এর আগের কিছু পর্বে বস্তারের গাছগাছালি, পশুপাখি, পোকামাকড়ের গল্প হল, ঘোটুলের গল্প হল, লিঙ্গোপেন-এর গল্প হল, লৌকিকে একদা প্রচলিত কোলাং-এর রঙিন আনন্দমাখা নাচগানের গল্প হল, এইবার আসা যাক বিয়ের গল্পে।
বস্তারে বর্তমানে প্রচলিত বিয়ের বিভিন্ন রকম ও রীতি
গোণ্ডি ভাষায় বিয়ে মানে মারমীং। বস্তারের গোঁড় জনজাতির মধ্যে নানান ধরণে বিয়ে প্রচলিত। বিভিন্ন দ্রাবিড়-গোষ্ঠির মত এইখানেই মামা-ভাগ্নীর বিয়ে বহুলপ্রচলিত। মানা হয়, মামার ঔরসে প্রথম সন্তান ধারণের অধিকার ভাগ্নীর। অবশ্যই, বিবাহোত্তর। পিসতুতো ভাই বোনেদের বিয়েও এইখানে সামাজিক স্বীকৃতি ও সমাদর পেয়েছে। এই এণ্ডোগ্যামি-কে ‘সমাজে দুধ ফেরানো’ ধরা হয়। অবশ্য সমস্ত বিয়েই যে এইরকম হয় না নয়। আপন আপন জীবনসঙ্গী চয়ন করে নেওয়ার সম্পুর্ণ সামাজিক অধিকার রয়েছে বস্তারের যুবক-যুবতীদের। বিভিন্ন ধরণের বিয়ে হলেও, প্রথাগত ভাবে মূল রূপরেখা একই রকমের। প্রথমে বরপক্ষ কন্যাপক্ষের বাড়ি যায় তত্ত্ব নিয়ে (কোনো কোনো প্রথায় এর উল্টোটাও হয়)। তত্ত্বে থাকে ফল, গুড়, মহুয়া, সালফি ইত্যাদি। সন্ধ্যে বেলা দুই পরিবারের মানুষেরা আর গ্রামের জ্যেষ্ঠরা বসে, খানা-পিনা চলে দেদার, সূচিত হয় বিবাহবন্ধনের প্রথম ধাপ। এর পর আরো দুইতিনবার এইভাবে তত্ত্ব নিয়ে যাওয়ার পর দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায়। তারপর বিয়ে। বস্তারের বিভিন্ন ধরণের বিয়ের মধ্যে প্রধান ধরণগুলো নিয়ে একটু জেনেশিখে নেওয়া যাক। অবক্ষয়ের মুখে এই জানাশেখাগুলোই তো সম্বল।
ক। বেহরাং-ভরবিং বা প্রচলিত বিবাহ তথা বড়-বিয়ে –
এই বিয়েতে বরযাত্রী কনেবাড়ি যায়। কন্যাসম্প্রদান সংঘটিত হয়, বরের সাথে কনে চলে যায় বাপের বাড়ি। বিয়ের আগে একাধিকবার তত্ত্বচালাচালি হয় নিয়মমাফিক। এই বিয়ের সাথে হিন্দু বিয়ে (যার আঞ্চলিক নাম ‘মাঞ্ঝলী মারমীং’ - তার মিল থাকার কারণে এবং বস্তারের ক্রমঃ হিন্দুত্বায়ণের কারণে এই দুই প্রথা মিলেমিশে একাকার হয়ে চলেছে লৌকিক স্রোতে।
খ। কই পইহনা বা ছোটো-বিয়ে –
এই বিয়েতে কনেযাত্রী যায় বরের বাড়ি, বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি রেখে ফিরে আসে কন্যাপক্ষ। এই বিয়েতে তত্ত্বের ব্যয়ভার বহনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত বরপক্ষের উপরে।
গ। উদেল দৈতুড় বা উঢ়রিয়া বিয়ে –
এইটা পাক্কা লাভ-ম্যারেজ। ঘোটুলের ভিতরে বা বাইরে যুবক-যুবতী প্রেমে পরে যায়। নিজেদের নিজেদের বাড়ির লোককে জানায়। এইবারে একটা মজার ব্যাপার আসে। মানে, ঘোটুল যতদিন ছিলো, আসতো। ধরা যাক বিয়েতে মা-বাবা নারাজি। তখন ঘোটুলের বাকি যুবক-যুবতীরা মিলে তখন ঘোটুলের ভিতরেই ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। বস্তারে ঘোটুলপ্রথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই প্রথাও বনের উদাস হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তাই দয়িত দয়িতার এখন বাবা মার মত না থাকলে পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া উপায় নেই। এদিকে পালিয়ে যাবে কোথায়? কোথাও মাইন তো কোথাও ল্যাণ্ডমাইন, আবার চারিদিকে ক্যাম্প – জঙ্গলের সম্পদে আর বেঁচেও থাকা যায় না, জীবিকা নির্বাহ করতে খুঁজতে হয় চাকরি, আর চাকরি জোটে মূলতঃ মজদুরীর।
যাই হোক, এইভাবে ইলোপ করাকে বলে হয়ে ‘উদেল বৈতুড়’। এখন ঘোটুল বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে নিয়মের কিছু রদবদল হয়েছে। প্রেম করেছে বলে তো আর সমাজচ্যুত করার বা ত্যাজ্যপুত্র-ত্যাজ্যকন্যা করার গোঁড়ামি আদিবাসীদের মধ্যে নেই, তাই এখন বাড়ির লোকজন খবর নিতে থাকে এদিক ওদিক। খোঁজ পেলে তখন জাতির জ্যেষ্ঠরা, মানে মুখিয়া, সিয়ানেরা সামাজিক পঞ্চায়েত ডাকে – সেইখানে উপস্থিত থাকতে হয় দম্পতিকে ও তাদের বাড়ির লোকেদের। পঞ্চায়েতের নির্ণয় অনুসারে দিনক্ষণ ঠিক করা হয় এবং নির্ধারিত শুভলগ্নে দস্তুর-রেওয়াজমাফিক বিয়ে সম্পন্ন হয়।
ঘ। ওড়ই বায়না বা পৈটু বিয়ে –
এইটাও প্রণয় থেকে পরিণয়ের পোক্ত পথ। প্রেম হয়। তারপর কনে এসে ঘরকন্না জমায় বরের বাড়ি। এরও আবার দুটো ধরণ হয় –
প্রথম ধরণ হল যেখানে প্রেমিক প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করে, বলে, ‘ঘরে এসো, একসাথে বাঁচি’। দ্বিতীয় ধরণটা যদিও আরেঞ্জড ম্যারেজ – হবু বরের মা-বাবা ছেলের জন্য কণে পছন্দ করে ঘরে নিয়ে আসে। এইখানেও আমরা হয়তো আদিবাসী সামাজিক কাঠামোয় পেট্রিয়ার্কির ছোঁয়া দেখতে পাই। তবে সেইখানে ঐ সামাজিক কাঠামোই ঢাল তুলে ধরে। সামাজিক পঞ্চায়েত সংঘটিত হয়, দুই পরিস্থিতিতেই। মেয়েকে জিগ্যেস করা হয় – তুমি কি সত্যিই ওর সাথে ঘর-গেরস্থালী পাতাতে চাইছো? মেয়ে সম্মতি দিলে তখন তাকে জিগ্যেস করা হয় – কে সেই ছেলে? কী নাম তার? মেয়ে তখন ছেলের নাম বলে। তখন সামাজিক ভাবে বিয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন, পূর্ববর্ণিত উঢ়রিয়া বিয়ের মতোই এই বিবাহানুষ্ঠানও এক দিনের মধ্যে সম্পন্ন হয়। যদি এর আগে মেয়ের বিয়ে অন্য কারির সাথে ঠিক হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয় পক্ষের বরের পরিবার থেকে প্রথম পক্ষের বরের পরিবারকে তার (প্রথম পক্ষের বরের) বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেই প্রথম পক্ষের চাহিদা অনুসারে পয়সা, চাল, ডাল, ছাগল, শুয়োর, মুর্গি ইত্যাদি দিতে হয়। মাঝে মধ্যেই এই ধরণের বিয়ের ফল হিসেবে প্রথম পক্ষ ও দ্বিতীয় পক্ষের বরেদের মধ্যে তীব্র বচসার সূত্রপাত হয়।
ঙ। লভদায়না বা ‘লমসেনা’ প্রথা।
এই সুপ্রাচীন ও বস্তারে বহুল প্রচলিত প্রথাটি মূলতঃ সেই সব কন্যাপক্ষের পরিবারের জন্য যেইখানে মেয়ের বাপমায়ের কোনো পুত্রসন্তান নেই। আমাদের ঘর-জামাই সিস্টেমের সাথে কিছুটা মিল থাকলেও, দুয়ের ফারাক বিস্তর। প্রথমে মেয়ের বাবা সামাজিক ভাবে প্রচার করে যে তার মেয়ের বিবাহের জন্য সুযোগ্য পাত্রের প্রয়োজন। সেই শুনে লমসেনা হতে ইচ্ছুক যুবকেরা তাদের বাবা-মা বা পরিবার পরিজনের সঙ্গে উপস্থিত হয় মেয়ের বাড়িতে। আবার কখনো মেয়ের মা-বাবাও কোনো যুবককে পছন্দ করে তার মা-বাবার সাথে কথা বলে নেয়।
এইভাবে পাত্র পছন্দ হলেই সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে হয় না। এক থেকে তিন বছর ছেলেকে তার সম্ভাব্য শ্বশুরবাড়িতে থেকে কৃষিকার্য্য, গাই-বলদের দেখভাল, জমি-জিরেতের তত্ত্বাবধান, ঘরের কাজ ইত্যাদি সেবার মাধ্যমে তুষ্ট করতে হয় হবু শ্বশুর-শাশুড়িকে। আগে তিন থেকে পাঁচ বছর অবধি করতে হত। ততদিন ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বরবধূর সম্পর্ক তৈরী হয় না। তারপর, সেবায় সন্তুষ্ট হলে, বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মেয়ে বা মেয়ের মা-বাবা এতে তুষ্ট না হলে কাজের হিসেব ও মজুরী অনুসারে প্রমাণ-পরিমাণ অর্থ দিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হয় ছেলেকে।
বিয়ের সিদ্ধান্ত হলে বর-বউ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত করে নেয় বিবাহোত্তর জীবন তারা কোথায় কাটাবে – মেয়ের বাড়ি না ছেলের বাড়ি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ হলে, অবশেষে বিয়ে হয়।
চ। পোয়স তাতানা বা জবরদস্তি বিয়ে।
কখনো কখনো দেখা যায় যে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইছে না অথবা মেয়ের বাড়ি থেকে তাকে যেতে দিচ্ছে না। তখন বর ও বরপক্ষের লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে এসে জোর-জবরদস্তি মেয়েকে নিয়ে যায়। সচরাচর মামা-ভাগ্নী বা মামাতো-মাস্তুতো-পিস্তুতো ভাইবোনেদের বিয়ে ঠিক হলে এই ধরণের কেলো হয়। এইখানে আবারও মনে করে নেওয়া ভালো – দূর থেকে আদিবাসী জীবন যতটা রোম্যাণ্টিক, জাস্ট ও এক্সটিক মনে হয়ে, বাস্তব, বাস্তবের অমোঘ নিয়মেই, ভিন্নতর।
তাছাড়া আরও একটা পরিস্থিতি দেখা যায়। কোনো গাঁয়ের মেয়ে যদি ভিনগাঁয়ে গিয়ে কোনো যুবকের প্রেমে পরে, তখন সেই ভিনগাঁয়ের লোকেরা মেয়ের সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। পেট্রিয়ার্কির ক্রমঃ-আঘাতে এই সব প্রথার প্রচলন। খুঁজলে হয়তো এর পিছনেও অঞ্চলের ক্রমার্যায়নের ছায়া পাওয়া যাবে এইসবে।
ছ। নৌসা-পৈসী তথা বশীকরণ মাধ্যমে বিবাহ -
পৃথিবীর বিভিন্ন আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর মতো বস্তারের গোঁড় আদিবাসীদের মধ্যেও স্মরণাতীত কাল থেকেই মন্ত্র-তন্ত্র-ম্যাজিক-হীলিং এর শামানিক রিচুয়ালস চলে আসছে। এই সব শামানদের গোঁড় ভাষায় বলা হয় সিরহা। এমনকি লিঙ্গোবাবার বিয়েও এমনই এক সিরহা পরিবারের মেয়ের সাথেই হয়েছিলো বলা হয় আঞ্চলিক ভক্তিকথায়। এমন মনে করা হয় যে যখন প্রণয়পাশবদ্ধ ছেলে কিছুতেই মেয়ের মন পাচ্ছে না, তখন সে সিরহার কাছে গেলে সিরহা তাকে মন্ত্রসিদ্ধ প্রসাদ দেয়, যার গুণে মেয়ে নিজের টানেই ছেলের কাছে আসতে থাকে। পরিবর্তে যুবক সিরহাকে মুর্গি, নারকেল আর মদ দিয়ে প্রসন্ন করে। সামাজিক ভাবে এই বিয়ে একদমই এনকারেজ করা হয় না কারণ গোঁড় আদিবাসীরা বিশ্বাস করে এইভাবে বিয়ে করলে যুবকের কপালে অসীম আর্থিক ও সম্পত্তিগত দুর্যোগ লেখা হয়ে যায় এবং হাজারকোটি চেষ্টাতেও সেই দুর্যোগ খণ্ডন করা যায় না জীবনভর।
কুসংস্কার কুসংস্কারই – তা সে ভিআইপি রোডের মা ভৈরবেশ্বরী করলেও যা, বস্তারের গহীন গাঁয়ের কোনো সিরহা করলেও তাই। এই প্রথা নিয়ে আদিবাসীদের দিকে আঙুল তুলে খুব হাসাহাসি করতে ইচ্ছে করলে তা করার আগে কালকের আনন্দবাজারের কয়েকটা পাতা উল্টে-পাল্টে কিছু বিজ্ঞাপন দেখে নিন।
এইভাবেই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি এসে তার বিপুল অথচ ক্রমহ্রসমাণ মিথষ্ক্রিয়ামণ্ডিত প্রাকৃত-সম্ভার সম্বল করে, মাইনিং, আর্যায়ণ, ঔপনিবেশিক সামন্ততন্ত্র ও হুহুবেগে বাড়তে থাকে ধর্ষকামী মিলিটারাইজেশনের শেলে শেলে বিদ্ধ হয়ে, জিডিপি-মুখীন ভালো থাকার হিসেবের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে, থমথমে দিনগুলো, রাতগুলো গুনে চলেছে বস্তারের জীবজগৎ ও মানবজগৎ যারা একে অপরকে অবলম্বন করে বেঁচে ছিলো এতদিন। হয় ডেভেলপমেণ্টের, শিল্পায়নের বীজমন্ত্রে ছারখার হয়ে যাবে বস্তার, আমরা চেয়ে চেয়ে দেখবো; নয় প্রবল দ্রোহরাগে জ্বলে উঠবে বস্তার, বস্তারের মানুষেরা, আমরা চেয়ে চেয়ে দেখবো। এই দেখাটুকুই যে আমাদের, ‘মিস্টার গামিশ’-দের, ব্যাঙের আধুলি!
কাঁকের
১৪-০৭-২০১৬
এই লেখার কোনো ব্যক্তি মালিকানা নেই। আমরা সবাই মিলে লিখছি, পড়ছি, চিনছি বস্তারকে।