঘ, বনবিড়াল, ছোটো ও বড়ো গিরগিটি, গোসাপ, তোতা, পায়রা ও বুনো পায়রা, ময়না, পাড়খী-পাখি, লীটি-পাখি, প্যাঁচা, পিটোরকা পাখি, উসু-ঘোড়া, উসু-চাহচী, লোহঝাড় পাখি, রমলী পাখি, সালো পাখি, বনমোরগ, রাওনা পাখি, ডালা-করবা, বাদুড়, ইঁদুড়, পাতি ও দাঁড়কাক, কমহা-কাঁকড়ী, কুহী-পাখি, কোয়েল-পাখি, উড়ুক্কু সহ নানান ধরণের গিরগিটী, বক, সারস, হরিল-পাখী, কুরুআ, পুরাল-পাখি, কিন্দরী, খিড়খিড়ি, মঞ্জুর-সূর্য্য, পাহডোল (মেঘরাজ), বাজ, তিতির, হুটকাল সহ অজস্র জানা-অজানা কতকিছু।
জলচরদের দলে রয়েছে কাঁকড়া, ঘোঙ্গী, সুতই, ব্যাং, ডুডসাম মাছ, বামী-মাছ, কেতরী, তুরু, কেউ (কৈ?), চিংড়ি, খেক্সী-মাছ, মাগুর, ভেটকী, চিফা, ট্যাংরা, কোত্রী মাছ, সারঙ্গা মাছ, সিঙ্গি মাছ, বোধ-মাছ, ঝরী-মাছ, দোতে-মাছ, ঘড়িয়া মাছ, রুই, কাতলা, বাঘাইর ও নানান কুচো মাছ।
কীটপতঙ্গের ফিরিস্তিও লম্বা। বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপত ছাড়াও রয়েছে ড্র্যাগনফ্লাই, মৌমাছি, ডাঁশ, নানাবিধ পিঁপড়ে, ঘাসফড়িং, ঝিঁঝিঁ, রেশম-পোকা, গুবড়ে, ঘুন, বত্তর, রাজাপোকা, ধোধী, জোঁক, কাসুম, ভৈখ, কেঁচো, ঢোকরা, চকরী, ছিন্দ-পোকা, সেলার, ওণ্ডার-মাছি, ভুরসা, লোকটী-মাছি, বাঁশের পোকা, গুনঘুটী, চেপোড়া, গেরীপোকা, মহুয়া-পিঁপড়ে, ঝুরলা-পোকা, ডোমপোকা, জলের পোকা, ডোগা-পিঁপড়ে, কোসা গাছের পোকা, গুড়মাড়বিসী ইত্যাদি।
এই প্রাণ-বৈচিত্র্যের হিসেবনিকেশ-গুলো জোগাড় হল শুধু উত্তর বস্তারের কাঁকের ও নারায়ণপুরের বিভিন্ন বনে ঢাকা গ্রামগঞ্জের মানুষজনের থেকে। বস্তার ডিভিশানের আরও পাঁচটা জেলার হিসেব যদি ধরা যায়, কি অপরিসীম চেতনধাঁধানিয়া বৈচিত্র প্রতিভ হবে, কিছুটা হয়তো আন্দাজ করা যায়। আসলে, সমস্ত ডিভিশানটাই ক্রমে ক্রমে আদানী-জিন্দাল-নেকো জয়সওয়াল সহ বড়-ছোটো নানান বেসরকারী ও সরকারী মাইনিং কোম্পানীর হাতে চলে গেলে কত কিছু সব হারিয়ে যাবে, সেইটা মেপে নেওয়ার জন্যই এই লিস্টিগুলো বানিয়ে চলা। এখন বর্ষাকাল। ক্রমঃ অপসৃয়মাণ জঙ্গল ও জীব-বৈচিত্রের যতটুকু যা টিঁকে আছে, এই সময়টাতেই তার প্রাণোচ্ছ্বল উদ্ভাস – আর কয়টা বর্ষা এগুলোর বেশীরভাগ টিঁকবে, তা আশঙ্কার অপেক্ষা রাখে।
মাইনগুলোর কিছু হিসেব আগের কিছু পর্বে দিয়েছি, দিয়েছি মাইনের পথ প্রশস্ত করবার অভিপ্রায় বস্তারে ঘটে চলে অবিরাম, ক্রমঃবর্ধমান ফৌজি অগ্রাসনের খতিয়ান – পরের কিছু পর্বে আবারও দেবো, আরও বিশদে। জগদলপুর-নিবাসী মাখনলাল সোরির হিসেব অনুসারে, এই সমস্ত মাইনগুলির ৯৮%র মালিক বহিরাগত অনাদিবাসীরা। নানাবিধ অপব্যবহার মাধ্যমে ২০০৭ সালে প্রণীত ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট (পোষাকী নামে – দ্য শ্যেড্যুল্ড ট্রাইবস অ্যাণ্ড আদার ট্রেডিশানাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স রাইটস টু ফরেস্টস অ্যাক্ট, ২০০৭) এর শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছে প্রশাসন এবং একের পর এক পিলে চমকানো নোটিফিকেশান বের করে এর কফিনের শেষ পেরেকগুলি মন দিয়ে ঠুকে চলেছে দিল্লির মসনদে আসীন মোদিবাহিনী। কাঁকেরে দেখে গেলো, যতটুকু যা সামুহিক বনাধিকার পাট্টা দেওয়া হচ্ছে গ্রামগুলোকে, দেওয়া হচ্ছে ১৯৮০-র বনসংরক্ষণ আইন মারফৎ গঠিত ফরেস্ট ম্যানেজমেণ্ট কমিটি মারফৎ বনদপ্তরকে, অথচ ২০০৭-এর আইনটি স্পষ্টতই বলেছে এই সব অধিকার প্রাপ্য গ্রামসাভাগুলির। বেশীরভাগ আবেদন খারিজ করে দিচ্ছে সাব ডিভিশানাল অফিসার, এবং কালেক্টরের মাধ্যমে যে ডিস্ট্রিক্ট লেভেল কমিটি গঠিত হয়ে এই ২০০৭-এর আইনটির প্রয়োগোপোযোগীতার তত্ত্বাবধান করার কথা, সেই কমিটি গত তিন বছরে একবারও কোনো মিটিং বসানোর ফুরসৎ পায় নি। নারায়ণপুরের অবস্থা আরও তথৈবচ। এমনিতেও নারায়ণপুরের একটা বিরাট অংশ হল অবুজমাড় – যেখানে সিংহভাগ গ্রাম ভারত সরকারের শাসনাধীন নয়। যদিও এখন হুহু করে তৈরী হচ্ছে পাকা রাস্তা।
এই রাস্তার এক কোণা ধরে মাতলা জঙ্গল। রাওঘাটের খনি এসে গিলে নেবে এই জঙ্গলটাকে। আরও অনেক জঙ্গলকে আরও অনেক খনি এসে গিলে নেবে। তোড়জোড় চলছে। রাওঘাটে মূল মাইনিং যেইখান থেকে চালু হবে – সেইখানেই দুটো গ্রাম ছিলো – আঞ্জ্রেল আর পাল্লাকসা। দেশ ও ডেভেলপমেণ্টের সেবায় নিযুক্ত ফৌজিরা এসে লুঠ-তরাজ-খুন-ধর্ষণ সমেত ‘এরিয়া ডমিনেশান’-এর জন্য প্রয়োজন সমস্ত কিছু করে গিয়েছে। খাঁ খাঁ গ্রাম। খালি খালি বাড়িঘর সারি সারি। হাওয়া দিলে শোঁ শোঁ শব্দ হয়, দরজার পাল্লা খোলে বন্ধ হয়। এই ভাবে এভিক্ট করলে আরে ‘রিলিফ অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশান’ জনিত আইনি ঝামেলার মধ্যে যেতে হয় না রাষ্ট্রকে।
তবে, বস্তার তো শুধুই ফৌজি বনাম নকাশাল, ফৌজি বনাম গ্রামবাসী, হিন্দু বনাম গোঁড় লড়াই, চরম রক্তপ্লাবনের হিসেবে আটকা জায়গাই নয় – বিরাট ব্যাপ্ত এর ক্যানভাস – গভীর অরণ্যের জঠরে প্রোথিত এর জীয়নকাঠি – যাতে রয়েছে এই সব গাছ পালা ফল মূলের গল্প, অজস্র পেন (প্রাকৃত ঈশ্বর গোঁড় ভাষায় হয় ‘পেন’) আর ইয়ায়া (প্রাকৃত ঈশ্বরী গোঁড় ভাষায় হয় ইয়ায়া)-দের গল্প, মানুষের প্রাত্যহিক বেঁচে থাকা – অদ্ভূত, বহু-স্তরে বিন্যাস্ত লৌকিক কালচেতনা – আরও কত কিছু। এই সবকিছু আমাদের খণ্ডচেত অধুনা-উদার মনের আয়নায় ধরা পড়ে না। তবুও, ধিরে ধিরে, যতটা সম্ভব, মনের ভিক্ষার ঝুলিতে প্রজ্ঞার মাধুকরী – এই সব জেনে নেওয়া, চিনে নেওয়া থেকেই হয়তো আমরা বস্তারের সাথে যে অন্যায়গুলো ঘটে চলেছে মুহুর্মুহু, সেই অন্যায়গুলোর প্রতিবাদ করার স্বর খুঁজে নেবো একদিন ঠিক।
আর এই চেতনায়, ‘সংস্কৃতি’ বলে কিছু নেই। যা আছে তা ‘প্রাকৃতি’। সেইজন্যই তো সংস্কৃতিওয়ালাদের চোখে এরা মূর্খ, ‘অবুঝ’। অথচ এই প্রাকৃতির গভীরতা অপার। এই বস্তারে জীবন, যাপন, জীবিকা, গান, বাজনা, ঈশ্বরচেতনা, মিথকগাথা – সব যেন মিলেমিশে একাকার।
এর আগের এক পর্বে বস্তারের আদিবাসী দেবদেবী (পেন-ইয়ায়া)-দের কথা কিছু বলেছি। বলেছিলাম কিভাবে আদিবাসী দেবী চিখলা পরিণত হল দলিত দেবী শীতলায়। আরও নানান ইয়ায়া রয়েছে এই সকল গ্রামের সুখ-দুখের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে – রয়েছেন জিম্মিদারিন ইয়ায়া – যার উপর গ্রামের জিম্মেদারী ন্যাস্ত। আবার জিপসি-আদিবাসীরা, যারা মহাশ্বেতা দেবীর আনা রিট পিটিশানের আগে অব্ধি সরকারী হিসেবে চিহ্নিত হত ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস’ হিসেবে, তাদের রয়েছে বাঞ্জারিন মাতা। আসলে বাঞ্জারা বা জিপসিদের বর্তনের ইতিহাসটা আমরা খুব সরলরেখায় জেনেছি। জেনেছি নাকি বেনারস থেকে একদল লোক বেরিয়ে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল, হয়ে গেল জিপসি। কিন্তু বাস্তবের বেড়াল এত সহজে কি রুমাল হয়? আসলে, বিভিন্ন পরতে ন্যস্ত জিপসিদের ইতিহাস, এবং প্রায় সম্পূর্ণই অলিখিত। বহু জাতি চাষবাসের ধার না ধেরে হয় প্যাস্টরালিস্ট হিসেবে নয় চারণ হিসেবে, হাণ্টার-গ্যাদারার হিসেবে থেকে যেতে চেয়েছিলো – তাদের প্রান্তিকে ঠেলে দিয়েছে প্রথমে কৃষি ও তারপরে শিল্প। তাই আমাদের ভিত্তি ও ভবিষ্যতের আখ্যানের এরা অপাংক্তেয়। এঁদের মধ্যে যেমন রয়েছে ফ্রান্স, সুদান, হাঙ্গেরির জিপসিরা, তে’মনই রয়েছে ওড়িষার জজপুর জেলার কলিঙ্গনগরের টাটার হাইলি কার্সিনোজেনিক হেক্স্যাভ্যালেণ্ট ক্রোমাইট মাইনিঙে বিপর্যস্ত বাঁদরখেকো বীর-হর বা মানকাড়িয়ারা, রয়েছে রায়গড়ে কিছুদিন আগে যাদের ঘর ভেঙে দিয়েছিলো সাউথ ইস্ট কোলফিল্ডসের ভাড়া করা গুণ্ডারা, সেই সব বীর-হরেরা, রয়েছে রাজস্থান থেকে যে মেষপালকেরা কর্ণাটকের চিত্রদূর্গার সাভানা-প্রতিম চারণভূমিতে ভেড়া নিয়ে আসত – যাদের সেইসব চারণভূমির কেড়ে নিলো ইস্রো, ডি-আর-ডি-ও-রা মিলে, সেই সব চারণেরাও, আবার মিশ্রাণা সুরজমল যে চারণদের হয়ে রাজদ্রোহ করেছিলেন ১৮৫৭ সালে যখন রাজপুত রাজারা তাঁদের তথাকথিত ক্ষাত্র-বীর্য্য ভুলে সিপাই বিদ্রোহে কোম্পানীর পক্ষ নিয়েছিলেন – তারা, আবার রাজপুত ‘বাঞ্জারা’ জাতির সামাজিক ভাবে দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত মূলতঃ বাণিজ্যনির্ভর মানুষেরাও। বাঞ্জারিন এদের সকলের দেবী। তাই যখন, বিলাসপুর থেকে বস্তার রোড ধরে এগোতে এগোতে রায়পুরের ঠিক আগে, সেই অঞ্চলের একদা-আদিবাসীময়তার বিস্মৃতি হিসেবে হনুমান আর শিবের মূর্তি সুদ্ধু দাঁড়িয়ে থাকে ‘বাঞ্জারিন মাতা’র মন্দির রাস্তার ধারে (বাঞ্জারিন মাতা যেহেতু আদিবাসী দেবী এবং আদিবাসীরা যেহেতু মূর্তিপূজা করে না, সেহেতু উক্ত মন্দিরে বাঞ্জারিনের কোনো মূর্তি নেই), অথবা বিলাসপুর শহরের গোলবাজার-অগ্রসেন চৌক-এর ঘিঞ্জি অঞ্চল ঘেঁষে অথবা রায়পুরের পচপেড়ি নাকার শহুরে ঝাঁকের-কৈ-বৈভবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে অপর এক অপার ইয়ায়া-র থান – মাউলি বা মৌলি দেবীর মন্দির – বোঝা যায় যে আদিবাসীদের ‘হিন্দুয়াইসেশান’ কিভাবে নানান লেয়ারে নানান ভাবে প্রবেশ করে গিয়েছে গত এক শতাব্দী ধরে। যবে থেকে রেলপথের লৌহনিগড়ে বাঁধা হল শিল্পায়নে পুড়ে যাওয়া এক অভাগা উপমহাদেশের ইতিহাস, তবে থেকেই বোধহয় এর শুরু – অথবা আরও আগে থেকে – যখন মধ্য ভারত চিরে, গোঁড়দের ঘর-বাড়ি-রাজ্যপাট ধুলোয় মিশিয়ে বাংলার দিকে এগোতে থকল মারাঠা বর্গীদের শৌর্য্যমদমত্ত তুরঙ্গম, বা তারও আগে, যখন বস্তারে উপস্থিত হলেন অন্ধ্রের হিন্দু রাজা কাকাতিয়ারা, বা যখন উজ্জয়িনীতে বসে বিক্রমাদিত্য ওড়ালেন হিন্দুধর্মের দম্ভিত নিশান – কবে থেকে যে এই সমানে চলা ট্রেডিশান শুরু হল – আদিবাসীদের হিন্দু বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হতে থাকল – তা নির্ধারণ হয়ত কোনো একদিন কোনো এক প্রাজ্ঞ ইতিহাসবেত্তা করবেন।
ততদিন আমরা ধরে রাখব, অক্ষরে ও অক্ষর-চেতনায়, এই অবক্ষয়ের কাহিনী – কিভাবে খোলা আকাশের নীচে গাছগাছালির ছায়ায় বা পাহাড়ি পাথরে, ঝর্ণার ধারে স্মৃতির অতীত কালে বসেছিলো কোন বুনো-দেবীর থান বা দেবগুড়ি, তা হয়ত ধরে রেখেছে আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাস; তারপর সেই খোলা থানের চারিদিকে দেওয়াল উঠে তা হয়ে গেল হিন্দু-মন্দির, রক্তমাখা, সিঁদুরলেপা পাথর বা গাছে বসে গেলো চোখ-নাক-মুখ-কান-হাত-পা, কেই বা জানে। হালের ইতিহাসবিদরা একটু একটু করে সেইসব কাহিনী বের করছেন। আমরা ধিরে ধিরে জানছি কিভাবে পুরীর মন্দির-ও আসলে শবরদেরই থান ছিলো। এখন অনেক হিংসার ক্ষত নিয়ে দক্ষিণ বস্তার অঞ্চলের কুখ্যাততম ফৌজি-ক্যাম্প দোর্ণাপালের পাশ দিয়ে শবরী নদী বইছে। ভক্ত হিন্দু মধ্যবিত্তিতে লালিত কিছু লোকজনের ‘শবরী’ বললেই রামায়ণের গল্প, শবর বললেই মহাভারতের কৃষ্ণর মৃত্যুকাহিনী, এইসব মনে পড়ে, কিছু কিছু ইঁচড়পক্ক্বদের শবরী বললেই চর্য্যাপদের সহজরসের গান মনে পড়তে পারে।
আবার পথ অনেক নতুন কিছু গল্পও শোনায়, দ্যাখায়। উত্তর বস্তারের চারামা অঞ্চলের কিছু গ্রাম – জবরতারা, কাহারগোণ্ডি, পুরি, ময়ানা, কোরতারা ঘুরতে ঘুরতে, নানান সুখে দুখে কোর্টে কাছাড়িতে জল-জঙ্গল-জমির লড়াইতে পাশে দাঁড়িয়ে স্যাঙাত-মিতালী পাতাতে পাতাতে হাফতা দুই আগে চমকে গেলাম – গোঁড় আদিবাসীদের বিভিন্ন উপ-জাতি তথা ক্ল্যান-এর এক হল পোয়া। তাঁরা যুগ-যুগান্ত ধরে যে ঈশ্বরের পুজো করে আসছেন, তার নাম – হিংলাজ! কিভাবে সুদূর আফঘনিস্থান বালুচিস্তান-আজেরবাইজানের মরূতীর্থ থেকে, সেই সব দেশের এক আদিবাসী দেবী, যিনিও ক্রমে পরিণত হয়েছিলেন এক হিন্দু দেবীতে, তার ভুবনের প্রতিকারহীন এত পাপ এত অনাচার এত উত্তমকুমারের প্রবাহ বয়ে, হয়ে গেলেন বস্তারের এক গোঁড়-দেবী? সম্প্রতি কিছু ইতিহাসবেত্তা ও নৃতত্ববেত্তা ঠাউর করেছেন যে সিন্ধুসভ্যতা ও গোঁড় সভ্যতা অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। হয়তো বা সমস্তটাই একই সভ্যতা ছিলো, বিশ্বমানবীয়া একই কৌম-প্রাকৃতেই লালিত হয়েছিলো প্রাগার্য্যকালের মানুষেরা, মহেঞ্জোদরোতে, বস্তারে, শিয়ালদহতে...
কাঁকের
১৪-০৭-২০১৬
এই লেখার কোনো ব্যক্তি মালিকানা নেই। আমরা সবাই মিলে লিখছি, পড়ছি, চিনছি বস্তারকে।